লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৫ - সেপ্টেম্বর
সপ্তাহজুড়ে ইন্টারনেট জাদু
রস্ব ‘ই’-তে ইন্টারনেট। এভাবেই দেখতে দেখতে বদলে যাচ্ছে আমাদের চিরায়ত বর্ণমালার শিশু-পাঠ। চক-পেন্সিল আর স্নেটের জায়গায় যুক্ত হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইস- ট্যাবলেট পিসি। কাঠের সেলফে থরে থরে সাজানো বইগুলো সব এখন জায়গা করে নিয়েছে ক্লাউডে। ইন্টারনেটে মিলছে জীবনের প্রয়োজনীয় সেবা। সেই অমিয় সম্ভাবনাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে দেশজুড়ে চলছে বাংলাদেশ ইন্টারনেট উইক ২০১৫। যৌথভাবে এই উৎসবের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), গ্রামীণফোন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ মাসিক কমপিউটার জগৎ ১৯৯৬ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রথম ‘ইন্টারনেট সপ্তাহ’ পালন করে এ দেশের জনগণকে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুফল ও প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে।
বাংলাদেশ ইন্টারনেট এক্সপো
ইন্টারনেটের জাদুর দেশে সব পাওয়া যায়- আহবানে গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় ইন্টারনেট নিয়ে সপ্তাহব্যাপী এই আয়োজন। ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেটে তিনটি বড় এক্সপোসহ দেশের ৪৮৭টি উপজেলা ডিজিটাল সেন্টারে চলছে ডিজিটাল দুনিয়ায় যোগাযোগের মহাসড়ক ‘ইন্টারনেট’ নিয়ে জাগরণী মেলা। রাজধানীর বনানী মাঠ থেকে শুরু হয় এই উৎসব। ৭ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া বনানী উৎসবে উঠে আসে ইন্টারনেট সংযোগের জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় কীভাবে বদলে যায় জীবন; সহজতর হয় জীবনযাত্রা; আসে সচ্ছলতা- সেইসব উপাখ্যান। সপ্তাহব্যাপী এই উৎসবে অংশ নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স কোম্পানি, মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান, ওয়েব পোর্টাল, ডিভাইস কোম্পানিসহ ইন্টারনেটভিত্তিক পণ্য ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর এক কোটি ইন্টারনেট গ্রাহক তৈরির লক্ষে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ইন্টারনেট সেবার পসরা যেমনটা প্রদর্শন করেছে; একইসাথে সপ্তাহজুড়ে চলেছে ইন্টারনেট নিয়ে বিষয়ভিত্তিক সংলাপ। ইন্টারনেট উৎসবের অংশ হিসেবে প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে বিভিন্ন কর্মশালা; ১৯টি টেক সেশন। গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে ৭টি পলিসি বৈঠক। রাজধানীর গ-- পেরিয়ে সপ্তাহব্যাপী এই উৎসব এবার চলছে ঢাকার বাইরেও। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে রাজশাহীর নানকিন বাজারে ও ১১ সেপ্টেম্বর সিলেটের সিটি ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ইন্টারনেট উইক ২০১৫। সাধারণ জনগণকে আরও বেশি অনলাইন সেবার আওতায় আনাসহ তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটভিত্তিক উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিতকল্পে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন উৎসবের আয়োজক, অংশগ্রহণকারী এবং সংশ্লিষ্টরা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সরকার দেশের ইন্টারনেটের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণের দোরগোড়ায় তথ্যপ্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দিতে ২০১৮ সাল নাগাদ প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যন্ত দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ইন্টারনেট ব্র্যান্ডউইডথের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক সাশ্রয়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইন্টারনেট উইকের মাধ্যমে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে। বিশ্বে একসাথে প্রায় ৪৮৭ জায়গায় এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের নজির এখনও নেই।
যত আয়োজন
গত ৫ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর ইন্টারনেট জয়গানে মুখর ছিল ঢাকা এক্সপো। একই আয়োজন রয়েছে রাজশাহী ও সিলেটে আয়োজিত ইন্টারনেট এক্সপোতে। ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে লাইভ টেরিস্ট্রিয়ালের মাধ্যমে ইন্টারনেট সপ্তাহের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বনানী সোসাইটির মাঠে ইন্টারনেট সেবার পসরা মেলে ধরে দেশের শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স কোম্পানি, মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান, ওয়েব পোর্টাল, ডিভাইস কোম্পানিসহ ইন্টারনেটভিত্তিক পণ্য ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যতম আয়োজক গ্রামীণফোন উপস্থাপন করে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে কীভাবে জীবনধারা উন্নত হয়, আসে সমৃদ্ধি। এক্সপো বিষয়ে গ্রামীণফোনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান বলেন, ‘গ্রামীণফোনের লক্ষ্য সবার জন্য ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা। প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট সপ্তাহ পালন করে আমরা কমপক্ষে ১ কোটি মানুষকে ইন্টারনেট সেবার সুবিধাগুলো সম্পর্কে জানাতে চাই।’
আজমান বলেন, আমাদের দেশে ইন্টারনেট সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এখনও সচেতন নন। তাই গ্রামীণফোন বছর দুয়েক আগে থেকে ‘ইন্টারনেট ফর অল’ লক্ষ্যের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। মানুষকে সচেতন করতেই মূলত গ্রামীণফোন ইন্টারনেট সপ্তাহ আয়োজনের সাথে যুক্ত হয়েছে। থাইল্যান্ডের উদাহরণ টেনে আজমান বলেন, থাই কৃষকেরা টেলিনরের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ডিটাকের মাধ্যমে কৃষি খাতের ব্যাপক উন্নয়ন করছে। আমরা মনে করি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ ধরনের সেবা বাংলাদেশেও সম্ভব। চলতি সময়ে আমরা দেখেছি, ইন্টারনেট আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, শিক্ষা ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। গ্রামীণফোন তাই বরাবরের মতো এই প্রযুক্তির সুবিধা প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছে।
বেসিস সভাপতি শামীম আহসান বলেন, সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ৪৮৭টি উপজেলায় একযোগে বাংলাদেশ ইন্টারনেট সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মশালা
ইন্টারনেট সপ্তাহ উপলক্ষে ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেটের ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অর্ধশতাধিক কর্মশালা, সেমিনার এবং টেক ইভেন্ট। এর মধ্যে উদ্বোধনী দিন বিকেলে অনলাইনে আয়ের দিক নির্দেশনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ টেক সেশন। ৬ সেপ্টেম্বর আগামীর ইন্টারনেট নিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। বাণ্যিজ্যিক খাতে ফ্রিল্যান্সিং এবং ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে আলোচনা হয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে। এছাড়া খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারনেট ব্যবহার করে উচ্চতর শিক্ষাও অনলাইন কোর্স সম্পাদনের আদ্যোপান্ত নিয়ে আলোচনা। একই দিনে রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ক্লাউড কমপিউটিং নিয়ে কর্মশালা। সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন ভবিষ্যতের জন্য ইন্টারনেট বিষয়ে বিশেষ টেক সেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ই-কমার্স নিয়ে আলোচনা হয় ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে হয় অ্যান্ড্রয়িড ডেভেলপমেন্টের ওপর সেমিনার। হাজী মুহম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় আইফোন অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন ও গবেষণা নিয়ে কর্মশালা। বিগ ডাটা বিষয়ক টেক সেশন হয় ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলোজিতে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় পিএইচপি প্রোগ্রামিং বিষয়ক কর্মশালা। ফ্রিল্যান্সিংয়ের সম্ভাবনা নিয়ে রাজশাহী কলেজে হয় বিশেষ টেক সেশন। সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সেমিনার হয় বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে হয় ভবিষ্যতের ইন্টারনেট বিষয়ে আলোচনা। ফ্রিল্যান্সিং ও অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং নিয়ে কর্মশালা হয় ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
উপজেলায় ইন্টারনেট উৎসব
ডিজিটাল রাজ্যে উন্নয়নের পাসওয়ার্ড হলো ইন্টারনেট। সেই পাসওয়ার্ডের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পরিচয় করিয়ে দিতে দেশের তিনটি বিভাগীয় শহরের পাশাপাশি ৪৮৭টি উপজেলার ৪ হাজার ৫০০টি ডিজিটাল সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারনেট সপ্তাহ। প্রতিটি উপজেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। কোথাও দুইদিন, কোথাও তিন বা সপ্তাহজুড়েই চলে ইন্টারনেট উৎসব। উৎসবে স্কুলের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গৃহিণী ও কৃষককেও ইন্টারনেটের জাদুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। ইন্টারনেট ব্যবহার করে কীভাবে পণ্য কেনাবেচা করা যায়, জমির যত্ন নেয়া বা চাষাবাদ করা যায়, ঘরে বসেই বিদেশী ডিগ্রি অর্জন করা যায় ইত্যাদি বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দর্শনার্থীদের। উৎসব নিয়ে বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ইন্টারনেট উইক ২০১৫-এর আহবায়ক রাসেল টি আহমেদ বলেন, সপ্তাহব্যাপী এ উৎসবে ই-কমার্স, ওয়েব পোর্টাল, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ও সারাদেশের স্থানীয় মোবাইলভিত্তিক উদ্যোগ অংশ নেয়। গ্রামের যেসব মানুষ এখনও ইন্টারনেটের জাদুর সাথে পরিচিত নন তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে কীভাবে জীবনকে পরিবর্তন করা যায়, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। আর এর মাধ্যমেই আশা করছি, এক কোটি মানুষকে ইন্টারনেটে সংযুক্ত করে প্রযুক্তির আলোয় গ্রামীণ সমাজকে জাগিয়ে তোলা হবে।