লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোহাম্মদ জাবেদ মোর্শেদ চৌধুরী
মোট লেখা:৫১
লেখা সম্পর্কিত
ডার্ক ওয়েব: ইন্টারনেটের রহস্যময় ও অন্ধকার জগৎ
ঢাকায় কিছুদিন আগে সন্ত্রাসী হামলার সময় জঙ্গিরা এমন কিছু মেসেজিং সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে, যা সাধারণত সাধারণ মানুষের এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি এড়িয়ে চালাতে পারে। জঙ্গিরা মূলত ডার্ক ওয়েবের বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করে এই যোগাযোগ রক্ষা করে চলে।
সহজভাবে বলতে গেলে ডিপ/ডার্ক ওয়েব হলো ইন্টারনেটের একটি অংশ, যা সার্চ ইঞ্জিনে সূচিবদ্ধ করা হয়নি। কেননা, সার্চ ইঞ্জিনগুলো তাদের সার্চ তদারকি করে এক ধরনের ভার্চুয়াল রোবট তথা ক্রলার দিয়ে। এই ক্রলারগুলো ওয়েবসাইটের এইচটিএমএল ট্যাগ দেখে ওয়েবসাইটগুলোকে লিপিবদ্ধ করে। এ ছাড়া কিছু কিছু সাইট থেকে সার্চ ইঞ্জিনে লিপিবদ্ধ হওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট যায়। এখন কিছু সাইট অ্যাডমিন চায় না যে তাদের সাইটটি সার্চ ইঞ্জিন খুঁজে পাক, তারা রোবট এক্সিকিউশন প্রটোকল ব্যবহার করে, যা ক্রলারগুলোকে সাইটগুলো খুঁজে পাওয়া বা লিপিবদ্ধ করা থেকে বিরত রাখে। কিছু সাইট আছে ডাইনামিক। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এই ধরনের সাইটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আর ক্রলারের পক্ষে এসব করা সম্ভব হয় না। কিছু সাইট আছে যেগুলোতে অন্য সাইট থেকে লিঙ্ক নেই। এগুলো বিচ্ছিন্ন সাইট। এগুলোও সার্চে আসে না। এ ছাড়া বলতে গেলে সার্চ ইঞ্জিন টেকনোলজি এখনও তার অাঁতুর ঘর ছাড়তে পারেনি। সার্চ ইঞ্জিনগুলো টেক্সট বাদে অন্য ফরম্যাটে থাকা (যেমন ফ্ল্যাশ ফরম্যাট) ওয়েবপেজ খুঁজে পায় না। একটি জরিপে দেখা গেছে, দৃশ্যমান ওয়েবে যে পরিমাণ ডাটা সংরক্ষিত আছে তার চেয়ে ৫শ’ গুণ বেশি পরিমাণ ডাটা সংরক্ষিত আছে অদৃশ্য ওয়েবে।
ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই এক ধরনের বিশেষ নেটওয়ার্কের সাহায্য নিতে হবে। ডার্ক ওয়েবের আরেকটি বিশেষত্ব হলো এগুলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (WWW) সাইটগুলোর মতো টপ লেভেল ডোমেইন (যেমন .com, .net, .org) ব্যবহার না করে Pseudo Top খবাবষ উড়সধরহ ব্যবহার করে, যা মূল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে না থেকে দ্বিতীয় আরেকটি নেটওয়ার্কের অধীনে থাকে। এ ধরনের ডোমেইনের ভেতর আছে Onion, Bitnet, Freenet ইত্যাদি। এই ডোমেইনগুলোর নামগুলোও একটু ভিন্ন ধরনের, সাধারণ কোনো নামের মতো না। যেমন- http://hpuuigeld2cz2fd3.onion ডার্ক ওয়েবে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেটওয়ার্ক হলো অনিয়ন নেটওয়ার্ক। অনিয়নের Pseudo-top-level-domain হলো .onion। অনিয়ন ওয়ার্ল্ডে ঢুকতে হলে আপনাকে টর ব্রাউজার ব্যবহার করতে হবে। টর আপনার পরিচয়কে লুকিয়ে ফেলবে। ফলে কারও পক্ষে আপনার অবস্থান শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। আপনি যখন টর দিয়ে কোনো সাইটে ঢুকতে যাবেন, তখন টর আপনার পাঠানো রিকোয়েস্ট কঠিন এনক্রিপশনের মধ্য দিয়ে অনিয়ন প্রক্সিতে পাঠাবে। অনিয়ন প্রক্সিতে আপনার পাঠানো ডাটা দুর্বোধ্য এক স্ক্রিপ্টে পরিণত হয়। এবার অনিয়ন প্রক্সি এই ডাটা নিয়ে মূল ইন্টারনেটমুখো হবে, যেখানে অনেকগুলো অনিয়ন রাউটার অপেক্ষা করছে। অনিয়ন রাউটারে প্রবেশের আগে অনিয়ন নেটওয়ার্কের প্রবেশপথে এই ডাটা আবার এনক্রিপশন হবে। নেটওয়ার্ক থেকে বের হওয়ার সময় আরও একবার এনক্রিপশনের ভেতর দিয়ে যায়। এর মাঝেই অনিয়নের বেশ কিছু রাউটারের ভেতর দিয়ে এনক্রিপশন হয়, যেখানে একেক রাউটারে এনক্রিপশন আউটপুট একেক ধরনের। সবশেষে ডাটা যখন প্রাপকের হাতে গিয়ে পৌঁছায়, তখন তা ডিএনক্রিপশন প্রসেসের মাধ্যমে আদি অবস্থানে ফিরে আসে।
ডার্ক ওয়েব অপরাধের একটি অভয়ারণ্য। সেখানে এমন কিছু ওয়েবসাইট আছে, যেখানে হেরোইন ও মারিজুয়ানা থেকে শুরু করে নানা ধরনের মাদক হোম ডেলিভারি দেয়া হয়। আরও কিছু ওয়েবসাইট আছে যেখানে জঙ্গি গ্রম্নপগুলো তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পালন করে। কীভাবে বোমা বানাতে হয়, নিক্ষেপ করতে হয়, বারুদ বানাতে হয়, বারুদ লোড করতে হয় ইত্যাদি শেখানো হয়ে থাকে সেসব ওয়েবসাইটে। এখানে কেনাবেচার জন্য কোনো ক্রেডিট বা ডেবিড কার্ড ব্যবহার করা হয় না। এখানে ব্যবহার করা হয় বিটকয়েন। ১ বিটকয়েনের দাম প্রায় সাড়ে ১০ ইউরো।
ইন্টারনেটের অন্ধকার এক সুড়ঙ্গ ‘সিল্ক রোড’
সিল্ক রোড নামের সাথে লুকিয়ে রয়েছে নজরদারির আড়ালে এক বিশাল অন্ধকার জগৎ। অস্ত্র, মাদকসহ নানা অবৈধ পণ্যের বিশাল এক অনলাইন বাজার সিল্ক রোড। সিল্ক রোড নামের এই সাইটটিতে প্রবেশ করতে ব্যবহারকারীদের ‘টর’ নামে একটি ব্রাউজিং সিস্টেম ব্যবহার করতে হতো। টর হচ্ছে বিশেষ সফটওয়্যার, যার মাধ্যমে নিজের পরিচয় গোপন রেখে ওয়েব ব্রাউজ করার সুযোগ পেতেন সিল্ক রোড ব্যবহারকারীরা।
সিল্ক রোড কী?
এশিয়া, ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলকে সংযুক্ত করেছে একটি প্রাচীন বাণিজ্যিক পথ। প্রায় চার হাজার মাইল দীর্ঘ এই পথের নাম দেয়া হয়েছে সিল্ক ব্যবসায়ের নামে, যা চীনের হান রাজত্বকালে
আরম্ভ হয়েছিল। যদিও সিল্কই ছিল প্রধান পণ্য, কিন্তু অন্যান্য আরও অনেক ধরনের পণ্যও এই পথে আনা-নেয়া করা হতো। চীনা, ভারতীয়, ফারসি, আরব ও ইউরোপীয় সভ্যতার উন্নয়নে এই বাণিজ্য পথের বিশাল প্রভাব ছিল। বিশেষ এই বাণিজ্য পথ সিল্ক রোডের নাম থেকে সিল্ক রোড ওয়েবসাইটটির নাম দেয়া হয়েছে। গোপনে ইন্টারনেট ব্যবহারের এ সাইটটি রীতিমতো কুখ্যাতিও অর্জন করেছিল। শুধু ‘টর’ নামের বিশেষ ব্রাউজিং ব্যবস্থায় সিল্ক রোডের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ‘টর’ নামের এ বিশেষ সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, যা গোপন তথ্য বিনিময়ে ব্যবহার করা যায়।
ইন্টারনেটে অবৈধ কার্যক্রম লুকিয়ে রাখার এ পদ্ধতিটির আরেকটি নাম হচ্ছে ‘দ্য ডার্ক ওয়েব’। অন্ধকার জগতের এ সাইটটি থেকে পণ্য কিনতে হলে এক ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রার ব্যবহার করতে হতো, যার নাম বিটকয়েন। এ বিটকয়েনের লেনদেন সহজে নজরদারি করা সম্ভব হয় না।
এফবিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিল্ক রোড সাইটটিতে ১০ লাখের বেশি নিবন্ধিত ব্যবহারকারী রয়েছে। এর আগে কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, সিল্ক রোড সাইটটিতে প্রতি মাসে প্রায় ১৩ লাখ মার্কিন ডলারের লেনদেন হয়, যা থেকে বিপুল পরিমাণ লাভ করে সাইটটির পরিচালকেরা।
অনলাইন কালোবাজার
অবৈধ পণ্য কেনাবেচার জন্য অনলাইনের কালোবাজার হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল সিল্ক রোড। ২০১১ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে সিল্ক রোড যাত্রা শুরু করলেও এর আরও আগে থেকে এর প্রস্ত্ততি চলছিল। অ্যামাজন ডটকম বা ই-বে ডটকম যেমন ই-কমার্স সাইট হিসেবে খ্যাত, তেমনি অনলাইনে মাদক কেনাবেচার সাইট হিসেবে সিল্ক রোড দ্রুত পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু ২ অক্টোবর এফবিআই এ সাইটটি বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন্ত ব্যবহারকারীরা এ সাইটে বিনামূল্যে নিবন্ধন করতে পারত। তবে কেউ কিছু বিক্রি করতে চাইলে অর্থ খরচ করে অ্যাকাউন্ট খুলতে হতো। এখানে মাদক ছাড়াও পর্নোগ্রাফি, চুরি করা ক্রেডিট কার্ডের তথ্যসহ নানা অবৈধ জিনিসের লেনদেন হতো। ডার্ক ওয়েবে অপরাধীরা যেমন বিচরণ করে, তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও নিয়মিত এই সাইটগুলোকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে যায় ও এর সাথে যুক্ত লোকজনকে আইনের আওতায় আনে
ফিডব্যাক : jabedmorshed@yahoo.com