তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধি করার অন্যতম এক উপায় হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়া। এর মাধ্যমে আজ বিশে^ নতুন যে অর্থনীতির জন্ম হয়েছে, এর নাম ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’। এই ডিজিটাল অর্থনীতির একটি অন্যতম খাত হচ্ছে সফটওয়্যার খাত। বাংলাদেশের এই খাত হতে পারে বৈদেশিকে মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত। বলা যায়, সফটওয়্যার খাত আমাদের সামনে হাজির করেছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হাতছানি। এই সুযোগকে কাজে লাগানোই হবে এখন আমাদের মুখ্য কাজ।
জানা গেছে, সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় শতকোটি ডলার রফতানি আয়ের পথে এগিয়ে চলেছে আমাদের দেশ। বর্তমানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭০ কোটি ডলার রফতানি আয় হয়েছে। দেশের সফটওয়্যার খাতের শীর্ষ সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিসেস (বেসিস) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা রফতানির মাধ্যমে বেসিস সদস্যভুক্ত ১৮৫টি কোম্পানি ৬০ কোটি ডলার আয় করেছে। বেসিস সদস্য কোম্পানির সাথে ফ্রিল্যান্স সফটওয়্যার ডেভেলপার ও কল সেন্টার কোম্পানির আয় যোগ করলে তা ৭০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা। তবে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। মূলত বেসিসভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সারেরা তাদের আয়ের বড় অংশ বৈধ চ্যানেলে না আনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রকৃত হিসাব থাকছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা খাত থেকে রফতানি আয়ের অঙ্কে এই বিভ্রান্তি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক খাতে ৩৬ শতাংশ দেশীয় সফটওয়্যার ও ৫৭ শতাংশ বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে। কোর ব্যাংকিংয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ সফটওয়্যার নির্মাতা কোম্পানি হলো মিলেনিয়াম ইনফরমেশন সলিউশন লিমিটেড। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির ডেভেলপ করা ‘আবাবিল’ সফটওয়্যার সমাদৃত। কোম্পানিটি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং সলিউশন দিচ্ছে। পাশাপাশি সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকে ‘আবাবিল’ সফটওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে। ব্যাংক কার্যক্রমে দেশী সফটওয়্যারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। বিদেশী সফটওয়্যার যেখানে ৮-১০ কোটি টাকা দিয়ে কিনতে হয়, সেখানে ৩-৫ কোটি টাকা দিয়ে দেশী সফটওয়্যার পাওয়া যায়। মেইনটেন্যান্স ও কাস্টমাইজেশনেও দেশী সফটওয়্যারের খরচ কম। এ ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হলে ব্যাংক খাতের পুরোটাই দেশী সফটওয়্যারের আওতায় আসতে পারে। এর ফলে সাশ্রয় হতে পারে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা। এ ছাড়া দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিকে সহজ শর্তে ঋণ দিলে, সরকারি ব্যাংকে দেশী সফটওয়্যার ব্যবহারের নীতি অবলম্বন করলে এ ক্ষেত্রে জাতি উপকৃত হতে পারে।
বিদেশে সফটওয়্যার রফতানির সম্ভাবনাও দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। বাংলাদেশের সফটওয়্যার কোম্পানি বিশ^জুড়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ-সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বাংলাদেশী আইটি কোম্পানি দোহাটেক নিউ মিডিয়া বর্তমানে ভুটানে ই-জিপি বাস্তবায়ন সফটওয়্যারসহ কারিগরি সেবা দিচ্ছে। নেপালে যানবাহন নিবন্ধন ডিজিটালাইজেশনের কাজ করছে বাংলাদেশী কোম্পানি টাইগার আইটি। ভিওআইপি সফটওয়্যারে বিশে^র অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি বাংলাদেশের রিভ সিস্টেমস। কোম্পানিটির যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ ৯টি দেশে আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। এই অফিসের মাধ্যমে ৮০টি দেশে সফটওয়্যার বিক্রি করছে কোম্পানি। জাপানে নিজস্ব অফিস চালু করেছে ডাটাসফট সিস্টেমস বাংলাদেশ লিমিটেড। সরকারি টেন্ডারের ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমে অনেক ক্ষেত্রে কাজ পেয়ে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানি। এ ক্ষেত্রে দেশী কোম্পানি কাজ পেলে সরকারের খরচ যেমন কমত, তেমনি টাকাটাও থেকে যেত দেশের ভেতরেই।
আমরা বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতের এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। হয়তো অচিরেই আমরা আমাদের ডিজিটাল অর্থনীতিতে সফটওয়্যার রফতানি খাতকে আরও বেশি শক্তিশালী দেখতে পারব। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশী সফটওয়্যার ব্যবহারের পরিসর আরও বেড়ে যাবে। আর সফটওয়্যার রফতানির মাধ্যমে আমরা পাব শত শত কোটি ডলার আয়ের সুযোগ। আর সে পথেই আসবে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এজন্য সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ও সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক ভূমিকা একান্ত কাম্য।