লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
ই-বর্জ্য যখন নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি
মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই তার কাজকর্মকে করে তুলছে সহজ থেকে সহজতর। একই সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের সামনে এনে হাজির করছে নতুন নতুন সমস্যাও। ই-বর্জ্য তেমনি একটি নতুন সমস্যা। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, ই-বর্জ্যের বিষয়টি বাংলাদেশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে উঠেছে। ফেলে দেয়া পুরনো টেলিভিশন, রেডিও, ভিসিআর, কমপিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনসহ বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতি ও বাতিল হওয়া হাজারো ইলেকট্রনিক্স পণ্য মিলে যে ই-বর্জ্য তৈরি করছে তা আমাদের মানবজীবনের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ ক্ষক্ষত্রে এখনই সতর্ক ব্যবস্থা না নিলে আমাদের চড়া মূল্য দিতে হবে।
একটি এনজিও এর নিজস্ব গবেষণা সূত্রে জানিয়েছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৫১ লাখ মেট্রিক টন। পরের অর্থবছরে তা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ১০ লাখ টনে। তবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ প্রকাশিত ই-বর্জ্য মানচিত্রে দেখা যায়, ২০১২ সালে বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার টন। এই বর্জ্যের মাত্র ৩০ শতাংশ রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। বাকি ৭০ শতাংশ ই-বর্জ্যই যেখানে-সেখানে ভেঙেচুরে ফেলে দেয়া হয়। এসব পণ্যের মাঝে থাকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রেজিন, ফাইবার গস্নাস, পস্নাস্টিক, সীসা, টিন, সিলিকন, কার্বন ও লোহার উপাদান। অল্প পরিমাণে হলেও থাকে ক্যাডমিয়াম ও পারদ একথালিয়াম। শুধু তাই নয়, এসব পণ্যে মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জিঙ্ক, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড, বেরিলিয়ামসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্যের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এসব পণ্য ক্রনিক ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, লিভার ও কিডনি সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড হরমোন সমস্যা, নবজাতকের বিকলাঙ্গতা, প্রতিবন্ধিতা, মস্তিষ্ক ও রক্তনালীর বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত।
সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হলো- এসব ই-বর্জ্য ধ্বংস, রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে কোনো পরিকাঠামো নেই। নেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সচেতনতা। এসব রোধে নেই কোনো কার্যকর আইন। অথচ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও রয়েছে ই-বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে আলাদা আইন। জরুরি ভিত্তিতে আমাদের দেশে প্রণয়ন করা দরকার ই-বর্জ্য সংক্রান্ত একটি আলাদা আইন অথবা সাধারণ বর্জ্যের জন্য প্রণীত আইনটি আরও যুগোপযোগী করা দরকার।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সময়ের সাথে দেশে ই-পণ্য ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাড়বে ই-বর্জ্যের পরিমাণও। দেশে মানুষ কী পরিমাণ বৈদ্যুতিক পণ্য ব্যবহার করে বা কতটা ই-বর্জ্যে পরিণত করে তা জানার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত সিরিয়াস মার্কেটিং অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ লিমিটেডের ‘ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে’ মতে, সে সময় দেশে টিভি সেটের সংখ্যা ছিল ২ কোটির কাছাকাছি। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের দেয়া হিসাব মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩ কোটি মোবাইল ফোন সংযোগ চালু রয়েছে। বাংলাদেশ মোবাইল ফোন বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গত এক বছরে দেশে বৈধ পথে মোবাইল ফোন আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ। আর অবৈধ পথে এসেছে ৫০ লাখেরও বেশি।
অতএব সহজেই অনুমেয়, দেশে সময়ের সাথে পালস্না দিয়ে বাড়ছে ই-বর্জ্যের পরিমাণ, সেই সাথে বাড়ছে ই-বর্জ্যসংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকিও। তাই অবিলম্বে প্রয়োজন ই-বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষপ। এ জন্য প্রয়োজন আলাদা আইন প্রণয়ন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ই-বর্জ্য রাখার জন্য কয়েকটি বিশেষ ভাগাড় দরকার। একই সাথে প্রয়োজন ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করার আধুনিক ব্যবস্থা। রিসাইক্লিং করার অনুপযোগী ই-বর্জ্য এমনভাবে ভাগাড়ে সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে তা মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। সাধারণ মানুষের মাঝে ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে এ ব্যাপারে তাদেরকে সচেতন করতে হবে। এ ব্যাপারে বেসরকারি সেবা সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এ ক্ষক্ষত্রে মুখ্য ভূমিকাটি পালন করতে হবে সরকারকেই। সরকারকে এ জন্য হাতে নিতে হবে আলাদা কর্মসূচি। সব কথার শেষ কথা, ই-বর্জ্য সম্পর্কে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষক্ষপ।