লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
সম্পাদকীয়
একটি জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশকিছু মৌলিক বিষয়কে সামনে রাখতে হয়৷ এসব বিবেচ্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাজেটে অবলম্বিত দর্শন৷ যে দৃষ্টি ভঙ্গিকে সামনে রেখে বাজেট প্রণেতারা বাজেট সূত্রায়ন করেন, সেটাই হচ্ছে বাজেটীয় দর্শন৷ এ বাজেটীয় দর্শন যেকোনো দেশের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ, সঠিক দর্শনকে বিবেচনায় না নিয়ে বাজেট প্রণীত হলে, সে বাজেট হয় দিক্ভ্রান্ত বাজেট৷ আর এধরনের দিক্ভ্রান্ত বাজেট নিয়ে আর যাই হোক, জাতিকে সামনে এগিয়ে নেয়া যায় না৷
আমাদের মনে হয়, এবার আমরা ভুল দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে দিক্ভ্রান্ত একটি বাজেট প্রণয়ন করলাম৷ আমরা এ পর্যন্ত একটা দর্শনের ওপর ভর করে স্বাধীনতাউত্তর প্রতিটি বাজেট প্রণয়ন করে আসছিলাম শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচনা করে৷ কিন্তু এবারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই প্রথমবারের মতো শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খাত থেকে অবনমন করে দ্বিতীয় অবস্থানে নামিয়ে এনেছে৷ এবার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধের খাতকে৷ এবারের বাজেটে এই দর্শনগত ভুল পদক্ষেপ আমাদের বাজেট প্রণেতাদের দূরদৃষ্টির অভাবকেই স্পষ্ট করে তুলেছে৷
এছাড়া এযাবত শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যৌথভাবে একক বরাদ্দে৷ এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ আমরা বার বার বলে এসেছি, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আলাদা খাত বিবেচনা করে স্বতন্ত্র বরাদ্দ ঘোষিত হোক বাজেটে৷ বিশ্বজুড়ে মানুষ এখন যৌক্তিক কারণেই প্রযুক্তি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে৷ ফলে প্রায় প্রতিটি দেশ এখাতে বরাদ্দ যথাসম্ভব বাড়িয়ে তুলছে৷ আজকের দিনে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো মোটামুটি একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছে, প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ যেনো সংশ্লিষ্ট দেশের মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপির ৩ শতাংশের নিচে না নামে৷ কোনো কোনো ধনী দেশ এই প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ জিডিপির ৪ শতাংশে নিয়ে পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে৷ আমরা আমাদের তহবিলের সীমাবদ্ধতার কারণে ২০০২ সালের জাতীয় আইসিটি নীতিমালায় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলাম, আমরাও জাতীয় বাজেটে কমপক্ষে জিডিপির ১ শতাংশ প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখবো৷ কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে যে কয়টি অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণীত হয়েছে, তার কোনোটিতেই প্রতিশ্রুত এই ১ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে পারিনি৷ এবারের সর্বশেষ বাজেটেও এই ব্যর্থতা আমাদের রয়েই গেলো৷ কিন্তু প্রযুক্তির ক্ষেত্র ক্রমবর্ধমান হারে প্রসারিত হয়েই চলেছে৷ অতএব এখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদটা স্বাভাবিকভাবেই এসে যাচ্ছে৷ এ প্রেক্ষাপটে আমরা দাবি করছি, আগামী অর্থবছরের বাজেট থেকে যেনো প্রযুক্তি খাতকে একটা স্বতন্ত্র খাত হিসেবে বিবেচনা করে শিক্ষা খাত থেকে পুরোপুরি আলাদা করে বরাদ্দ দেয়া হয় এবং এই বরাদ্দ যেনো জিডিপির ২ শতাংশের কম কিছুতেই না হয়৷ কারণ, তা না হলে আমরা আমাদের দেশের জন্য একটি শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত-দক্ষ প্রযুক্তি প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারবো না, পারবো না প্রযুক্তিবিষয়ক কোনো গবেষণা পরিচালনা করতে৷ আশা করি, বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকরা মাথায় রাখবেন ভবিষ্যৎ সব জাতীয় বাজেট সূত্রায়নের বেলায়৷
আমরা চাই একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে৷ তাই যদি হয়, তবে আমাদের প্রয়োজন উচ্চশিক্ষিত ও উঁচুমানের প্রশিক্ষিত একটি প্রযুক্তিপ্রজন্ম৷ কিন্তু আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ করছি, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আজকের দিনের তরুণ প্রজন্ম উচ্চশিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার বদলে বরং অন্যান্য অনুষদের উচ্চশিক্ষার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে৷ কেনো এমনটি ঘটছে, তার কারণ অনুসন্ধান করে, এ সমস্যার অবসান ঘটিয়ে আমাদেরকে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে করে তরুণ প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী হয়৷ আর তরুণ প্রজন্মকেও বুঝতে হবে সামনে তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানের নানা সুযোগ আমাদের সামনে এসে হাজির হবে৷ এ জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে৷
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মেধাসম্পদ সংরক্ষণের বিষয়টি এখনো আমাদের দেশে তেমন গুরুত্ব পায়নি৷ অথচ সত্যিকার অর্থে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে হলে মেধাসম্পদ রক্ষার ব্যাপারে আমাদের কঠোর অবস্থান নিতে হবে৷ সম্প্রতি সরকার এ ব্যাপারে একটু তত্পর হয়েছে বলে মনে হয়৷ আমরা সরকারের এই ইতিবাচক তত্পরতাকে স্বাগত জানাই৷
চলতি জুলাই মাসের ৩ তারিখে আমরা পালন করেছি মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষাবিদ ও এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রনায়ক অধ্যাপক আবদুল কাদেরের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী৷ ওই দিনে আমরা তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি৷ সেই সাথে মহান আল্লাহ্র কাছে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি৷ আল্লাহ্ আমাদের সবার সহায় হোন৷