লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ যাই ভাবুন: ইন্টারনেট আমেরিকার নয়
ইন্টারনেটের অ্যাড্রেস যে-ই নিয়ন্ত্রণ করুক, তার হাতেই থাকবে নেটওয়ার্কের জীবন-মরণের ক্ষমতা। যেমন ক্ষমতা থাকবে একটি ডোমেইন নেম (যেমন Comjagat.com, Ittefaq.com ইত্যাদি) ডিলিট করে দেয়ার, নেটওয়ার্ক থেকে একটি ওয়েবসাইট সরিয়ে ফেলা, যাতে ওই ওয়েবসাইট আর কখনই ওয়েবে দেখতে পাওয়া যাবে না। একটি ই-মেইল সরবরাহ না করে রেখে দেয়া যাবে। কখনই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না এই ই-মেইল।
এ পর্যন্ত এই কর্তৃত্ব ছিল আমেরিকার হাতে। ইন্টারনেটের আবিষ্কারক দেশ আমেরিকা হওয়ার সুবাধে এ পর্যন্ত ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের ক্ষমতাটুকু হাতে রেখেছে। আর এই তদারকির কাজ করে আসছে আমেরিকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি অলাভজনক সংস্থা। এর নাম Internet Corporation for Assigned Names and Numbers (ICANN)। এই আইক্যান হচ্ছে ‘ইন্টারনেট অ্যাড্রেস সিস্টেম’ তদারকি সংস্থা। ১৯৯৮ সালে এই ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স তদারকির জন্য আইক্যানের ভেতরে খোলা হয় একটি বিভাগ, যার নাম Internet Assigned Numbers Authority (IANA)। এই বিভাগের সাথে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি মতে এই বিভাগ ২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের বিষয়টি তদারকি করে। গত ১ অক্টোবর ২০১৬ এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। অতএব এই বিভাগ ১ অক্টোবর থেকে আর ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের দায়িত্ব পালন করছে না।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এখন ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের দায়িত্বটা কার হাতে যাবে। প্রতি বছর জাতিসংঘ আয়োজিত ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের সম্মেলনে বারবার দাবি তোলা হয়, ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের কর্তৃত্ব তুলে দিতে জাতিসংঘের আইটিইউ তথা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের মতো একটি সংস্থার কাছে। কিন্তু আমেরিকা তাতে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজের মতো কারও কারও অভিমত, এমনটি করলে ইন্টারনেট তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাদের যুক্তি- এ ধরনের হস্তান্তর করা হলে, তাদের ভাষায় চীন, ইরান ও রাশিয়ার মতো স্বৈরাচারী সরকারগুলো অনলাইনে পাওয়া রিসোর্সগুলোর ওপর বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাবে। কার্যত এর উল্টোটাই সত্য।
আমেরিকার সরকারের সহায়তায়ই ১৯৯৮ সালে আইক্যানের সৃষ্টি, যাতে করে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের দেখাশোনার কাজটি জাতিসংঘের মতো কোনো সংস্থার কাছে চলে না যেতে পারে। এর পরিবর্তে আমেরিকা সরকার সামনে নিয়ে আসে একটি ‘মাল্টিস্টেকহোল্ডার’ মডেল। যেখানে শুধু সরকারগুলোর বক্তব্যের সুযোগই থাকবে না, একই সাথে বক্তব্য থাকবে প্রকৌশলী, নেটওয়ার্ক অপারেটর, এমনকি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদেরও। যেহেতু এ ধরনের কোনো সংগঠনের উদাহরণ এর আগে ছিল না এবং ভয় ছিল আইক্যান এর বৈধতা হারিয়ে ফেলবে, তাই আমেরিকা নিজের জন্য ভেটো দেয়ার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে ইন্টারনেট মাস্টার লিস্ট অব অ্যাড্রেসের ব্যাপারে।
যখন আইক্যান সৃষ্টি করা হয়, তাদের উপলব্ধিতে ছিল- ইন্টারনেটের ছিল জোরালো আমেরিকান ফ্লেভার এবং তখন বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই ছিল আমেরিকান। কিন্তু আজকের দিনে বেশিরভাগ নেটিজেন বসবাস করে আমেরিকার বাইরের দুনিয়ায়। এদের বেশিরভাগের বসবাস চীন ও ভারতে। আর বেশিরভাগ ট্রাফিক এখন আর আমেরিকান ক্যাবলের মধ্য দিয়ে চলে না।
২০১৩ সালে এসে উদঘাটিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ বিশ^ব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ওপর গোয়েন্দা তৎপরতা চালায়। ফলে আমেরিকার ওপর চাপ বাড়ে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইন্টারনেটের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়ার ব্যাপারে। ২০১৪ সালে সরকার ওয়াশিংটন ডিসিতে বলে- সরকার তা করবে। তবে আইক্যান হচ্ছে পুরোপুরি স্বাধীন এবং এটি অন্য সরকারের ক্ষমতা নিয়ে যাওয়া ঠেকাতে সক্ষম। আইক্যান বেশ কয়েকটি সংস্কার চলতি বছরের প্রথম দিকে বাস্তবায়নে রাজি হওয়ার পর ওবামা প্রশাসন এই সংস্থাটিকে পূর্ণ দায়দায়িত্ব দিতে সিদ্ধান্ত নেয়।
এমনই কথা যথাযথ। ইন্টারনেটকে ভাবতে হবে একটি বৈশি^ক বিষয় হিসেবে। তবে এটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে- ন্যাশনাল ফায়ারওয়াল অথবা এমন আইনি ম্যান্ডেট দেয়ার কারণে যে, কিছু সুনির্দিষ্ট ধরনের তথ্য মজুদ করতে হবে একটি দেশ-বিশেষের ভেতরে।
রাশিয়ার নয়া ডাটা লোকালাইজেশন আইন কার্যকর করা হয় গত ১ সেপ্টেম্বরে। এতে বলা হয়, রাশিয়ান নাগরিকদের পার্সোন্যাল ইনফরমেশন রাশিয়ার ভেতরে একটি ডাটাবেজে স্টোর করতে হবে। আইক্যান থেকে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করার পরও চীন ও রাশিয়াকে ইন্টারনেটের ওপর তাদের নিজস্ব আইন কার্যকর করার বিষয়টিকে থামাতে পারবে না। তবে এর ফলে ইন্টারনেট কীভাবে পরিচালিত হলো বা না হলো সে ব্যাপারে তাদের অভিযোগের মাত্রা কমবে।
অপরদিকে আইক্যানের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করার ফলে ঐকমত্যভিত্তিক মডেলকে দুর্বল করে তুলবে। আসলে ঐকমত্যভিত্তিক মডেলই ইন্টারনেটকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ইন্টারনেট সম্পর্কিত সবচেয়ে কণ্টকময় সমস্যা হচ্ছে- সাইবার সিকিউরিটি ও হেইট স্পিচ থেকে শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল ডাটা প্রবাহ পর্যন্ত- সবখানেই রয়েছে রাজনৈতিক ও কারিগরি বিষয়ের জটিল মিশন। আইক্যানেরও রয়েছে নানা ত্রুটি। এর হাইপার ব্যুরোক্র্যাটিক প্রসেসও কম নয়। তবে এটি দেখিয়েছে, মাল্টিস্টেকহোল্ডার মডেল কঠিন সমস্যাও সমাধান করতে পারে। যেমন ইন্টারনেট অ্যাড্রেসের জন্য নতুন সাফিক্স সৃষ্টি। বর্তমানে এখন ১১০ কোটি ওয়েবসাইট রয়েছে অনলাইনে। গ্লোবাল অনলাইন ট্রাফিক প্রথমবারের মতো এ বছর ১ জেটাবাইট ছাড়িয়ে যাবে, যা ১৫২এম বর্ষ হাই ডেফিকেশন ভিডিওর সমান।
টেড ক্রুজ হয়তো অক্টোবরে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের কর্তৃত্ব হস্তান্তর ব্যর্থ হবেন বলেই মনে হয়। তবে আইনি বৈধতা অনিশ্চিতই থেকে যাবে- রিপাবলিকানরা এতে বাধা সৃষ্টি করতে আদালতের আশ্রয় নিতে পারবে আমেরিকান সরকারকে আইক্যানের ওপর নিয়ন্ত্রণ আবার হাতে নিতে। এর আগে কংগ্রেস স্পেন্ডিং বিল পাস করে প্রশাসনের ওপর বাধা সৃষ্টি করেছে এর ওপর অর্থ খরচ করার ব্যাপারে। এটি হবে একটি ভুল লড়াই। আইক্যানের স্বাধীনতা সমর্থন করে ইন্টারনেটকে বাঁচানো যাবে না।
আড়াই বছর আগে আইক্যান মাল্টিস্টেকহোল্ডার কমিউনিটি এক অভিযাত্রা শুরু করে বৈশি^কভাবে সম্মত একটি পরিকল্পনা তৈরির ব্যাপারে। আইএএনএ’র কাজটি একটি গ্লোবাল ইন্টারনেট কমিউনিটির কাছে স্থানান্তর করা যায়। এই প্রক্রিয়াটি তৈরি করবে একটি ট্র্যানজিশন প্রপোজালের প্যাকেজ, ইন্টারনেট ইটসেলফ-গ্লোবাল, ডাইভার্স অ্যান্ড ইনক্লুসিভ চেতনাকে ধারণ করে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাত, সংস্কৃতি, রুচির লোক একসাথে কাজ করে ঐকমত্যভিত্তিক দুটি প্রস্তাব তৈরি করবে, যা নিশ্চিত করবে আইএএনএ’র স্থিতিশীল অব্যাহত ও নিরাপদ পরিচালনা