লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
নেটওয়ার্কিং নিয়ে বুয়েটে আন্তর্জাতিক সম্মেলন
সীমানার কাঁটাতার ছিঁড়ে আজ আমরা মিলিত হয়েছি প্রযুক্তির একক বাঁধনে। প্রযুক্তির এই সংযোগ সেতুতে যুক্ত হচ্ছেন সব ঘরানার মানুষ। সংযুক্ত থাকছে তাদের ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো। এর ফলে স্বজনদের সাথে আলাপনে ব্যবহৃত মুঠোফোনটি একাধারে হয়ে উঠেছে বায়োস্কপ, ব্যাংক, হাসপাতাল...। অপরদিকে কমপিউটার হয়ে উঠেছে ব্যক্তি ও পেশাজীবনের অন্যতম সঙ্গী। ফ্রিজ-টিভি থেকে সিসিক্যাম হয়ে এই সংযোগ পৌঁছে গেছে শয্যাঘরেও। এই সংযোগের শিরা-উপশিরার বাড়-বাড়মেত্মর ফলে আইপিভি৬ প্রটোকলে সংযুক্ত হতে ডিভাইসগুলোও এখন তৈরি হচ্ছে নতুন ধাঁচে। কিন্তু এই সংযোগ নকশাটি কতটা নিরাপদ, আদৌ কি এর সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে, কীভাবেই বা এই সংযোগ সেতুতে চেপে আমরা পৌঁছতে পারব ঈপ্সিত বন্দরে?
প্রযুক্তির প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচিত এই ‘সংযোগ’ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আয়োজনে গত ৫ থেকে ৮ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো ‘নেটওয়ার্কিং, সিস্টেম এবং সিকিউরিটি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। অ্যাকাডেমিয়া, ইন্ডাস্ট্রি ও সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে বুয়েট গ্র্যাজুয়েট কমপ্লেক্সের পঞ্চম তলায় অনুষ্ঠিত হয় এই ব্যাতিক্রমী সম্মেলনটি। সম্মেলনে অংশ নেয় ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। নিচতলায় পোস্টার প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীরা। সম্মেলনে বেশ কয়েকটি আলোচনা ও সেমিনারের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়েছে কারিগরি অধিবেশন। গবেষক, পেশাজীবী, ডেভেলপার ও ব্যবহারকারীদের মিথষ্ক্রিয়ায় বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে পলাশী মোড়ের বুয়েট ভবন। তিন দিনের এই সম্মেলনে উপস্থাপিত হয় কমপিউটার নেটওয়ার্ক, নেটওয়ার্ক সিস্টেম ও সিকিউরিটি বিষয়ে তত্ত্বীয় এবং প্রায়োগিক ফলাফল। ভাবনার জানালা খুলে মেলে ধরা হয় অমিত সম্ভাবনার বাতিঘর। কারিগরি অধিবেশনে তুলে ধরা হয় ভবিষ্যৎ নেটওয়ার্ক ভাবনার বাস্তবতা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মালাগাঁথা ভবিষ্যৎ নেটওয়ার্কিংয়ের এই আন্তর্জাতিক ফোরাম দেশের সীমানা জয় করে পৌঁছে গেছে প্রাচ্য-প্রাতিচ্যে।
এদিকে সম্মেলন উপলক্ষে আগেভাগেই অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, ভারত, চেক রিপাবলিক, আয়ারল্যান্ড, জাপান, মালয়েশিয়া, মরক্কো, নিউজিল্যান্ড, কাতার, সৌদি আরব, সেনেগাল, তাইওয়ান, ত্রিনিদাদ ও যুক্তরাজ্য থেকে নেটওয়ার্কিং বিশেষজ্ঞেরা নেটওয়ার্কিং নিয়ে নিজেদের গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেন। এতে ১৩টি সংক্ষেপ্তসহ মোট ৬৩টি পেপার জমা পড়ে। নিরীক্ষণ শেষে সম্মেলনে ৮টি সংক্ষেপ্ত ও ৫টি পূর্ণাঙ্গ পেপার গৃহীত হয়। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ পেপার গৃহীত হয়।
সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে এম-হেলথ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাজ্যোর মারক্যুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও ইউবিকম্প ল্যাবের পরিচালক শেখ ইকবাল আহমেদ। সেখানে উন্নয়নশীল দেশে মুঠোফোনের মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের পীড়া বিশেস্নষণের প্রযুক্তির কথা তুলে ধরেন তিনি। সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক পেশ করেন স্মার্ট সিটির রূপরেখা। সেখানে তিনি মুঠোফোন অথবা পরিধেয় প্রযুক্তির দারুণ সব ব্যবহার তুলে ধরেন। মোবাইল নেটওয়ার্ক হয়ে ভ্যাস সেবা উন্নয়নের পরিকল্পনা ও বাস্তবতার বিষয়টি প্রবন্ধের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন গ্রামীণফোনের আইটি ও সেবা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান কেএম তারিকুজ্জামান। সম্মেলনে এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে চমৎকার একটি প্রবন্ধ পেশ করেন ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ফ্লোরিডার সহযোগী অধ্যাপক শ্রীরাম চেলস্নাপান। ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের নতুন স্বপ্ন মেলে ধরেন জার্মানির আরিবাস গ্রুপের সাইবার নিরাপত্তা প্রকৌশলী খান ফেরদৌস ওয়াহিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদ নূর-ই আলম।
বিগডাটা নেটওয়ার্কে যোগাযোগ, সুরক্ষা ও ঝুঁকি মোকাবেলার পথনির্দেশনার সন্ধানে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বুয়েট শিক্ষক মাহমুদা নাজনীন, মুহাম্মদ ইউনুস আলী, মুহাম্মদ আবদুলস্নাহ আদনান, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজেশ পালিত, ডাটাসফট পরিচালক এম মানজুর মাহমুদ, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ মোয়াজ্জেম হোসাইন খান ও গ্রামীণফোনের অ্যানালাইটিক্স অ্যান্ড ইনসাইট সিস্টেমস প্ল্যানিং বিভাগের প্রধান আরাফাত আনোয়ার।
আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে বিভিন্ন প্রটোকলের ওপর নির্ভরশীলতা ও কীভাবে নেটওয়ার্কের চরিত্রগুলো বদলে যাচ্ছে, তা নির্ণয়ের মাধ্যমে আধুনিক কমপিউটার নেটওয়ার্কের জটিলতা ব্যবস্থাপনার প্রায়োগিক বিষয়গুলো তুলে ধরেন যুক্তরাজ্যের ভেরিফ্লোর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান প্রকৌশলী আহমেদ খুরশীদ এবং জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার আর ইসলাম।
৭ জানুয়ারি রাতে আন্তর্জাতিক এই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন বুয়েট উপাচার্য সাইফুল ইসলাম। ইসিই ভবনে অনুষ্ঠিত সমাপনী অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্য দেন আয়োজক কমিটির সহসভাপতি আবু সাইয়্যেদ মুহাম্মদ লতিফুল হক। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মুহাম্মাদ জুলকারনাইন, বুয়েট ট্রিপলই বা ইইই অনুষদের ডিন এম কায়কোবাদ এবং সিএসই অনুষদের প্রধান এম সোহেল রহমান। সমাপনী রাতে চারটি বিভাগে সম্মেলনের সেরা গবেষণা ও উপস্থাপনাকে পুরস্কৃত করা হয়। এ সময় সম্মেলনের বেস্ট পেপারস সম্মাননা অর্জন করেন তারিক রেজা তোহা, সালমান ইশতিয়াক, তাসলিম আরেফিন খান, তুষার চক্রবর্তী এবং এবিএম আলিম আল ইসলামের কম খরচে পথচারী গণনার উদ্ভাবনী গবেষণাপত্র স্পার্স ম্যাট।
কম খরচে দৃশ্যমান আলোর ওপর নির্ভরশীল অঙ্গভঙ্গি শনাক্তকরণ প্রযুক্তিভাবনা উপস্থাপন করে বেস্ট স্টুডেন্ট পেপারস অ্যাওয়ার্ড জয় করেন তুষার চক্রবর্তী, এমডি নাসিম, সাকিব মুহাম্মদ বিন মালেক, তাসকির হাসান মজুমদার, সামিউল সাইফ ও এবিএম আলিম আল ইসলাম। চ্যাম্পিয়ন স্টুডেন্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন মাজহারুল ইসলাম ও এবিএম আলিম আল ইসলাম। এতে রানার আপ হন মলয় কুমার দেবনাথ, শারমিন আক্তার ও সাইদুর রহমান।
সম্মেলন শেষে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানা পরিদর্শন করেন সম্মেলনের আয়োজক ও অতিথিরা। নেটওয়ার্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের আয়োজনে সহযোগিতা করেছে এসিএম চ্যাপ্টার কনফারেন্স, আইট্রিপলই বাংলাদেশ সেকশন। সম্মেলন আয়োজনে আর্থিক সহায়তা করেছে টাইগার আইটি, দোহা টেক, রিভ সিস্টেমস, অ্যাপনিক, এমবিল, শিওরক্যাশ ও ওয়ালটন