• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > উনিশ অক্টোবর থেকে আটাশ জুন
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৭ - জুলাই
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
প্রতিবেদন
তথ্যসূত্র:
রির্পোট
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
উনিশ অক্টোবর থেকে আটাশ জুন
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে নিজের অবস্থান তিরিশ বছরের বেশি সময় পার করছি। সেই ১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে এখনও বহমান এই যাত্রার বাঁকে বাঁকে যেমনি আছে সুখ-দুঃখ, তেমনি আছে জয়-পরাজয়। পেছনের এই তিরিশ বছরের দিকে তাকালে যেমনি বলা যাবে অর্জনের কথা, তেমনি বলা যাবে অর্জন করতে না-পারার কথা। এসব মিলেই তো জীবন। মানুষ খুব ভাগ্যবান, সে তার কষ্টের কথা, বেদনার কথা বা পরাজয়ের কথা তেমনভাবে মনে রাখে না। যদি সেটি করত, তবে তার সামনে চলা থেমে যেত। বেশিরভাগ সময়েই মানুষ তার আনন্দ ও বিজয়ের কথাই মনে রাখে। আমিও তাই আনন্দের কথা বা সফলতার কথাগুলোই মনে রাখি। এই খাতে আমার নিজের কী অর্জন, সেটি আমি গুছিয়ে বলতে পারব না। তবে তিরিশ বছরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার অন্তত দুয়েকটি স্মৃতি এখানে তুলে ধরতে চাই। আমাদের নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তিবিদ, রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকেরা এই স্মৃতিচারণ থেকে কিছু না কিছু জানবেন- সেই প্রত্যাশা আমার রয়েছে।
স্মৃতিচারণ করলে স্মরণে পড়বে কমপিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের কথা, প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস প্রতিষ্ঠার কথা, ডেস্কটপ প্রকাশনার বিপ্লবের কথা, জাতীয় নির্বাচনে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, কমপিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার, দেশব্যাপী কমপিউটার প্রশিক্ষণ, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের লড়াই, ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা, দেশে ডিজিটাল যন্ত্র উৎপাদনের সুযোগ তৈরি, দেশীয় সফটওয়্যার ও সেবা খাতের সুরক্ষা এবং সম্ভবত সর্বশেষটি ডিজিটাল পণ্য রফতানিতে নগদ সহায়তার ব্যবস্থা করা।
৬ আগস্ট ’১৫ : খুব পেছনের কথা না-ই বলি। ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের স্মৃতিটা ছোট করে স্মরণ করি। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভা অনুষ্ঠিত হয়। কোনো পদবী ছাড়াই আমি তখন সেই কমিটির সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। কোনো সন্দেহ নেই, সেটি আমার জন্য ছিল একটি বিরাট সম্মান। আলোচ্যসূচি অনুযায়ী সভা পরিচালিত হওয়ার শেষ প্রান্তে আমি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে প্রসঙ্গ উত্থাপন করি, বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী আছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে ল্যাপটপ দেয়া হবে, এমন ঘোষণা আপনি দিয়েছেন। আমরা এখন সব ডিজিটাল যন্ত্র আমদানি করি। এর ফলে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আমাদেরকে খরচ করতে হয়, নিজের দেশে যদি সংযোজনও করি, তবে তাতে অন্তত শতকরা ২৫ ভাগ সাশ্রয় হবে। সভায় এই প্রসঙ্গে অনেক আলোচনা হয়। টেলিফোন শিল্প সংস্থার বিষয় নিয়েও কথা হয়। দোয়েলের ব্যর্থতাও আলোচনায় আসে। এতে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনার ফাঁকে অন্যদের বক্তব্যের আলোকে আমি বলি, টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। কারণ, সেটি ছিল ব্যবস্থাপনা ক্রুটি। আমরা যদি আমদানির শেকল ছিঁড়তে না পারি তবে আমাদের সঙ্কট আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে টেলিফোন শিল্প সংস্থার দায়িত্ব দেয়ার কথা বলে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ ডিজিটাল যন্ত্র শুধু উৎপাদন করবে না, রফতানিও করবে। সভাশেষে অনানুষ্ঠানিকভাবেও তিনি বিষয়টি নিয়ে আমার ও অর্থমন্ত্রীসহ অন্যদের সাথে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে টেলিফোন শিল্প সংস্থার দায়িত্ব আমার নেয়া হয়নি। কারণ, সংস্থাটি চায়নি যে আমি সেটি সার্বিকভাবে পরিচালনা করি। তারা চেয়েছে বরং নামকাওয়াসেত্ম কর্মহীন উপদেষ্টা হয়ে থাকি।
আমরা এর পরের বছর ২০১৬-১৭ বাজেটে এর প্রতিপালন হবে, তেমন আশা করলেও বিষয়টি নিয়ে কোনো মহল থেকেই সেভাবে সরকারকে বুঝানো হয়নি। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোনো বাণিজ্য সংগঠন, যেমন- বিসিএস, বেসিস বা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ কিংবা এফবিসিসিআই এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই যখন আমি বেসিসের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন আমার মাথায় প্রচ-ভাবে এটি কাজ করে যে, শুরুতেই নিজের দেশকে বাঁচাতে হবে। তাই সেই নির্বাচনেই আমরা দেশীয় সফটওয়্যারের সুরক্ষার পাশাপাশি দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনের জন্য সরকারকে সক্রিয় করার অঙ্গীকার ঘোষণা করি। বিগত প্রায় এক বছরে সংশ্লিষ্ট সব মহলেই এটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বিশেষ করে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। দেশে হার্ডওয়্যার উৎপাদন, দেশীয় সফটওয়্যারের সুরক্ষা এবং তথ্যপ্রযুক্তি রফতানিতে প্রণোদনার বিষয়গুলো এই বিভাগের বাজেটে অগ্রাধিকার তালিকায় গুরুত্ব পায়। এই বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিজে এ বিষয়ে দারুণভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তার বিভাগকে এজন্য সব ধরনের কাজ করতে নির্দেশ দেন। তিনি নিজেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের সব স্তরে এই বিষয়ক সভায় যোগ দেন এবং এই খাতের বক্তব্যগুলো তুলে ধরেন।
২০১৭-১৮ সালের বাজেট দেখে আমরা অনুভব করলাম- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি ও দেশপ্রেম এবারের বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে এবং এবার দেশীয় সফটওয়্যারের সুরক্ষা ও দেশটি ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনে মাইলফলক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা এখন দুনিয়াকে এই অর্জন দেখাতে পারব। সরকার এবার ডিজিটাল যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সব কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশকে মাত্র শতকরা ১ ভাগ করের আওতায় রেখে খুচরা স্তরের ভ্যাটও প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে ১৯৯৮-৯৯ সালে কর ও শুল্ক প্রত্যাহারের ঘটনাটি যেমন মাইলফলক ছিল, এবার সেটিও তেমনি একটি কাজ হলো। আশা করি, একটি অর্থবছরেই এর প্রভাব আমাদের ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রফতানিতে দেখতে পাব। অন্যদিকে সরকার বিদেশী সফটওয়্যারের ওপর করারোপ করার ফলে দেশীয় সফটওয়্যারের প্রতিযেগিতার শক্তি বাড়ল।
তবে বাজেট পেশ করার পর আমাদের একটি দাবিই অনুপস্থিত দেখতে পেয়েছিলাম। সেটি হলো আমরা তথ্যপ্রযুক্তি রফতানিতে যে নগদ প্রণোদনার দাবি তুলেছিলাম, সেটি বাজেটে ছিল না। বাজেট আলোচনায় আমি প্রায়ই বলেছিলাম, আমাদের এই দাবিটি হয়তো এই বিষয়ক কমিটির সভায় আলোচিত হয়ে ইতিবাচক হবে। এই লেখায় সেই গল্পটিই তুলে ধরতে চাই। এজন্য কিছুটা পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। উল্লেখ করা দরকার, এই দাবি তোলারও একটি সুন্দর ও চমকপ্রদ ইতিহাস রয়েছে।
১৯ অক্টোবর ’১৬ : সকাল সাড়ে ১০টায় বসুন্ধরা সম্মেলন কেন্দ্রে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ’১৬-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। বেসিস এর সহ-আয়োজক বিধায় অনুষ্ঠানের মঞ্চে আমারও থাকার কথা। উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থলে এসে হাজির। অনুষ্ঠানের স্বাগত ভাষণও শেষ হয়ে গেছে। অনেক অতিথিই বক্তব্য দিয়ে ফেলেছেন। আমি প্রবেশ করার সময় বক্তব্য রাখছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত থেকে শুরু করে পদস্থ আমলা ও সাংসদরাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত। বেসিস থেকে আমার লিখিত বক্তব্যের একটি খসড়া এসএসএফকে দেয়াও হয়েছিল। কিন্তু আমি আগেও যেমন লিখিত বক্তব্য পাঠ করিনি, সেদিনও তা করিনি। পুরোটাই আমার নিজস্ব বক্তব্য দিলাম। যদি পুরো বক্তব্যের একটি শিরোনাম তৈরি করতে হয়, তবে তা হচ্ছে ‘দেশ ও দেশভিত্তিক’। আমি ডিজিটাল যন্ত্রপাতি আমদানির বিপরীতে দেশে উৎপাদন ও রফতানির প্রসঙ্গটি তুললাম। আমি ইন্টারনেটের কথা বললাম। আমি বললাম আমাদের ছেলেমেয়েদের দিয়ে ডিজিটাল রূপান্তরের কাজ করানোর কথা। তবে আমার সেদিনের প্রধান উপজীব্য বিষয় ছিল তথ্যপ্রযুক্তি রফতানি খাতে সরকারের পক্ষ থেকে নগদ প্রণোদনা দেয়ার দাবি তোলা।
আমার বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য পেশ করার সময় আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো কথা বললেন না। অনুষ্ঠানের শেষে তিনি যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসেন, তখন আমিও তার সাথে নামি এবং অর্থমন্ত্রীর সাথে মঞ্চের সিঁড়িতেই দেখা হয়। আমি তখন প্রসঙ্গগুলো তুলি। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলি, ‘এই যে আমাদের মুহিত ভাই আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি মুহিত ভাইকে আমাদের দাবির কথা এখনই বলে দিন, তাহলে সামনের বাজেটে তিনি আমাদের সব দাবি মেনে নেবেন।’ প্রধানমন্ত্রী মুহিত ভাইকে আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘শুনেন উনার কথা।’ এরপর ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের এক সেমিনারে তোফায়েল ভাইকে পেয়ে যাই। তার সামনেও আমি দাবিগুলো তুলি। তিনি সেই সেমিনারে প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন যে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সরকার শতকরা ১০ ভাগ নগদ প্রণোদনা দেবে। ২১ অক্টোবর ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের সমাপনী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীর কাছেও আমার সেই কথাগুলো তুলে ধরি। এরপর যখনই আমার সুযোগ হয়েছে, তখনই আমি দেশীয় সফটওয়্যারের সুরক্ষা, দেশে ডিজিটাল যন্ত্র উৎপাদনের ব্যবস্থা ও রফতানিতে নগদ প্রণোদনা- এই তিনটি বিষয়ের মাঝেই আমার বক্তব্য সীমিত রেখেছি।
১৫ জুন ’১৭ : আমি আগেই জানতাম ১৫ জুন সকাল ১০টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে রফতানি প্রণোদনা বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ের সভা হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তারিখটা আমাকে অনেক আগেই জানিয়েছিলেন। শুধু সেদিনের তারিখ স্মরণ করানো কেন, তিনি তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রফতানিতে নগদ প্রণোদনা দেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দিয়েছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে।
আমাকেই জোর দিয়ে বলেছিলেন, সভা অনুষ্ঠানের আগেই অর্থমন্ত্রীর সাথে আমি যেন কথা বলে নিই। তিনি নিজেও প্রস্ত্ততি নিয়েছিলেন সভায় যোগদানের। কদিনের প্রস্ত্ততির ফলাফল হিসেবে ১৪ জুন সকালে আমাকে আর সামি আহমদকে অর্থ সচিবের কাছে তিনি তার ডিও লেটার দিয়ে পাঠান। ডিও লেটারটি তিনি ১৩ জুন সই করেন, যার নম্বর হচ্ছে আধাসরকারি পত্র সংখ্যা ৫৬০০০০০০০০৬৯৯০০৩১৭-৫৭৪ তারিখ ১৩ জুন ২০১৭। পত্রে তিনি নগদ সহায়তা প্রদানের যৌক্তিকতা তুলে ধরে শতকরা ২০ ভাগ প্রণোদনা প্রদানের অনুরোধ করেন। তিনি পত্রে ’২১ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানির লক্ষ্যমাত্রার কথাও উল্লেখ করেন।
আমি ও সামি আহমদ ১৪ জুন ’১৭ সকালে সেই পত্রটি নিয়ে অর্থ সচিব হেদায়েত আল মামুনের সাথে দেখা করে কথা বলি। একই সাথে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, প্রকৃতপক্ষে অর্থমন্ত্রীই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। কয়েক মিনিটের আলোচনায় আমরা সচিবকে ইতিবাচক দেখে আশান্বিত হলাম। চাইছিলাম এই সুযোগে অর্থমন্ত্রীর সাথেও দেখাটা করে যাই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অর্থমন্ত্রী তখনও অফিসে আসেননি। ফলে সেদিনই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, পরের দিন ১০টায় সভা শুরু হলেও অন্তত এক ঘণ্টা আগে এসে আমরা অর্থমন্ত্রীর সাথে এই বিষয়ে আমাদের প্রস্তাবনা পেশ করব।
সেদিন সকাল পর্যন্ত আমি জানতাম যে, সভায় জুনাইদ আহমেদ পলক থাকবেন। আমার সাথে সামি আহমদেরও থাকার কথা। কিন্তু সেদিন সকালে সামি আহমদ জানালেন, প্রতিমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। সামিও আসতে পারবেন না। বিষয়টি পরে টের পেয়েছিলাম যখন সভা চলাকালে তাতে আমাকেও থাকতে দেয়া হয়নি। সকাল সাড়ে ৯টায় আমি অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব জাকারিয়ার রুমে বসে অনুভব করলাম যে, আজকের লড়াইটা আমার একারই। জাকারিয়া জানতেন, আমি অর্থমন্ত্রীর সাথে সভার আগে এক মিনিট কথা বলতে চাই। তিনি বারবার খোঁজ নিচ্ছিলেন মুহিত ভাই কখন আসবেন। কিন্তু হঠাৎ জানলাম ঠিক সকাল ১০টায় অর্থমন্ত্রী সরাসরি সভাকক্ষে ঢুকে পড়লেন। আমিও ঢুকে গেলাম। সালাম দিলাম মুহিত ভাইকে। মুহিত ভাই মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন- ‘আজকে তো তোমার এজেন্ডা আছে’। ‘জ্বি, আপনার বিবেচনার অপেক্ষায় আজকের মাইলফলক প্রস্তাবনা আমাদের রফতানিতে নগদ সহায়তা দেয়ার জন্য।’ তিনি বললেন, ‘আর কত দেব তোমাকে। সেই যে ২০০৯ সাল থেকে নিচ্ছ, নিয়েই যাচ্ছ। তোমাদের ২০২৪ সাল পর্যন্ত আয়কর নেই। আমার সরকার তো বটেই, পরের সরকারের জন্যও তোমাদের আয়কর মাফ করে দিছি। সব ভ্যাট তুলে দিলাম। তোমার সব দাবি তো মেনে নিছি। তোমার যন্ত্রাংশ আর কাঁচামালকে শুল্কমুক্ত ও ভ্যাটমুক্ত করে দিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক তোমার সব সমস্যার সমাধান করে পাঁচটা এসআরও জারি করেছে। জুলাইয়ে তোমার ইইএফ ফান্ড পেয়ে যাবা। আর কী?’ আমি স্মরণ করলাম- ২০০৯ সালেই ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দিয়ে তিনি তার ইতিবাচক কাজের সূচনা করেছিলেন। এখনও সেটি অব্যাহত রয়েছে।
আমি বললাম, সবই পেয়েছি মুহিত ভাই। সব দিয়েছেন-দিচ্ছেন, তবুও রফতানি প্রণোদনাও দিতে হবে। এটি আমাদের অধিকার। তিনি অর্থ সচিব ও অন্য কর্মকর্তাদেরকে দেখিয়ে বললেন, দেখি ওরা কী বলে? একবার ভাবলাম, জাকারিয়া সাহেবের রুমে গিয়ে বসি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল ভাই তো আসেননি। তাকে তার প্রতিশ্রম্নতির কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। প্রায় ২০ মিনিট পর তোফায়েল ভাই এলেন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘কি ভাই জববার, আজকে আপনার এজেন্ডা। আমি জ্বি বলে পাশাপাশি হাঁটতে থাকলাম। কিছু না বলে তিনি শুধু আস্থাসূচক একটা হাসি দিয়ে সভায় ঢুকে গেলেন। আমার তখন প্রচ- টেনশন। বরাবর মুহিত ভাই আমার প্রস্তাবে সরাসরি হ্যাঁ বলেন। যেটি পারবেন না, সেটিতে না বলেন। কোনো প্রস্তাব দিলে সেটি নিয়ে মাঝামাঝি কোনো কথা বলেন না। যেটি বাদ পড়ার সেটিকে বাদ দেন। রফতানি প্রণোদনা নিয়ে আমি আগে যতবারই কথা বলেছি, মুহিত ভাই প্রকাশ্যে সেই কথাই বলে আসছিলেন- আইসিটি অনেক কিছু পায়, আর কত? মনে মনে ভাবলাম, আমি এমন চূড়ান্ত একটি সভায় যৌক্তিক বিষয়গুলো তুলে ধরতে না পারলে হেরে যাব। স্মরণ করছিলাম ’৯৭ সালের কথা, যখন তোফায়েল ভাই জেআরসি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই বছরের ডিসেম্বরের সেমিনারটির কথাও মনে করতে পারছিলাম। তোফায়েল ভাই বরাবরই আমাদের বিষয়গুলোকে ইতিবাচকভাবে দেখেন, সেটি আমার একটি ভরসাস্থল বলে মনে হলো। একজন সরকারি কর্মকর্তা এসে আমাকে বললেন- আপনাকে ভেতরে ডাকছে। প্রথমেই মুহিত ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তাকে দেখে সাহস পেলাম। তোফায়েল ভাই বললেন, বলুন আপনার রফতানি প্রণোদনার যুক্তি কী? আমি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম এই বলে যে, এটি আমার অধিকার। সরকার সব রফতানি খাতে প্রণোদনা দেবে, আমাকে কেন দেবে না। আমি যেকোনো রফতানি খাতের চেয়ে বেশি মূল্য সংযোজন করি। অন্যরা বস্ত্তগত পণ্য রফতানি করে, আমি মেধা রফতানি করি। আমার মূল্য সংযোজন শতভাগ। আমার কাছে এটি অর্থনৈতিক বিষয় নয়, মানসিক শক্তি অর্জনের বিষয়। এর মানে হবে- সরকার যে আমাদের সাথে আরও জোর দিয়ে আছে, সেটি নিজেকে ও বিশ্ববাসীকে জানানো। সরকার এই খাতকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে আসছে বলেই আমরা এতটা পথ এলাম। সেই ’৯৭ সালের তোফায়েল ভাইয়ের গঠন করা জেআরসি কমিটি, ’৯৮-৯৯ সালের শুল্ক ও ভ্যাট মুক্তকরণ, ২০০৮ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা এবং ২০০৯ সাল থেকে অব্যাহত সমর্থন আমাদেরকে অনেকটা পথ সামনে এনেছে। আমরা ২০০৮ সালের ২৬ মিলিয়ন ডলার রফতানি থেকে ২০১৬ সালে ৭০০ মিলিয়নে পৌঁছেছি। এই প্রণোদনা আমাদেরকে মানসিকভাবে আরও শক্ত করবে। কোনো কোনো কর্মকর্তা এই প্রণোদনার বিষয়ে কিছুটা শঙ্কা প্রকাশ করলেন। কিন্তু সভার প্রায় সবাই এই বিষয়ে একমত হলেন, তথ্যপ্রযুক্তির জন্য এই প্রণোদনা দেয়া উচিত। আমি আনন্দিত হলাম সভার সুর ইতিবাচক দেখে। অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্যমন্ত্রী সবাই বললেন- হ্যাঁ, নগদ প্রণোদনা দিতে হবে। তবে তারা প্রশ্ন তুললেন, এর যেন অপব্যবহার না হয়। আমি দায়িত্ব নিয়ে বললাম, সেটি আমার ওপর ছাড়বেন। ব্যর্থ হলে আমাকে ফাঁসিতে লটকাবেন।
কত ভাগ প্রণোদনা দেয়া হবে সেটিতে প্রথম শতকরা ৫ ভাগ প্রস্তাব এলো। বলা হলো, শতকরা ৫ ভাগ দিয়ে শুরু করা হোক। কিন্তু আমি বললাম, প্রণোদনা ৫ ভাগ দিলে সেটি কারও মনেই কোনো অাঁচড়ই কাটবে না। আমি অন্তত ১০ ভাগের দাবিতে অনড় থাকলাম। তখন সর্বসম্মতিক্রমে ১০ ভাগই অনুমোদিত হলো। এরপর প্রশ্ন এলো কিসের ওপর এই প্রণোদনা দেয়া হবে। আমি বললাম, এটি কমপিউটারের সফটওয়্যার, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা এবং ডিজিটাল যন্ত্রসহ সব রফতানির ক্ষেত্রেই দিতে হবে। ডিজিটাল যন্ত্র প্রসঙ্গে একটু গলাটান শুনে আমি জানালাম- এটির রফতানিতে সহায়তা করা বরং সহজ হবে। কারণ, তাতে আমরা সহজে শনাক্ত করার সুযোগ পাব। অন্যদিকে আমরা দেখব, বিশ্বের বড় বড় ডিজিটাল যন্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করবে এবং এখান থেকে পণ্য রফতানি করবে। তোফায়েল ভাই নগদ প্রণোদনার অপব্যবহার সম্পর্কে আমাকে মনে করিয়ে দিলেন- এর আগে জামদানিতে নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল, কিন্তু অপব্যবহার হওয়ায় সেটি বাতিল করা হয়েছে। এরপর অর্থমন্ত্রী বললেন, তুমি তো খুশি। সব পেয়ে গেছ। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার আগে এ কথা প্রকাশ করতে পারবে না। তোফায়েল ভাই জানালেন, ২৮ জুন ’১৭ প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণ দেবেন এবং তার ঘোষণার পরই সেটি যেন সবাই জানে। আমি সম্মতি দিয়ে অনুরোধ করলাম, ঘোষণা না হয় পড়ে হবে। কিন্তু এই সভাটি ইতিহাসের একটি অংশ। অনুমতি পেলে আমি এর একটা ছবি তুলে রাখি। অর্থমন্ত্রী সম্মতি দিলেন। আমিও ছবি তুললাম।
২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বাজেট ভাষণ প্রদান করেন এবং ২৯ জুন সেই বাজেট পাসও হয়। প্রণোদনার বিষয়টি বাজেট আলোচনায় না আসায় আমি অর্থমন্ত্রী ও অর্থ সচিবের সাথে কথা বলে জানতে পারি, এটি বাজেটে প্রকাশ করতে হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। আমরা এখন সেই প্রজ্ঞাপনের অপেক্ষায় আছি।
১ জুলাই ২০১৭ থেকে বহাল হওয়া এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা, যাকে আমি ১৯৯৮-৯৯ সালে কমপিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করি। এটি বাংলাদেশ থেকে মেধাসম্পদ ও ডিজিটাল যন্ত্র রফতানির এমন এক দিগন্ত উন্মোচন করবে, যা এর আগে আমরা কখনই ভাবতে পারিনি।
এবারের বাজেটটিই বস্ত্তত তথ্যপ্রযুক্তির। এবার বাজেটে দেশীয় সফটওয়্যার ও সেবাখাতকে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। এই বাজেট ডিজিটাল যন্ত্র উৎপাদনকে সুরক্ষা দিয়েছে এবং দিয়েছে রফতানিতে প্রণোদনা। বিজয় হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com

পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৭ - জুলাই সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস