কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে গবেষণা চলছে দীর্ঘদিন ধরে৷ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি ইতোমধ্যেই একটি সমৃদ্ধ অবস্থানে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন৷ আজকের দিনে আমরা যেসব অত্যাধুনিক ডিভাইস ব্যবহার করছি তার অনেকটিতেই ব্যবহার হচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা৷ ক্রমাগত গবেষণায় বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার একটি ইঙ্গিত সম্প্রতি দিয়েছেন মার্কিন প্রকৌশলী রেই কুরজওয়েল৷ তিনি বলছেন, ২০২৯ সাল নাগাদ অর্থাৎ এখন থেকে ২০ বছরের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মান হবে মানুষের পর্যায়ের৷ অর্থাৎ মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যা ভাবে এবং করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোনো ডিভাইস বা রোবট সে পর্যায়ে ভাবতে এবং কাজ করতে সক্ষম হবে৷ ফলে রোবটরা হবে আরো বেশি স্মার্ট এবং কর্মক্ষম৷ মানবিক বোধও তাদের থাকবে৷ অর্থাৎ তারাও হাসিকান্নার বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হবে৷ মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে রোবট বা ইলেকট্রনিক্স পণ্যের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও সেভাবে কাজ করবে৷
প্রকৌশলী কুরজওয়েল বলেন, মানুষ এবং মেশিন একাকার হয়ে যাবে৷ মানবদেহে স্থাপন করা হবে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস৷ ফলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বহুগুণে বেড়ে যাবে এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যাও দূর হবে৷ মানব সভ্যতার অংশ হয়ে যাবে যন্ত্র৷ তবে ভয়ের কিছু নেই৷ কুরজওয়েল বলছেন, ওই যন্ত্র অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট বা ডিভাইস সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রের মতো মানুষকে বিতারিত করে পৃথিবী দখল করে নেবেনা৷ তারা বরং নানা কাজে মানুষের সঙ্গী হিসেবে কাজ করবে৷ ইতোমধ্যেই বহু ধরনের রোবট এমন শত শত কাজ করে দিচ্ছে যা মানুষ করতে অভ্যস্ত৷ বিশেষ করে গৃহস্থলির কাজে এখনকার রোবটের রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা৷ প্রচুর কাজ করে মানুষের শ্রমঘণ্টা বাড়িয়ে দিচ্ছে তারা৷ উন্নত বিশ্বে ঘরে ঘরে এদের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়৷ এখন যদি তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তার পর্যায়ে চলে আসে বা তারচেয়ে বেশি হয়ে যায় তাহলে সেই বুদ্ধিমত্তাকে এমন কোনো কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে যে কাজে মানুষ এখনো পিছিয়ে আছে৷
প্রকৌশলী কুরজওয়েল বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে বিশেষ হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার৷ এসব উদ্ভাবন করতে হবে৷ তারপর তাদের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে মানুষ পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তায় উত্তরণ ঘটাতে হবে৷ আর এটা সম্ভব হবে ২০২৯ সালের মধ্যেই৷ তিনি বলেন, বর্তমান সভ্যতায় মানুষ এবং মেশিন উভয়েরই সহাবস্থান বিরাজমান রয়েছে৷ আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছি আমাদের শারীরিক এবং মানসিক দিগন্ত প্রসারের কাজে৷ এভাবেই একদিন চরম সাফল্য ধরা দেবে৷ পৃথক অবস্থানে থেকে অর্থাৎ স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েও মানুষ স্তরের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ডিভাইস গবেষণাসহ বহুবিধ কাজ করে দিয়ে মানবসভ্যতায় নিজেদের অবদান রাখবে৷ আবার মানবদেহে একাকার হয়েও মানুষকে সমৃদ্ধ করবে ওই সব ডিভাইস৷ এক্ষেত্রে প্রশংসা পাবেন ন্যানো টেকনোলজি অর্থাৎ ক্ষুদ্র প্রযুক্তিবিদরা৷ তারা ইতোমধ্যেই এমন সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিভাইস উদ্ভাবন করেছেন যা কিনা অনায়াসেই রক্তের সাথে ঘুরে আসতে পারে পুরো মানবদেহ৷ এছাড়াও বহু ক্ষুদ্র ডিভাইস মানবদেহের ভেতরে থেকে দেহকে সচল রাখতে নিরলস কাজ করে চলেছে৷
এমনি একটি ক্ষুদ্র ডিভাইস হলো ইন্টেলিজেন্ট ন্যানোবোটস৷ এটিকে ক্যাপিলারি বা কৈশিক নালীর মধ্য দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেয়া হবে৷ তখন এটি মানুষের স্নায়ুর সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করবে৷ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্দেশনাও দেবে৷ ফলে মানুষ হবে আরো স্মার্ট৷ এই ইন্টেলিজেন্ট ন্যানোবোটস এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে৷ মস্তিষ্কের স্নায়ুকে যদি যন্ত্র দিয়ে প্রভাবিত করা যায় তাহলে মানুষের আচরণে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য৷ সেটা হতে পারে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক৷ তবে এ বিষয়টি নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে ভাবছেন না৷ তাদের বিশ্বাস বিষয়টি বাস্তবে রূপ পেলে মানুষ আরো চৌকস হবে ভাবনায় এবং আচরণে৷
কুরজওয়েল মনে করেন এই ন্যানোবোটস আমাদেরকে অধিক স্মার্ট করবে, স্মরণশক্তি বাড়াবে এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি জগতে স্নায়ু ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশিত করবে৷ কুরজওয়েলসহ ১৮ জন প্রভাবশালী প্রযুক্তিবিদ একবিংশ শতাব্দিতে মানুষ যে ১৪টি প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে তা সম্প্রতি তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সের বার্ষিক বৈঠকে৷ চ্যালেঞ্জগুলো হলো-সৌর বিদ্যুৎ সহজলভ্য করা, সংমিশ্রণ (ফিউশন)থেকেবিদ্যুৎ সরবরাহ, কার্বন কমানোর পথ বের করা, নাইট্রোজেন চক্র ব্যবস্থাপনা, বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিতকরণ, মস্তিষ্ক উন্নয়ন, পরমাণু হামলার ঝুঁকি রোধ, সাইবার স্পেসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সমৃদ্ধ করা, নগর অবকাঠামোর উন্নয়ন, আধুনিক স্বাস্থ্য তথ্য দেয়া, উন্নত ওষুধ উদ্ভাবন, ব্যক্তিগত শিক্ষা উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান করা৷
মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে আপাতত এই বিষয়গুলোর ওপরই বেশি জোর দিতে চান বিশেষজ্ঞরা৷ মাস্তিষ্কের উন্নয়ন ক্যাটাগরিতেই আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের স্তরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি৷ একটা সময় আসবে যখন মানুষের হয়ে কঠিন ও জটিল সব কাজ করে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোনো ডিভাইস৷ তাদের দৈহিক কাঠামোও হবে এখনকার চেয়ে উন্নত৷ তারা মানুষের মতোই আবেগ-অনুভূতি সম্পন্ন হবে৷ মানুষের সুখে তারা হাসবে, দুঃখে কাঁ দবে৷ চিন্তাকে টেনে নিয়ে যাবে এক উচ্চমাত্রায়৷
গবেষকরা ইতোমধ্যেই অগ্রগতি ঘটিয়েছেন প্রি-টাচ টেকনোলজির৷ এই প্রযুক্তিতে কোনো রোবট কোনো বস্তু স্পর্শ না করেই বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ফেলতে পারে৷ বিশ্বখ্যাত প্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের গবেষকরা এই প্রি-টাচ প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করছেন৷
এদিকে আনন্দের খবর হলো অস্ট্রেলিয়া বেজড সফটওয়্যার কোম্পানি অ্যান্টসরোবট প্রজেক্টের পরিচালক ফিরোজ আহমেদ সিদ্দিকী বাংলাদেশে এই প্রথম তৈরি করেছেন হিউম্যানয়েড রোবট৷ এই রোবট হাঁটবে, ঘর মুছবে, এমনকি অবসরে গান-বাজনা শোনাবে৷ বেসিস সফট এক্সপোতে টেকঅ্যান্টস-এর স্টলে এই রোবট প্রদর্শিত হয়৷ ফিরোজ ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ঢাকা ক্যাম্পাসের ছাত্র৷ রোবটটি বাংলায় কথা বলতে পারে, মানুষের কথাও বুঝতে পারে৷ সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়েছে৷ রোবটটির উন্নয়নকাজ চলছে৷ আগামী ১ বছরে এটি পূর্ণাঙ্গ হবে বলে আশা করা হচ্ছে৷
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com