কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী। ইতোমধ্যেই তাদের ঝুলিতে কিছু সাফল্য ধরা দিলেও তা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে নিরলসভাবে। পেন্টাগনের সমর্থনপুষ্ট মার্কিন বিজ্ঞানীরা মানুষের মতো যন্ত্র তৈরির লক্ষ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দিনরাত কাজ করে চলেছেন। তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা, যার পর্যায় বা মাত্রা হবে বিড়ালের মস্তিষ্কের সমান। অর্থাৎ একটি বিড়াল যে পরিমাণ বুদ্ধি তার মস্তিষ্কে রাখে সেই পরিমাণ বুদ্ধি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা। যদিও কথাটা যত সহজে বলা যায়, কাজটা তত সহজ নয়। কাজটি করতে গিয়ে ইতোমধ্যেই তারা পড়েছেন বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে।
বিষয়টি নিয়ে গবেষণায় জড়িত রয়েছেন এমন এক বিজ্ঞানী বলেছেন, ওই ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির বিষয়টি এখনও বহু দূরে রয়েছে তারপরও তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় বিড়ালের মতো বুদ্ধিমত্তা তৈরি সম্ভব। এর আকৃতি হতে পারে একটি কমপিউটার মাউসের সমান। এমনকি একটি ছোট দেহও তৈরি করা যেতে পারে। আর এ কাজটি যে তাত্ত্বিকভাবে করা সম্ভব তার প্রমাণ তারা পেয়েছেন।
নিউইয়র্কের ট্রয়ে রেনসেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নিউরোবায়োলজিস্ট মার্ক চেঙ্গিজি বলেছেন, বড় মস্তিষ্ক থাকা অর্থ এই নয় যে সেই প্রাণীটির হয়তো বুদ্ধি বেশি। কিংবা আচার-আচরণ জটিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গরুর কথা। বিড়ালের চেয়ে গরুর মস্তিষ্ক ১০ গুণ বড় হলেও বিড়াল গরুর তুলনায় অনেক বেশি চৌকস। তিনি বলেন, বিড়াল পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভাবতে হলে কেবল এটি নিয়েই কাজ করা উচিত। অন্য প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভাবনার এ পর্যায়ে প্রয়োজন নেই। নইলে মস্তিষ্কের জটিল কর্মকান্ড বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। প্রথমে বিড়ালের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তারপর এক সময় প্রয়োজন হবে একটি দেহ বা এমন কিছুর।
মার্ক চেঙ্গিজি তার এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন মার্কিন ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি তথা ডিএআরপিএ পরিচালিত সিনেপস প্রকল্পে কর্মরত আইবিএম গবেষকদের সাথে। একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য আইবিএম, এইচপি এবং শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় পেন্টাগনের ওই এজেন্সি গবেষক সংগ্রহ করেছে। সেই কৃত্রিম মস্তিষ্কের আকার হতে পারে বিড়ালের মস্তিষ্কের সমান, মস্তিষ্কের কোষ থাকতে পারে সমানসংখ্যক, দৈহিক কাঠামো এবং জটিল আচরণও বজায় রাখা হবে। আর এসব বিষয় একসাথে সমন্বয় ঘটানো চাট্টিখানি কথা নয়। তাই এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদিও বিভিন্ন গবেষক নানা ইলেকট্রনিক যন্ত্রের জন্য ইতোমধ্যেই উদ্ভাবন করেছেন এবং করতে যাচ্ছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এসব উদ্ভাবন কৃত্রিম বিড়ালের মস্তিষ্ক তৈরির কাজে সহায়ক হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বহু ইলেকট্রনিক যন্ত্র এখন বাজারে সহজলভ্য। কিন্তু সেই বুদ্ধিমত্তার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মানোন্নয়নে তাই গবেষণার শেষ নেই।
চেঙ্গিজি আশাবাদী। তিনি মনে করেন, গবাদিপশুর মস্তিষ্কের আকারের সমান কৃত্রিম মস্তিষ্ক তথা বুদ্ধিমত্তা তৈরি অবশ্যই সম্ভব। মস্তিষ্কের আকার বড় হলেই যে সেখানে বুদ্ধি বেশি থাকবে তা নয়। অনেক বড় মস্তিষ্কে বুদ্ধিমত্তা কম থাকার প্রমাণ রয়েছে। আবার আকারে অনেক ছোট মস্তিষ্কে রয়েছে জ্ঞানের ভান্ডার। তাই আকার কোনো ব্যাপার নয়। তিনি বলেন, পশু-প্রাণী যত বড়ই হোক আর ছোটই হোক না কেনো, তারা সবাই বোবা। বড় মস্তিষ্ক কেবল আকারেই বড় হয়, আকারের সাথে মস্তিষ্কের মানোন্নয়নের কোনো সম্পর্ক নেই বা নাও থাকতে পারে।
বড় মস্তিষ্কে থাকে অনেক বেশি নিউরন বা স্নায়ু। একই সাথে থাকে প্রতিটি স্নায়ুর সাথে সংযোগ, যাতে করে তারা নিজেদের মধ্যে সিগনাল বা সঙ্কেত বিনিময় করতে পারে। তা ছাড়া বড় মস্তিষ্কে একাধিক ভাগ বা কম্পার্টমেন্ট থাকতে দেখা যায়। তারা একত্রেই অবস্থান করে। কিন্তু বৃহৎ বুদ্ধিমত্তা মস্তিষ্কের ভাগ বা স্তরের ওপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে জটিল সংযোগ বা বেশি স্নায়ু থাকাও আবশ্যক নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্ক কোনো পতঙ্গের মস্তিষ্কের তুলনায় ১০ লাখ গুণ বেশি বড় হয়ে থাকে। অথচ আচরণগত দিক দিয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা পতঙ্গের তুলনায় মাত্র ২ থেকে ৩ গুণ বেশি বৈচিত্র্য দেখাতে সক্ষম। তাছাড়া পিঁপড়া, মৌমাছি এবং অন্যান্য ছোট পতঙ্গের ক্ষেত্রে জটিল সামাজিক আচরণ লক্ষ করা যায়, যা কি না ভাবনায় ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এত ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক এত জটিল আচরণ কীভাবে করতে সহায়তা করে সেটাই অবাক করে গবেষকদের।
পতঙ্গরা লাখ লাখ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কমপিউটিং ক্ষমতা বাড়িয়েছে। অন্যদিকে মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভাবছে খুব বেশিদিন হয়নি। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কৃত্রিম নিউরন নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম নিউরন জটিল ভাবনাচিন্তাগুলো করে থাকে।
চেঙ্গিজি বলেন, মস্তিষ্কের আকারের সাথে দেহের আকারের রেশিওর বিষয়টি নিউরোসায়েন্টিস্টদের কাছেও স্পষ্ট নয়। ডিএআরপিএতে যে গবেষণা চলছে তার প্রেক্ষিতে হয়তো এই অবোধগম্য বিষয়টি বোঝার পর্যায়ে আসবে। এক সময় নিশ্চয়ই জটিল আচরণে সক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা সম্ভব হবে। আপাতত ভাবনাটা যদিও বিড়াল আকারের মস্তিষ্ক তৈরি করা। যে কি না পরিচালনা করবে জটিল সব কার্যক্রম। চেঙ্গিজির ধারণা, একটি চৌকস মস্তিষ্ক নির্ভর করে নিউরনের বৈচিত্র্যায়নের ওপর। আর তার কার্যক্রমের দক্ষতা নির্ভর করে মনের শ্রম বিভাজনের ওপর। তবে তিনি স্বীকার করেন, বেশিরভাগ মস্তিষ্কই বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যময় ‘ব্ল্যাক বক্স’-এর মতো।
এদিকে জার্মানির বিজ্ঞানীরা মানুষ আর রোবটের মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। রোবটকে কেবল মানুষের মতো শারীরিক আকারই নয়, মানুষের সাথে যোগাযোগের সামর্থ্য দেয়ারও চেষ্টা করছেন তারা। তারা চাইছেন রোবটের ভেতর মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা প্রবেশ করাতে। জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিলেফেল্ড কগনিটিভ ইন্টারেকটিভ টেকনোলজি সেন্টার অব এক্সিলেন্স তথা সাইটেক এবং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর কগনিশন অ্যান্ড রোবোটিক্স তথা কোর-ল্যাবের বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন রোবটকে কীভাবে মানুষের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে। এজন্য তারা অনুভূতিকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন।
জার্মান বিজ্ঞানী হেলগে রিটারের নেতৃত্বে একদল গবেষক এজন্য নতুন মডেলের রোবট তৈরি করেছেন, যার নাম দিয়েছেন ‘ফ্লোবি’। তিনি বলেন, রোবটকে তার আশপাশের অবস্থা এবং আমি কী চাচ্ছি তা বুঝতে হবে। আমরা এমন এক ধরনের রোবট নিয়ে কাজ করছি যে বুঝতে পারবে আমি তাড়াহুড়ার মধ্যে রয়েছি কি না।
নতুন এই রোবটকে নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। রোবটটি একটি বয়াম ধরতে এবং সেটির মুখ খুলতে পারে কি না সেটি তারা পরীক্ষা করে দেখছেন। খুব ধীরে হলেও শেষ পর্যন্ত রোবটটি তা করতে সক্ষম হয়।
জার্মান বিজ্ঞানীরা চান এমন রোবট তৈরি করতে যাকে কেবল সুইচ টিপে কাজ করানো হবে না, বরং সে কথা বুঝতে পারবে এবং একজনের চেহারার দিকে তাকিয়ে তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবে। রোবটকে মানুষের কাছাকাছি আনতে হলে তার চেহারাতেও মানুষের আদল আনাটা জরুরি। এ বিষয়টি নিয়েও কাজ করছেন তারা। আশা করা হচ্ছে একটা সময় আসবে যখন রোবটকে কেবল যান্ত্রিক কিছু মনে করা হবে না। সে হয়ে উঠবে মানুষের কাছের কেউ।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com