ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে কমপিউটার। ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, পামটপের পর এখন আসছে কলম এবং কাগজ আকৃতির কমপিউটার। এগুলো অনায়াসেই নিজের পকেটে পুরে রাখা যাবে। প্রয়োজনের মুহূর্তেই সেটি বের করে মেলে ধরলেই চলবে- অমনি সক্রিয় হয়ে উঠবে আপনাকে প্রয়োজনীয় সেবা দেয়ার জন্য। যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময় এ কমপিউটারের সেবা পাওয়া সম্ভব হবে। কাগজ আকৃতির যে কমপিউটারের কথা বলা হচ্ছে তার উন্নয়ন ঘটিয়েছেন কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটিংয়ের অধ্যাপক রোয়েল ভারটেগাল। তিনি তার হিউম্যান মিডিয়া ল্যাবরেটরিতে এ ‘পেপার কমপিউটার’-এর প্রাথমিক সংস্করণ তৈরি করেছেন। এটি নিয়ে আরো গবেষণা অব্যাহত আছে।
ভারটেগাল বলেছেন, তার উন্নয়ন করা কাগুজে কমপিউটার ফ্ল্যাট এবং খুবই নমনীয়। তাই কাগজ যেভাবে ভাঁজ করে পকেটে রেখে দেয়া যায়, ঠিক একইভাবে এ কমপিউটারও পকেটে রেখে দেয়া যাবে। আবার স্থান, কাল, পাত্র বুঝে এর আকারও পরিবর্তন করে কাজ করা সম্ভব হবে। তিনি একে বলছেন নতুন ‘নন-প্ল্যানার’ ডিভাইস বা যন্ত্র।
এ কমপিউটার যে কেবল ভাবনার অতীত নমনীয় তাই নয়, এটি তার তথ্য-উপাত্ত ছবির ভিত্তিতে নিজেকে পরিবর্তিত রূপ দিতে পারে। কোনো কোমল পানীয়র ক্যানের আকারে রূপ দিয়ে দুই হাতের আঙ্গুলে ধরে দিবিব এতে দেখা যাবে নানা চলচ্চিত্রের ট্রেইলার কিংবা প্রয়োজনীয় অন্য কিছু। টাচ স্ক্রিনপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ হওয়ায় আলাদা করে কীবোর্ডের অসিত্মত্ব নেই। আঙ্গুলের আলতো ছোঁয়ায় স্ক্রিনে ভেসে উঠবে নানা প্রোগ্রাম। এটাই ভবিষ্যৎ কমপিউটার। এগুলো হবে সফটওয়্যারনির্ভর। তাই বলা যায়, হার্ডওয়্যারের দিন হয়ত ফুরিয়ে আসছে।
এই পরবর্তী প্রজন্মের কমপিউটার তৈরির পেছনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে ‘অর্গানিক ইউজার ইন্টারফেস’ ব্যবস্থা। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব কমপিউটার মেশিনারির (এসিএম) প্রকাশনা কমিউনিকেশন্স অব এসিএমে। যুগ্মভাবে ওই প্রতিবেদন সম্পাদনা করেছেন জাপানের টোকিওতে সনি ইন্টারেকশন ল্যাবরেটরির ড. রোয়েল ভারটেগাল এবং ড. ইভান পাপেরেভ।
ড. ভারটেগাল বলেছেন, আমরা আসলে যা বলতে চাচ্ছি তা হিউম্যান কমপিউটার ইন্টারেকশনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ছাড়া আর কিছুই নয়। একটা সময় ছিল যখন সব কিছু ভাবা হতো দ্বিমাত্রিকভাবে। ফলে সব কিছুর ছিল একটা সীমাবদ্ধতা। বহুমাত্রিক চিন্তাই করা সম্ভব ছিল না। অথচ জীবনকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন বহুমাত্রিক চিন্তাচেতনা। কমপিউটারকে সে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আজো সম্ভব হয়নি। দ্বিমাত্রিক চিন্তার স্তরেই রয়ে গেছে তার অবস্থান। ফলে নানা সীমাবদ্ধতা তাকে জর্জরিত করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই নেক্সট জেনারেশন অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের কমপিউটার উদ্ভাবন নিয়ে কাজ শুরু হয়, যার পথ ধরে উদ্ভাবিত হয়েছে এ পেপার কমপিউটার। এটি এতই নমনীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে প্রয়োজনমতো বাঁকিয়ে যেকোনো আকৃতিতে নিয়ে ব্যবহারকারীরা এটি ব্যবহার করতে পারবেন। ত্রিমাত্রিক চিন্তার চেয়ে অনেক বেশি সীমাবদ্ধ দ্বিমাত্রিক চিন্তা। তাই অনলাইন বিশ্বে আধিপত্য নিয়ে টিকে থাকতে ত্রিমাত্রিক চিন্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দ্বিমাত্রিক চিন্তা সম্বলিত ‘ফ্ল্যাটল্যান্ড’ ইন্টারফেস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
কমপিউটারপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি কমপিউটারের ক্ষেত্রে বিরাজমান প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে উদ্ভাবকদের আয়তক্ষেত্রাকার বর্তমান ডিজাইনের কমপিউটার তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। এর প্রথমটি হলো আধুনিক টাচ ইনপুটপ্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির কারণে দুই হাতের একাধিক আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শের মাধ্যমে প্রোগ্রাম পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে। আলাদা করে কীবোর্ডের আর প্রয়োজন থাকছে না। স্পর্শের মাধ্যমেই ইনফরমেশন ইনপুট করা যাচ্ছে এবং সে অনুযায়ী সাড়া আসছে।
দ্বিতীয় অগ্রগতি হলো নমনীয় ডিসপ্লে ব্যবস্থা উদ্ভাবন। এই ব্যবস্থায় যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে নমনীয় সার্কিট বোর্ড, যাতে সংযুক্ত থাকছে অর্গানিক এলইডি (লাইট ইমিটিং ডায়োডস)। ইলেকট্রনিক পেপার তৈরিতে এটি ব্যবহার হচ্ছে। ই-ইঙ্ক (ইলেকট্রোফোরেটিক ইঙ্ক) ডিসপ্লে তৈরি হচ্ছে লাখ লাখ ক্ষুদ্র, পোলারাইজড ইঙ্ক ক্যাপসুল থেকে, যার অর্ধেক সাদা এবং অর্ধেক কালো। কমপিউটারে সুইচ দেয়া হলে মাইনাস বা প্লাস ভোল্টেজ বের হয়ে আসে এবং ডিসপ্লে তৈরির জন্য ইঙ্ক বা কালি যুক্ত হয় কিংবা সরে যায়। একবার ডিসপ্লে এসে গেলে বিদ্যুতের সুইচ বন্ধ করা যেতে পারে। যেহেতু ই-পেপারটি বা কমপিউটারটি নমনীয়, তাই ডিসপ্লে হওয়ার পর সেটি ভাঁজ করে বা মুড়িয়ে পকেটের ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে দেয়া যাবে।
তৃতীয় অগ্রগতি হলো কাইনেটিক অর্গানিক ইন্টারফেস (কেওআই)। এর কারণেই ব্যবহারকারীর প্রয়োজনমাফিক আকার পরিবর্তনশীল কমপিউটার ডিজাইন করা সম্ভব হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এর মাধ্যমে কেবল ছবি নয়, ত্রিমাত্রিক ব্যবস্থায় শারীরিক কাঠামোও প্রদর্শন সম্ভব হবে।
ড. ভারটেগাল বলেন, আমরা আসলে চাইছি বর্তমান কমপিউটার তৈরি ও পরিচালনায় যত সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তার থেকে বেরিয়ে এসে সহজ যন্ত্র ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করতে। যাতে করে যেকেউ খুব সহজেই কমপিউটার ব্যবহার করতে পারে এবং একে তার কাছে বোঝা মনে না হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে যে সংস্করণ তৈরি করা হয়েছে তাতে হাই রেজ্যুলেশনের ডিসপ্লে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ অর্গানিক শেপের কোনো যন্ত্রে উচ্চ রেজ্যুলেশনের ছবি প্রদর্শনের প্রকৃত প্রযুক্তি এখনো উদ্ভাবন সম্ভব হয়নি। তবে কাজ চলছে বিষয়টি নিয়ে।
পেন বা কলমের আকৃতির যে কমপিউটারের কথা বলা হয়েছে জাপানি বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন মিনিয়েচার কমপিউটার। তিনটি কলমের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ওই কমপিউটার। কলমগুলোর একটি হবে কমপিউটারের মনিটর, একটি কীবোর্ড এবং অন্যটি সিপিইউ। এগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে ব্লুটুথ প্রযুক্তিতে। এদের বিদ্যুৎ সরবরাহ আসবে সূর্যালোক থেকে, যা রিচার্জেবল ব্যাটারিতে জমা রেখে রাতের বেলায়ও কাজ করা যাবে। কেউ কেউ এদেরকে হলোগ্রাফিক কমপিউটার বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তিতে ইন্টারনেটে যুক্ত হবে এই পকেট কমপিউটার। তাই বাস, ট্রেন বা প্লেন সব জায়গাতেই ব্যবহার করা যাবে ইন্টারনেট।
কুইন্স হিউম্যান মিডিয়া ল্যাবরেটরিতে যেসব প্রকল্পের কাজ জোরকদমে এগিয়ে চলেছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হলো বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ ভাঁজযোগ্য পেপার কমপিউটার উদ্ভাবন।
ইন্টারেকটিভ কোক ক্যান উদ্ভাবনের কাজও চলছে। এতে থাকবে সিলিন্ডারের আকৃতির ডিসপ্লে ব্যবস্থা।
গবেষণা চলছে আরো কিছু বিষয় নিয়ে। যার মধ্যে যেকোনো যন্ত্রে কমপিউটারের মতো ডকুমেন্ট এবং চিত্র আনার উদ্যোগও রয়েছে।
এখন শুধু অপেক্ষার পালা- এমন যন্ত্র হাতে আসার এবং এর সুফল ভোগ করার।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam@gmail.com