সাউন্ড এডিটিং ও রেকর্ডিংয়ে ব্যবহার করুন অডাসিটি
এস. এম. গোলাম রাবিব
এনালগ প্রযুক্তির যুগ পার করে মানুষ এখন ডিজিটাল যুগে বসবাস করছে। এ যুগে সব মাধ্যমেই মানুষ ডিজিটাল সুবিধা চায়। কারণ ডিজিটালপ্রযুক্তি অনেক দ্রুত, অনেক স্বচ্ছ এবং অনেক বেশি সুবিধাদানকারী। শব্দ মাধ্যমেও এর ব্যতিক্রম নেই। শব্দ মাধ্যমে শব্দ শোনা থেকে শুরু করে শব্দ রেকর্ডিং, শব্দ সম্পাদনা ইত্যাদি সব কিছুতেই মানুষ এখন ডিজিটালপ্রযুক্তির প্রয়োগ করছে। আর শব্দ রেকর্ডিং কিংবা শব্দ সম্পাদনার জন্য কখনো কখনো প্রয়োজন হয় বিভিন্ন সফটওয়্যারের। অডাসিটি এমনই একটি সফটওয়্যার যা সাউন্ড এডিটিং টুল বা শব্দ সম্পাদনাকারী সফটওয়্যার হিসেবে পরিচিত। আমাদের এ নিবন্ধের আলোচিত বিষয় অডাসিটি নামের এ সফটওয়্যারের বিভিন্ন বিষয়াদি। অডাসিটি নিয়ে আলোচনার আগে আমরা শব্দ, ডিজিটাল শব্দ, শব্দ রেকর্ডিং এবং ডিজিটাল শব্দ রেকর্ডিং নিয়ে কিছু ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করবো।
শব্দ :
শব্দ হচ্ছে বিদ্যুৎ কিংবা আলোর মতো এক ধরনের শক্তি। বাতাসের অণুগুলো যখন প্রকম্পিত হয় এবং সেগুলো ওয়েভ বা সাউন্ড ওয়েভের আকারে চলাচল করে তখন শব্দ তৈরি হয়। যখন আমরা চিৎকার করি কিংবা গাড়ির দরজা বন্ধ করি, ঠিক ওই সময়টার কথা চিন্তা করুন। ওই সময় যে কাজগুলো হয় তা সাউন্ড ওয়েভ তৈরি করে, যা আমাদের কানে আসে এবং মস্তিষ্কে পৌঁছায়। মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পরে আমরা বুঝতে পারি যে, একটি শব্দ হয়েছে। মূলত শব্দের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বায়ু। যেখানে বায়ু নেই, সেখানে আমরা শব্দ শুনতে পারব না। যেমন-মহাশূন্যে কোনো শব্দ নেই।
ডিজিটাল শব্দ :
ডিজিটাল ফরমেটে রক্ষিত কোনো শব্দকেই ডিজিটাল শব্দ বলা হয়। সিডি, ডিভিডি কিংবা কমপিউটারে রক্ষিত যেকোনো সাউন্ড ফাইলের শব্দ হলো ডিজিটাল শব্দের চমৎকার উদাহরণ। অন্যদিকে টেলিফোন সিস্টেমের শব্দ হচ্ছে এনালগ শব্দের উদাহরণ। উল্লেখ্য, আইএসডিএন টেলিফোন এর অন্তর্ভুক্ত নয়।
যেভাবে শব্দ রেকর্ডিং করা হয় :
শব্দ রেকর্ডিং পদ্ধতিতে অবশ্যই একটি মাইক্রোফোন দরকার হয়। মাইক্রোফোনে একটি ছোট ঝিল্লি বা অতি পাতলা পর্দা থাকে যা স্পন্দনশীল। এখানে এমন একটি কৌশল যুক্ত থাকে যা ওই পাতলা পর্দার স্পন্দনকে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে রূপান্তর করে। সুতরাং মাইক্রোফোনের মাধ্যমে মূল শব্দতরঙ্গ ইলেকট্রিক্যাল তরঙ্গে পরিণত হয়। এবার একটি টেপ রেকর্ডার ওই ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালকে একটি তারের ভেতর দিয়ে একটি টেপে ম্যাগনেটিক সিগন্যালে পরিণত করে। এবার যখন আপনি ওই টেপটি চালাবেন, তখন এই পদ্ধতিটি আবার বিপরীত দিক থেকে চলতে থাকবে। অর্থাৎ এবার ম্যাগনেটিক সিগন্যালটি ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে পরিণত হবে এবং ওই ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ইলেকট্রোম্যাগনেট ব্যবহার করে স্পিকারকে স্পন্দনশীল করবে। ফলে আপনি শব্দ শুনতে পাবেন।
ডিজিটাল শব্দ রেকর্ডিং পদ্ধতি :
টেপে কোনো কিছুর রেকর্ডিং হলো এনালগ রেকর্ডিংয়ের উদাহরণ। আর ডিজিটাল ফরমেটে কোনো কিছুর রেকর্ডিং যেমন-সিডি, ডিভিডি কিংবা কমপিউটারে রেকর্ডিং হচ্ছে ডিজিটাল রেকর্ডিংয়ের উদাহরণ। ডিজিটাল রেকর্ডিংয়ে ডিজিটাল রেকর্ডারটি প্রথমে দ্রুত ভোল্টেজের কিছু স্যাম্পল (প্রতি সেকেন্ডে ৩০ হাজার স্যাম্পল হতে পারে) নেয়ার মাধ্যমে সিগন্যালটি ডিজিটাইজ করে। প্রতিটি স্যাম্পলকে এনালগ টু ডিজিটাল কনভার্টার নামের একটি ডিভাইসের মাধ্যমে ডিজিটাইজ করা হয়। কনভার্টার থেকে এই ডিজিটাল নাম্বারসমূহ বিভিন্ন উপায়ে ডিজিট্যালি সংরক্ষণ করা হয়। এনালগ টু ডিজিটাল কনভার্টার হচ্ছে ডিজিটাইজেশন পদ্ধতির মূল বস্ত্ত। মূলত এটি একটি চিপ।
অডাসিটি :
শব্দ নিয়ে কিছু আলোচনার পরে এবার আমরা আমাদের মূল আলোচনার বিষয় অডাসিটিতে ফিরে আসব। অডাসিটি হচ্ছে সাউন্ড রেকর্ডিং ও এডিটিংয়ের জন্য একটি ফ্রি ওপেনসোর্স সফটওয়্যার। এটি ম্যাক, উইন্ডোজ, লিনআক্সসহ অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেমে চালানো যায়। http://audacity.sourceforge.net/download সাইট থেকে এ সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করা যাবে।
অডাসিটির বৈশিষ্ট্যসমূহ
আকর্ষণীয় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে অডাসিটি নামের এ সাউন্ড এডিটর ও রেকর্ডার। অডাসিটির কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করব।
০১. রেকর্ডিং :
মাইক্রোফোন কিংবা মিক্সারের মাধ্যমে অডাসিটি সরাসরি রেকর্ডিং (লাইভ অডিও) করতে পারে। ক্যাসেট টেপ থেকে রেকর্ডিংকে ডিজিটাইজ করার সামর্থ্যও রয়েছে এর। সাউন্ড কার্ডের সাহায্যে এটি স্ট্রিমিং অডিওকেও ক্যাপচার করতে পারে। অডাসিটি মাইক্রোফোন, লাইন ইনপুট কিংবা অন্য যেকোনো সোর্স থেকে রেকর্ড করতে পারে।
০২. ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট :
অডাসিটি বিভিন্ন সোর্স থেকে সাউন্ড ফাইল ইমপোর্ট করে, এডিট করে এবং প্রয়োজনে সেগুলো নতুন ফাইল বা নতুন কোনো রেকর্ডিংয়ের সাথে সমন্বয় করে। নির্দিষ্ট কিছু ফাইল ফরমেটে এটি আপনার রেকর্ডিংকে এক্সপোর্টও করতে পারে। অডাসিটির মাধ্যমে ডব্লিউএভি (WAV), এআইএফএফ, এইউ এবং অগ ভরবিট (অগ ভরবিট একটি অডিও এনকোর্ডিং ও স্ট্রিমিং টেকনোলজি) ফাইলসমূহ ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট করা যায়। ম্যাড (উচ্চ মানসম্পন্ন অডিও ডিকোডার)-এর সাহায্য নিয়ে এটি এমপিইজি অডিও (এমপি-টু এবং এমপি-থ্রি ফাইলসহ) ইমপোর্ট করতে পারে। ডব্লিউএভি বা এআইএফএফ ফাইলকে সিডিতে বার্নিংয়ের উপযুক্ত করতে পারে অডাসিটি।
০৩. এডিটিং :
অডাসিটির মাধ্যমে সাউন্ড কাট, কপি, পেস্ট এবং ডিলিট করা যায়। প্রয়োজনানুযায়ী যতবার দরকার ততবার আনডু (Undo) এবং রিডু (Redo) করা যায়। অডাসিটি ব্যবহার করে বড় বড় ফাইল খুব দ্রুত এডিট করা যায়। এর মাধ্যমে কোনো সাউন্ড ফাইলকে টুকরা টুকরা করা যায় কিংবা টুকরা টুকরা ফাইলসমূহ সংমিশ্রণ করা যায়।
০৪. সাউন্ডের গুণগত মান :
অডাসিটি ১৬বিট, ২৪বিট এবং ৩২বিটের সাউন্ড স্যাম্পল রেকর্ড ও এডিট করতে পারে। এটি ৯৬ কিলোহার্টজ গতি পর্যন্ত রেকর্ড করতে পারে। ফলে অডাসিটির মাধ্যমে প্রাপ্ত রেকর্ডিংয়ের গুণগত মান খুব ভালো হয়।
অডাসিটি ব্যবহারে যা মনে রাখা প্রয়োজন :
অডাসিটি নিয়ে কাজ করার সময় কয়েকটি বিষয় মনে রাখা খুব দরকার। যেমন- ১. অডাসিটির প্রতিটি ট্র্যাকে একটি ক্লিপ রাখা যাবে (ক্লিপ হলো খুব সাধারণ এক টুকরো অডিও মেটেরিয়াল। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি ট্র্যাকে কেবল একটি অডিও থাকতে পারবে)। ২. অডাসিটি সব সময় নতুন ট্র্যাকে রেকর্ড করে। ৩. এডিট/ডুপ্লিকেট নতুন অডিও ফাইল তৈরি করে না।
অডাসিটির সীমাবদ্ধতা :
একটি শক্তিশালী অডিও অডিটর হওয়া সত্ত্বেও অডাসিটির রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। যেমন- অনেক সিস্টেমে অডাসিটি একই সময়ে দু’টির বেশি চ্যানেলে রেকর্ডিং করতে পারে না। অডাসিটিতে মিডি (MIDI) ফাইল খুলে, কিন্তু অডাসিটি মিডি এডিটর নয় এবং এর মিডি বৈশিষ্ট্যগুলো খুবই সীমাবদ্ধ।
শেষ কথা :
এতক্ষণের আলোচনা থেকে আমরা শব্দ এবং অডাসিটি নামের সাউন্ড এডিটিং ও রেকর্ডিং সফটওয়্যারটি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেলাম। ব্যক্তিগত বা পেশাজীবী যেকোনো সাউন্ড এডিটরের কাজে অডাসিটির ব্যবহার লাভজনক হবে বলে আশা রাখা যায়।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : rabbi1982@yahoo.com