• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০০৯ - জুন
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন

যিনি যে ভোবেই দেখুন না কেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের এক স্বপ্নের নাম। স্বাধীনতার আটত্রিশ বছর পর এই জাতি তার সাফল্য-ব্যর্থতাকে অনুভব করেছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে রূপকল্প তৈরি করেছে তার স্বপ্নের দেশের। বলা যায়, একাত্তরে দেশ স্বাধীন করার পর ২০০৮ সালে এই জাতি আবার নতুন করে এক স্বপ্নের ঠিকানায় নৌকা ভাসিয়েছে। সেই স্বপ্নই ডিজিটাল বাংলাদেশ।

সেই স্বপ্নটা এমন সুন্দর :

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়মত্মীতে সমাজে জ্ঞানই শক্তির কেন্দ্র হবে বলে অর্থের-বিত্তের চাইতে জ্ঞানের প্রভাব কেবল বেশি নয়, নিরঙ্কুশ থাকবে। এই সময়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোর একটি বিশাল পরিবর্তন হবে। সমাজে জ্ঞানী ও পন্ডিত ব্যক্তিরা সম্মানিত হবেন। অর্থনীতি জ্ঞানভিত্তিক বলে কৃষি ও শিল্পের চাইতে মেধাভিত্তিক সেবা ও শিল্প-কারখানার প্রসার বেশি হবে। কৃষিতে কাজ করবে শতকরা বড়জোর সাত ভাগ লোক। ষাট ভাগের বেশি লোক কাজ করবে সেবা খাতে। বস্ত্তগত সম্পদের চাইতে মেধাজাত সম্পদ সৃষ্টির প্রতি সবার বেশি আগ্রহ থাকবে। মেধার বিকাশ, সংরক্ষণ ও সৃজনশীলতাই হবে নীতি ও নৈতিকতার কেন্দ্র। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের জ্ঞানভিত্তিক সৃষ্টির বিশাল বাজার তৈরি হবে। প্রচলিত কৃষি-শিল্প-ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ সবকিছুতে বাঙালীর বিজ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কল্যাণে তথা মেধার স্পর্শে মূল্য সংযোজন এমনভাবে হবে যে বস্ত্তগত মূল্যের চাইতে মেধাজাত মূল্য সংযোজন অনেক বেশি হবে। নারী ও তরুণরা এসব কাজে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকবে। বয়স্করা প্রধানত অভিভাবকত্ব এবং অবসর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। আগামী বছরগুলোতে নতুন একদল জ্ঞানকর্মী তৈরি হবে। এই জ্ঞানকর্মীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র নেতৃত্ব দেবে। এরা সংখ্যায় বেশি বলে সাধারণভাবে বাংলাদেশের একুশ শতকের ইতিহাস তারাই রচনা করবে। অর্থনীতি হবে চাঙ্গা। দুই ডিজিটের নিচে প্রবৃদ্ধি হবে না। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের অপবাদ ঘুচবে। নিজেদের অর্থ দিয়ে আমরা আমাদের উন্নয়ন করতে থাকবো। দাতারা আমাদের জন্য প্রেসক্রিপশন দেবে না, বরং বলা যায় দিতে পারবে না। বরং আমরা দুনিয়াকে দেখিয়ে দেবো জ্ঞানভিত্তিক সমাজের রূপরেখা কেমন।

আমরা স্বপ্ন দেখি, পুরো দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কোনো মানুষ বসবাস করবে না। দেশে সচ্ছল মানুষ সবাই হবে। সমাজে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক-এমন খুব বেশি ধনী কোনো মানুষ বা পরিবার থাকবে না। বড় বড় শিল্প-কল-কারখানা থাকবে। তবে এসব কারখানার শেয়ারহোল্ডাররা থাকবে সাধারণ জনগণ। দেশে ব্যাপকভাবে ছোট ও মাঝারি পুঁজির বিকাশ ঘটবে। তবে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার জন্য ধনী আরো ধনী হবার সুযোগ পাবে না। মাঝারি আয়ের মধ্যবিত্তের সংখ্যাই অধিক হবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা কোনোটাই কোনো মানুষের সঙ্কট হবে না। সবাই তার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারবে। অন্নের অভাবে পড়বে না কোনো মানুষ। সারাদেশে থাকবে না কোনো বস্ত্রহীন মানুষ। ছিন্নমূল-বাসস্থানহীন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না। রাস্তায় ভিক্ষুক পাওয়া যাবে না। সরকারি-খাস জমি, ফুটপাত, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট বা অন্য কোথাও ঝুপড়ি ঘরের বস্তিতে কেউ বাস করবে না। নিজের হোক, ভাড়ায় হোক একটি নিরাপদ আবাস প্রতিটি মানুষের থাকবে। প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সেবা পাওয়া যাবে। বিনা চিকিৎসায় মরবে না কেউ। প্রতিটি মানুষের জন্য ডাক্তার-হাসপাতাল-ওষুধ পাওয়া যাবে। গ্রামের হোক আর শহরের হোক ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা সবার জন্যই বিরাজ করবে। সরকার সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। বেনিয়া চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সে পেতে পারবে। ডিজিটাল যন্ত্র প্রতিটি মানুষের কাছে সেই সুযোগ পৌঁছে দেবে। এমনকি দেশের বাইরের বিশেষজ্ঞদের কাছে একজন সাধারণ মানুষকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেবে সরকার।

সরকার গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশনসহ সব সাধারণ সেবাই মানুষের জন্য প্রদান করবে। দেশের সর্বত্র পৌর সেবা ঘরে বসেই পাওয়া যাবে। মানুষ ঘরে বসেই তাদের সব বিল পরিশোধ করবে। প্রতিটি মানুষের জন্য মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে এবং সরকার সেই শিক্ষা বিনামূল্যে প্রদান করবে। শিক্ষার ন্যূনতম এই স্তরটিতে কোনো বৈষম্য থাকবে না। স্কুল হোক, মাদ্রাসা হোক সবার জন্যই এক ধারার পাঠ্য বিষয় থাকবে। শহর-গ্রাম, ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবার জন্য ন্যূনতম শিক্ষার একটিই ধারা প্রবহমান থাকবে। দেশের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর নিজের কমপিউটার বা অন্য কোনো ডিজিটাল যন্ত্র থাকবে। ক্লাসরুমগুলো কমপিউটার দিয়ে ভরা থাকবে। সব পাঠ্যপুস্তক ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে। বাড়িতে বসে ক্লাস করা যাবে। পরীক্ষা দেয়া যাবে ঘরে বসে। ফল পাওয়া যাবে পরীক্ষা দেবার পরপরই।

নিরাপত্তার অভাব থাকবে না কারো। তার নিজের জীবন নিয়ে কোনো ভয় থাকবে না। সে ভয়লেশহীনভাবে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো সময় চলতে পারবে। ঢাকার পথে রাত বারোটায় ১৮ বছরের সুন্দরীটি সম্পূর্ণ একা হাঁটবে বা সাইকেল চালাবে। তার নিরাপত্তার কোনো অভাব হবে না। সব মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো থাকবে নিশ্চিত। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হবে না। দেশে স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকবে। সেটি কেবল কাগজে থাকবে না, বিরাজ করবে আইনের শাসন। রাজনীতি নষ্টামিতে ভরা থাকবে না। দুর্বৃত্তায়ন পাওয়া যাবে না তাতে। থাকবে না লুটেরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি। মানুষ রাজনীতিবিদদের চোর-মহাচোর বলবে না, সম্মানের চোখে দেখবে। রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেমিক বলে মনে করা হবে। রাজনীতিকরা গম, টিন আত্মসাত, মামলাবাজি, দলবাজি, কমিশনবাজি এসব করবেন না। তাদের হ্যামার-জাগোয়ার-মার্সিডিজ বেঞ্জ থাকবে না, মগজের ধার থাকবে। সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদ বা টিআর-এর পেছনে লেগে থাকবেন না। তারা আইন প্রণয়নে নিমগ্ন থাকবেন। তারা দেশের জন্য একুশ শতকের আইন প্রণয়ন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মানুষের করণীয় বিষয়াদি নিয়ে কাজ করবেন। দেশে একটি সচেতন নাগরিক সমাজ দেশবাসীর সব ধরনের বিষয়সহ মানবাধিকারের বিষয়সমূহও মনিটর করবে।

সংবিধানে প্রদত্ত নিয়ম কাঠামোর মাঝে সংবাদপত্রের-মিডিয়ার স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে। মানুষ ঢাকা শহরের সরকারের কাছে আসবে না, সরকার যাবে তার গ্রামের বাড়িতে, পর্ণকুটীরে। সে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে কোথায় তার উন্নয়ন হবে। ততদিনে দোকানপাট আর মার্কেটনির্ভর ব্যবসায়-বাণিজ্য উধাও হয়ে যাবে। মানুষ তার ঘরে বসে পছন্দমতো পণ্য কিনবে। কাগজের টাকা জাদুঘরে থাকবে। মাছ-মুরগির ব্যবসায়ওয়ালা, চানাচুরওয়ালা ও অন্য ফেরিওয়ালারা ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করবে। উৎপাদন ব্যবস্থা যাবে বদলে। শ্রমঘন বিপজ্জনক শিল্প কারখানায় মানুষের কাজ হবে কেবল নিয়ন্ত্রণ করা। যন্ত্রপাতি করবে উৎপাদন। মানুষ করবে সেই উৎপাদন ব্যবস্থার মনিটরিং। কৃষি কাজ পর্যন্ত চিপসনির্ভর হবে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সরকার হবে দক্ষ ও জনগণের সেবক। সরকারের সব তথ্য নাগরিকরা যেকোনো স্থান থেকে জানতে পারবে। বিচার হোক আর সরকারের কাছে কোনো আবেদন হোক, কমপিউটার বা মোবাইল ফোন দিয়েই নাগরিকরা সরকারের কাছে পৌঁছাতে পারবে। কাউকে সশরীরে সরকারি অফিসে আসতে হবে না। শহরের পাতাল-আকাশ রেল তাদের চলাচলের উপায় হবে। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাবার জন্য তারা ট্রেনে চড়ে বা রেলে উঠে দ্রূত চলাচল করবে। নদী-খাল দিয়ে আরামদায়ক দ্রুতগতির নৌযান চলবে। সড়কপথগুলো প্রশস্ত, নিরাপদ ও আরামদায়ক গণবাহনে ভরা থাকবে। পদ্মা সেতু ততদিনে শেষ হয়ে যাবে। শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, ধনু, সুরমা, কংস, যমুনায় আরো অনেক সেতু হবে। রেললাইন যাবে টেকনাফ পর্যন্ত। প্রশাসনে স্পিড মানির প্রয়োজন থাকবে না। কাজ হবে আপন গতিতে। টিআইবির অফিস তালাবদ্ধ হয়ে যাবে। দেশজুড়ে বিরাজ করা তাদের শাখা অফিসগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। পুলিশ এসএমএস বা ই-মেইলে মামলা গ্রহণ করবে। তারা ঘুষ কাকে বলে জানবে না। কাস্টমস অফিসাররা ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করবেন। তারা ঘুষ কাকে বলে জানবেন না। ভূমির সব তথ্য ঘরে বসে পাওয়া যাবে। জমি রেজিস্ট্রি করার সাথে সাথে দলিল পাওয়া যাবে। দেশের যেকেউ চিহ্নিত অপরাধীকে ইন্টারনেটে দেখতে পাবেন। বিচারক প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সহায়তা নিয়ে বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারবেন। আইন-বিচার কার্যক্রম, আইনের ব্যাখ্যা, আদালত, উকিল এবং বাদী-বিবাদী সবার কাছেই ঘরে বসে পাবার মতো তথ্য সহজলভ্য থাকবে।

আমাদের স্বপ্নের মাঝে থাকতে পারে, দেশের নদীগুলো মিষ্টি পানি আর সুস্বাদু মাছে পরিপূর্ণ থাকবে। আমি স্বপ্ন দেখতে চাই যে, দেশের দুই কোটি শিক্ষিত বেকার নিজেদের একুশ শতকের উপযুক্ত করবে এবং তাদের বেকারত্ব ঘুচবে। নতুন যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বের হবে তারা তৈরি হবে জ্ঞানকর্মী হিসেবে।

কখনও কখনও এমনটি মনে হতে পারে যে, এটি হয়তো উচ্চাভিলাসী, অলীক বা বাস্তবায়ন অযোগ্য একটি কল্পনার ফানুস। ভাবলেই সব হবে, স্বপ্ন দেখলেই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাবে এমনটি নাও হতে পারে। কিন্তু চেষ্টা করলে সেটি হতেও পারে।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com

পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস
অনুরূপ লেখা