৬-৭ আগস্ট নয়াদিল্লিতে হয়ে গেল গ্লোবাল ইন্ডিয়ান আইসিটি সামিট ২০১০। ভারতীয় চেম্বার অব কমার্সের আয়োজনে ও ভারতীয় আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ১৪টি দেশ থেকে প্রায় ২০০ প্রতিনিধি এ সামিটে অংশ নেন। বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল এ সামিটে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করে। ২ দিনের এ সামিট অনুষ্ঠিত হয় নয়াদিল্লির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হায়াত রিজেন্সিতে।
প্রথম দিনের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট সবার উদ্দেশে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। এর পর পরই বাতি জ্বালিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন পশ্চিমবঙ্গের আইসিটিমন্ত্রী ড. দেবেশ দাশ।
ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের ওপর ভারত সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানান ইন্ডিয়ান ডিপার্টমেন্ট অব আইটির বিজ্ঞানী ডা. গোবিন্দ।
আগামী ২০২০ সাল নাগাদ ভারতের আইসিটি খাতে বিভিন্ন কার্যক্রম ও আউটসোর্সিং বাজার কিভাবে নিজেদের আয়ত্তে আনা যায়- এ বিষয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। এ ছাড়াও ভবিষ্যতের আইসিটি ও বিপিও খাতে ভারতীয় সরকারের মিশন ২০২০-এর ওপর একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। প্রসঙ্গত, বর্তমান বিশ্বের আউটসোর্সিং কাজের ৫০ ভাগের বেশি ভারতের দখলে। তাদের কাছাকাছি চীন ও ফিলিপাইন চেষ্টা করলেও চীনের প্রোগ্রামারদের ইংরেজি জ্ঞান কম থাকায় কাজ করতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে। তাই সামনের আউটসোর্সের বিপুল ক্ষেত্র ভারতের দখলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আউসোর্সিংয়ের জন্য ভারতের যাবতীয় কর্মকান্ড আমাদের বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। ভবিষ্যতে বিশ্বের একটি বড় অংশ ভারতের দখলে নেয়ার জন্য যেভাবে এরা এগিয়ে যাচ্ছে, তার কয়েকটি নিচে দেয়া হলো :
০১.
দক্ষ আইটি প্রফেশনাল তৈরির জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাসের শেষের দিকে এসে ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য ভারত সরকার একটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। এখান থেকে বের করে আনা হয় দক্ষ প্রফেশনাল, যারা আউটসোর্সসংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ।
০২.
কাজের জন্য সব ধরনের সুবিধাসহ রয়েছে সর্বাধুনিক হাইটেক পার্ক, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা।
০৩.
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কাজ নেয়ার জন্য ভারত সরকার সেই সব দেশে অবস্থানরত ভারতীয়দের কাজে লাগাচ্ছে, মূলত ওই সব অনাবাসী ভারতীয়রা সফটওয়্যার ও অন্যান্য কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে লবিস্ট হিসেবে কাজ করে।
০৪.
প্রেজেন্টেশন ও কাজের অভিজ্ঞতার ব্যাপারগুলো উপস্থাপন।
০৫.
কাজপরবর্তী নিরবচ্ছিন্ন সাপোর্ট ছাড়াও সরকার আরও বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা দিয়ে এই খাতকে সামনে এগিয়ে নেয়ার কাজ করছে।
ই-গভর্নেন্স চ্যালেঞ্জের ওপর একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতীয় আইসিটি মন্ত্রণালয়ের পরিচালক অভিষেক সিং। সেখানে দেখিয়েছেন কিভাবে তারা ই-গভর্নেন্স সিস্টেমস তৈরি করে সুফল ভোগ করছেন। একটি ব্যাপার খুব লক্ষণীয়, সরকারি চাকরিজীবী যারা বিভিন্ন স্তরে গভর্নেন্সের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত, তাদের বেশিরভাগেরই আইটি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। কিন্তু তাদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে যে তারা টেকনিক্যাল ও নন-টেকনিক্যাল সব প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবেই দিতে পারে।
দ্বিতীয় দিনের সেশনে প্রথমেই প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তথ্যপ্রযুক্তির প্রকৃত শিক্ষা মনিটরিং ম্যানেজমেন্ট ও ইভ্যালুয়েশনের ওপর (পিপিপি) মডেল, পাবলিক প্রাইভেট এই প্রোগ্রামের সিইও কামাল মানসারামানি। দেখিয়েছেন কিভাবে ভারতের আইটি শিক্ষায় শিক্ষিতদের ঘষামাজা করে প্রকৃত প্রোগ্রামার হিসেবে বের করে আনা যায়।
আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই মডেলটি খুব ভালো করে কাজে লাগানো যেতে পারে। তারা দেখিয়েছেন, একজন গ্র্যাজুয়েটকে কিভাবে শুধু ৪-৫ মাসের হাতেকলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাকে চাকরির উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। আমাদের দেশে সব ছাত্রছাত্রী গ্র্যাজুয়েশনের শেষের দিকে এসে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্টের জন্য হন্যে হয়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে অনেকেই প্রকৃত হাতেকলমে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান না। ফলাফল চাকরি বাজারে এসে হতাশ হচ্ছেন এবং চাকরি না পেয়ে অন্য ট্রেডে চলে যাচ্ছেন অথবা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
আমাদের দেশে যদি রুট লেবেল গবেষণার মাধ্যমে একটি কোর্স কারিকুলাম তৈরি করে গ্র্যাজুয়েটদের প্রজেক্টভিত্তিক হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার এ ধরনের কোনো মানসম্মত ইনস্টিটিউট চালু করা যেত, তাহলে তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা আরো অনেক দক্ষ লোকবল পেতাম, যা কাজে লাগিয়ে বর্তমান আউটসোর্সের একটা অংশ আমরাও দখলে আনতে পারতাম। এখনই সময় বর্তমান বিশ্বের সাথে নিজেদের আইটি প্রফেশনালদের খাপ খাইয়ে নেয়া। বর্তমান বিশ্বের সফটওয়্যার রফতানির প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই। অথচ এখান থেকে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। শুধু সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে এসব গ্র্যাজুয়েটের একটি বড় অংশ হারিয়ে যাচ্ছে। তাই সফটওয়্যার রফতানির উপযুক্ত পরিবেশের সাথে সাথে দক্ষ লোকবল তৈরির জন্য ভারতের পিপিপি মডেল আমাদের দেশে কাজে লাগানো যেতে পারে।
আইসিটি ইন হেলথকেয়ারে অ্যাপোলো টেলিমেডিসিন নেটওয়ার্কিং ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ডা. কে গণপতির দেয়া ৫০ মিনিটের উপস্থাপনায় উঠে এসেছে কিভাবে তারা থ্রিজি ব্যবহার করে গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন।
তাইওয়ানের অ্যাম্বাসেডর ফিলিপ ওয়ানচাই দেখিয়েছেন, সেমিকন্ডাক্টরের বিশ্বব্যাপী তাদের চাহিদার কথা এবং কিভাবে তারা একদম শূন্য থেকে বর্তমান বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর তৈরির সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ডেলিগেশনের পক্ষ থেকে বিসিএস সভাপতি মোস্তাফা জববারের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বেসিসের পরিচালক এস কবির আহমদ। তিনি দেখিয়েছেন বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রণয়নে বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা। এক্ষেত্রে ভারত সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের আমাদের দেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
অধিবেশনের শেষের দিকে বাংলাদেশ ডেলিগেশনের সাথে তাইওয়ানের রাষ্ট্রদূত, ভারতের আইসিটিমন্ত্রী ও বিশিষ্টজনদের দ্বি-পাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হয়। বৈঠকে ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে যেকোনো সহায়তা দিতে তারা আশ্বাস দেন।