লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১০ - সেপ্টেম্বর
লেখার ধরণ:
প্রযুক্তি ভাবনা
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি বিপ্লব
ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থা
ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন আমাদেরকে ভাবতে হয়, এ স্লোগান দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ ও কৃষক-শ্রমিক কিভাবে উপকৃত হবে। এদের সামনে কিভাবে উপস্থিত করা হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা? কিভাবে তাদের ডিজিটাল লাইফস্টাইল গড়ে উঠবে। আমাদের সনাতনী কৃষিযুগের জীবনধারায় এরই মাঝে শিল্পযুগের বা যন্ত্রযুগের কিছু না কিছু প্রভাব পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কায়িক শ্রম প্রতিস্থাপিত হয়েছে যান্ত্রিক শ্রমের মাধ্যমে। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে অতি ধীরে ধীরে বদলাতে থাকা জীবনে গ্রামের মানুষ তার চারপাশের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচাই বাছাই করে দেখছে, নতুন সমাজ বা নতুন দুনিয়াটা তার জন্য কেমন। দিনে দিনে এর মাঝে এমন সব সেবা সে পেতে শুরু করেছে যাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সাথে যুক্ত করা যায়। কিন্তু আমরা যদি তাকে সত্যি সত্যি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বাদ দিতে চাই, তবে তার অতিপ্রয়োজনীয় এবং দৈনন্দিন জীবনের অংশবিশেষকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে। ভূমি হলো তার তেমন একটি ক্ষেত্র। সেজন্যই তার ভূমি ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টাতে হবে।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশের দুর্নীতির সবচেয়ে বড় আখড়াটি হলো ভূমি ব্যবস্থায়। সম্ভবত এটিও সত্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাটিও হতে যাচ্ছে ভূমি নিয়ে। জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের ভূমির পরিমাণ খুবই কম। আমরা বর্গকিলোমিটারপ্রতি এত বেশি লোক বাস করি যে, এক সময়ে দেশের মানুষ বাসস্থানের জায়গা পর্যন্ত পাবে না। এখন মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইলের একটি ভূখন্ডে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। নগরায়ন বা শিল্পায়ন জমির ওপর আরো বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
দৈনিক জনকণ্ঠ ৮ জুলাই ২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি খবর অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন ৪৪৪ একর কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। এই হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় কমছে ১৮ একর জমি। এভাবে চললে আগামী ৫০ বছরে এক ইঞ্চি জমিও থাকবে না চাষাবাসের। পত্রিকার খবরে আরো বলা হয়, ১৯৭৪ সালে মোট আবাদী জমি ছিলো মোট জমির শতকরা ৫৯ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে তা ৫৩ শতাংশে নেমে আসে। বর্তমানে প্রতি বছর ১ লাখ ৬০ হাজার একর আবাদী জমি কমছে।
দুর্ভাগ্য, দেশের কম মানুষই এ বিষয়ে সচেতন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ভূমির সিলিং ১০০ বিঘায় করলেও নানা ফাঁকফোকর দিয়ে জোতদারের জমি জোতদারের কাছেই থেকে গেছে। তারা নানা নামে-বেনামে, এক পরিবারকে নানা পরিবারে বিভাজিত করে এসব জমি কাগজেকলমে হস্তান্তর করে নিজের পরিবারের মাঝেই রেখে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তখনকার প্রেক্ষিতে ১০০ বিঘার সিলিংটাই সঠিক ছিল না। সেটি দশ একর বা ১০০০ শতাংশ হলে কিছু ফল পাওয়া যেতো।
১০০ বিঘার সীমাকে বেশি মনে করে ১৯৮৪ সালে কৃষিজমির সর্বোচ্চ সীমা ৬০ বিঘা করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। কারণ, জমিগুলো যখন পরিবারের বিভিন্ন জনের হাতে ভাগ হয়ে যায় তখন ৬০ বিঘার বাড়তি জমি আর অবশিষ্ট থাকেনি।
ভূমি ব্যবস্থাপনার ত্রুটির জন্য সরকারের খাসজমি ব্যবস্থাপনায় রয়েছে চরম দুর্নীতি। প্রকৃত ভূমিহীনরা খাসজমি পায় না। জোতদাররাই নামে-বেনামে খাসজমি দখল করে থাকে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারি কর্মচারীরাও দুর্নীতির মহাসমুদ্রে বাস করে। কিন্তু এর চাইতে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে ভূমি নিয়ে বিরোধ। দীর্ঘদিন ধরে কায়িকভাবে ভূমির রেকর্ডপত্র রক্ষা, রেজিস্ট্রেশন, নকশা প্রস্ত্তত ও জালিয়াতি ইত্যাদি করার ফলে ভ‚ূম নিয়ে বিরোধ দিনে দিনে বাড়ছে।
সম্প্রতি ভূমি ব্যবস্থাপনার রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি পরিবর্তন করা হলেও সমস্যা এখনো কাটেনি। ভূমিসংক্রান্ত মামলা বা বিরোধ বছরের পর বছর সম্প্রসারিত হয়। গত ৬ জুন ২০০৯ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ভূমি ব্যবস্থাকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বলেছেন। ডিজিটাল পদ্ধতি ছাড়া এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। কারণ, ভূমির কাজকর্ম একটি বা দুটি অফিসে সম্পন্ন হয় না। এমনকি একটি মন্ত্রণালয়েও ভূমির কাজকর্ম সীমাবদ্ধ নয়।
সরকারের যে অংশগুলো ভূমি নিয়ে কাজ করে সেগুলো হলো : ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর, ভূমি আপীল বোর্ড, ভূমি সংস্কার বোর্ড, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আঞ্চলিক সেটেলমেন্ট অফিস, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, উপজেলা ভূমি অফিস, উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিস, সাব রেজিস্ট্রার অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস।
তবে এসব অফিস প্রধানত তিন ধরনের কাজ করে থাকে। একটি হলো ভূমির দলিল নিবন্ধন করা। এটি করে থাকে সাবরেজিস্ট্রার অফিস, যা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে ভূমির রেকর্ড। এর জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় রয়েছে। এই দুটি কাজের বাইরে ভূমির মালিকানা বিষয়টি দেখে থাকে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন আবার ভূমি অধিগ্রহণের কাজও করে।
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থার ডিজিটালায়ন: গত ১১ আগস্ট ২০১০ বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভূমি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার সভাপতিত্বে একটি মতবিনিময়সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ প্রশাসন ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাচক্রে আমিও সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম এবং সেই সুবাদে ভূমিসংক্রান্ত সরকারের পরিকল্পনা বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থাটি আমার পক্ষে অবহিত হওয়া সম্ভব হয়। সেই সভার কার্যপত্রে বলা হয়, বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় বাস্তবায়নে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর দেশের সব এলাকায় ডিজিটাল নকশা ও ভূমি মালিকদের রেকর্ড প্রস্ত্তত, স্যাটেলাইট প্রযুক্তিসহ ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম, ডিজিটাল নকশা ও খতিয়ান প্রণয়ন ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ‘সাভার ডিজিটাল জরিপ ২০০৯’-এর কাজ শুরু করেছে। নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ৪৪টি মৌজায় ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ভিশনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরে সম্প্রতি ১৯১টি মৌজায় সম্পাদিত জরিপ অনুযায়ী ৪ লাখ ৪১ হাজার ৫০৬টি খতিয়ান ও ৪ হাজার ৮৯টি মৌজা ম্যাপশিট ডিজিটায়নের কাজ শেষ হয়েছে, তৈরি রেকর্ড ওয়েবসাইটে শিগগিরই দেয়া হবে। ‘কমপিউটারাইজেশন অব ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অব ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট’ কর্মসূচির আওতায় ঢাকা জেলার ৫টি উপজেলাকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নেয়া হয়েছে। এ কাজে সফল হলে সারাদেশের ৬৪ জেলা এর আওতায় আনা সম্ভব হবে।
সর্বশেষ জরিপে প্রণীত মৌজাম্যাপ ও খতিয়ানের ওপর ভিত্তি করে পার্বত্য তিন জেলা ছাড়া বাংলাদেশের সব উপজেলা ও সিটি সার্কেলের ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং সংরক্ষণ প্রকল্প (১ম পর্যায়) প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২,০৫২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রকল্পটিতে অর্থ বিভাগের সম্মতি পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা কমিশনে শিগগিরই তা পাঠানো হবে। এ ছাড়া সেটেলমেন্ট প্রিন্টিং প্রেসের সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন করে প্রমাপ অর্জনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ডিজিটাল জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও সক্ষমতা গড়ে তোলা, আন্তর্জাতিক সীমার স্ট্রিপ ম্যাপ ডিজিটাইজেশন ও আন্তর্জাতিক সীমানা পিলারের ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি, ম্যাপ প্রিন্টিং প্রেসের আধুনিকায়ন, সারাদেশে ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি, ডিজিটাল ভূমি তথ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাসহ ‘ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় ১ কোটি ২৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার ঋণের আশ্বাস পাওয়া গেছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫টি জেলার ৪৫টি উপজেলার সব মৌজার সর্বশেষ জরিপে প্রণীত মৌজাম্যাপ ও খতিয়ান এবং মিউটেশন খতিয়ানকে ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা হবে।
সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভূমি রেকর্ড ও ভূমি জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আসলাম আলমের উপস্থাপনা। তিনি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থার কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। তার আলোচনায় অনেক বাস্তব প্রেক্ষিত আলোচিত হয়েছে।
আমি এখানে বিষয়গুলোকে খুব সংক্ষেপে আবার উল্লেখ করছি। প্রথমে আইনের কথা বলা যায়। আমাদের দেশের উত্তরাধিকারী আইন ও ভূমিসংক্রান্ত অন্যান্য আইন কার্যত ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলের। ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বড় লক্ষ্য হতে হবে ভূমি সংস্কার এবং এর ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার। প্রথমত এজন্য ভূমিসংক্রান্ত আইনগুলোকে আমূল বদলাতে হবে। এর মাঝে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি মীমাংসা করতে হবে সেটি হচ্ছে মালিকানা। কেউ একটি জমি কিনল এবং সেই কেনা জমি অন্য একজন দখল করে রাখলে তার মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ হবে, সেটির মীমাংসা হতে হবে। জমির নিবন্ধন মানেই মালিকানা, নাকি দখল মানেই মালিকানা সেটি যেমন জরুরি, তেমনি কার উত্তরাধিকার কার কাছে বিক্রি করলো বা কে ভোগ দখল করলো এসব প্রশ্নের মীমাংসার জন্যও আইনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা দরকার। আবার কে খাজনা দিল, কার নামে দলিল, উত্তরাধিকারসূত্রে কে জমিটা বিক্রি করতে পারে বা কে পেতে পারে ইত্যাদি ছাড়াও আছে জমির অতীত অনুসন্ধান ও মালিকানা নির্ধারণসংক্রান্ত জটিলতা। এক নাম্বার খতিয়ান বা খাসজমিবিষয়ক জটিলতা ও অর্পিত সম্পত্তিবিষয়ক জটিলতারও অবসান হওয়া চাই। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। প্রয়োজনে পৃথক আদালত করে ভূমিসংক্রান্ত মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করতে হবে।
ভূমি ব্যবস্থাকে এনালগ বা কাগজভিত্তিক রেখে আইন বদলালেও তার সুফল জনগণ পাবে না। এজন্য ভূমির তথ্যাদি বিদ্যমান এনালগ কাগুজে পদ্ধতিকে ডিজিটাল করতে হবে। ভূমিসংক্রান্ত সব ধরনের নকশা ডিজিটাল করতে হবে। জমি রেজিস্ট্রি, হস্তান্তর, রেকর্ড, মামলা-মোকদ্দমা, আইনী ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও বিতরণ করতে হবে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংগৃহীত চিত্রকে ভিত্তি করে ডিজিটাল নকশা তৈরি করে এর সাথে জমির মালিকানা এবং অন্যান্য তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হবে। এসব তথ্য সাধারণ মানুষ যাতে খুব সহজেই পেতে পারে তার জন্য এগুলো ইন্টারনেটে পাবার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলা দরকার, শুধু ইন্টারনেটে তথ্য রাখলেই দেশের সাধারণ মানুষ সেসব তথ্য নিজেদের কাজে লাগাতে পারবে তেমনটি ভাবার কোনো কারণ দেখি না। বরং আমি মনে করি, ইন্টারনেটে তথ্য রাখার পাশাপাশি গ্রামের মানুষের হাতের কাছে ভূমিবিষয়ক ডিজিটাল তথ্য অবশ্যই থাকতে হবে।
ব্যবস্থাটি এমন হবে যে, মানুষ যেমন করে টেলিফোন বিল বাড়িতে বসে জানতে পারে, একটি স্টার, তারপর তিন/চারটি সংখ্যা এবং হ্যাস বোতাম চাপে ও পুরো তথ্যটি তার কাছে চলে আসে, তেমনি মানুষ এটিও জানতে পারবে- কোন জমিটি কার মালিকানায় আছে, এর খাজনা কত, কবে এর শেষ খাজনা দেয়া হয়েছে এবং এটি কার দখলে আছে। একই সাথে মানুষ এটিও জানতে পারবে- জমিটি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক দেয়া আছে কি না বা এর মালিকানা নিয়ে কোনো আদালতে কোনো মামলা আছে কি না। মালিকানার বদল বা অন্য কোনো রেকর্ডের পরিবর্তনও সাথে সাথে আপডেট করতে হবে। ফলে ভূমি নিয়ে জালিয়াতি-প্রতারণা করার কোনো সুযোগ থাকবে না। ভূমি রেকর্ডের সাথে ডিজিটাল ভোটার তালিকা এবং ডিজিটাল জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পকে যুক্ত করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে এটি জানা যাবে- কোন ব্যক্তির কোথায় জমি আছে এবং কোন সম্পদের মালিক কে। প্রতিটি মানুষেরই একটি সম্পদের বিবরণী থাকতে হবে। দেশের (প্রয়োজনে বিদেশেরও) যেখানেই তার যেসব সম্পদ থাকবে তার বিবরণ ওই হিসাবে থাকবে। কেউ সেই সম্পদ বিক্রি করলে সেটি তার হিসাব থেকে বাদ যাবে। আবার কেউ কোনো সম্পদ কিনলে তার হিসাবে সেই সম্পদ যোগ হবে। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক হিসাব থেকে শুরু করে আয়কর পর্যন্ত সবকিছুই একটি বোতামের নিচে নিয়ে আসা যাবে।
বর্তমানে নিয়ন্ত্রণহীন অপরিকল্পিতভাবে পুরো দেশের ভূমি ব্যবহার করা হচ্ছে। যার যেখানে যা খুশি তাই করছে। জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে, কেটে ফেলা হচ্ছে পাহাড়। ফলে পরিবেশে বিপর্যয় ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০২১ সালে বাংলাদেশের মানুষের বাসস্থান এবং ফসলি জমি কোনোটাই পাওয়া যাবে না। সেজন্য বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পিত করার জন্য নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি নাগরিকের বাসস্থান এবং ফসলি জমি রক্ষা; দুটিই করতে হবে।
ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থা জিআইএস প্রযুক্তিনির্ভর ডাটাবেজভিত্তিক হতে হবে। জমির নকশা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিইঞ্চি ভূমির ডিজিটাল নকশা থাকতে হবে। জমির বেচা-কেনা, উত্তরাধিকার, বণ্টন, দান ইত্যাদি এবং সব ধরনের হস্তান্তরের রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণভাবে কমপিউটারে করতে হবে। জমিসংক্রান্ত সব তথ্য কমপিউটারে সংরক্ষণ করতে হবে। সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে মাত্র পাঁচ বছরে এক হাজার কোটি টাকায় এই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব (ডিএলআর কর্তৃক আয়োজিত ২৮ জুন ২০০৮ তারিখের সভায় প্রদত্ত তথ্য)। এতে আর যাই হোক, টিআইবির রিপোর্টে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ খাত হিসেবে এই খাতটিকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে না।
ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থা জিআইএস প্রযুক্তিনির্ভর ডাটাবেজভিত্তিক হতে হবে। জমির নকশা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিইঞ্চি ভূমির ডিজিটাল নকশা থাকতে হবে। জমির বেচা-কেনা, উত্তরাধিকার, বণ্টন, দান ইত্যাদি এবং সব ধরনের হস্তান্তরের রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণভাবে কমপিউটারে করতে হবে। জমিসংক্রান্ত সব তথ্য কমপিউটারে সংরক্ষণ করতে হবে।
সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা
০১.
বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে ফসলি জমি ও পরিবেশ। বর্তমানের নিয়ন্ত্রণহীন অপরিকল্পিতভাবে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি নাগরিকের বাসস্থান এবং ফসলি জমি রক্ষা; দুটিই করতে হবে। রাষ্ট্র ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে ন্যূনতম মূল্যে তার নিজের ও পরিবারের জন্য ন্যূনতম বাসস্থান দেবে। যার বাসস্থান একসাথে বা কিস্তিতে কেনার সামর্থ্য নেই রাষ্ট্র তাকে ন্যূনতম বাসস্থান বিনামূল্যে দেবে। এই ন্যূনতম ব্যবস্থার বাইরে নাগরিকেরা নিজস্ব অর্থে বড় আকারের বা নির্ধারিত উন্নত স্থানে বাসস্থান কিনতে পারবেন।
০২.
দেশের সব জমি বাসস্থান, ফসলি জমি, খাল-বিল-নদী, জলাশয়, শিল্পাঞ্চল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির, ঈদগা, বনাঞ্চল, প্রত্নতত্ত্ব এলাকা, অভয়ারণ্য, মাছ প্রজনন কেন্দ্র, পার্ক বা খেলার জায়গা ইত্যাদিতে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত থাকবে। এসব নির্দিষ্ট স্থানের জমি শুধু নির্দিষ্ট কাজেই ব্যবহার করা যাবে।
০৩.
বর্তমানের ছনের-টিনের-আধাপাকা-পাকা ঘরবাড়ির বদলে কমিউনিটিভিত্তিক বহুতল উঁচু দালান নির্মাণ করে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এসব বাসস্থানের জন্য পানি-পয়ঃনিষ্কাষণ, বিদ্যুৎ, বিনোদন, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি নিশ্চিত করা হবে। পরিবারপ্রতি ফসলি জমির সর্বোচ্চ সিলিং হবে ৫ একর বা ৫০০ শতাংশ। বাসস্থানের জন্য রাজধানী শহরে ব্যক্তিগতভাবে ৩০ শতাংশের বেশি, জেলা শহরে ৫০ শতাংশের বেশি, উপজেলা বা থানা সদরে ১০০ শতাংশের বেশি জমির মালিক থাকা যাবে না। সব খাসজমি শুধু ভূমিহীনদেরকে দেয়া হবে। রাষ্ট্র উদ্বৃত্ত জমি বাজার দরে কিনে ভূমিহীনদের দেবে। ভূমিহীনরা এই জমি ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু কোনোভাবেই বিক্রি করে স্বত্ব হস্তান্তর করতে পারবে না। তেমন অবস্থায় সরকারের বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে এবং সেই ভূমিটি সরকার পুনরায় কোনো ভূমিহীনকে বরাদ্দ দেবে।
০৪.
ভূমি ব্যবস্থা জিআইএস প্রযুক্তিনির্ভর ডাটাবেজভিত্তিক হবে। জমির রেজিস্ট্রি ও নকশা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিইঞ্চি ভূমির ডিজিটাল নকশা থাকবে। জমির বেচা-কেনা, উত্তরাধিকার, বণ্টন, দান ইত্যাদি এবং সব ধরনের হস্তান্তরের রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণভাবে কমপিউটারে করা হবে। জমিসংক্রান্ত সব তথ্য কমপিউটারে সংরক্ষণ করা হবে এবং জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে।
২০০০ সালে এডিবি হিসেব করেছিল যে ভূমি ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করার জন্য ২৬ বছর সময় লাগবে এবং এর জন্য ৫০০ কোটি ডলার লাগবে। কিন্তু এখন সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তিন বছরেই ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com