• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > নতুন দিনের প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১১ - জানুয়ারী
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
নতুন বছর
তথ্যসূত্র:
পর্যালোচনা
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
নতুন দিনের প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ

আরও একটি ইংরেজি বছর বিদায় নিলো। নতুন আরেকটি বছর আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। যদিও এই বছর শুরু বা শেষটার সাথে বাস্তবে নতুন কিছু ঘটার বা নতুন কিছু বদলে যাবার তেমন কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই, তথাপি বছর ঘুরে নতুন একটা পঞ্জি এলেই সবার মাঝেই সাধারণত এক ধরনের প্রত্যাশা জন্ম নেয়।

আমরা যারা তথ্যপ্রযুক্তি জগতের মানুষ তাদের জন্যও এর ব্যতিক্রম নেই। অতীতে অনেকবার এমন সময়ে আমরা নানা প্রত্যাশার প্রদীপ জ্বালিয়ে আশা করেছি নতুন দিনে নতুন কিছু পাওয়ার জন্য। কিন্তু সব সময়ে সব কিছু আমাদের ভাগে পড়েনি। বরং অনেক অধ্যায়জুড়ে হতাশা ও না পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে মেলাতে পারিনি আমরা।

এবার যখন শেখ হাসিনার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় আসে তখন সেই প্রত্যাশা নতুন করে জন্ম নেয়। বলা যায়, এক ধরনের আশায় বুক বেঁধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই আমরা। এর সবচেয়ে বড় ভিত্তি ছিল, নির্বাচনের আগেই তিনি বারো বছরের একটি পরিকল্পনা নিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

দুই বছর পর আমার প্রথম মূল্যায়ন হলো, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণাটিই এই সরকারের প্রথম বড় সাফল্য। সারা দুনিয়ার প্রায় সবাই যখন ইলেকট্রনিক কালচারে ব্যস্ত এবং দুনিয়াতে একটি ইলেকট্রনিক বিপ্লব বা সভ্যতার কথা বলছেন, তখন একেবারে পেছনের কাতার থেকে বাংলাদেশ একটি ডিজিটাল সভ্যতা গড়ে তোলার অঙ্গীকার ঘোষণা করতে সক্ষম হলো। একটি সাধারণ গণভিত্তির রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে, একটি দরিদ্র দেশের একজন নেত্রীর পক্ষ থেকে এমন একটি ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসাটাই শেখ হাসিনার অনেক বড় একটি সাফল্য।

শেখ হাসিনার সরকারের দুই বছরকে মূল্যায়ন করার সময় দুটি বিষয় স্মৃতিতে রাখা দরকার। প্রথমত, অন্তত ২০০১ থেকে ২০০৮ সময়ের দুটি সরকার একই বিষয়ে কী ধরনের কাজ করেছে সেটি মনে রাখতে হবে। অন্যদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ দুই বা পাঁচ বছরে গড়ে তোলার কথা বলা হয়নি। এটি একটি বারো বছরের কার্যক্রম এবং এই সরকার সেই সময়ের মাত্র এক-ষষ্ঠমাংশ সময় অতিক্রম করেছে।

তিনি সেই প্রত্যাশার কতটা পূরণ করেছেন এবং কতটা করতে পারেননি, তার হিসেব নিকেশ আসলে হবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে। এখন আমরা সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। যেসব বড় ইস্যুতে আমাদের সঙ্কট দানা বেঁধে ছিল যেমন বিদ্যুৎ, এই দুই বছরে তার চূড়ান্ত সমাধান না হলেও অন্তত কিছু একটা ঘটার মতো অবস্থা অবশ্যই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ঢাকার যানজট যেভাবে দিনকে স্থবির করে দিয়েছে, তার সমাধান হয়নি, তবে সেটির বিপরীতে কিছু না কিছু প্রচেষ্টার নমুনা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমি মনে করি, ২০১৩ সালের শেষ প্রান্তে গিয়ে আমরা এসব বিষয়ের মূল্যায়ন করতে পারবো। তাছাড়া সব বিষয় নিয়ে এমন ছোট নিবন্ধে আলোচনা করাও সহজ নয়। আমাদের জীবনের চাকাটি বেশ বড়-সরকারের কাজের পরিধিটাও অনেক বড়। তাই আমরা অতিসংক্ষেপে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলায় সরকারের কোন কোন প্রধান প্রধান মাইলফলক তৈরি হলো বা কী কী মাইলফলক তৈরি হতে হবে সেসব বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি।

প্রথমত, বিগত দুই বছরে বড় কয়েকটি পরিবর্তনের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। এই সময়ে একটি ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আগামী তিন মাসে এই খাত আরও প্রসারিত হবে এবং বছর শেষে এটি বাংলাদেশের অন্য সব খাতের শীর্ষে অবস্থান নেবে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনমান থেকে শুরু করে ব্যবসায় বাণিজ্য ও শিল্প-কলকারখানায় একটি ডিজিটাল যুগ কেবল দৃঢ় হবে না, একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের ভিত যথেষ্ট শক্ত হয়ে উঠবে।

দুই বছরে আমি এই সরকারের যে সফলতাটিকে গুরুত্ব দিতে চাই সেটি হলো নীতি ও কৌশল বিষয়ে সরকারের একটি সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেয়া। সরকার একশ’ দিনের মাঝেই একটি আইসিটি নীতিমালা গ্রহণ করেছে এবং অন্তত দুই বছরের মাঝেই একটি কৌশলগত বিষয় নির্ধারণ করতে সম হয়েছে।

তৃতীয়ত, সরকার তার নিজের শরীরে ছোটখাটো একটি ঢেউ তুলতে পেরেছে এবং সরকারের তৃণমূল, মাঠ পর্যায়ের বা সচিবালয়ের আমলাদের কাছে এই বিষয়টি স্পষ্ট করতে পেরেছে, একটি ডিজিটাল রূপান্তর অনিবার্য এবং সেই পরিবর্তনকে না ঠেকিয়ে একে সহায়তা করাই তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

চতুর্থত, সরকার অন্তত এটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, তার দায়িত্বের সীমানাটা অবকাঠামো তৈরিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নিজে তার সব কাজ সম্পন্ন করতে পারবে না এবং সরকরের উপলব্ধি হয়েছে, বেসরকারি খাত বা জনগণকে সাথে নিয়ে সরকার অবকাঠামোগত বিষয়গুলোর একটি সঠিক অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।

বিগত দুই বছরে সরকার আরও অনেক কিছু করতে পারতো। হতে পারে, সরকারের সফলতা আরও ব্যাপ্ত হতে পারতো। কিন্তু আমি এবারের সময়সীমাটিকে এক যুগ বিবেচনা করে দুই বছরের সময়টিকে শুধু ওয়ার্মআপ সময় হিসেবে ধরে নিয়ে ২০১১ থেকে ২০১৩ সময়কালে খুব গুরুত্বপূর্ণ দু-চারটি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

বরাবরের মতো আমি এবারও বলতে চাই, সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির এবারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সরকারের নিজের চরিত্র বদলানোর। সরকার তার কাগজের সচিবালয়কে একটি ডিজিটাল সচিবালয়ে, কাগজের প্রশাসনকে একটি ডিজিটাল প্রশাসনে এবং তার কাগজের বস্তাকে ডিজিটাল স্টোরেজ ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে পারলে এটি হবে আগামী তিন বছরের সবচেয়ে বড় সফলতা। শুধু কয়েকটি ওয়েবসাইট প্রকাশ করে সরকার তার ডিজিটাল কর্মসূচির কোনো সফলতা আনতে পারবে না। বরং সরকারকে তার কাজ করার পদ্ধতি বদলাতে হবে। বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত আমরা শুধু ওয়েবসাইট দেখেছি-ডিজিটাল প্রশাসন দেখিনি। একটি জেলা প্রশাসনে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করলে সেটি মানুষের প্রচলিত কাজ করার পদ্ধতিকে কিছুটা সহজ করতে পারে বটে-কিন্তু প্রশাসন ডিজিটাল না করে যদি এমন কিছু করা হয় তবে সেটি অফিসে একজন রিসিপশনিস্ট বসানোর মতো কাজ হবে।

সরকারের আরও দুটি কাজ হতে পারে দুটি বড় ক্ষেত্রে। একটি ক্ষেত্রে ভূমি ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করে। অতীতে অনেক উদ্যোগ নিয়েও সেসব কার্যক্রমকে সফল করা সম্ভব হয়নি। এখনও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আমরা নিতে দেখিনি। ২০১১ সালের দ্বিতীয় দিনে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি আমত্মঃমন্ত্রণালয় সভায় তিন বছরের মাঝে ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থা গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, সরকারের তিন বছরের প্রধানতম সাফল্য হবে সেটি, যদি তা বাস্তব রূপ দেয়া যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ সাধারণ মানুষের জন্য- এমন কথা কেবল তখনই বাস্তবায়ন করা যাবে যদি গ্রামের কৃষক তার ২০ শতাংশ ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটালপ্রযুক্তির সহায়তা পায়।

তৃতীয়ত ক্ষেত্রটি সরকারের অগ্রাধিকার হতে পারে শিক্ষাখাত। একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে সরকার নীতি ও আইনগত বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ভালো কাজ করেছে। তবে আমি ভুলে যাইনি, যারা এই শিক্ষানীতির মূল কাঠামো তৈরি করেছেন তারা নিজেরাই শিক্ষায় প্রযুক্তির প্রয়োগ বিষয়ে সন্দিহান। আমি এর চেয়ারম্যান কবীর চৌধুরীর একটি লেখা একটি অনলাইন সংবাদ সংস্থার ওয়েবসাইটে পড়ে এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় এই মানুষ সাহস করলেও খুব বেশিদূর যাবার মতো স্বপ্ন দেখতে সক্ষম নন। এজন্য এখনও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ১৭৬০ সালে শুরু হওয়া শিল্প বিপ্লবের উপযোগী-২০১০ সালের উপযোগী নয়। ২০২১ সালের জন্যও এই শিক্ষানীতির ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। এর অন্তরে ও বাইরে পরিবর্তন ছাড়া এটি ডিজিটাল বাংলাদেশের চাহিদা মেটাতে পারবে না। বিষয়বস্ত্ত-শিক্ষাদান পদ্ধতি-কোনোটাই এখনও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী আধুনিক নয়। এই শিক্ষানীতি হয়তো আগের চাইতে ভালো, কিন্তু সেটি কোনোভাবেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নয়। তবে শিক্ষানীতির দশা যা-ই হোক না কেনো, শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতিতে যদি বিদ্যমান অবস্থা বহাল রাখা হয়, তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের গায়ের চামড়া তৈরি হবে, অন্তরটা তৈরি হবে না। এমনকি একটি ডিজিটাল বাংলাদেশের কাঠামো তৈরি হলেও বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা থেকে জন্ম নেয়া জ্ঞানকর্মীরা সেটি রক্ষা করার যোগ্যতা রাখবেন না। শুধু ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার সৈনিক তৈরি করতে পারে। আমি মনে করি এই ক্ষেত্রে আগামী তিন বছর সরকারের জন্য অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হবে। আমরা যত দ্রুত আমাদের সমাজটাকে কৃষি যুগ থেকে একটি ডিজিটাল যুগে নিতে চাই, তার জন্য শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত ও শিক্ষাদানের উপায়টা বদলানো দরকার।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস