২০১১ যেন মাইক্রোচিপ নির্মাতাদের জন্য অনেকটা উৎসবের বছর। বছরের শুরুতে বিশ্বের অন্যতম চিপ প্রস্ত্ততকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টেল বাজারে এনেছে দ্বিতীয় প্রজন্মের মাইক্রো-প্রসেসর স্যান্ডিব্রিজ। আর বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে আসছে ডেস্কটপ কমপিউটারে ব্যবহার উপযোগী সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এএমডির প্রসেসর বুলডোজার। মূলত বুলডোজার তৈরি হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার মিলপিটাসে অবস্থিত গ্লোবাল ফাউন্ডারিজে, যা বিশ্বের একক বৃহত্তর সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত।
অ্যাডভান্স মাইক্রো ডিভাইস তথা এএমডি মোটামুটি সবার কাছে পরিচিত, বিশেষ করে যারা আশির মাঝামাঝি থেকে নববইয়ের দশকে কমপিউটার চিপ যুগের বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখেছেন। বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম মাইক্রো-প্রসেসর প্রস্ত্ততকারী প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৫ সালের দিকে বিট-স্লাইস প্রসেসর সিরিজ তৈরি করে যা নানা ধরনের কমপিউটার বাজারজাতকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে অন্য চিপ নির্মাতাদের সাথে যৌথভাবে কাজ করে সময়োপযোগী মাইক্রো-প্রসেসর বাজারে নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। উল্লেখ্য, এএমডি ১৯৮২ সালে ইন্টেলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আইবিএম পিসির জন্য এম২৮৬ প্রসেসর তৈরি করে। পরে ১৯৮৬ সালে আই৩৮৬ তৈরি করার সময় ইন্টেল তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এর পর আদালতের শরণাপন্ন হলে ১৯৯৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায়ে এএমডি ইন্টেলের মাইক্রোকোড ব্যবহার করার অনুমতি পায়। তবে এরই মধ্যে ১৯৯১ সালে এম৩৮৬ প্রসেসর সফলভাবে বাজারজাত করে এএমডি, যা ছিল ইন্টেল৩৮৬-এর ক্লোন। প্রসেসরটি এক বছরের কম সময়ের মধ্যে দশ লাখ কপি বিক্রি হয়। এটিই এখন পর্যন্ত এএমডি’র সর্বাধিক বিক্রি হওয়া প্রথম প্রসেসর। এরপর ১৯৯৬ সালে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এএমডি কে৫ সিরিজের এক্স৮৬ প্রসেসর তৈরি করে। এর পরের ধাপে আসে এএমডি কে৬ সিরিজ যার কাছে হার মানে ইন্টেলের পেন্টিয়াম টু সিরিজের সাথে তীব্র প্রতিযোগিতা। পরে এএমডি মাইক্রো-প্রসেসর ধারায় যোগ হয় অ্যাথলন, ডুরন, শেম্প্রন, অ্যাথলন ৬৪, অপটেরন ও ফেনম। এসময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে এএমডি’র দ্বিতীয় প্রজন্মের মাইক্রো-প্রসেসর বুলডোজার ও ববকাট। প্রতিষ্ঠানটির দেয়া ঘোষণা অনুসারে নির্ধারিত ২০১০ সালের শেষের দিকে ফিউশন প্রযুক্তির ‘ববকাট’ এবং ২০১১-এর মাঝামাঝি সময়ে ‘বুলডোজার’ বাজারে আসবে।
এএমডি’র টেকনলোজি অ্যানালিস্ট ডে ২০০৭-এ খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রথম ‘বুলডোজার’ প্রসেসরের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সে সময় বিস্তারিত কোনো কিছুই জানানো হয়নি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রসেসর সম্পর্কে। বুলডোজার হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের নতুন প্রযুক্তির মাইক্রো-আর্কিটেক্সচার। এতে সিপিইউ ও গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট তথা জিপিইউ একই সাথে একই প্লাটফর্মে কাজ করবে। অর্থাৎ গ্রাফিক্সের জন্য আলাদা কোনো হার্ডওয়্যার দরকার হবে না। এ ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর চিপ নির্মাণের পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে বিশ্বখ্যাত গ্রাফিক্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এটিআই ও এএমডি’র যৌথ প্রয়াস। প্রতিষ্ঠান দু’টি একীভূত হওয়ার পর ‘ফিউশন’ কোড-নামে যে উদ্যোগ নেয়া হয় তারই ফসল হচ্ছে বুলডোজার। আর ‘ফিউশন’-এর অধীনে যেসব চিপ নির্মিত হবে সেগুলো সিপিইউ ও জিপিইউসমৃদ্ধ। এছাড়াও ইন্টেল প্রসেসরে বর্তমানে যেসব নির্দেশনা নিতে পারে এগুলোর পাশাপাশি নতুন AVX-সহ XOP ও FMA4 অন্তর্ভূক্ত থাকবে বলে জানা যায়।
কখনও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে, বাজারে নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখতে এবং নিজেদের অবস্থানকে অন্যদের তুলনায় অধিকতর সুদৃঢ় করতে এএমডি সবসময় নতুন প্রযুক্তিসমৃদ্ধ মাইক্রোপ্রসেসর বাজারে এনেছে। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত এএমডি’র Annual Analyst Day-তে দেয়া তথ্য অনুসারে জানা যায়, Orochi পরিবারের অন্তর্ভুক্ত জাম্বোজি নামের ডেস্কটপ কমপিউটারে ব্যবহারের উপযোগী বুলডোজার প্রসেসরে থাকছে এক্স৮৬ প্রসেসিং ইঞ্জিন দু’টি ১২৮-বিটের এফএমএসি ফ্লোটিং পয়েন্ট ইউনিটস (গাণিতিকবিষয়ক) এবং এটি ৩৬৪-বিটের এভিএক্স (নির্দেশনাবিষয়ক) সমৃদ্ধ। এর আরো বিশেষ সুবিধাগুলো হচ্ছে এর Extensive New Power Management Innovations ফিচার, এর ফলে কম বিদ্যুতে বেশি সময় চলতে সক্ষম।
জানুয়ারি ৩-৬ তারিখ অনুষ্ঠিত সিএএস ২০১১ এএমডি’র ফিউশনের অধীনে নোটবুকের উপযোগী ববকাট প্রসেসর প্রদর্শন করা হয়। এসময় ববকাট মাইক্রো-আর্কিটেক্সচারের বেশ কয়েটি ল্যাপটপ প্রদর্শন করা হয়। এসব চিপ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা থেকে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এএমডি কম বিদ্যুতে চলতে সক্ষম।
এক্স-বিট ল্যাবের তথ্য অনুসারে জানা যায়, গত ডিসেম্বরে বুলডোজারের জাম্বোজি চিপের নমুনা এএমডি’র সহযোগীদের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় এবং যার চূড়ান্ত ফলাফল জানানো হবে ফেব্রুয়ারিতে। আশা করা হচ্ছে প্রত্যাশিত ৬ কোর ও কোয়াড কোর চিপ বাজারে আশার সম্ভাবনা রয়েছে এপ্রিল ২০১১-এ। উল্লেখ্য, বুলডোজার জাম্বোজির প্রথম মাইক্রো-প্রসেসর হবে ৮ কোর বিশিষ্ট। ৯৫-১২৫ ওয়াটের চলতে উপযোগী এই চিপে থাকবে ৮ মে.বা. লেভেল থ্রি ক্যাশ। এছাড়া কোম্পানির পরিকল্পনা অনুসারে ৬ কোরের প্রসেসরে ৮ মে.বা. এবং ৪ কোরে থাকবে ৪ মে.বা. ক্যাশ।
৮ কোরের জাম্বেজি ও অরচি চিপে থাকবে ডুয়াল-কোর বুলডোজার মডিউল। এর ২ মে.বা. শেয়ার লেভেল টু ক্যাশ ৮ মে.বা. লেভেল থ্রি ক্যাশে বিভক্ত হয়ে কাজ করতে সক্ষম। সুতরাং সব মিলিয়ে এর ক্যাশ মেমরির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৬ মে.বা. যা তুলনামূলকভাবে বর্তমান ৬ কোর মাইক্রো-প্রসেসরের ৭৭ ভাগ বেশি শক্তিসম্পন্ন।
বুলডোজার মাইক্রো-আর্কিটেক্সচার নিয়ে এএমডি’র পরিকল্পনা অনেক বড় ও দীর্ঘমেয়াদি। যদিও এর প্রথম ভার্সন এখনো বাজারে আসেনি, তবুও এর মানোন্নয়নের দিকে নজর দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১২ সাল নাগাদ ২০ কোরের চিপ বাজারে আনার মহাপরিকল্পনা রয়েছে। প্রযুক্তিগত গঠনের দিক থেকে এতটাই উন্নত যা কম শক্তি খরচে অধিক কাজ করার ক্ষমতা রাখে চিপটি। এই প্রযুক্তিকে পুঁজি করে দ্বিতীয় বৃহত্তর চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যানহ্যান্সড বুলডোজার মাইক্রো-আর্কিটেক্সচার এবং ২০১৩ সাল নাগাদ পরবর্তী প্রজন্মের বুলডোজার প্রসেসর বাজারে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
Terramar মূলত বুলডোজার মাইক্রো-আর্কিটেক্সচারের সার্ভারভিত্তিক প্রসেসরের কোড-নাম। ডুয়াল-সকেট ও কোয়াড-সকেট সার্ভারে ব্যবহার উপযোগী এক্স৮৬-এর দুটি Sepang চিপে থাকবে ২০টি কোর যা ৩২এনএম silicon-on-insulator টেকনোলোজিসমৃদ্ধ।
সিপিইউ ও জিপিইউ সমন্বয়ে গঠিত ফিউশন প্রযুক্তির এই প্রসেসর বাজারে ছাড়ার মধ্য দিয়ে নববই দশকে চেয়েও অধিক সাড়া পাওয়ার প্রত্যাশা করছে এএমডি। শুধু তাই নয়, নতুন প্রযুক্তির এই প্রসেসরের উপযোগী বিভিন্ন সফটওয়্যারও তৈরি করার জন্য সফটওয়্যার ডেভেলপাররাও কাজ করছে বিরামহীনভাবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : animesh@letbd.com