বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই উপমহাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট হলেও এ খেলাকে অধিকতর আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী করার জন্য কী ধরনের টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা অনেকেই রাখেন না। এ সত্য উপলব্ধিতে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১ অনুষ্ঠিতব্য আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে কি ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে তা তুলে ধরা হয়েছে এবারের দ্বিতীয় প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে। লিখেছেন মইন উদ্দীন মাহ্মুদ।
ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রজনের খেলা। সমালোচকেরা বলেন অলস লোকের খেলা। তবে যে যা-ই বলুন, ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। ক্রিকেট কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি চীনের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এসব দেশের সরকার ও ক্রীড়া সংগঠনগুলো ক্রিকেটের প্রতি সবার আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্টের আয়োজনও বাড়ছে ব্যাপকভাবে। যেমন : অ্যাশেজ, আইসিসি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং আইপিএল। আর এসব ক্রিকেট টুর্নামেন্টকে আকর্ষণীয় ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য যেমনি উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি, তেমনি এর সফল প্রয়োগ ক্রিকেট খেলাকে দিচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। শুধু তাই নয়, ক্রিকেট খেলা এখন হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিনির্ভর খেলা। প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে ক্রিকেট খেলার পণ্যসহ দর্শকদের জন্য প্রতিটি অংশেই রয়েছে প্রযুক্তির প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। আর তাই ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১ অনুষ্ঠিতব্য আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে কী ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে, তারই ওপর আলোকপাত করে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে।
সময়ের বিবর্তন ধারায় ক্রিকেট খেলায়ও পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে বেশ কিছু নিয়ম-কানুনেও। এটি একটি টেকনিক্যাল গেম। তাই ক্রিকেট খেলায় বেশ কিছু নিয়ম-কানুন মাথায় রাখতে হয়। মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব তথা বহুল আলোচিত এমসিসি একটি প্রাইভেট ইংলিশ ক্রিকেট ক্লাব। এ ক্লাবই ক্রিকেট খেলার জন্য প্রথম বারের মতো কিছু নিয়ম-কানুন তৈরি করে, যা ‘laws of cricket’ নামে পরিচিত। এর প্রবর্তিত নিয়ম-কানুন ক্রিকেটকে একটা সাধারণ রীতিনীতিতে নিয়ে আসে এবং ক্রিকেট খেলাকে সবার কাছে স্বচ্ছ বা পক্ষপাতহীন করে। এতে রয়েছে আম্পায়ার স্ট্যান্ডার্ড, পিচ, গ্রাউন্ডের অবস্থা, খেলার স্বচ্ছতাসহ ৪২ সেট আইন, যা গেমের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আওতাভুক্ত করে।
ক্রীড়ামোদিদের কাছে এখন ফুটবলের পরই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো ক্রিকেট। তবে এ উপমহাদেশ বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতা তথা আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে একবার করে চাম্পিয়ন হওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে ক্রিকেট উন্মাদনা আরো অনেক বেড়ে গেছে। সেই সূত্রে এ অঞ্চলে ক্রিকেট এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় এক খেলায় পরিণত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পর বাংলাদেশেও ক্রিকেট উন্মাদনা অনেক গুণে বেড়ে গেছে। দিন দিন এর কলেবর বাড়ছে। বাড়ছে সাফল্য, ক্রীড়ানৈপুণ্য আর রেকর্ড।
এ উপমহাদেশের কোণায় কোণায় রয়েছে ক্রিকেটপাগল সমর্থক। আর এ কারণেই ব্রডকাস্টারদের পরামর্শ অনুসারে ‘আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১১’ যৌথভাবে আয়োজন করার সম্মানজনক সুযোগ পায় বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা। এবারের আয়োজন হচ্ছে আইসিসির এ ধরনের দশম আয়োজন। ইতঃপূর্বে আইসিসি সফলভাবে আয়োজন করে নয়টি প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া সর্বোচ্চ চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়।
ক্রিকেটে প্রযুক্তির ছোঁয়া
ক্রিকেট খেলাকে আকর্ষণীয় ও বিতর্কাতীত করতে কয়েক বছর ধরে আইসিসি বেশ কিছু টেকনোলজি সম্পৃক্ত করেছে। এসব টেকনোলজির মধ্যে কিছু যন্ত্রপাতি রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে দর্শকেরা পান খেলা দেখার অধিকতর অভিজ্ঞতা। চমৎকার ডেলিভারি হওয়া বলের বা এলবিডব্লিউ আবেদনের বা দুর্দান্ত কোনো বিশেষ মুহূর্তের ক্লোজ লুকের সুযোগ এনে দেয় এ প্রযুক্তি, যা থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা রাখে। এর ফলে সিদ্ধান্ত যেমনি সঠিক হয়, তেমনি খেলায় প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে।
থার্ড আম্পায়ার/টেলিভিশন রিপ্লে
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে অনেক জটিল বা ক্লোজ সিদ্ধান্ত নিতে হয় থার্ড আম্পায়ারে রেফার করার পর। থার্ড আম্পায়ারের আবেদন বা সিদ্ধান্ত তখনই দরকার হয়, যখন মাঠের দুই আম্পায়ার যৌথভাবে কোনো নির্ভুল সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একমত বা নিশ্চিত হতে না পারেন, তখনই আম্পায়াররা থার্ড আম্পায়ারের জন্য আবেদন করেন। থার্ড আম্পায়ার ব্যবহার করেন টিভি রিপ্লে সিস্টেম।
গত কয়েক বছর ধরে সমর্থক ও অ্যানালিস্টদের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষার কারণে থার্ড আম্পায়ারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। ইদানীং থার্ড আম্পায়ার যেসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন সেগুলো হলো : স্ট্যাম্পিং, রান আউট, বাউন্ডারি বা ক্যাচ। এসব ক্ষেত্রে জটিল সিদ্ধান্তের জন্য ভিডিওর নির্দিষ্ট কোনো অংশ জুম করে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে ফোকাস করা হয়। এক্ষেত্রে কখনো কখনো মাল্টিপল ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ব্যবহার হয়। শুধু তাই নয়, ফিল্ডের বাইরে আম্পায়ার অন্যান্য আম্পায়ারের সাথে ওয়্যারলেস টেকনোলজির মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেন। থার্ড আম্পায়ার কখনো কখনো অন্যান্য আম্পায়ারের সাথে আলোচনা করেই রান আউটের সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন।
ক্রিকেটে এই টেকনোলজির সফল প্রয়োগ দেখে ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় ও দর্শক-সমর্থকদের কাছে আরো স্পষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী করার লক্ষ্যে নতুন কিছু টেকনোলজির আবির্ভাব ঘটে। এসব টেকনোলজির অনেকই এখন টেলিভিশন ক্রিকেট কাভারেজের কমন প্লেসে পরিণত হয়েছে, যা এই খেলাকে বুঝতে সহজ করেছে।
আল্ট্রা স্লোমোশন ক্যামেরা
সম্প্রতি আইপিএল সিরিজে ব্যবহার হতে দেখা গেছে আরো স্পষ্ট ও নির্ভুল স্লোমোশন টেকনোলজি, যাকে ‘আল্ট্রা স্লোমোশন’ রিপ্লে বলে। আমরা জানি, স্বাভাবিক স্লোমোশন ক্লিপ সাধারণত প্রদর্শিত হয় স্বতন্ত্র ফ্রেম হিসেবে, যা ভিডিও থেকে বের করে নেয়া হয়। তারপরও অতি সূক্ষ্ম টুকরা ক্যাপচার করতে ব্যর্থ হয় এই ফ্রেম। ফলে অতি সূক্ষ্মভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কখনো কখনো জটিলতা দেখার সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের ক্ষেত্রে আল্ট্রা স্লোমোশন রিপ্লে ক্রিকেট খেলায় দিতে পারে অধিকতর ডিটেইল ক্যাপচার। এই টেকনোলজি ব্যবহার করে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা, যা ক্যাপচার করে উচ্চতর ফ্রেম রেটে ভিডিও। এর ফলে রিপ্লে হয় আরো ধীরে এবং শনাক্ত করতে পারে মুহূর্তের নড়াচড়াকে।
সিমুল ক্যাম
সিমুল ক্যাম তথা সিমুলেটর ক্যামেরা টুল ব্যবহার করা হয় দুই খেলোয়াড়ের চলাচলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের উদ্দেশ্যে। এটি একটি চমৎকার টুল দুই খেলোয়াড়ের স্টাইলের পারফরমেন্সের পার্থক্য নিরূপণের ক্ষেত্রে। এই টুলের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অনুরূপ খেলোয়াড়েরা পারফরমেন্স সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে পারবে এবং নিতে পারবে কার্যকর পদক্ষেপ।
ডার্টফিশ প্রো
ডার্টফিশ এক বিস্ময়কর টুল। এটি তৈরি করে বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ, যা ইতোপূর্বে শোভা পেত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রশিক্ষণ ও তৃণমূল পর্যায়ে। ডার্টফিশ অ্যাপ্লিকেশন হলো একটি প্রয়োজনীয় ভিডিও অ্যানালাইসিস টুল, যার রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফিচার। যেমন- ভিজ্যুয়াল ফিডব্যাক, কৌশলগত পারফরমেন্সের অ্যানালাইসিস এবং প্রশিক্ষক, খেলোয়াড় ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক সমন্বিত ভিউ।
এ অ্যাপ্লিকেশন প্রত্যেক ইন্টারনেট চ্যানেলকে কানেক্ট করে এবং ভিডিও আপলোড করে। একে বলা হয় ডার্টফিশডটটিভি। এটি ভিডিওকে বিভিন্ন ফরমেটে রেকর্ড করা হয়। এতে সম্পৃক্ত থাকে এইচডি টিভি, সরাসরি গেম রেকর্ড করার জন্য টিভি টিউনার কার্ড থেকে নিচুমানের ভিডিও ফুটেজ এবং ক্যামেরা। ভিডিও রেকর্ড হবার পর তা বিভিন্ন অ্যানালাইটিক টুলে রান করে ডেলিভারির প্রকৃতি চেক করে দেখা যায়।
স্ট্রোমোশন
এই টেকনোলজি অনেকটা সিমুল ক্যামেরার মতো সুপার ইম্পোজ করা ভিডিওর মাধ্যমে খেলোয়াড়ের খেলার স্টাইল এবং গঠনের মধ্যে পার্থক্য যাচাই করে দেখে। স্ট্রোমোশন টেকনোলজি তৈরি করে বিস্ময়কর ট্র্যাজেক্টরি ভিডিও ফুটেজ, যা প্রকাশ করে খেলোয়াড়ের মুভমেন্ট। এটি গঠন করে ফ্রেম-বাই-ফ্রেম সিকোয়েন্স, যা ভিউ করা যায় এক সিরিজ ইমেজ হিসেবে। এ টেকনোলজির ভিডিওগুলো এমনভাবে কাজ করে যে, মনে হবে এটি ইমেজের কালেকশন, যা খেলোয়াড়ের ট্র্যাজেক্টরি বোঝার জন্য ইমেজগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজানো হয়েছে। এটি খেলোয়াড়ের পারফরমেন্স অ্যানালাইসিস করার জন্য কার্যকর ও সহায়ক প্রযুক্তি।
স্নিক-ও-মিটার
স্নিক-ও-মিটার (Snick-o-Meter) হলো একটি খুবই সংবেদনশীল মাইক্রোফোন, যা কোনো একটি স্ট্যাম্পে সেট করা থাকে। একে স্নিকোমিটারও (Snickometer) বলা হয়। যখন বল ব্যাটের প্রান্ত মৃদুভাবে ছুঁয়ে অতিক্রম করে যায়, যা সাধারণত বোঝা যায় না সেই শব্দ ধারণ করে এই স্নিকোমিটার। বল সত্যিকার অর্থে ব্যাটে আঘাত করেছে কি না, সে সম্পর্কে তথ্য টেলিভিশনের দর্শকদের সামনে তুলে ধরতেই এই টেকনোলজি ব্যবহার হয়।
স্নিকোমিটার প্রথম আবিষ্কার করেন ইংলিশ কমপিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান প্লাস্কেট (Allan Plaskett) ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। স্নিকোমিটার টেকনোলজি প্রথম ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ৪।
মেথড :
স্নিকোমিটার গঠন করা হয় খুবই সংবেদনশীল মাইক্রোফোন দিয়ে, যা কোনো এক স্ট্যাম্পে থাকে। এটি যুক্ত থাকে ওসিলস্কোপ (oscilloscope)-এর সাথে, যা শব্দতরঙ্গ পরিমাপ করে থাকে। যখন বল ব্যাটকে খাঁজ কেটে (nick) যায়, তখন ওসিলিস্কোপ শব্দ খুঁজে নেয়। একই সাথে উচ্চগতির ক্যামেরা ব্যাট অতিক্রম করে যাওয়া বলের রেকর্ড রাখে। ওসিলস্কোপ ট্রেস এরপর স্লোমোশন ভিডিও মাধ্যমে ব্যাট অতিক্রম করে যাওয়া বলের ভিডিও পাশে দেখাবে। সাউন্ড ওয়েবের আকার বা ধরন দেখে বুঝতে পারবেন উদ্ভূত শব্দটি বা নয়েজটি ব্যাটে বলের সংঘর্ষের কারণে হয়েছে কি না বা অন্য কোনো বস্ত্ত থেকে এসেছে।
ব্যবহার :
এই টেকনোলজি ব্যবহার হয় টেলিভাইজড ক্রিকেট ম্যাচে, যাতে বল ব্যাট অতিক্রম করে যাওয়ার সময় গ্রাফিক্যালি ভিডিও প্রদর্শন করে এবং একই সময় একই সাথে অডিও সাউন্ডও শোনা যায়। এটি মূলত ব্যবহার হয় টেলিভিশন দর্শকদের জন্য, যাতে তারা বুঝতে পারে বা তথ্য পায় যে সত্যিকার অর্থে ব্যাটে বলে সংঘর্ষ হয়েছে কি না। আম্পায়ার স্নিকো (snicko) দেখার সুযোগ পান না।
বল ব্যাট অতিক্রম করে যাওয়ার সময় অন্য কোনো ধরনের নয়েজও হতে পারে, যা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। খেলার সময়মাঝে মধ্যেই ব্যাট প্যাডকে হিট করতে পারে এবং বল ব্যাটকে অতিক্রম করার সময় সৃষ্টি করতে পারে শব্দ। সাউন্ড/সাউন্ড ওয়েব ব্যাট-প্যাড এবং ব্যাট-বল থেকে ভিন্ন, তবে এটি সবসময় স্পষ্ট নয়। রেকর্ড করা সাউন্ড ওয়েবের আকার তথা গ্রাফই শনাক্ত করার চাবিকাঠি।
হক-আই ডিআরএস
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পরিচালনা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বকাপ ২০১১-এ ডিসিশন রিভিউই সিস্টেম (DRS) হক-আইভিত্তিক টেকনোলজি এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সব খেলায় থাকবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ আরো জানিয়েছে, এই বিশ্বকাপে ডিআরএস-এর অংশ হিসেবে হটস্পটও ব্যবহার করা হবে দুটি সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সব ম্যাচেই থাকবে ডিআরএস টেকনোলজি, যা হবে ভার্চুয়াল টেকনোলজিভিত্তিক। এগুলো হলো ভার্চুয়াল আই (Virtual Eye) এবং হক-আইভিত্তিক।
হক-আই :
হক-আই (Hark-Eye) হলো একটি কমপিউটার সিস্টেম, যা বলের রিজেক্টরিকে অনুসরণ করে এবং তথ্যের নির্ভুলতা দাবি করে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মেশিনে পাঠায়।
পদ্ধতি :
হক-আই ব্যবহার করে ছয় বা তারও বেশি কমপিউটার লিঙ্ক টেলিভিশন ক্যামেরা, যেগুলো ক্রিকেট খেলার মাঠের চারদিকে বসানো থাকে। এই কমপিউটারগুলো রিয়েল-টাইম ভিডিও রিড করে এবং প্রতি ক্যামেরায় ক্রিকেট বলের পথ ট্র্যাক করা হয়। ক্রিকেট মাঠে সেট করা ন্যূনতম এই ছয়টি আলাদা ক্যামেরার ভিউ একত্রিত করা হয় বলের গতিপথের যথার্থ ও নির্ভুল ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনের জন্য।
ইতিহাস :
হক-আই সিস্টেম প্রথম চালু হয় ২০০১ সালে। এটি প্রথম ব্যবহার হয় ক্রিকেট খেলার টেলিভিশন কাভারেজে।
ব্যবহার :
লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ২০০১ সালে পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচে কমপিউটার সিস্টেম হক-আই সিস্টেম ব্যবহার হয় চ্যানেল ৪-এর টিভি কাভারেজের জন্য। এরপর থেকেই বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকারদের জন্য এই টুল অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। প্রাথমিকভাবে বেশিরভাগ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক উড়ন্ত বলের ট্র্যাজেক্টরি ট্র্যাক করার জন্য এবং এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্তের জন্য অ্যানালাইজ করতে এটি ব্যবহার করে। বর্তমানে প্রতিটি বল ট্র্যাক করা হয় হক-আই সিস্টেমের মাধ্যমে, যা ব্রডকাস্টারদের গেমের অন্যান্য ফিচার সম্পৃক্ত করার সুযোগ করে দেয়। যেমন- বলের স্পিড, স্পিন, সুইং, লাইন এবং লেংথ।
হক-আই সিস্টেম ব্যবহারে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। কেননা, এটি ম্যাচের প্রতিটি ডেলিভারি হওয়া বলের রিডিংয়ের আর্কাইভ মেইনটেইন করে। এটি খেলোয়াড় ও সমর্থকদের বোলিং পারফরমেন্স এবং পিচের ধরন-প্রকৃতি বিচারকার্যে সহায়তা করে। হক-আই টুলটি ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য টেকনোলজি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
হট-স্পট
আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১১-এ আম্পায়ার ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম (UDRS) ব্যবহার করতে উদগ্রীব। তবে এই টুর্নামেন্টে নির্ভুলতার জন্য খেলোয়াড়দের কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় টেকনোলজি হলো হট-স্পট। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এর ব্যবহার দুটি সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল ম্যাচ ছাড়া দেখা যাবে না। চমৎকার এই টেকনোলজি হট স্পট বিশ্বকাপ ২০১১-এ না দেখার কারণ হলো, হট-স্পটের জন্য ব্যবহার হওয়া ক্যামেরার অপ্রতুলতা, এই টেকনোলজি সংগ্রহ ও ব্যবহার করা খুবই ব্যয়বহুল, এই ইক্যুইপমেন্ট অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রকৃতির। হট-স্পট প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান BBG Sports-এর স্বত্বাধিকারী ওয়ারেন ব্রেননান ক্রিকইনফো-কে ই-মেইল বার্তায় জানান, ‘বর্তমানে আমাদের কাছে মাত্র চারটি হট-স্পট ক্যামেরা আছে, যার কারণে শুধু কোয়ার্টার ফাইনাল এবং তার পরবর্তী ম্যাচগুলোর জন্য সরবরাহ করা যাবে।
ওয়ারেন ব্রেননান আরো জানান, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ক্যামেরা দরকার। বাড়তি আরো ৮-১০টি হট-স্পট ক্যামেরার জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে স্থাপন করা দরকার। ক্যামেরা তৈরি করতে ছয় মাস সময় লাগতে পারে। সারাবিশ্বে মাত্র ৪-৫টি কোম্পানি হট-স্পট তৈরি করতে পারে।
বিবিজি কোম্পানি চায় নতুন আরেকটি হট-স্পট ক্যামেরা কিনতে, তবে ক্যামেরা কিনলেই তো হবে না। ক্যামেরাগুলো প্রথমেই মিলিটারি সিকিউরিটিতে চেক করার জন্য পাঠাতে হয়। কেননা, এ ধরনের ক্যামেরা মিলিটারি ইক্যুইপমেন্ট হিসেবে মূলত বেশি ব্যবহার হয়। সিকিউরিটি চেকের জন্য তিন মাসের বেশি সময় লাগতে পারে। কারণ, এই ক্যামেরাগুলো মিলিটারি ইক্যুইপমেন্ট হিসেবে ব্যবহার হওয়া সিকিউরিটিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রসেস সম্পন্ন করতে হয়। হট-স্পটে ইনফ্রারেড ইমেজিং টেকনোলজি ব্যবহার করা হয় বল ব্যাটে বা প্যাডে লেগেছে কি না, তা নির্দিষ্ট করার জন্য। বর্তমানে দুই ক্যামেরা সেটআপ করতে খরচ হয় প্রতিদিন ৬০০০ ইউএস ডলার এবং চার ক্যামেরা সেটআপের জন্য খরচ হয় প্রতিদিন ১০ হাজার ইউএস ডলার।
হট-স্পটের অনুপস্থিতি মানে এই নয় যে, আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১১-এ ইউডিআরএস-এর ব্যবহার সম্ভাবনা কম। রেফারেল সিস্টেমের জন্য আইসিসি, ন্যূনতম দরকার বল ট্র্যাকিং সিস্টেম তথা হক-আই, সুপার স্লোমোশন ক্যামেরা এবং স্ট্যাম্প মাইক্রোফোন থেকে স্পষ্ট অডিও ফিড (যা নিয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে)। হট-স্পট প্রত্যাশা করা হয়, তবে আইসিসির মতে এটি অত্যাবশ্যকীয় নয়। শীর্ষস্থানীয় এবং জগৎখ্যাত খেলোয়াড় যেমন- শচীন টেন্ডুলকর তার ৫০তম টেস্ট সেঞ্চুরি করার পর বলেন, ‘আমি রেফারেল সিস্টেম (ইউডিআরএস) পুরোপুরি মেনে নিতে পারছি না। তিনি আরো বলেন, হট-স্পট অনেক ভালো।
দেখা যাক হট-স্পটে কী আছে?
হট-স্পট হলো টেলিভিশন উদ্ভাবন, যা চ্যানেল নাইন ২০০৬-০৭ সালে অ্যাশেজ ম্যাচে সর্বপ্রথম ব্যবহার করে। এতে ব্যবহার হয় ইনফ্রারেড ক্যামেরা টেকনোলজি। এটি মূলত ব্যবহার করা হয় বল ডেলিভারির সময় ব্যাটসম্যানের সংযোগ হয়েছে কি না তা নির্দিষ্ট করার জন্য। যদি হয়ে থাকে তাহলে তার ব্যাটের বা শরীরের কোন অংশের সাথে সংযোগ ঘটেছে তা নিরূপণ করা। লক্ষণীয়, হট-স্পট টেকনোলজি শুধু ক্রিকেটেই ব্যবহার হয়।
যেভাবে কাজ করে :
দুটি শক্তিশালী থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা খেলার মাঠের ওপর বোলারের বাহুর পেছনে মাঠের যেকোনো শেষপ্রান্তে রাখা হয়। এটি দূর থেকে বুঝতে পারে এবং ক্রিকেট বলের সাথে অন্য কোনো বস্ত্তর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট তাপ পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিমাপ করতে পারে। কমপিউটার টেকনোলজি তারপর জেনারেট করে এক নেগেটিভ ইমেজ, যেখানে দেখা যায় কোন পয়েন্টে সংঘর্ষ হয়েছিল তা লাল বৈসাদৃশ্য তথা হট-স্পট আকারে। হট-স্পট শুধু বল ও অন্য অবজেক্টের সংঘর্ষ রেকর্ড করে না, বরং ব্যাট-প্যাড বা গ্রাউন্ডকে আঘাত করেছে কিনা তাও রেকর্ড করতে পারে।
ক্রিকেটে প্রযুক্তির ছোঁয়া : ইতিহাসের আলোকে
১৯৩৮ :
ইংল্যান্ডের লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে অ্যাশেজ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট খেলা বিশ্বে প্রথমবারের মতো বিবিসি সরাসরি টিভির মাধ্যমে সম্প্রচার করে অর্থাৎ ক্রিকেটে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগে, যা দর্শকেরা সরাসরি দেখতে পায়।
১৯৯০ :
মিডল স্ট্যাম্পে ‘স্ট্যাম্প ভিশন’ নামের এক ধরনের ক্যামেরা বসানো হয়। এরপর থেকেই ক্রিকেটের প্রতিটি টেস্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে উইকেটে ক্যামেরা সেট করা থাকে।
১৯৯২ :
দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত টেস্ট সিরিজে থার্ড আম্পায়ারের প্রচলন শুরু হয়। যেখানে এ প্রযুক্তির সহায়তায় শচীন টেন্ডুলকর হলেন প্রথম ব্যাটসম্যান, যিনি রান আউট হন।
১৯৯৯ :
যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ৪ টেলিভিশনের সৌজন্যে স্নিকোমিটারের আবির্ভাব।
২০০১ :
ইংল্যান্ডের লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচে আত্মপ্রকাশ ঘটে হক-আই (Hawk-Eye) টেকনোলজির।
২০০২ :
শ্রীলঙ্কা বনাম পাকিস্তানের মধ্যকার অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ম্যাচে প্রথমবারের মতো ‘টিভি রিপ্লে সিস্টেম টেকনোলজি’ ব্যবহার করে প্রথম এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রথম শিকার শোয়েব মালিক।
২০০৩ :
বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণের জন্য আইসিসি কমপিউটারাইজড ডাকওয়ার্থ লুইস ক্যালকুলেটরের সহায়তা নেয়।
২০০৫ :
মার্লিন নামে বিশেষ ধরনের বোলিং মেশিন ব্যবহার করা হয় ২০০৫ সালে। একজন খেলোয়াড়কে বিভিন্ন ধরনের বা স্টাইলের বল ডেলিভারি করতে সক্ষম করে তোলার প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড অ্যাশেজ সিরিজের আগে এটি চালু করা হয়।
২০০৬ :
অবলোহিত আলোভিত্তিক ছবি তোলার ব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়, এর মূল উদ্দেশ্য ব্যাটসম্যানকে এড়িয়ে ব্যাট বা প্যাডে বল আঘাত করেছে কি না, তা স্পষ্ট করে তুলে ধরা। এই টেকনোলজি হট-স্পট হিসেবে পরিচিত। এ প্রযুক্তি প্রথম চালু করে অস্ট্রেলিয়ান নাইন নেটওয়ার্ক। হট-স্পট প্রযুক্তির প্রথম ব্যবহার হয় ২০০৬ সালের অ্যাশেজ টেস্টে।
শেষ কথা
এটা সত্য, বেশিরভাগ ক্রিকেটপ্রেমী যুক্তি দেখাবেন যে, আরাম করে টিভির সামনে বসে খেলা দেখার চেয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখা অনেক আনন্দ ও উপভোগ্য। তবে এটি সর্বোতভাবে সত্য নয়। আধুনিক প্রযুক্তি এ ধারণা পাল্টে দিয়েছে। কেননা, ক্রিকেট মাঠের প্রত্যেক প্রান্তের শেষে সেট করা থাকে ন্যূনতম ১৬টি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা, যা সম্ভাব্য সব প্রান্তের ছবি ক্যাপচার করতে থাকে। এই ক্যামেরাগুলো শুধু টেলিভিশন ব্রডকাস্টকে সমৃদ্ধ করেছে তাই নয়, বরং গ্রাফিক্যাল টেকনোলজি যেমন হক-আই-এর সোর্স হিসেবেও কাজ করছে। এই টেকনোলজি থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। এর ফলে ক্রিকেট খেলা থাকছে বিতর্কাতীত। এ ধরনের সুবিধা স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকেরা পাবেন না।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : mohmood_sw@yahoo.com