বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কমপিউটার সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি মেলা বেসিস সফট এক্সপো ২০১১-র নবমবারের মতো সফল সমাপ্তি হলো গত ৫ ফেব্রুয়ারি। মহান ভাষা আন্দোলন মাসের শুরুর দিন থেকে পঞ্চম দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কেন্দ্র মাতিয়ে রেখেছিল এই প্রদর্শনী। ডিজিটাল বাংলাদেশ ইন অ্যাকশন প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস তথা বেসিস আয়োজিত প্রদর্শনীতে ছিল নানারকম চমকপ্রদ প্রযুক্তি ও তারুণ্যের বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা। নানান মানুষের পদচারণায় প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জমজমাট ছিল প্রদর্শনী। মেলার প্রবেশ ফি ছিল ৩০ টাকা। তবে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে বেসিস ওয়েবসাইটে নাম নিবন্ধন করে এবং বিভিন্ন পেশাজীবীদের ভিজিটিং কার্ড প্রদর্শন করে মেলায় বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ ছিল। বেসিস সূত্রে জানা গেছে, এবারের মেলায় অন্যান্যবারের চেয়ে সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছে। মেলায় প্রায় ৫৪ হাজার দর্শনার্থী বিভিন্ন স্টল ও প্রজেক্ট পরিদর্শন করেছে। এছাড়া ২০টিরও বেশি বিভিন্ন সেমিনার ও টেকনিক্যাল সেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার প্রতিটিতে প্রায় ৬-৭শ’ বিভিন্ন পেশাজীবী, ছাত্র ও বিদেশী ডেলিগেট উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান :
সকাল ১১টায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, সব কার্যক্রমে দেশীয় সফটওয়্যারের প্রাধান্য থাকবে, দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ঘটানোর জন্য সরকার ও আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, সফটওয়্যার শিল্পের জন্য দেশীয় যে বাজার তৈরি দরকার সেটা ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে সফটওয়্যার শিল্পের ভবিষ্যৎ আরো মঙ্গল হবে এবং এ লক্ষ্যে তহবিল গঠনের কাজও চলছে বলে তিনি জানান। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বলেন, সফটওয়্যার খাতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে আমাদের রফতানি আয় ছিল সাড়ে ৩ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। তিনি আরো বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাত একদিন গার্মেন্টস খাতের মতো বিলিয়ন ডলারের খাতে পরিণত হবে, সেদিন আর বেশি দূরে নয়। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিকে অর্থপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনযাপনের ক্ষেত্র বদলানোর ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর। তিনি আরো বলেন, আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে বিক্ষিপ্তভাবে যে কাজগুলো হচ্ছে তা যদি সব একত্র করা হয়, তাহলে আমরা টেকনোলজির দুনিয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সরকার ব্যান্ডউইডথের দাম কমিয়েছে, যা আরো কমানো হবে। অনুষ্ঠানে বেসিস সভাপতি মাহবুর জামান বলেন, আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশের বয়স ২৫-এর নিচে। এই তরুণদের নিয়ে আমাদের জ্ঞানভিত্তিক শিল্প-অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তিনি আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য সরকারের কাছে ৭শ’ কোটি টাকার বিনিয়োগের অনুরোধ করেন।
এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সরকারের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের (এটুআই) প্রজেক্ট ডিরেক্টর নজরুল ইসলাম খান, বেসিসের সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রদর্শনীর আহবায়ক একেএম ফাহিম মাশরুর, বেসিস মহাসচিব ফোরকান বিন কাশেম, জিপি আইটির সিইও কাজী ইসলাম, বেসিস সহ-সভাপতি ফারহানা এ রহমান, মেলার সহ-আহবায়ক তামজিদ সিদ্দিকসহ বেসিস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তারা। বেসিস সফট এক্সপো ২০১১-এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছে প্লাটিনাম স্পন্সর গ্রামীণফোন আইটি, গোল্ড স্পন্সর রিভ সিস্টেমস, কো-স্পন্সর ব্র্যাক ব্যাংক, মাইক্রোসফট ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল। এছাড়া প্রদর্শনীর সহ-আয়োজক হিসেবে ছিল সরকারের বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম।
চমকপ্রদ আয়োজন :
বেসিস আয়োজিত এ মেলা আকার, আয়তন, বৈচিত্র্য ও উপস্থাপনার দিক থেকে অন্যান্য প্রদর্শনীকে ছাড়িয়ে গেছে। এ মেলায় দেশীয় ১১০টি, ইউরোপিয়ান ১০টি (ডেনিশ, ডাচ ও অন্যান্য) প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এর ফলে সফটওয়্যার শিল্পের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ সুগম হবে বলেও অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এবারই প্রথম দর্শনার্থী, অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীসহ সব মহলের সুবিধার জন্য প্রদর্শনীকে বিজনেস সফটওয়্যার, ই-কমার্স, ই-গভর্ননেন্স, কমিউনিকেশন্স, মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড এনিমেশন, মোবাইলফোন ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন এবং আউটসোর্সিং ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। মেলায় তরুণ প্রজন্মকে আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যও নেয়া হয়েছে নানা প্রতিযোগিতা। প্রদর্শনীর আহবায়ক একেএম ফাহিম মাশরুর জানান, এবারের মেলা সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে আমরা সাজানোর চেষ্টা করেছি। অন্যবারের তুলনায় এবার মেলার আয়োজনের ব্যাপকতাই অনেক বেশি। এবারেই মেলায় বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন- অনলাইনে বই কেনাবেচা থেকে শুরু করে টেনোলজিভিত্তিক জব ফেয়ারের ব্যবস্থা ছিল। এবারের মেলায় আইটি জব ফেরার অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ২০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান মেলায় চাকরিপ্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ ও সরাসরি মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করে। এবারের স্টলগুলোতে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং অফিস ম্যানেজমেন্ট, বিজনেজ ম্যানেজমেন্টের সফটওয়্যারের আধিক্য দেখা গেছে। এছাড়া ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফলাফল তৈরি, রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার, হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিকিউরিটি, ডাটা ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি সফটওয়্যারের প্রচুর অর্ডার পাওয়া গেছে। এবারকার মেলায় ই-কমার্সে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। ডেফোডিল কমপিউটার লিমিটেড ইনফো বাংলা নামের একটি সাইটের মাধ্যমে অনলাইনে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন জব সার্চ, অ্যাপ্লিকেশন, যেকোনো পণ্য কেনা, ইন্টারনেট মোবাইল কার্ড কেনা, দেশী-বিদেশী জার্নাল পত্রিকা পড়ার সুবিধা দিচ্ছে। ই-গভর্নেন্স স্টলে বাংলাদেশ সরকারের এটুআই প্রকল্প শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহারের কর্মসূচি, আইসিটি ইন এডুকেশন, গ্রামীণ মানুষের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (ইউনিয়ন ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার-ইউআইএসসি), ই-পুর্জি ব্যবস্থাসহ নানা ধরনের সেবা প্রদান বা প্রদর্শন করেছে। গ্রামীণফোন আইটি এবার মেলায় নিয়ে এসেছে ডাটা সেন্টার সলিউশনস, কলসেন্টার সফটওয়্যার, গ্রাহকসেবা ব্যবস্থাপনা, এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং ইত্যাদি। মেলায় অংশ নেয়া বাংলাদেশী মাল্টিন্যাশনাল সফটওয়্যার কোম্পানি রিভ সিস্টেমস ভিওআইপির নানা রকমের সফটওয়্যার প্রদর্শন করে। রিভ সিস্টেমেসের বিক্রয় প্রধান শাহিনুর রহমান বলেন, রিভ সিস্টেমস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের সেবা পৌঁছে দিচ্ছে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকায়। এছাড়া বাংলাদেশেরও অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান তাদের সফটওয়্যার ব্যবহার করছে।
শিক্ষা উন্নয়নে চ্যাম্পস টোয়েন্টি ওয়ান ডটকম নামের প্রতিষ্ঠান মেলায় এনেছে বিশ্বের প্রথম বাংলা ই-লার্নিং সার্ভিস। প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও পরীক্ষার মাধ্যমে বাচ্চাদের মেধা যাচাইয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়া মেলায় উল্লেখযোগ্য কিছু প্রতিষ্ঠান শিশুদের জন্য কার্টুন, এনিমেশন, শিক্ষা সফটওয়্যারসহ বিনোদনভিত্তিক অনেক সফটওয়্যার প্রদর্শন ও শিশুদের তা নামমাত্র মূল্যে সরবরাহ করেছে।
বাংলাদেশ ওপেনসোর্স নেটওয়ার্ক মেলায় প্রদর্শন করেছে উবুন্টুর সর্বশেষ সংস্করণ, উইকিপিডিয়াসহ বেশ কিছু মুক্ত সফটওয়্যার। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি মুক্ত সফটওয়্যার সম্পর্কে আগত দর্শনার্থীদেরকে বিভিন্ন পরামর্শও দিচ্ছে। অংকুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন মেলায় প্রদর্শন করেছে সম্পূর্ণ বাংলায় মুক্ত সফটওয়্যার ওপেন অফিস, ইন্টারনেট ব্যবহারের সফটওয়্যার ফায়ারফক্স, ভিএলসি মিডিয়া প্লেয়ারের একটি প্যাকেজ। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি এসব সফটওয়্যারের সাথে যোগ করেছে বাংলা বানান পরীক্ষক।
মেলায় অংশ নেয়া দক্ষিণ আফ্রিকার রেইনবো ইন্টারন্যাশনাল নামের টেলিকমিউনিকেশনস সার্ভিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রিমন্ড সিয়েরা বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সফটওয়্যার অনেক বেশি সস্তা ও কার্যকর। এছাড়া এদেশীয় প্রতিষ্ঠানের সততা ও আন্তরিকতার জন্য দেশটির আইটি শিল্প দ্রুত অগ্রসর হবে। তিনি জানান, তিনি বাংলাদেশের রিভ সিস্টেমসের সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া ডাচ প্রতিষ্ঠান অটোস অরিজিনের প্রজেক্ট ম্যানেজার উইলিয়াম বলেন, গার্টনারের রিপোর্ট দেখে আমরা প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের মতো এমন একটি দেশে নীরবে যে সফটওয়্যার বিপ্লব ঘটছে তা মেলায় অংশগ্রহণ না করলে অনুধাবন করতে পারতাম না। বেসিস সম্পর্কে তিনি বলেন, আইসিটি উন্নয়নে বেসিসের এই কর্মধারা যদি অব্যাহত থাকে, তবে বাংলাদেশ সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে যেকোনো দেশকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হবে।
জয় হোক তারুণ্যের :
এবারের মেলায় ছিল উল্লেখ করার মতো তারুণ্যের অংশগ্রহণ। মেলায় যেন তারুণ্যের নক্ষত্র নেমে এসেছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ও পড়ুয়া তরুণদের ভিড় ছিল প্রতিটি স্টলে। আবার অনেক তরুণই অংশগ্রহণ করেছে প্রতিটি সেমিনার ও টেকনিক্যাল সেশনে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্কিং বিষয়ে পড়ুয়া ছাত্র মো: আতিকুর রহমান মেলায় এসেছেন আউটসোর্সিং বিষয়ে বিস্তারিত জানতে। কি বিষয়ে আগ্রহ তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অনলাইনে আয়বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তার নজর কেড়েছে। ভবিষ্যতে তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার হতে চান। বেসিসের সভাপতি মাহবুর জামান বলেন, তরুণদের মধ্যে সুপ্ত মেধা খুঁজে বের করার জন্য আমরা কোড ওয়ারিয়র এবং আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে এমন তরুণদের জন্য ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড কমপিটিশন ‘আবিষ্কারের খোঁজে’ এর আয়োজন করেছি। আবিষ্কারের খোঁজে প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৬টি দল অংশগ্রহণ করে। এই প্রতিযোগিতার পাশাপাশি ছিল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা কোড ওয়ারিয়র। এছাড়া আমরা জানি গার্টনারের প্রতিবেদনের তালিকায় বাংলাদেশ ৩০টি দেশের মধ্যে একটি। আউটসোর্সিংকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তারা আয়োজন করেছিল বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড। এবারের মেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ তাদের প্রজেক্ট উপস্থাপন করেন। আহমেদ ইমাতিয়াজ নামের এক তরুণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ব্রেইল পদ্ধতির লেখার একটি উন্নত সংস্করণ বের করেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গাড়ি চুরি প্রতিরোধের উপায় আবিষ্কার করেছেন কাজী বজলুর রশিদ নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, সেলফোনের মাধ্যমে গাড়ি বন্ধ, চালু এবং এটিকে আবার গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমস হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। খুলনা তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী একটি রোবট তৈরি করেছে, যা রাস্তার যেকোনো অযাচিত প্রতিবন্ধকতা দূর করে রাস্তা পরিষ্কার রাখবে। তারুণ্যের এই অংশগ্রহণ মেলার সৌন্দর্যকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
প্রদর্শনীর যত সেমিনার :
পাঁচদিনের মেলায় প্রতিদিনই ছিল বিভিন্ন সেমিনার ও টেকনিক্যাল বিষয়ের ওপর আলোচনা ও পৃথক কর্মশালা। প্রায় ২০টির আইটিবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার ও টেকনিক্যাল সেকশন ছিল মেলাতে। সেমিনারগুলো মূলত তথ্যবিষয়ক উন্নয়ন শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, ই-কমার্স, ই-গভর্নেন্স, ফ্রি সফটওয়্যার ও আউটসোর্সিং নিয়ে। এছাড়া টেকনিক্যাল সেশনে ছিল ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামিং।
মেলার তৃতীয় দিন অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারি রিভ সিস্টেমস আয়োজন করে আউটসোর্সিং অপরচুনিটি ইন ভিওআইপি ইন্ডাস্ট্রিবিষয়ক সেমিনার। সেমিনারে বাংলাদেশের আইটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আইটি বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আইটি সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। অনুষ্ঠানে টেকনো হ্যাভেন কোম্পানি লিমিটেডের সিইও ও বেসিসের সদ্য বিদায়ী সভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, বিশ্বের ৩০ আউটসোর্সিং গন্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশ নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। টেলিকম খাতে বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি রয়েছে এবং এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মতো চমৎকার একটি পরিবেশ বাংলাদেশে আছে। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ওরেড সিস্টেমসের বিপণন পরিচালক সঞ্জিৎ চ্যাটার্জি। প্যানেল আলোচনায় ভারতীয় টাটা টেলিসার্ভিসের সাবেক সভাপতি সুকান্ত দে বলেন, বাংলাদেশের অনেক আইটি বিশেষজ্ঞ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আইটি ক্ষেত্রে তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছেন।
একই দিন বেসিস আয়োজিত বাংলাদেশ ইন টপ থার্টি আইটি আউটসোর্সিং ডেস্টিনেশনস ইন গার্টনার র্যাংআকিং অ্যাকশন প্ল্যান ফর ওয়ে ফরোয়ার্ড সেমিনারে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, শুধু হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার নয়, আমাদের নজর দিতে হবে হিউম্যানওয়্যারের দিকেও। তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস তারা যদি একযোগে কাজ করে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত আরো সমৃদ্ধ হবে। অনুষ্ঠানে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আগে সম্পদ বলতে ছিল তেল আর কয়লা। কিন্তু আমাদের আছে আইডিয়া আর সময়। দুটির মেলবন্ধনে তথ্যপ্রযুক্তিকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসিস সভাপতি মাহবুব জামান। এছাড়া সেমিনারে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমপিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জিয়াউল হাসান সিদ্দিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইটি বিশেষজ্ঞগণ।
মেলা চলাকালীন ইনফরমেশন টুবিএ সোর্স অব ইনকাম বা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে আয় শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে জাপানের কিয়োশু ইউনিভার্সিটি ও আইজিপিএফ। সেমিনারে জাইকার প্রধান প্রতিনিধি তাকাও তোদা বলেন, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে, তবেই বাংলাদেশ উন্নয়ন সিঁড়িতে পা দেবে। সেমিনারে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক নজরুল ইসলাম খান বলেন, প্রযুক্তিকে সংরক্ষণ না করে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। সেমিনারে মূলত কোথায় প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে এবং কিভাবে তার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় এসব বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিনে বেসিস ও অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) আয়োজিত সেমিনারে প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান তার বক্তব্যে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়াগুলো ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। এখন প্রয়োজন শুধু সাধারণ মানুষের প্রযুক্তিবিষয়ক সচেতনতা। অনুষ্ঠানে বেসিস সভাপতি মাহবুব জামান বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে আমরা হাঁটছি। সরকারও সহযোগিতা করছে। ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ে ওয়েবসাইট চালুসহ তৃণমূল পর্যায়েও সেবা চলে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন এটুআই প্রকল্প পরিচালক নজরুল ইসলাম খান।
উপরোক্ত সেমিনারগুলো ছাড়াও আরো প্রায় ১৬টি সেমিনার ও টেকনিক্যাল সেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের আইসিটি উন্নয়নের বিভিন্ন কৌশল, বাস্তবায়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গার্মেন্টস সেক্টরে আইটি বৈদেশিক সম্পর্ক, গ্লোবাল আইটি মার্কেট, আইটি সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে দেশী-বিদেশী আইটি বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সরব উপস্থিতি ছিল।
জমজমাট পুরস্কার রজনী :
৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মেলার চতুর্থ দিন অনুষ্ঠিত হয় জমকালো অ্যাওয়ার্ড নাইট। ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরিতে বেসিস পুরস্কার দেয় বিজয়ীদের। আউটসোর্সিংকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ফ্রিল্যান্সার পুরস্কার পায় মোট ১২ জন ৩টি ক্যাটাগরিতে। গ্রুপ ক্যাটাগরিতে বিজয়ীরা হলো- পিক্সেল নেট টেকনোলজিস, আলফা ডিজিটাল, সেন্টিনেল সলিউশনস লিমিটেড ও আলম সফট। ব্যক্তি পর্যায়ে বিজয়ীরা হলেন- মো: আল আমিন চৌধুরী, ফায়সাল ফারুক, এনায়েত হোসেন রাজিব ও মো: জাকারিয়া চৌধুরী। স্টুডেন্ট ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন- মো: সাবিবর হোসেন, শাওন ভূইয়া, আবদুল্লাহ আল জাহিদ ও মো: খায়রুল আলম।
আইটি ইনোভেশন সার্চের আওতায় আবিষ্কারের খোঁজে শীর্ষক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় এফএম মাহবুবুল ইসলাম এবং তার দলের তৈরি বাংলা টেক্সট টু ব্রেইল ট্রান্সলেশন সিস্টেম, প্রথম রানারআপ হয়েছে মোহাম্মদ রেজাউল করিমের তৈরি অপরেইন্ট কনটেন্ট ম্যানেজম্যান্ট ফ্রেমওয়ার্ক, দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছে শিবলী ইমতিয়াজের তৈরি ফাইন্ডার আলটিমেট প্রকল্প।
কোড ওয়ারিয়র প্রতিযোগিতায় জাভা, পিএইচপি ও ডটনেট শাখায় স্টুডেন্ট ও গ্রুপ ক্যাটাগরিতে ছয়জনকে পুরস্কৃত করা হয়।
উপরোক্ত পুরস্কার দেয়া ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর সম্মাননা পুরস্কার দেয়া হয় দ্য গ্রাফিক্স অ্যাসোসিয়েটস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক আহমেদ আশরাফুজ্জামান তুহিনকে। ই-কমার্স ও মোবাইল পেমেন্ট পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ডিজিটাল চ্যাম্পিয়নশিপ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিজয় বাংলা কীবোর্ডের প্রবক্তা মোস্তাফা জববারকে দেয়া হয় লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট। ডিজিটাল প্রকাশনায় বাংলাভাষা প্রবর্তনের জন্য তাকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বাংলাভাষাভিত্তিক ইউনিকোড প্রবর্তনের জন্য ‘অভ্র’কে দেয়া হয় স্পেশাল কন্ট্রিবিউশন অ্যাওয়ার্ড।
সমাপনী অনুষ্ঠান :
পাঁচদিনের তথ্যপ্রযুক্তির মিলনমেলা শেষ হয় গত ৫ ফেব্রুয়ারি। বেসিসের পরবর্তী সফট এক্সপো অনুষ্ঠিত হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২০১২ সালের ২৩ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি। ২০০৩ সাল থেকে বেসিস সফলতার সাথে আয়োজন করে আসছে এই আইসিটি মহাযজ্ঞ। যাতে করে আইসিটিবিশ্বে মাথা উঁচু করে দেশ ও জাতি দাঁড়াতে পারে, ছড়িয়ে দিতে পারে তারুণ্যের ক্ষুরধার মেধা- গার্টনারের প্রতিবেদন সেই ইঙ্গিতই বহন করে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : ferdovsbduaga77@yahoo.com