আমরা অনেক সময় মনে করি, শিশুরা হয়তো বড়দের কথা সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। কারণ বড়দের ব্যবহৃত অনেক শব্দের অর্থই তাদের জানা থাকে না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন অন্য কথা। তারা গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শিশুরা প্রায় সব কিছুই বুঝতে পারে। ভাষা প্রক্রিয়া তথা প্রসেসের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে শিশুদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটে। কথা বলতে শেখেনি এমন শিশুদের ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা বলতে চাইছেন, প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কে যেভাবে ভাষা প্রসেস হয়, শিশুদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। এই শিশুরা বড়দের ব্যবহৃত বহু শব্দ অর্থসহ বুঝতে পারে।
সান দিয়াগোয় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সর্বাধুনিক এমআরআই এবং এমইজি প্রযুক্তির যৌথ প্রয়োগ করে দেখেছেন, মাত্র এক বছর বয়সের ওপরের শিশুরাও যে শব্দটি বড়দের কাছ থেকে শোনে তা তাদের মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াজাত তথা প্রসেস হয় বড়দের মতো করেই। এই শব্দ প্রসেসের জন্য যে মস্তিষ্কের কাঠামো থাকা দরকার বড়দের এবং ছোটদের ক্ষেত্রে তা একই ধরনের হয়ে থাকে। শব্দ বা ভাষা প্রসেসের জন্য যে সময়টুকু মস্তিষ্কের দরকার হয় বড়দের এবং ছোটদের জন্য সে সময় অভিন্ন। অর্থাৎ বড়রা শব্দ বা ভাষা প্রসেস করতে যে সময় নেয়, শিশুদের ক্ষেত্রেও ঠিক একই সময় লাগে। অত্যাধুনিক কমপিউটার সফটওয়্যার গবেষকদের এ বিষয়ে গবেষণাকে দ্রুত এবং সঠিক পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। মস্তিষ্কের প্রতিটি স্পন্দন মনিটর করা যাচ্ছে কমপিউটারে। বিশ্লেষণের কাজটিও করা যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে মোটেও দেরি হচ্ছে না। সিদ্ধান্তের নির্ভুলতা বেড়েছে। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানও এগিয়ে চলেছে দ্রুতলয়ে। কমপিউটার প্রযুক্তির এই অগ্রগতিই হয়তো আমাদের নিয়ে যাবে অমরত্বের পথে। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন টাইম-এর সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় এই অমরত্ব নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
মস্তিষ্কের বিষয়টি নিয়ে যারা কাজ করছেন, সেই বিজ্ঞানীরা আরো যে বিষয়টি লক্ষ করেছেন তা হলো- শিশুর মস্তিষ্ক যে কেবল সাউন্ড বা ধ্বনি শুনেই শব্দ প্রসেস করে তা নয়, শব্দটির অর্থ উপলব্ধি করতেও সক্ষম করে তোলে।
এই গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন যৌথভাবে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের রেডিওলজির অধ্যাপক ড. এরিক হ্যাগরেন, সোস্যাল সায়েন্স বিভাগের ড. জেফ এলম্যান এবং নিউরোসায়েন্স বিভাগ ও মাল্টিমডেল ইমেজিং ল্যাবরেটরির ক্যাথেরিন ই ট্র্যাভিস। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের সাময়িকী সেরেব্রাল করটেক্সে এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ট্র্যাভিস বলেছেন, বড়রা যেভাবে মানসিক ‘ডাটাবেজ’ থেকে শব্দের অর্থ খুঁজে পেতে চেষ্টা করে, শিশুরাও এ কাজে এই ধরনের ব্রেন ম্যাকানিজম বা মস্তিষ্ক কৌশল ব্যবহার করে। ওই ডাটাবেজ বয়স বাড়ার সাথে সাথে সঠিক ও আপডেটেড হয়। এর আগে বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা ছিল, শিশুরা সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতি বা ম্যাকানিজমে শব্দ শিখে থাকে এবং পরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওই পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে। উন্নয়নশীল মস্তিষ্কের ঠিক কোন এলাকায় শব্দ বা ভাষা প্রক্রিয়াজাত বা প্রসেস হয় সে সম্পর্কে প্রমাণ না থাকায় ভাষা শেখার জন্য ব্যবহার হওয়া মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট অঞ্চল চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই জানতেন, মস্তিষ্কের ব্রোকাস এবং ওয়েরনিকস তথা ফ্রন্টোটেম্পোরাল এলাকায় কোনো ক্ষত বড়দের ভাষার দক্ষতা কমিয়ে দেয়। এ ধরনের ক্ষত শৈশবের শুরুর দিকে হলে তা ভাষার উন্নয়নে খুব কমই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। এই বৈসাদৃশ্যের প্রেক্ষিতে কেউ কেউ তত্ত্ব দিয়েছেন, মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধ তথা রাইট হেমিস্ফিয়ার এবং সামনের কিছু অংশ ভাষার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে জটিল এলাকা। আর বড়দের ক্ষেত্রে ভাষাগত দক্ষতা বাড়ার সাথে সাথেই ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ এলাকা প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। আবার অন্য তত্ত্বে বলা হয়েছে, কম বয়সেই যদি মস্তিষ্কের বাম ফ্রন্টোটেম্পোরাল অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে শিশুদের মস্তিষ্কের প্লাস্টিসিটি মস্তিষ্কের অন্য অঞ্চলগুলোকে ভাষা শিক্ষার কাজে ব্যবহার করে।
বর্তমান গবেষণায় নিয়োজিত বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের ভাষা প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টি নির্ণয়ের জন্য এমইজি এবং এমআরআই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। এমইজি হচ্ছে একটি ইমেজিং প্রসেস, যা মস্তিষ্কের নিউরন থেকে বেরিয়ে আসা চুম্বক ক্ষেত্র পরিমাপ করে। আর এমআরআই দিয়ে ১২ থেকে ১৮ মাস বয়সী শিশুদের মস্তিষ্কের কার্যক্রম পরিমাপ করা হয়।
প্রথম পরীক্ষায় দেখা গেছে, শিশুরা ধ্বনি বা সাউন্ডের সাথে একই ধরনের শব্দ শুনলেও দুটি শব্দের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। তাই এই ধরনের শব্দের অর্থ পৃথক করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। দ্বিতীয় পর্যায়ে গবেষকরা দেখেছেন ঠিক কখন শিশুরা একই ধরনের সাউন্ডের শব্দের অর্থ বুঝতে সক্ষম হয়। এই পর্যবেক্ষণটি করতে গিয়ে তারা শিশুদের দেখিয়েছেন তাদের পরিচিত কিছু ছবি। তার পর ছবির সাথে মিলিয়ে বা ম্যাচ করে কিংবা না মিলিয়ে বা মিসম্যাচ করে উচ্চারণ করেছেন শব্দ। যেমন ছবিতে একটি বল দেখিয়ে উচ্চারণ করা হয়েছে বল শব্দটি। আবার একটি বলের ছবি দেখিয়ে উচ্চারণ করা হয়েছে ডগ বা কুকুর শব্দটি। এ পর্যায়ে দেখা গেছে শিশুরা দুটি শব্দের ছবির সাথে মিসম্যাচ বা অমিল ঠিকই ধরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এটি ধরা পড়েছে তাদের মস্তিষ্কের কর্মতৎপরতায়, যা মনিটর করা হয়েছে কমপিউটারে। ছবির সাথে যে উচ্চারিত শব্দটি মিলল না, তা যে তারা ধরে ফেলল তা তাদের মস্তিষ্কের স্পন্দন পরিমাপ করে বোঝা যায়। আর এটা ধরা যায় মস্তিষ্কের বাম ফ্রন্টোটেম্পোরাল এলাকা পর্যবেক্ষণ করে। মস্তিষ্কের ওই এলাকাতেই প্রাপ্তবয়স্কদের শব্দার্থ প্রসেস হয়ে থাকে বলে জানা যায়। শিশুদের ওপর পরিচালিত এই পরীক্ষা বড়দের ওপর চালিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। দেখা গেছে, পরীক্ষার সময় শিশুদের মস্তিষ্ক যে ধরনের স্পন্দনের সৃষ্টি করেছে, বড়দের বেলায়ও ঠিক তাই ঘটে।
ড. হ্যাগরেন বলেন, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্করা শব্দের অর্থ বুঝতে যে নিউরাল মেশিনারি ব্যবহার করে তা আগে থেকেই কার্যকর থাকে। মূলত শব্দটি যখন তারা প্রথম শোনেন তখন থেকেই মস্তিষ্কের ওই সক্রিয়তা শুরু হয়।
গবেষকরা বলছেন, তাদের এই গবেষণালব্ধ ফল এ বিষয়ে ভবিষ্যৎ গবেষণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। একই সাথে এটাও বোঝা যাবে যে শিশু কথা বলতে শেখার আগে কিভাবে শব্দের অর্থ বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী সাড়া দেয়। যারা কথা বলতে পারেন না অর্থাৎ বাকপ্রতিবন্ধী কিংবা অটিজমে আক্রান্ত তাদের চিকিৎসায়ও এক গবেষণা ফল কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন। এটি সফল হলে মস্তিষ্কবিষয়ক যেকোনো রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এই গবেষণায় আংশিক তহবিল যোগান দিয়েছে। গবেষণায় আরো সহায়তা করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের ম্যাথিউ কে লিওনার্দ, টিমোথি টি ব্রাউন, ডোনাল্ড জে হ্যাগলার জুনিয়র, মেগান কারেন এবং অ্যান্ডার্স এম ডেল।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com