লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
বাজেট ও আইসিটি
আইসিটি বাজেট নিয়ে প্রত্যাশা
এখন চলছে ২০১০-১১ অর্থবছর। আগামী ১ জুলাই শুরু হবে নতুন অর্থবছর ২০১১-১২। আসছে ২২ মে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন আহবান করা হয়েছে। সংসদ সচিবালয়ের সূত্রমতে, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগামী নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হতে পারে। জাতীয় বাজেটের সাথে আমরা পাব নতুন অর্থবছরের আইসিটি বাজেট। নিশ্চয়ই আইসিটি খাতের সংশ্লিষ্টজনেরা গত বছরের তুলনায় এবার প্রত্যাশা করছেন আরো অধিকতর অনুকূল একটি আইসিটি বাজেট। আমরা ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য কেমন আইসিটি বাজেট প্রত্যাশা করছি? সে প্রসঙ্গে পড়ে আসছি। তার আগে ফিরে দেখা যাক কেমন ছিল চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের আইসিটি বাজেট।
আইসিটি বাজেট ২০১০-১১
চলতি অর্থবছরের অর্থাৎ ২০১০-২০১১ আইসিটি বাজেটে আগের অর্থবছরের তুলনায় আইসিটি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু আইসিটি খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের অনেক সুপারিশ বাজেটে আমলে নেয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতের ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর লক্ষ করা গেছে, আইসিটি খাতের ব্যবসায়ী নেতারা যেমন বাজেট নিয়ে ততটা খুশি হতে পারেননি, তেমনি অখুশিও ছিলেন না। চলতি অর্থবছরের আইসিটি বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ খাতে কিছু বিশেষ বরাদ্দ ছিল, যা এর আগের বাজেটগুলোতে অনুপস্থিত ছিল। তা সত্ত্বেও আইসিটি খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের অভিযোগ ছিল, তারা বাজেট ঘোষণার আগে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যেসব দাবি ও সুপারিশ রেখেছিলেন, তা সে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতের বাজেট ঘোষণার পর পরই আইসিটি খাতের প্রতিনিধিত্বকারী তিনটি ব্যবসায়ী সমিতি- বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস) এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) একযোগে বাজেটের প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ী নেতারা সাংবাদিকদের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। প্রথমে তারা সরকারের প্রতি আহবান জানান বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য। বাজেট প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের আলোচনা মূলত সীমিত ছিল কর, মূল্য সংযোজন কর ও অন্যান্য কিছু দাবি-দাওয়ার মধ্যে।
আইসিটি খাতের অব্যাহত উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। আলোচ্য বাজেটে উন্নয়ন বাজেটের ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দ গেছে জ্বালানি খাতে। এর লক্ষ্য বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন। সাবমেরিন ক্যাবল একটি বহুল আলোচিত বিষয়। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, বিগত বছরের বাজেটে আমাদের অঙ্গীকার ছিল দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করা। খুব শিগগিরই উদ্যোগ নেয়া হবে তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে প্রবেশের জন্য একটি বিকল্প ব্যাকবোন সৃষ্টির। তিনি তার বাজেট বক্তৃতায় আইটি ভিলেজ ও আইটি পার্ক স্থাপন, শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন দূর করার জন্য ১৩৩ উপজেলায় কমিউনিটি ই-কমার্স চালুর কথাও উল্লেখ করেন। তিনি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিমালায় উল্লিখিত ৩০৬টি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও করেন।
সবিশেষ উল্লেখ্য, আমাদের জাতীয় আইসিটি নীতিমালায় বলা হয়েছে- এডিপির ৫ শতাংশ ও রাজস্ব বাজেটের ২ শতাংশ বরাদ্দ ব্যয় হবে দেশের আইসিটি খাতের উন্নয়নের জন্য। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ভাষণে ৭০০ কোটি টাকার আইসিটি খাত উন্নয়ন তহবিলের ব্যাপারেও কিছু উল্লেখ ছিল না। ৩০০০ কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব তহবিল অবশ্য আইসিটি খাত প্রসারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে বেসরকারি খাতের শিল্পপতিদেরকে এ তহবিল দক্ষতার সাথে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকেও এ তহবিলের যথার্থ বিতরণে আন্তরিক ভূমিকা রাখতে হবে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ইকুইটি এন্টারপ্রিনিউয়ার ফান্ড বরাদ্দ ছিল ১০০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে করা হয় ২০০ কোটি টাকা।
আগামী বাজেট ও প্রত্যাশা
আমাদের জাতীয় বাজেটে জাতীয় আইসিটি নীতিমালার প্রতিফলন থাকবে এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু এ পর্যন্ত যে কয়টি জাতীয় বাজেট আমরা পেয়েছি, এর প্রতিটিতেই আমাদের জাতীয় আইসিটি নীতিমালা উপেক্ষিত হয়েছে। আগেই উল্লেখ রয়েছে, আমাদের জাতীয় আইসিটি নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে এডিপির ৫ শতাংশ ও রাজস্ব বাজেটের ২ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হবে দেশের আইসিটি খাতের উন্নয়নের জন্য। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে এর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। সম্প্রতি ঢাকায় একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করা হয়েছিল। বৈঠকের বিষয়বসুত ছিল : ‘বাংলাদেশের আইসিটি বাজেটে জাতীয় আইসিটি নীতিমালার প্রতিফলন’। তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর আইসিটি পলিসি রিসার্চ (সিআইপিআর)’ বিসিএস ডিজিটাল এক্সপো-২০১১’র শেষ দিনে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। উল্লেখ্য, সিআইপিআর হচ্ছে দেশের প্রথম তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এ থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক। এর বোর্ড মেম্বারদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যাক্তিবর্গ। এদের মধ্যে আছেন কমপিউটার বিজ্ঞান অনুষদ, তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিকতা জগৎ, তথ্যপ্রযুক্তিশিল্প ও উন্নয়নক্ষেত্রের ব্যক্তিবর্গসহ সাবেক সরকারি কর্মকর্তা।
এ গোলটেবিল বৈঠকে আইসিটি সমাজের ব্যক্তিবর্গ উল্লেখ করেন, আইসিটি নীতিমালায় আইসিটি খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে, এ পর্যন্ত কোনো অর্থবছরের বাজেটেই সে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। তাদের প্রত্যাশা ২০১১-১২ অর্থবছরের আসন্ন বাজেটে জাতীয় আইসিটি নীতিমালা অনুযায়ী দেশের আইসিটি খাতের উন্নয়নে এডিপির ৫ শতাংশ ও রাজস্ব বাজেটের ২ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হবে।
গোলটেবিল আলোচনায় সফটওয়্যার ডেভেলপার ও হার্ডওয়্যার ভেন্ডরদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয় ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর কোনো শুল্ক আরোপ না করতে। এর সরল অর্থ তারা চান আগামী বাজেট থেকে শুরু করে ২০২১ সালের আগের সব বাজেটেই কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর যেনো কোনো শুল্ক আরোপ করা না হয়। সফটওয়্যার শিল্পমহল থেকে সেখানে জানানো হয়, বর্তমানে সফটওয়্যার ও আইটিইএসের ওপর কার্যকর কর অব্যাহতির মেয়াদ আগামী কয় মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এ প্রেক্ষাপটে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয় এ মেয়াদ আগামী ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য।
বাজেটপূর্ব এ সময়ে সিআইপিআর সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের জন্য একটি সুপারিশনামা ও পরামর্শনামা তৈরির জন্য কাজ করে চলেছে। সুশীল সমাজের উদ্যোগ হিসেবে এর বোর্ড সদস্যরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসছেন আইটি উদ্যোগকে আরো ব্যাপক করে তুলতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য। সিআইপিআর চেয়ারম্যান এসএএসএম তাইফুরের মতে, বাজেটে আইটি খাতে দেয়া বরাদ্দের বেশিরভাগই খরচ হয়ে যাচ্ছে কমপিউটার কেনার পেছনে। ‘ব্লক অ্যালোকেশন’ নামের পুরো বরাদ্দ দিয়ে দেয়া হয় এ খাতের চাহিদা মোকাবেলার জন্যই। তার মতে, আগামী বাজেটে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে যে আইসিটি বরাদ্দ হয় তা দিতে হবে সুনির্দিষ্ট খাতে।
সাবেক বিসিএস সভাপতি ফয়জুল্লাহ খান বলেন, সরকার শুধু হাইটেক পণ্য থেকে শুল্ক আদায়েই ব্যস্ত থাকবে না, সরকারকে বিনিয়োগও করতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করাতে হবে, যাতে করে বিদেশী বিনিয়োগ সরাসরি আসে। বিদেশী বিনিয়োগের জন্য আহবানও জানাতে হবে সরকারকেই।
টেকভ্যালির চেয়ারম্যান আসিফ মাহমুদ উল্লেখ করেন, আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রকে ঘিরে এখনো অনেক সার্ভিস ফিচার অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। এর ওপর ভিত্তি করে আমরা অনেক সেবা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি।
আরএম সিস্টেমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আশফাক আলী বলেন, নানা ধরনের ডিভাইস বাজারে আসার ফলে পিসি এখন কার্যত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশি থেকে বেশিসংখ্যক পিসি খুব শিগগিরই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। কারণ, ন্যানোটেকনোলজি তথা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রযুক্তির ডিভাইস পিসির জায়গা দখল করে নেবে। তিনি আরো বলেন, আপনি যখন একটি গ্রেডেড গেজেট আনবেন, শুল্ক কর্মকর্তা বলবেন এটি একটি বিনোদন পণ্য। অতএব আপনাকে বেশি হারে ট্যাক্স দিতে হবে। কেননা, সরকার বিলাসপণ্যের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করেছে। দুর্ভাগ্য, আমরা বুঝতে চাই না এ ধরনের পণ্য খুব শিগগিরই অতি সাধারণ পণ্যে রূপ নেবে। কয়েক বছরের মধ্যেই এগুলো হয়ে উঠবে প্রতিদিনের ব্যবহারের পণ্য।
সিআইপিআরের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন জোর তাগিদ দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আওতায় সরকারের উচিত একটি ‘জাতীয় আইসিটি কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা। এ ধরনের কেন্দ্র রয়েছে জাপান, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও আরো অনেক দেশে। এই আইসিটি কেন্দ্র কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে জাতীয় ডাটাবেজ, সব সরকারি অফিসের আনুষঙ্গিক আইসিটি পণ্য কেনাকাটা ও সরবরাহ করার কাজ এবং সমন্বয় সাধন করবে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে। কারণ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনতে হবে। সেই সাথে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে আমলাতন্ত্রে নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয় ও স্বচ্ছতা বিধান।
সম্প্রতি গার্টনার বাংলাদেশকে বিশ্বের সেরা ৩০ আউটসোর্সিং দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে আইসিটিকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের তাগিদটুকুই আমাদের সামনে নিয়ে এলো। গার্টনারের সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে ১০টি মাপকাঠি বা ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে। এগুলো হচ্ছে- ভাষা, সরকারি সহায়তা, শ্রমের প্রাপ্যতা, অবকাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা, ব্যয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক সাযুজ্যতা, বৈশ্বিক ও আইনি পরিপক্বতা ও গোপনীয়তা। আর রেটিং স্কেল ছিল ‘ফেয়ার’, ‘গুড’, ‘ভেরি গুড’ এবং ‘ এক্সেলেন্ট’। তার পরও আমাদেরকে আইসিটি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে হলে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য আমাদের বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেমিনারে এ যথার্থ তাগিদও এসেছে ড. মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিনের কাছ থেকে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মনে রাখতে হবে প্রযুক্তি-গবেষণা একদিন দেশে সুফল বয়ে আনবে। আমাদের ধৈর্য ধরে গবেষণাকর্মে লেগে থাকতে হবে। তার এ তাগিদের সরল অর্থ হচ্ছে- আগামী বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভালো অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ থাকা চাই। বেসিসের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, শুধু ছাত্রদের জন্য কমপিউটার কিনে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। জাতীয় আইসিটি নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে মোট বাজেটের ২ শতাংশ আইসিটি খাতের জন্য বরাদ্দ দেয়ার জন্য। আগামী বাজেটে এ নীতিমালার বাস্তবায়ন দরকার। তিনি আরো বলেন, আমাদেরকে আরো দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। এই দক্ষ জনবল ছাড়া আইসিটি খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের উপলব্ধিতে থাকা দরকার, আইসিটি খাতে ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের অর্থ হচ্ছে দেশে ১০ হাজার কোটি টাকা আনার ব্যবস্থা করা। বেসিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাহিম মাশরুর বেসিসের পক্ষ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সফটওয়্যার কেনার ওপর কোনো ভ্যাট আরোপ না করার দাবি জানান।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের তিন শীর্ষ সংগঠনের যৌথ প্রাক-বাজেট প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিধিত্বকারী তিন শীর্ষ সংগঠন- বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)- গত ৭ মে ঢাকায় ‘জাতীয় আইসিটি নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন : প্রেক্ষাপট জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে। এ সেমিনারের মাধ্যমে এই তিন সংগঠন যৌথভাবে আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য একটি যৌথ প্রস্তাবনা তুলে ধরে। এতে রয়েছে আয়কর বিষয়ে চারটি প্রস্তাব, ভ্যাট বিষয়ে পাঁচটি প্রস্তাব এবং আমদনি শুল্ক বিষয়ে দুইটি প্রস্তাব।
আয়কর নিয়ে এ তিন সংগঠনের প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- ০১. জাতীয় আইসিটি নীতিমাল ২০০৯-এর আয়কর মওকুফ প্রস্তাব অনুযায়ী দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য সফটওয়্যার ও আইটিইএসের ওপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত আয়কর মওকুফ করতে হবে। ০২. বর্তমানে সুনির্দিষ্ট কিছু কমপিউটার ও আনুষঙ্গিক পণ্য ও যন্ত্রাংশের ওপর আমদানি পর্যায়ে যে ৩ শতাংশ হারে এআইটি তথা আগাম আয়কর কার্যকর আছে তা সব ধরনের কমপিউটার, অ্যাক্সেসরিজ ও নেটওয়ার্কিং পণ্যের ক্ষেত্রেও একই হারে আগামী বাজেটে ধার্য করতে হবে। ০৩. বর্তমানে কমপিউটার ব্যবসায়ের আয় নিরূপণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো হার ধার্য করা নেই। এ ক্ষেত্রে জিপি বা গ্রস প্রফিট সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হারে ধার্য করতে হবে। ০৪. দেশে কমপিউটারের দাম কমানোর মাধ্যমে এর ব্যবহার বাড়ানো উৎসাহিত করার জন্য কমপিউটার ব্যবসায়ের ওপর আয়করের হার সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ আরোপ করতে হবে।
এ সংগঠন তিনটির মূল্য সংযোজন কর বিষয়ক পাঁচটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ০১. দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য ইন্টারনেট সার্ভিসের ওপর বর্তমানে কার্যকর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে হবে। ০২. বর্তমানে কিছু কমপিউটার ও আনুষঙ্গিক পণ্যে শূন্য হারে ও কিছু পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর রয়েছে, এসব পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট মওকুফ করতে হবে। ০৩. বর্তমানে যেসব কমপিউটার ও নেটওয়ার্ক আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারে এটিভি বা আগাম ট্রেড ভ্যাট কার্যকর আছে তাকেই চূড়ান্ত ভ্যাট হিসেবে গণ্য করতে হবে। ০৪. কমপিউটার ও কমপিউটার সামগ্রীর খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য এ ক্ষেত্রে বার্ষিক নির্দিষ্ট ভ্যাট ধার্য করা হোক (৪৫০০-৬০০০ টাকা)। ০৫. সফটওয়্যার ও আইটিইএসের জন্য একটি নতুন সার্ভিস কোড ঘোষণা করতে হবে, যা সফটওয়্যার ও আইটিইএস কর্তৃপক্ষ তদের ভ্যাট তালিকাভুক্তির/নিবন্ধনের সময় ব্যবহার করতে পারবে।
অপরদিকে আমদানি শুল্ক সম্পর্কিত তাদের দুটি প্রস্তাব রয়েছে- ০১. সব ধরনের কমপিউটার, কমপিউটার যন্ত্রাংশ ও নেটওয়ার্ক পণ্যের ওপর বর্তমানে যে ৩ শতাংশ ও ততোধিক হারে শুল্ক কার্যকর রয়েছে, তা আগামী বাজেটে প্রত্যাহার করতে হবে। ০২. বর্তমানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমপিউটার ও নেটওয়ার্ক পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় (২৫ শতাংশ হারে) শুল্ক কার্যকর রয়েছে, যদিও একই ধরনের অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে অনেক কম হারে শুল্ক ধার্য আছে। এ ধরনের সব পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক পুরোপুরি মওকুফ করতে হবে।
আইসিটি নীতিমালা ও বাজেট
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসীন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এ সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক জাতীয় আইসিটি নীতিমালা। সে উপলব্ধি থেকে সরকার এরই মধ্যে আমাদের উপহার দিয়েছে ‘জাতীয় আইসিটি নীতিমালা ২০০৯।’ এই আইসিটি নীতিমালাসহ সরকার প্রণয়ন করেছে একটি রূপকল্প। এই রূপকল্প এরই মধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে ভিশন ২০২১ বা রূপকল্প ২০২১ নামে। আমাদের আইসিটি নীতিমালায় রয়েছে ১০টি উদ্দেশ্য, ৫৬টি কৌশলগত বিষয়বস্তু ও ৩০৬টি করণীয়। উল্লিখিত রূপকল্পে যে আরাধ্য কাজের কথা বলা আছে, তা হচ্ছে- ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করা; দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন নিশ্চিত করা; সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা বাড়ানো; সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বে সুলভে জনসেবা জোগানো নিশ্চিত করা; ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ত্রিশ বছরের মধ্যে উন্নত দেশের সারিতে উন্নীত করার জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা।’ পাশাপাশি আমাদের জাতীয় আইসিটি নীতিমালার ১০টি উদ্দেশ্য হচ্ছে- সামাজিক সমতা, উৎপাদনশীলতা, অখন্ডতা, শিক্ষা ও গবেষণা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, তথ্যজগতে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার, পরিবেশ জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং আইসিটিতে সহায়তা দেয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রূপকল্পে ও আইসিটি নীতিমালায় বর্ণিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে আমাদের জাতীয় বাজেটে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। আইসটি নীতিমালায় উল্লিখিত ৩০৬টি করণীয় সম্পর্কে জাতীয় নীতিমালার এক জায়গায় সে প্রয়োজনীয়তার কথাই উল্লিখিত রয়েছে- ‘...করণীয় বিষয়গুলো বাস্তবায়নের নিমিত্তে জাতীয় বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত নিয়মিত কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়, দফতর ও সংস্থাসমূহে আর্থিক বরাদ্দ দিতে হবে। এ ছাড়াও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে আইসিটি উন্নয়নের নিমিত্তে তহবিল জোগানোর জন্য বার্ষিক বাজেট পরিকল্পনায় অনুদানের মাধ্যমে একটি আইসিটি তহবিল গঠন করা যেতে পারে।’ তাই আইসিটি খাতের সংশ্লিষ্টজনেরা জাতীয় বাজেটে এবার আইসিটি খাতে সে অনুযায়ী বর্ধিত বাজেট বরাদ্দের প্রত্যাশা করছেন।
এ ছাড়া আমাদের জাতীয় আইসিটি নীতিমালায় যে ৩০৬টি করণীয় উল্লিখিত হয়েছে, তাতে আইসিটি শিল্পের উন্নয়নে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কর্মপরিকল্পনার কথা রয়েছে। যেমন ১০০ নম্বর করণীয়তে বলা হয়েছে- সব প্রতিষ্ঠানে ই-গভর্নেন্স উদ্যোগের জন্য উন্নয়ন বাজেট অর্থের সংস্থান করা এবং সব উদ্যোগের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাজস্ব বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেয়া (উন্নয়ন বাজেটের ৫ শতাংশ ও রাজস্ব বাজেটের ২ শতাংশ)। এর বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদফতর। ১০১ নম্বর করণীয়তে উল্লেখ আছে- বেসরকারি উদ্যোগে আইসিটির মাধ্যমে সেবা দেয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ উৎসাহিত করা হবে। ১৫৮ নম্বর করণীয় মতে, আইসিটি শিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি কর্তর্ৃপক্ষ তৈরি করা হবে। ১৫৯ নম্বর করণীয়তে বলা হয়েছে- আইসিটি উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হবে। উল্লিখিত বরাদ্দ ৭০০ কোটি টাকা। ১৬১ নম্বর করণীয় হচ্ছে- স্থানীয় ও রফতানিমুখী কাজের জন্য স্বল্প ব্যাংকসুদে বিশেষ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ফান্ড তৈরি করা হবে। ১৬২ নম্বর করণীয় মতে, আইসিটি পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ খরচ ৫০ শতাংশ পরিশোধ করা হবে। ১৬৩ নম্বর করণীয় মতে, সরকারি মালিকানাধীন আইটি পার্ক, এসটিপি, ইনকিউবেটর, হাইটেক পার্ক ও অন্যান্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে মূল্যছাড় দেয়া হবে। ১৬৮ নম্বর করণীয়তে উল্লেখ আছে- মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক/স্নাতক পর্যায়ের বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য বিশেষ বৃত্তি/শিক্ষাঋণের ব্যবস্থা চালু করা হবে। ১৭৭ নম্বর করণীয়তে বলা আছে- সব আইসিটি গ্র্যাজুয়েটকে সুস্পষ্ট মানদন্ডের ভিত্তিতে এক বছর মেয়াদি অন-দ্য-জব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। ১৯৪ নম্বর করণীয় মতে, সফটওয়্যার ও আইটিইএস খাতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের বিপরীতে জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। ১৯৩ নম্বর করণীয় মতে, আইসিটি শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী ইইএফ নীতি প্রণয়ন করা হবে। ১৯৫ নম্বর করণীয়তে উল্লেখ আছে- আইসিটি খাতের অর্থায়নের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড গঠন করা হবে। ১৯৯ নম্বর করণীয় হচ্ছে- সারাদেশে আরো সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, হাইটেক পার্ক ও আইসিটি ইনকিউবেটর স্থাপন করা হবে।
কজ ওয়েব