বিপুল আয়ের সম্ভাবনাময় সেমিকন্ডাক্টও প্রযুক্তিশিল্প পরিপ্রেক্ষিত : বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা
প্রতিবছরের মতো ১৯৫৬ সালেও পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়৷ সেবার ড. উইলিয়াম ব্রাডফোর্ট শকলি, ড. জন বার্ডেন এবং ড. ওয়ালটন এইচ ব্রাটেইন এ পুরস্কার পান৷ তাদের কাজ ছিল সেমিকন্ডাক্টরের কাজের তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা এবং ট্রানজিস্টর নামের একটি নতুন ডিভাইস উদ্ভাবন৷ কিন্তু অন্যান্য বারের পুরস্কারগুলোর সাথে এটি কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী ছিল৷ কেননা, প্রায় ৫০ বছরের নোবেল ইতিহাসে সেবারই প্রথম কোনো প্রকৌশল ডিভাইসের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়৷ প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকালে ব্রাটেইন এবং বার্ডেন বেল গবেষণাগারে সর্বপ্রথম ট্রানজিস্টরের বিবর্ধন ক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন৷ এরা ১৯৪৮ সালের ৩০ জুন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন৷ এ খবর গুটিকয়েক সংবাদপত্রের পেছনের পৃষ্ঠায় দায়সারা ভাবে ছাপা হয়৷
এই সাদামাটা আবিষ্কারের প্রভাব কিন্তু মোটেও সাধারণ ছিল না৷ এ আবিষ্কারের হাত ধরেই কালের বিবর্তনে আমরা পেয়েছি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় লেজার ডায়োড থেকে শুরু করে বিভিন্ন অতি ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং আজকের ব্যাপক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ইন্টিগ্রেটেড চিপ তথা আইসি৷ আমাদের প্রতিদিনের জীবনের একটা বড় অংশই এখন এই আইসিনির্ভর৷ তাছাড়া এই আবিষ্কারের হাত ধরেই উঠে এসেছে অ্যাপ্লায়েড ম্যাটেরিয়াল, ইনফিনিয়ন, ইন্টিগ্রেটেড ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন (ইন্টেল), তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি), ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন (আইবিএম) এবং টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টের মতো বিখ্যাত সব কোম্পানি৷
তাছাড়া তাদের কাজ পরিবাহী এবং অন্তরক তথা অপরিবাহী থেকে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতর অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরের ধারণাকে স্পষ্ট করে, যা থেকে পরবর্তী সময়ে পদার্থবিজ্ঞানে ইলেকট্রনিক্স নামের একটি নতুন বিষয়ের সৃষ্টি হয়৷ যদিও ইতোপূর্বে প্রতিষ্ঠিত ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশলের সাথে ইলেকট্রনিক্সের পার্থক্য ছিল মূলত ঐতিহাসিক৷ ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশল বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যেখানে এমন সব ডিভাইস নিয়ে কাজ করতো, যাদের কার্যনীতি পুরোপুরি কন্ডাক্টরের মধ্যে ইলেকট্রনের গতির ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন এই শাখা গ্যাস, ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান ও সেমিকন্ডাক্টরের মধ্যে ইলেকট্রনের গতি নিয়ে কাজ করে৷
সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী
তড়িৎ আবিষ্কারের পরেই দেখা গেল এমন কিছু বস্তু আছে, যেগুলো তড়িৎ পরিবহন করে আর অন্যগুলো তা করে না৷ প্রথমটিকে বলা হলো পরিবাহী আর পরেরটিকে অপরিবাহী৷ তাপমাত্রা বাড়লে পরিবাহীর রোধ বাড়ে অর্থাৎ তা অপরিবাহীর মতো আচরণ করে৷ কিন্তু আরেক ধরনের বস্তুর ক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টোটি ঘটে৷ অর্থাৎ তাপমাত্রা বাড়ালে এদের রোধ না বেড়ে বরং কমতে শুরু করে৷ ফলে এগুলো ক্রমশ পরিবাহীর মতো আচরণ শুরু করে৷ এরাই প্রধানত অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টর৷ যেমন : সিলিকন, জার্মেনিয়াম, গ্যালিয়াম আর্সেনাইড, ইনডিয়াম নাইট্রাইড, গ্যালিয়াম নাইট্রাইড ইত্যাদি৷ সেমিকন্ডাক্টরকে ভালোভাবে বুঝা যায় ব্যান্ডগ্যাপ ধারণার মাধ্যমে৷ সাধারণভাবে বলা যায়, সাম্যাবস্থায় যেকোনো বস্তুতে কতগুলো শক্তির ব্যান্ড সৃষ্টি হয়, যাদেরকে এনার্জি ব্যান্ড বলে৷ এই এনার্জি ব্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে ভ্যালেন্স ব্যান্ড এবং কন্ডাকশন ব্যান্ড৷ আর কন্ডাকশন ব্যান্ডের সর্বনিম্ন এবং ভ্যালেন্স ব্যান্ডের সর্বোচ্চ শক্তির মানের পার্থক্যই হলো ব্যান্ডগ্যাপ৷ এটি তাপমাত্রা ও বস্তুর আন্তঃপারমাণবিক দূরত্বের ওপর নির্ভর করে এবং সেমিকন্ডাক্টরের জন্য বৈশিষ্ট্যসূচক৷ বিভিন্ন দূষণের জন্যও এই ব্যান্ডগ্যাপের কিছু পরিবর্তন ঘটে৷ ব্যান্ডগ্যাপের আলোকে সেমিকন্ডাক্টরকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় : পরমশূন্য তাপমাত্রায় যেসব কঠিন বস্তু অপরিবাহী কিন্তু গলনাঙ্কের নিচে কোনো তাপমাত্রায় তড়িৎ পরিবহন করে, তারাই সেমিকন্ডাক্টর৷
সেমিকন্ডাক্টরের সাথে পরিবাহকের বেশ কিছু অমিল রয়েছে৷ এর মধ্যে একটি হচ্ছে আধান বাহকের প্রকৃতি৷ পরিবাহকে আধান বাহক শুধু ইলেকক্ট্রন, কিন্তু সেমিকন্ডাক্টরে দুই ধরনের আধান বাহক রয়েছে : ইলেকক্ট্রন ও হোল৷ হোল এক ধরনের কাল্পনিক কণা, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে একে ব্যাখ্যা করা হয়৷ সাধারণভাবে ইলেকক্ট্রনবিহীন শক্তিস্তরই হোল৷
সেমিকন্ডাক্টর বস্তু আবার দুভাবে বিভক্ত : ০১. ইনট্রিনজিক ও ০২. এক্সট্রিনজিক৷ আজকের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি অনুযায়ী রাসায়নিকভাবে যেগুলো পরিশুদ্ধ সেগুলো ইনট্রিনজিক৷ আর যাদের মধ্যে ইচ্ছেকৃতভাবে দূষণ যোগ করা হয়, সেগুলো এক্সট্রিনজিক৷ কর্মক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর সেমিকন্ডাক্টরই বেশি প্রয়োজনীয়৷ তবে কোন ধরনের সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার হবে, তা নির্ভর করে বিভিন্ন প্যারামিটারের ওপর; যেমন : তাপমাত্রা, চাপ, রাসায়নিক অবস্থা, ফার্মি লেভেল ইত্যাদি৷
সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি
অর্ধপরিবাহী বস্তু থেকে নানা ধরনের ইলেক্ট্রনিক, অপটোইলেক্ট্রনিক কিংবা ফটোনিক ডিভাইস তৈরির প্রযুক্তি ঘিরেই গড়ে উঠেছে অর্ধ পরিবাহী প্রযুক্তির কলাকৌশল৷ উদাহরণ হিসেবে আইসি তৈরির বিষয়টিকে ধরা যাক৷ সাধারণভাবে একটিমাত্র সেমিকন্ডাক্টর বস্তুতে রোধক, ডায়োড এবং ট্রানজিস্টরের সমন্বয়কে আইসি বলা যেতে পারে৷ আইসি তৈরির প্রক্রিয়াকে আমরা দুটি ভাবে ভাগ করি- বর্তনী ডিজাইন ও ফেব্রিকেশন৷ ফেব্রিকেশনের যন্ত্রপাতি অনেক ব্যয়বহুল, কিন্তু ডিজাইন তুলনামূলকভাবে কম খরচেই করা যায়৷ বর্তমানে লজিক গেটের হিসেবে আইসি কে নিচের তালিকায় শ্রেণীবিন্যাস করা যায় :
সব ধরনের আইসি ফেব্রিকেশন করা গেলেও বর্তমান প্রতিবেদনের আলোচনায় মূলত ভিএলএসআই-কে বুঝানো হচ্ছে৷ বর্তমানের ডিজিটাল ব্যবস্থায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমএসআই, এলএসআই, ভিএলএসআই, ইউএলএসআই, জিএসআই ডিভাইস ব্যবহার হয়৷ তবে এখনো এসএসআই দুটি জটিল আইসির মাধ্যমে আঠা হিসেবে ব্যবহার হয়৷ সব চিপের মূল ইক্ট্রেনিক উপাদান হলো আবার ট্রানজিস্টর, একে আবার বাইপোলার ও ইউনিপোলার এ দুভাবে ভাগ করা যায়৷ ফলে কোন ধরনের ট্রানজিস্টর ব্যবহার হবে, তার ওপর ভিত্তি করে আইসিগুলো আবার দুভাবে বিভক্ত : বাইপোলার আইসি এবং ইউনিপোলার আইসি৷ বাইপোলার আইসির মূল উপাদান হলো বিজেটি৷ অপরদিকে ইউনিপোলারের ক্ষেত্রে তা ফেট৷ ফেট আবার বিভিন্ন ধরনের হয় : জেফেট, মসফেট (এনহ্যান্সমেন্ট টাইপ ও ডিপেশন টাইপ), মেসফেট, সিমস প্রভৃতি৷ তবে পোলারিটির ভিত্তিতে সব ফেটই প্রধান দুই শ্রেণীতে বিভক্ত : এন-টাইপ ও পি-টাইপ৷ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টিটিএল (ট্রানজিস্টর-ট্রানজিস্টর লজিক) বাইপোলার আইসিতে প্রাধান্য ধরে রেখেছে৷ এছাড়া রয়েছে ইমিটার-কাপল্ড লজিক বা ইসিএল৷ অপরদিকে ইউনিপোলার আইসির ক্ষেত্রে এটি হলো সিমস৷ এদের একেকটির একেক দিক দিয়ে সুবিধা থাকলেও বর্তমানে সাধারণভাবে ইউনিপোলার আইসি-ই বেশি জনপ্রিয়৷ কেননা, সাধারণ অপারেটিং অবস্থায় এর সুবিধাসমূহ বেশি৷ তুলনামূলকভাবে অধিক ইনপুট ইমপিডেন্স, দ্রুত সুইচিং এবং অপেক্ষাকৃত কম অপারেটিং পাওয়ার প্রভৃতির জন্য সিমস অন্যান্য মসদের চেয়ে বেশি ব্যবহার হয়৷ গতির দিক দিয়ে ইসিএল সর্বাপেক্ষা গতিময়৷ এছাড়া রয়েছে সিমস এবং বাইপোলারের যৌথ সুবিধা নিয়ে বাইমস৷
গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক
১৯০৬ - প্রথম সেমিকন্ডাক্টর ডায়োড
১৯১২ - কাসকেডেড অ্যামপ্লিফায়ার, রিজেনারেটিভ অ্যামপ্লিফায়ার, ওসিলেটর
১৯১৭ - হেটারোডাইন
১৯১৮ - মাল্টিভাইব্রেটর
১৯২৭ - নেগেটিভ ফিডব্যাক অ্যামপ্লিফায়ার
১৯৩৭ - স্যানন কর্তৃক বুলিয়ান বীজগণিত ডিজিটাল বর্তনীতে প্রয়োগ
১৯৪৬ - আইবিএম-এর প্রথম ছোট বাণিজ্যিক কমপিউটার
১৯৪৮ - বাইপোলার জাংশন ট্রান্সজিস্টর
১৯৫১ - শকলির ফেটের প্রস্তাবনা
১৯৫৮ - প্রথম জেফেট
১৯৫৯ - আইসি/চিপ
১৯৬০ - মসটে
১৯৬০ - এসএসআই
১৯৬১ - টিটিএল সিরিজের সূচনা
১৯৬২ - ইসিএল সিরিজের সূচনা
১৯৬৪ - অপারেশনাল অ্যামপ্লিফায়ার
১৯৬৬ - মেসফেট প্রস্তাবিত
১৯৬৭ - রম
১৯৬৯ - এলএসআই
১৯৭০ - র্যা ম বাণিজ্যের সূচনা
১৯৭০ - সিসিডি, কক্ষ তাপমাত্রায় অবিচ্ছিন্ন সেমিকন্ডাক্টর লেজার
১৯৭৪ - কোয়ান্টাম ওয়েল
১৯৭৫ - ভিএলএসআই
১৯৭৬ - পি-এন জাংশন সৌর কোষ
১৯৭৮ - মাল্টি কোয়ান্টাম ওয়েল লেজার
১৯৮০ - হাই ইলেকট্রন মোবিলিটি ট্রানজিস্টর
১৯৮৭ - সিঙ্গেল ইলেকট্রন ট্রানজিস্টর
১৯৯০ - জৈব সেমিকন্ডাক্টর এলইডি
১৯৯৪ - কোয়ান্টাম কাসকেড লেজার
১৯৯৪ - গ্যালিয়াম নাইট্রাইডের নীল লেজার
১৯৯৮ - ৩ কেভি শটকি বেরিয়ার ডায়োড (4H-SiC)
আর এসব কাজের জন্য প্রথমেই বাছাই করতে হয় সঠিক সেমিকন্ডাক্টর বস্তু৷ এরপর একে পরিশুদ্ধ (৯৯.৯৯৯%) করতে হয়৷ তাছাড়া রয়েছে গ্রোথ প্রসেস৷ যেমন : এমবিই, এমওভিপিই, এমওসিভিডি, এলপিসিভিডি, এলপিই প্রভৃতি৷ এদের একেকটি একেক দিক দিয়ে ভালো, তবে সাধারণত এমবিই ও এমওসিভিডি বেশি ব্যবহার হয়৷ এরপর রয়েছে সার্কিট ইমপ্লিমেনটেশন, যার জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন : ফটোলিথোগ্রাফি, ইলেক্ট্রন বিম লিথোগ্রাফি প্রভৃতি৷ অতঃপর ইচিং এবং সর্বশেষে ধাতবকরণ, প্যাকেজিং প্রভৃতি৷ আর এ সবকিছু নিয়েই সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি৷ অর্ধপরিবাহী ডিভাইস তৈরির গবেষণাগার ক্লিনরুম নামে পরিচিত৷
প্রতিটি প্রক্রিয়ায় ক্লিনরুমের জায়গা ব্যবহারের শতকরা হার নিম্নরূপ :
ফটোলিথোগ্রাফি ২৫%
ব্যাপন এবং এলপিসিভিডি ২০%
থিন ফিল্ম ২০%
ড্রাই ইচিং ১৫%
ইমপ্লিমেনটেশন ১০%
ওয়েট প্রসেসিং ১০%
যা-ই হোক, বর্তমান বিশ্বে বেশিরভাগ উন্নত দেশের সাফল্যের পেছনে রয়েছে এই সেমিকন্ডাক্টর শিল্প৷ উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিসংখ্যান দেয়া যেতে পারে৷ ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে মাত্র কয়েকটি আইসি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি থাকলেও ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯-এর মধ্যে নতুন ২৪টি মাইক্রোইলেকট্রনিক কোম্পানি গড়ে ওঠে এবং ১৯৮৪ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়৷
বর্তমানে ইলেকট্রনিক্স সিস্টেম এবং সেমিকন্ডাক্টরের বেড়ে চলার হার পরের পাতার লেখচিত্রটি থেকে বুঝানো যেতে পারে৷ সবার উপরেরটি ৪৬.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশ্বব্যাপী জিডিপি, পরেরটি ৮৭৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার উত্পাদন এবং সর্বনিচে ১৩৯.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর রেভিনিউ৷ বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আইসি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি হচ্ছে অ্যাডভ্যান্সড মাইক্রো ডিভাইসেস (এএমডি), ফেয়ারচাইল্ডসেমিকন্ডাক্টর, জেনারেলসেমিকন্ডাক্টর, ফুজিসু, হিটাচি সেমিকন্ডাক্টর, আইবিএম মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্স, ইন্টেল, মটোরোলা সেমিকন্ডাক্টর, স্যামসাং সেমিকন্ডাক্টর, সিমাটেক, টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্ট, জিলগ প্রভৃতি৷
সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিশিল্প তথা যেকোনো প্রযুক্তি খাতকেই বিকশিত করার জন্য প্রয়োজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোক্তা এবং দক্ষ জনশক্তির সঠিক সমন্বয়৷ আর দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মূল কারখানা হিসেবে কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়৷ তাই এ বিষয়টিতে আলোকপাত করছি৷
উচ্চশিক্ষা
বাংলাদেশের বেশিরভাগ সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি বিষয়টি পড়ার সুযোগ রয়েছে৷ সাধারণত স্নাতক সম্মান কিংবা স্নাতকোত্তর শ্রেণীর পাঠ্যসূচীতে সেমিকন্ডাক্টর বিষয়ে ১টি বা ২টি কোর্স অন্তর্ভুক্ত রয়েছে৷ দেশে ব্যাপকভাবে সেমিকন্ডাক্টরে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে স্বতন্ত্র ডিগ্রি দেয়া প্রয়োজন৷ এমএস ইন সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজি বা এমএস ইন ন্যানোটেকনোলজি অ্যান্ড ন্যানোডিভাইজ ফেব্রিকেশন নামে নতুন কোর্স চালু হলে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যাবে অনায়াসে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় :
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালবে জন্মলগ্ন থেকেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয় এবং কালক্রমে বিশ্বখ্যাত গবেষকদের ছোঁয়ায় এ বিভাগ সব সময়ই পদার্থবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে উত্কর্ষ লাভ করে৷ বর্তমানে এ বিভাগে সেমিকন্ডাক্টর বিজ্ঞানের মূল বিষয়াবলী কোয়ান্টাম মেকানিক্স, সলিড স্টেট ফিজিক্সের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক্স এবং কমপিউটার প্রোগ্রামিং কোর্স চালু রয়েছে৷ প্রায়োগিক ক্ষেত্রের উত্তরোত্তর চাহিদাকে সামনে রেখে ১৯৬৫ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স পর্যায়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ গঠিত হয়৷ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সেমিকন্ডাক্টর বিষয়েও বেশ কয়েকজন গবেষককে এ বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে৷ বর্তমানে এটি ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স ও যোগাযোগ প্রকৌশল নামে সদ্য গঠিত প্রযুক্তি ও প্রকৌশল অনুষদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৷
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) : পূর্বে এটি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত থাকলেও বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রূপে প্রকৌশল শিক্ষায় দেশের শীর্ষস্থানে রয়েছে৷ এখানে অর্ধপরিবাহী প্রযুক্তি এবং ভিএলএসআই প্রযুক্তি বিষয়ে কোর্স চালু রয়েছে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে৷
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় :
সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজিতে পড়ার জন্য এখানে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স ও যোগাযোগ প্রকৌশল এবং ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের মতো বিভাগ৷
এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান এবং ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ধারার বিভাগসমূহে সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি এবং বস্তু বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে৷ এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপিউটার বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগে ভিএলএসআই ডিজাইনিং পড়ানো হয়৷ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পাঠ্যক্রমে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ব্যান্ডগ্যাপ ইঞ্জিনিয়ারিং, সলিড স্টেট ফিজিক্স, সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি, ওয়েফার ফেব্রিকেশন, ক্রিস্টাল গ্রোথ টেকনোলজি, স্পিনট্রনিক্স, ন্যানোফেব্রিকেশন এবং অরগ্যানিক সেমিকন্ডাক্টরের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত৷
গবেষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিকন্ডাক্টর বিষয়ে প্রধান গবেষণাগার হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার তথা এসটিআরসি৷ এখানে সেমিকন্ডাক্টর বিষয়ে মৌলিক এবং প্রায়োগিক গবেষণা করা হয়৷ এ কেন্দ্রে মূলত দুটি ধারায় গষেণা পরিচালিত হয়৷ প্রথমত, সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য সৌরকোষ নির্মাণ ও তাদের গুণাগুণ পরীক্ষাপূর্বক সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উত্পাদনের কার্যকারিতা নিরূপণ৷ এখানে সৌর ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় সৌরকোষের উইন্ডো লেয়ারের ফেব্রিকেশন সফলভাবে করা হচ্ছে৷ পাশাপাশি থিন ফিল্মের ফেব্রিকেশন এবং ক্যারাক্টারাইজেশনের কাজও করা হচ্ছে৷ দ্বিতীয়ত, বস্তু বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা৷ এ পর্যায়ে রয়েছে হাই ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার অতিপরিবাহী পদার্থ ও তার সূক্ষ্ম স্তরের আচরণ ও ধর্ম সংক্রান্ত গবেষণা৷ এ বিষয়ে সফল কাজগুলোর একটি হচ্ছে মরহুম অধ্যাপক ড. সুলতান আহমেদের গবেষণায় প্রাপ্ত প্রায় ১৩০ কেলভিন তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী বস্তু৷ এছাড়া এখানে ইলেকট্রোডিপোজিশন এবং ফটোলিথোগ্রাফির কাজও করা হচ্ছে৷ সফলভাবে কার্যকর একটি শটকি ডায়োডও প্রস্তুত করা হয়েছে৷ এ গবেষণাগারে বিভিন্ন বস্তুর ইলেকট্রনীয় গঠন এবং তাদের ইলেকট্রনীয় ও আলোকীয় ধর্মাবলম্বীর ওপরও কাজ হয়েছে৷
তথ্যকণিকা
বিজেটি - বাইপোলার জাংশন ট্রানজিস্টর
সিমস - কমপ্লিমেন্টারি মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর
ফেট - ফিল্ড ইফেক্ট ট্রানজিস্টর
জেফেট - জাংশন ফিল্ড ইফেক্ট ট্রানজিস্টর
এলপিই - লিকুইড ফেজ এপিট্যাক্সি
এলপিসিভিডি - লিকুইড ফেজ কেমিক্যাল ভ্যাপার ডিপোজিশন
এমবিই - মলিকিউলার বিম এপিট্যাক্সি
এমওসিভিডি - মেটাল অরগ্যানিক কেমিক্যাল ভ্যাপার ডিপোজিশন
এমওভিপিই - মেটাল অরগ্যানিক ভ্যাপার ফেজ এপিট্যাক্সি
সেমিকন্ডাক্টর এবং মেটেরিয়াল সায়েন্স গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আরো একটি গবেষণাগার : সেন্টার ফর এডভান্স রিসার্চ ইন ফিজিক্যাল, কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সেস৷ এখানে রয়েছে অর্ধপরিবাহী বস্তু বা ডিভাইসের নানা ধরনের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রপাতি৷ যেমন : এফটিআইআর স্পেকট্রোফটোমিটার, স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, আলট্রাসেন্ট্রিফিউজের এটমিক অ্যাবযর্বশন স্পেকট্রোস্কপি, লেসার স্পেকট্রোস্কপি, কিউ-সুইচ, এনডি: ওয়াইএজি লেসার, স্ক্যানিং মনোক্রোমিটার, অ্যাশিং ফার্নেস পিএইচ মিটার, ভার্টিক্যাল ল্যামিনার এয়ার ফ্লো ক্যাবিনেট প্রভৃতি৷ যার মাধ্যমে উচ্চতর গবেষণা কার্যক্রম সম্ভবপর হচ্ছে৷
এছাড়া সরকারি অর্থায়নে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন বাংলাদেশেভিএলএসআই প্রযুক্তির জন্য সেন্টার অব এক্সেলেন্স স্থাপন শীর্ষক প্রকরে অধীনে একটি ক্লিনরুম তৈরি শুরু করেছে৷
বুয়েটের রয়েছে ভিএলএসআই বিষয়ক একটি অত্যাধুনিক ডিজাইন গবেষণাগার৷ বুয়েট সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে এ ধরণের ডিজাইন গবেষণাগার তৈরি করে৷ বর্তমানে শিল্প ক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যবহৃত একটি সফটওয়্যার এই গবেষণাগারে রয়েছে, যার ৩ বছরের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি ১৮ হাজার মার্কিন ডলার৷
অন্যান্য দেশ : ভারত এবং মালয়েশিয়া
সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিতে প্রথমেই ভেসে আসে ভারতের নাম৷ ভারতের সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে আসতে পারে সেন্ট্রাল ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট তথা সিইইআরআই৷ রাজস্থানের পিলানিতে এর অবস্থান৷ এটি ভারতের একটি অগ্রণী প্রতিষ্ঠান৷ এ ছাড়া আছে নয়াদিল্লির কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ তথা সিএসআইআর৷ এটি উচ্চতর গবেষণা এবং উন্নয়ন (R&D) কাজের জন্য ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এটি শিল্প অবকাঠামো এবং দক্ষ জনবল তৈরি- এই দুই মৌল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কাজ করে চলেছে৷ এর ফলে ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই, পুনে, আহমেদাবাদ এবং গোয়ার মতো জায়গায় গড়ে উঠেছে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রি, ভিএলএসআই ডিজাইন, সফটওয়্যার কোম্পানি৷ এসব প্রতিষ্ঠানের ভোক্তা বাজার (কনজিউমার মার্কেট) হচ্ছে প্রায় ৪০ কোটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জনগণ, যাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান৷ এরা বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দৈন িন্দন কাজে ব্যবহার করে৷ এসব সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রিসমূহ ২০০৫ সালে ৩২০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যবসায় করেছে৷ আশা করা হচ্ছে, ২০১৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৪৩০০ কোটি বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে এবং ৭,৮০,০০০ জনের কর্মসংস্থান হবে, সেই সাথে ৩০ শতাংশের আশপাশে সিএজিআর৷
এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন টিআইএফআর, আইআইটি, আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমানসম্পন্ন ক্লিন রুম রয়েছে৷
এরপর বলা যেতে পারে মালয়েশিয়ার কথা৷ সম্প্রতি দেশটি সেমিকন্ডাক্টর ওয়েফার ফেব্রিকেশনে কারিগরি উন্নয়ন করেছে, যার শুরুটা হয় কুয়ালালামপুরে ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোইলেকট্রনিক সিস্টেম (এমআইওএমএস)-এর মাধ্যমে৷ এরপর সেমিকন্ডাক্টর ফেব্রিকেশনের জন্য স্থাপন করা হয় কুলিমে সিলতারা এবং সারাবাকে ফার্স্ট সিলিকন৷ সেই সাথে এ খাতে চাহিদা মেটানোর জন্য দক্ষ লোকবলের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়৷ ফার্স্ট সিলিকন জাপানের বিশ্বখ্যাত শার্প কোম্পানির সাথে ওয়েফার প্রসেসিং সংক্রান্ত প্রযুক্তি বিনিময়ের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধও হয়েছে৷ অপরদিকে এমআইওএম আরঅ্যান্ডডি-কে সামনে রেখে মালয়েশিয়া তার নিজস্ব মাইক্রন প্রযুক্তিতে স্মল-স্কেল ওয়েফার ফেব্রিকেশন শুরু করেছে৷
বাংলাদেশের অবস্থান
সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের শুরুটা হয় ভ্যাকুয়াম টিউব দিয়ে৷ অতঃপর ট্রানজিস্টর এবং বর্তমানে আমরা আইসির যুগে অবস্থান করছি৷ স্বাধীনতাপরবর্তী যুগে আজ পর্যন্ত বলতে গেলে এ শিল্পক্ষেত্রে আমরা কিছুই করিনি৷ এর জন্য প্রধানত দায়ী ছিল সরকারের সদিচ্ছা ও দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব৷ সেই সাথে এ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের দক্ষ ব্যক্তিদের মূল্যায়ন না করা৷ ফলে সব সময় আমরা পিছিয়ে পড়েছি৷ এক্ষেত্রে সাবমেরিন ক্যাবলের উদাহরণ দিতে পারি৷ অনেক আগেই আমরা এর প্রধান শাখায় যুক্ত হবার সুযোগ পেলেও তা গ্রহণ না করায় পরে আমাদেরকে প্রায় ৩৯২ কোটি টাকা খরচ করে একটি শাখায় যুক্ত হতে হয়েছে৷ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেলে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি হতে পারে বিরাট একটি খাত৷ এ খাতে ভারতের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে৷ একসময় বিশ্বের অন্যতম লাভজনক পেশা জাহাজ শিল্পে দেশটি এ অঞ্চলে অগ্রগামী হলেও এখন দেশটির প্রধান আগ্রহের খাত হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প৷ এ খাতে অত্যন্ত ভালো সুযোগসুবিধা থাকার ফলে তরুণ প্রজন্ম সেদিকে ঝঁুকছে৷ ফলে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল শ্রমবাজার৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যথাযথ সুবিধা দিয়ে এরা সহজেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে৷ আর আমেরিকার মতো দেশের সাথে দিন-রাতের ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে এরা পাচ্ছে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা৷ আর এসব কিছুর মূলেই রয়েছে তাদের রাষ্টীয় নীতিমালা৷ যার উদাহরণ সিইইআরআই৷ ১৯৪৮ সালে ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই ভারত এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, অথচ দেশটি তখন (১৯৪৭) সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে৷ যা-ই হোক দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার এ খাতকে কিছুটা বরাদ্দ দিচ্ছে৷ যার ফলে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে ভিএলএসআই গবেষণাগারে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়েফার ফেব্রিকেশনের জন্যে ক্লিনরুম তৈরির কাজ শুরু হয়েছে এবং আরো ৬ কোটি টাকার বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে৷ ফলে পুরো কাজটি সম্পন্ন হলে আমরা সাভারে ভিএলএসআই-এর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগার পাবো, যা আমাদের প্রযুক্তিতে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে৷ তবে বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা৷
প্রস্তাবনা
অপার সম্ভাবনাময় এই শিল্পখাতকে বিকশিত করার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পোদ্যোক্তাদের সাথে নিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারি, যাতে লাভবান হবে সব পক্ষ তথা আমাদের এই দেশ৷
এজন্য একটি সম্ভাব্য রূপরেখা হতে পারে নিম্নরূপ :
এ ব্যবস্থার কেন্দ্রে থাকবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়৷ এদেরকে সহায়তা করবে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং যৌথ কাজে আগ্রহী অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান৷ এই অংশ প্রয়োজনীয় গবেষণা শেষে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণাপত্র বের করবে এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাছে তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা দেবে৷ পাশাপাশি সেমিকন্ডাক্টর ক্ষেত্রের বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী এবং বিদেশে এ সংক্রান্ত কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে এমন দক্ষ ব্যক্তিবর্গের একটা তালিকাও তৈরি করবে, যাতে প্রয়োজনে এই ডাটাবেজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে ব্যবহার করা যায়৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশীয় উদ্যোক্তাগণ এসব কাজের ওপর ভিত্তি করে উত্পাদন প্রক্রিয়ায় যাবেন এবং এরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারকে সামনে রেখে কাজ করবেন৷ সেই সাথে এরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কাজ করবেন, যার আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় তাদেরকে দক্ষ জনবল দেবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ ইন্টার্নি সুবিধা ও গবেষণাগার নির্মাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আ ির্থকভাবে সাহায্য করবেন৷ এর ফলে একটি সমন্বিত গতিময়-উন্নয়নশীল ব্যবস্থা গড়ে উঠবে৷
যেখানে সুদক্ষ কারিগরি পর্যবেক্ষণে শটকি ডায়োড, ট্রানজিস্টর, লেজার, সৌরকোষ, সেমিকন্ডাক্টর ডিটেক্টর, এলইডি, হাইইলেকট্রন মবিলিটি ট্রানজিস্টর কিংবা অপটিক্যাল ওয়েব গাইড তৈরি করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন৷
সবশেষে বলা দরকার, দেশে সেমিকন্ডাক্টর বিষয়ে উচ্চমানের শিক্ষা এবং গবেষণা শেষ করে মেধাবী-দক্ষ জনশক্তি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, গবেষণাগার এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানে হাইটেক চাকরি পাবেন৷ অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ভিএলএসআই গবেষণাগার এবং ক্লিনরুম ঘিরে আশু প্রতিষ্ঠেয় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পায়নে আমাদের বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা নতুন নতুন গবেষণা ও আবিষ্কারে ভূমিকা রাখবেন৷ এই বাস্তব আশা আমাদের সবার৷ এভাবে দক্ষ জনশক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প দেশের জিডিপি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে৷ নীতি নির্ধারক এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য সুখবর এই যে ইন্টেল, মটোরোলা, এনভিডিয়া কিংবা এটিঅ্যান্ডটিসহ আরো অনেক বিশ্ববিখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা মোটামুটি ৫০০ জন৷ তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করলে দেশের প্রয়োজনে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব৷ বিষয়টির প্রতি এখনই সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি দেয়া জরুরি৷
..............................................................................।
এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সহযোগিতা জরুরি
অধ্যাপক ড. জালালুর রহমান
ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইকেট্রনিক্স এবং যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশ্ন : সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজিতে উন্নতির জন্য আমাদের পাঠ্যসূচীতে কী কী বিষয় থাকা উচিত?
উত্তর : ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ফিজিক্যাল ইলেকট্রনিক্স, সলিড স্টেট ডিভাইস, সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজি প্রভৃতি৷ সেই সাথে বিভিন্ন মৌলিক বিষয় যেমন : কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স, এটমিক ফিজিক্স এবং গণিতের জন্য ম্যাথামেটিক্যাল মেথডস ফর ফিজিসিস্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স পড়ানো উচিত৷
প্রশ্ন : কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে?
উত্তর : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মরহুম অধ্যাপক ড. সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে এসটিআরসিতে কিছু কাজ হয়েছে৷ এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের ওপর একটি দল কাজ করছে৷ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট কাজের লোক রয়েছেন৷ বুয়েট বর্তমানে ডিজাইনের ওপর কাজ করছে৷ বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশন একটি ক্লিনরুম তৈরি করছে৷
প্রশ্ন : অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সহযোগিতা কতটা জরুরি এবং এটি কিভাবে হতে পারে?
উত্তর : অত্যন্ত জরুরি৷ এতে সবাইকে চেষ্টা করতে হবে তবে প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ভূমিকাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ সেই সাথে রাষ্ট্রকেও এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর যথাযথ ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে৷ বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে মতভেদ দূর করে একত্রে কাজ করতে হবে৷
..............................................................................
সেমিকন্ডাক্টরশিল্পে তুলনামূলকভাবে মেধাবী ও দক্ষ লোকের দরকার
অধ্যাপক ড. এবিএম হারুন-অর-রশীদ
ইকেট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট
প্রশ্ন : বাংলাদেশে কিভাবে ভিএলএসআই ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করা যায়?
উত্তর : প্রথমে আমরা সার্কিট ডিজাইন দিয়ে শুরু করতে পারি, তারপর সেগুলোকে বিদেশী কোনো কোম্পানি থেকে ফেব্রিকেট করে, কিছুটা দক্ষতা অর্জন করে ফেব্রিকেশনে আসতে পারি৷ এর মধ্যে ডিজাইনে আমাদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু ক্রেতাও সৃষ্টি হবে৷
প্রশ্ন : টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির সাথে এই সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির তুলনাটা কেমন হতে পারে?
উত্তর : টেক্সটাইলে বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম কারণ কম খরচে উত্পাদন, কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে বেশি বেতনাদি ও সুযোগসুবিধা দিতে হবে৷ কেননা, এখানে তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম কিন্তু মেধাবী ও দক্ষ লোকের দরকার হয়৷ তবে একবার শুরু হলে এটি অনেক বেশি লাভজনক৷ তাছাড়া টেক্সটাইলের মতো এর বাজারটাও মূলত আন্তর্জাতিক৷
প্রশ্ন : দক্ষ জনবল তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেমন সুযোগসুবিধা দরকার?
উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে ডিজাইন গবেষণাগার তৈরি সম্ভবপর হলেও সঠিক রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ছাড়া ফেব্রিকেশন গবেষণা অসম্ভব৷ তবে এক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প খাতের মধ্যে সহযোগিতা জরুরি৷
প্রশ্ন : আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ ধরনের সাহায্য করা রাষ্ট্রের জন্য কি সম্ভব?
উত্তর : আমি মনে করি সম্ভব, কেননা বিভিন্ন অউত্পাদনশীল খাতে প্রচুর খরচ করা হচ্ছে৷ তাই ৫-১০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ ধরনের সাহায্য করাটা সম্ভব৷
প্রশ্ন : ইন্ডাস্ট্রি তৈরিতে কারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন?
উত্তর : সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে৷ তবে প্রবাসী বাংলাদেশীরা যারা এ খাতের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে আছেন, তাদের ভূমিকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ভারতে ব্যাপারটা এভাবেই ঘটেছে৷ আমাদের অনেক প্রাক্তন ছাত্র বিশ্বের নামকরা এসব প্রতিষ্ঠানে আছেন৷
প্রশ্ন : বর্তমানে কোন কোন দেশ ফেব্রিকেশনের কাজ করছে?
উত্তর : জাপান, কোরিয়া, আমেরিকা, চীন, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া৷
..............................................................................
দেশীয় খাতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন কাঁচামাল এবং উত্পাদন কর কমাতে হবে
অধ্যাপক ড. খন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশ্ন : সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি গবেষনার প্রধান অন্তরায়গুলো কী কী?
উত্তর : অবকাঠামো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, বিশ্বায়নের প্রভাব এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত৷
প্রশ্ন : এসব সমস্যাকে মোকাবেলা করে আমরা কিভাবে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ে তুলতে পারি?
উত্তর : প্রথমেই বলব প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প গড়ে তুলতে হবে৷ আর এক্ষেত্রে দেশীয় খাতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন কাঁচামাল এবং উত্পাদন কর কমাতে হবে৷ বিষয়টিতে দীর্ঘমেয়াদী সময় নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে৷ শুরুতেই লাভের চিন্তাকে বাদ দিয়ে তাকে বিকশিত হতে দিতে হবে৷ এতে দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা গড়ে উঠবে এবং তখন এরা অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসবে৷ এতে দেশীয় প্রযুক্তিতে সঠিক শিল্প গড়ে উঠবে৷ এনবিআরকে সঠিকভাবে পরিচালিত হতে হবে৷
প্রশ্ন : আমাদের মতো দেশে এ প্রযুক্তির বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কেমন?
উত্তর : তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্যই তা খুবই কঠিন৷ তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগের ফলে তৃতীয় বিশ্বেও এ শিল্পের সম্প্রসারণ সম্ভব৷
কজ ওয়েব
প্রচ্ছদ এবং প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবি গুলো বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে৷
লেখক : যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স এবং কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষ সম্মানের ছাত্র৷
ফিডব্যাক : zhmjami@yahoo.com
onirban_islam@yahoo.com