• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের সঙ্কট
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: আবীর হাসান
মোট লেখা:১৫০
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৪ - অক্টোবর
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ফিচার
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি বিপ্লব
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের সঙ্কট

রূপান্তরের মূল ক্ষেত্রগুলোকে নিশ্চয়ই এতদিনে চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু কাজ কি হচ্ছে আশানুরূপ? প্রশ্নটা উঠছেই। কারণ, কিছুদিন পরপর তথ্য-উপাত্ত যা আসছে কিংবা আন্তর্জাতিক তুলনামূলক প্রতিবেদন- তাতে খুব একটা আস্থা থাকছে না রূপান্তরমূলক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাংবাদিকেরা যা দেখছেন, তাতেও সঙ্কটের আবর্তের মধ্যেই যে রয়ে গেছে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার কাজ, তাতে সন্দেহ নেই।

অতিসম্প্রতি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) একটি প্রতিবেদন দিয়েছে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি সম্পর্কে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির রেটিং করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। এতে দেখা যাচ্ছে- সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ২৮ দেশের মধ্যে ২৭তম, শিক্ষায় ২৫তম, উদ্ভাবনে ২৭তম এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ২৬তম। উপসূচক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেই শুধু বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা ভালো, শুল্ক ও অশুল্ক কাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিধি-বিধান পর্যবেক্ষণ করে এই উপসূচকের মূল্যায়ন করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ অন্যান্য বিষয়েও কি ওই ধরনের অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে? তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে শুধু কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর গড় মান যেখানে ১০-এর মধ্যে ৪ দশমিক ২৮, সেখানে বাংলাদেশের মান ১ দশমিক শূন্য ১। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মান ৩ দশমিক ৬ ও ভারতের ১ দশমিক ১।

উদ্ভাবনে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম আর সূচক ১ দশমিক ৬৯। ২৮তম অবস্থান নিয়ে মিয়ানমায় রয়েছে সবার শেষে। তাদের সূচক ১ দশমিক ৩। এ ক্ষেত্রে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গড় সূচক ৪ দশমিক ৫। উদ্ভাবনে ভারতের সূচক ৪ দশমিক ৫ ও অবস্থান ১১তম। পাকিস্তানের ২ দশমিক ৮৫ ও নেপালের ১ দশমিক ২৩।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম আর মিয়ানমারও এগিয়ে রয়েছে, ভারত-শ্রীলঙ্কা তো আছেই। তবে পিছিয়ে রয়েছে নেপাল, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া। তবে গড়ে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক গড় যেখানে ১০-এর মধ্যে ৪ দশমিক ৬৬, সেখানে বাংলাদেশের সূচক ১ দশমিক ৭৫।

এবার দেখা যাক, প্রথম দিকের দেশ কোনগুলো। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে প্রথম অবস্থানে রয়েছে চীন। সার্বিকভাবে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতেও প্রথম অবস্থানে চীন। তারপর রয়েছে হংকং এবং তৃতীয় জাপান। উদ্ভাবনে প্রথম অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর আর শিক্ষায় প্রথম অবস্থানটি দক্ষেণ কোরিয়ার।

গত এপ্রিল ২০১৪-এ প্রতিবেদনটি প্রস্ত্তত করে এডিবি এবং গত মাসে তা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রতিবেদনটি যেদিন অর্থমন্ত্রীর হাতে পৌঁছায়, সেদিন তিনি বলেছিলেন- এডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট তাকে জানিয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, শিক্ষা ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি- এই চারটি বিষয়েই বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে, তবে দেশটির অগ্রগতি ভালো। আর অর্থমন্ত্রীর নিজের ভাষ্য হচ্ছে- ‘স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) অবস্থান থেকে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার যাত্রা শুরু করেছে। এখন ভালো একটা উত্তরণ দরকার আর সেটা করতে হবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ভালো করার মাধ্যমে।’

অর্থমন্ত্রীর এই পর্যবেক্ষণের সাথে নিশ্চয়ই কেউই দ্বিমত পোষণ করবেন না। কিন্তু দিনবদলের অগ্রযাত্রার উপলব্ধির তুলনায় আমাদের অগ্রযাত্রা যে শস্নথগতির সেটাও স্বীকার করতে হবে। এডিবির প্রতিবেদনের তথ্যনিষ্ঠতা নিয়ে অবশ্য ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা বলছেন- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নেপালের চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

অবশ্যই এ বক্তব্যের মধ্যে সারবত্তা কিছু আছে। কারণ, বছর দুয়েক আগেও এই খাতে নেপালের চেয়ে বেশ এগিয়েই ছিল বাংলাদেশ। তবে এটাও সত্যি, যুগের প্রয়োজনে নেপালকে এ ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হয়েছে- অন্যতম আর্থিক খাত পর্যটন শিল্পকে সচল ও হালনাগাদ রাখতে নেপাল সরকারের চেয়ে বেশি বেসরকারি খাতের উদ্যোগেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত অগ্রগামী ও গতিশীল হয়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই একই সময়ে বাংলাদেশে কি কোনো কাজ হয়নি বা হচ্ছে না? এর মধ্যে তো অনেক সেস্নাগানকে আমরা সামনে নিয়ে এসেছি- বলছি ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং দিনবদলের কথাও। এটুআইয়ের মতো কিছু উদ্যোগও সরকার নিয়েছে, যার মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছানো হচ্ছে। তবে বিকাশের সংখ্যা ও বিসত্মৃতির গতি যে খুব বেশি নয় তাও সত্যি। এছাড়া অন্যান্য উদ্যোগও আছে বেসরকারি পর্যায়ে। ই-কমার্সের প্রসারে কমপিউটার জগৎ-এর অবদান এবং কম মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেয়ায় মোবাইল অপারেটরগুলোর অবদান উল্লেখযোগ্য।

তবে এ কথাও সত্যি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিকাশের বড় দায়ভারটা সরকার যতটা রাজনৈতিকভাবে নিজের কাঁধে নিয়েছে, সে তুলনায় কর্ম-কুশলতা তেমন দেখাতে পারেনি। ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১০ সালের আগস্ট মাসের পর আর কোনো বৈঠকও হয়নি বলে রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে কমপিউটার জগৎ-এ।

তবে এটাই মুখ্য সমস্যা নয়। এডিবির রিপোর্টকে ভুল বা খুঁতযুক্ত প্রমাণ করতে হলে অন্যান্য পারফরম্যান্সও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গাজীপুরের হাইটেক পার্ক নিয়ে জটিলতার অবসান হয়নি, অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে পারেনি কারওয়ান বাজারের সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কও। প্রতিশ্রুত জেলায় জেলায় টেকনোলজি পার্ক সম্ভবত সরকারি পরিকল্পনাতেও নেই। এগুলো হয়নি বলেই যে অগ্রগতি কম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে- সেটাও বহু কথিত।

এ ক্ষেত্রে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি উদ্ভাবনের বিষয়টিকে। হাইটেক পার্ক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের মূল উদ্দেশ্যই ছিল উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি উন্নয়ন করে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করা। অথচ প্রায় প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছে বাংলাদেশ। দোষ দেয়া যাবে না উদ্ভাবকদের। এরা যে পারেন তা বিদেশে গিয়ে প্রমাণ করছেন। কেউ কেউ দেশেও অনেক সৃজনশীল প্রকল্প তৈরি করেছেন, কিন্তু বিষয়গুলোকে দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেভেলে প্রযুক্তি করার উদ্যোগ কই? ডিজিটাল বাংলাদেশ সেস্নাগান তোলা সরকারের দায় কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেকটাই। উদ্যমীদের উদ্যোগের পরিপুষ্টি জোগান সরকার শুরু করলে বেসরকারি মূলধারার শিল্প-বাণিজ্যও আগ্রহী হতো নিঃসন্দেহে। সেটা তো এখন পর্যন্ত হয়নি। ফলে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রটাতে এডিবি কথিত ওই ১ দশমিক ৬৯ রেটিংয়ে মিয়ানমারের ওপরেই মাত্র অবস্থান করতে হচ্ছে। এই রেটিংয়ের জন্য তো এডিবিকে দোষ দেয়া যাবে না, প্রত্যুত্তরে দেখানো যাবে না- কত কিছু আমরা করতে পেরেছি!

শিক্ষা ক্ষেত্রের অবস্থাকে ঠিক ভয়াবহ বলা না গেলেও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গড়ের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে- ৪ দশমিক ৬৬-এর বিপরীতে বাংলাদেশের মান ১ দশমিক ৭৫। মাইক্রো লেভেলের পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে সঙ্কটটা কোথায়? পাসের হার বাড়ার সাথে এই মানের সম্পর্ক নেই। কারণ, বিষয়টি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কিত, যার সাথে বিজ্ঞান শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষা দুটোরই মূল্যায়ন করা হয়।

জ্ঞানচর্চার বাধাও এখানেই এবং স্বভাবতই জাতীয় অর্থনীতিকে জ্ঞানভিত্তিক করে তোলার সমস্যাটারও শুরু এ কারণেই। বহু আগেই বিজ্ঞান বিষয়ের ওপর আগ্রহ বাড়ানো এবং ইংরেজি বিষয়কে ভীতিমুক্ত করায় বিশেষ উদ্যোগের তাগিদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক বিগত দুই দশকের বেশি সময়েও সমস্যাটার সুরাহা হয়নি।

সমস্যা অর্থমন্ত্রীর বলা কথাতেই স্পষ্ট। শিক্ষা এবং তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে উন্নতি করতে থাকলে স্বল্পোন্নত অবস্থান থেকে মধ্যম পর্যায়ে দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব। এই বিষয়টিকে পথনির্দেশক হিসেবে নিয়ে এখন যা করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে শিক্ষার ও শিক্ষকের মান এবং পাঠসূচির আধুনিকীকরণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

কাজেই একাধারে মাধ্যমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার মানোন্নয়নে যেমন কাজ করতে হবে, তেমনি উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো ও শিল্পোদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম বিশ্বমানের উদ্যোগগুলোকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলে রূপান্তরও ঘটবে প্রাক্কলিত সময়ের আগেই ।

ফিডব্যাক : abir59@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস