ই-ভোটিং। প্রযুক্তির এক অবদান। এর যেমনি সুবিধা আছে, তেমনি আছে এর নিরাপত্তা নিয়ে কিছু শঙ্কা। সেজন্য আমাদের দেশে ই-ভোটিং চালু হবে কি হবে না, তা নিয়ে আছে বিতর্ক। এ প্রেক্ষাপটেই আমাদের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের বিষয় ই-ভোটিং।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ জুন বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া সব দেশেই ইলেকট্রনিক ভোটিং তথা ই-ভোটিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বাংলাদেশেও ই-ভোটিং চালু হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনেই ই-ভোটিং চালু করা হবে। অপরদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল কারচুপির অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ ই-ভোটিং চালু করতে চাইছে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের দিন ৭ জুন ৩৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে মতবিনিময় কর্মসূচি শুরু করেছে। এই মতবিনিময় চলবে আগামী ১৪ জুলাই পর্যন্ত। এই মতবিনিময় বা সংলাপ যে ৫টি বিষয়ে চলবে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ই-ভোটিং চালু হবে কি হবে না। তবে এরই মধ্যে যেসব মতামত পাওয়া গেছে, তাতে বলা যায় ই-ভোটিং নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ই-ভোটিং চালুর পক্ষে তার দলের সমর্থন আছে বলে জানিয়ে বলেন, আমরা ইভিএম সমর্থন করি, তবে তা রাতারাতি চালু সম্ভব নয়। অপরদিকে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ড. অলি আহমদের অভিমত হচ্ছে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন অর্থাৎ ইভিএম চালু করতে হলে ভোটারদের আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক করতে হবে। তা না হলে ভুয়া ভোটার আটকানো যাবে না। তিনি আরও বলেছেন, কেউ যাতে ইভিএম চালুর নামে অর্থ উপার্জনের সুযোগ না পায়, জাতীয় সম্পদের যেনো অপচয় না হয়, সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে। ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে ইভিএম চালুর পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল)। তাদের মতে, বাংলাদেশের নির্বাচনে ইভিএম বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। অপরদিকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ইভিএমে ভোট কারচুপির রক্ষাকবচ না থাকায় এ সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাধরেরা প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে আবারও ক্ষমতায় আসার সুযোগ নিতে পারে। ইভিএম চালুর ব্যাপারে সরকারের অতিউৎসাহ দেখে সাধারণ মানুষের মাঝে সে সন্দেহই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন ভোট কারচুপি ও ভোট ছিনতাই অনেক কষ্ট। এ পদ্ধতি চালু করলে সে কষ্ট কমে যাবে। সংলাপে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে ন্যাপ ও ওয়ার্কার্স পার্টি। ন্যাপ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনামুল হক বলেন, ইভিএম ব্যবহার করলে নির্বাচনের খরচ কমবে। তার মতে, ইভিএম পদ্ধতিতে এমন প্রযুক্তি সংযোজন দরকার, যাতে কেউ কেন্দ্র দখল ও ভোট জাল করতে না পারে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ইভিএম প্রশ্নে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। তিনি তার নির্বাচনী এলাকার সব কটিতে নয়, কয়েকটি কেন্দ্রে ই-ভোটিং চালু করার পরামর্শ দেন।
বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, ইভিএম পদ্ধতি ভালো। কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে এর নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। শুধু বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কোনো একটি পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে না। অপরদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে পরীক্ষামূলকভাবে স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম চালু করতে হবে। শুধু এরপরই জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) নেতারা ইভিএম প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব প্রশ্ন রয়েছে সবার আগে তা সমাধানের প্রস্তাব দেন। একইভাবে জাকের পার্টির নেতা মোস্তফা আমির ফয়সাল মোজাদ্দেদী বলেন, ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব প্রশ্ন রয়েছে আগে তার সমাধান করতে হবে। এদিকে জাতীয় দৈনিকের ও অন্যান্য গণমাধ্যমের সম্পাদকরা বিরোধী দলের সাথে আলোচনা না করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালু না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। গত ১১ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের সাথে মতবিনিময়ের সময় সম্পাদকরা এ আহবান জানান।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এই সংলাপ এখনও অর্ধেকেরও বেশি বাকি। তার আগেই গত ২১ জুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, বিরোধিতা সত্ত্বেও ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন কমিশন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাবে। কমিশনের নিজস্ব চিন্তাভাবনা থেকে এ প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। চট্টগ্রামে এ প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে। অন্যান্য নির্বাচনেও এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে। বিরোধিতার কারণে কোনোভাবেই ইভিএম পদ্ধতি পরিত্যক্ত হতে দেয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে মনে হয় সরকার ই-ভোটিং চালুর ব্যাপারে শক্ত একটা অবস্থান নিতে পারে। এ ব্যাপারে সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রস্ত্ততি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রি. জে. সাইফুর রহমান বলেছেন, চলতি বছরের আগস্টের মধ্যে কার্যাদেশ পেলে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনের জন্য ইভিএম তৈরি করা সম্ভব হবে।
ই-ভোটিংয়ের সমর্থকদের কথা হচ্ছে- প্রযুক্তিনির্ভর এই ভোটিং ব্যবস্থায় সঠিকভাবে দ্রুততর সময়ে নির্বাচন সম্পন্ন ও ফল প্রকাশ করা যায়। এর বিরোধিতাকারীরা বলে ই-ভোটিং মেশিন যথাযথ নিরাপদ নয়। এর ভোট রেকর্ডিং পাল্টে দিয়ে ভোট জালিয়াতি চলতে পারে। বিষয়টির সম্যক উপলব্ধির জন্য আমাদেরকে আগে জানতে হবে ই-ভোটিং প্রযুক্তি আসলে কী।
ই-ভোটিং প্রযুক্তি
ই-ভোটিং মেশিন অর্থাৎ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বলতে আমরা বুঝি কমপিউটারায়িত ভোটিং মেশিনকে, যাতে ব্যবহার হয় পেপার ব্যালটের বদলে ইলেকট্রনিক ব্যালট। এর আরেক নাম ‘ডাইরেক্ট ইলেকট্রনিক মেশিন’। সংক্ষেপে ডিআরই।
ই-ভোটিং মেশিন তিন ধরনের-
০১. টাচ স্ক্রিন মেশিন : এ ক্ষেত্রে ভোটাররা কমপিউটারের এলসিডি স্ক্রিনের ওপর ইলেকট্রনিক ব্যালট স্পর্শ বা টাচ করে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে;
০২. পাঞ্চ-কী মেশিন : এ মেশিনে ব্যবহার হয় একটি কী-পেড। এই কী-পেডে থাকা ইলেকট্রনিক ব্যালটের ওপর ভোটার তার পছন্দমতো ভোট দেন এবং
০৩. হুইল মেশিন : এই মেশিনে একজন ভোটারকে একটি হুইল বা চাকা ঘুরিয়ে পছন্দমতো বোতাম টিপে ভোট দিতে হয়।
সাধারণ অর্থে প্রধানত দুই ধরনের ই-ভোটিং চিহ্নিত করা যায়। প্রথমেই আসে সেই ই-ভোটিং, যেখানে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনগুলো নির্বাচনী কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এগুলোর পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানে থাকেন সরকারের প্রতিনিধি বা স্বাধীন নির্বাচন কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে রিমোট ই-ভোটিং, এ ক্ষেত্রে ভোট দেয়া হয় ভোটারের নিজস্ব প্রভাবে। সেখানে সরকারি কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিনিধি সশরীরে উপস্থিত থাকেন না। এ ক্ষেত্রে একজন ভোটার তার পার্সোনাল কমপিউটার, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ইত্যাদি থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারেন। এ ধরনের ভোটিংকে আই-ভোটিং বলা হয়। বাংলাদেশে যে ধরনের ই-ভোটিং চালুর কথা ভাবা হচ্ছে, সেটি এখানে উল্লিখিত প্রথম ধরনের ই-ভোটিং।
ডিআরই ভোট ব্যবস্থা
একটি ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক (ডিআরই) ভোট মেশিন ভোট রেকর্ড করে মেকানিক্যাল বা ইলেকট্রো-অপটিক্যাল উপায়ে প্রদর্শিত হয় একটি ব্যালট ডিসপ্লেতে। আর ভোট মেশিন চালু করে ভোটার নিজে। বোতাম টিপে বা টাচ স্ক্রিনে স্পর্শ করে মেশিনটি চালু করা যায়। এই ভোট মেশিন ডাটা প্রসেস করে কমপিউটার সফটওয়্যারের সাহায্যে। আর এটির মাধ্যমে ভোট ডাটা ও ব্যালটের ছবি রেকর্ড হয় একটি মেমরি কম্পোনেন্টে। নির্বাচনের পর ভোট টেব্যুলেশন জমা করা হয় একটি রিমোবেবল মেমরিতে অথবা একটি ছাপা কপিতে। এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কোনো অফিসে কারও মোট পাওয়া ভোটের হিসাব পাঠানোর সুয়োগ সৃষ্টি করা যেতে পারে যেখান থেকে ভোটের ফল ঘোষণা করা যাবে।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘হেল্প অ্যামেরিকা ভোট অ্যাক্ট’ ম্যান্ডেট দেয় যে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী ভোটব্যবস্থা থাকতে হবে। এই প্রয়োজন মেটানো হয় ডিআরই ভোট মেশিনের মাধ্যমে ২০০৪ সালের নির্বাচনে। নিবন্ধিত ভোটারের ২৮.৯ শতাংশ ভোটার এ ধরনের ডিআরই ভোট মেশিন ব্যবহার করে।
পাবলিক নেটওয়ার্ক ডিআরই ভোট ব্যবস্থা
পাবলিক নেটওয়ার্ক ডিআরই ভোট ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা, যেখানে ইলেকট্রনিক ব্যালট ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে ভোট ডাটা স্থানান্তর করা হয় ভোট গ্রহণের স্থান থেকে অন্য কোনো স্থানে একটি পাবলিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। স্বতন্ত্র ব্যালটের মাধ্যমেও সময়ে সময়ে নির্বাচনের দিনে গুচ্ছভাবে কিংবা ভোটশেষে একবারেও ভোট ডাটা পাঠানো যেতে পারে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে ইন্টারনেট ভোটিং ও টেলিফোন ভোটিংও। পাবলিক নেটওয়ার্ক ডিআরই ভোটিং সিস্টেমে precinct count method (নির্বাচন কেন্দ্র এলাকায় ভোট গণনা পদ্ধতি) অথবা control count method ব্যবহার করতে পারে। কন্ট্রোল কাউন্ট মেথডে একটি স্থানে ব্যালট টেবুলেশন চলে মাল্টিপল প্রিসিঙ্কট থেকে পাওয়া ব্যালটের মাধ্যমে। ইন্টারনেট ভোটিংয়ে রিমোট লোকেশন ব্যবহার করে ভোট নেয়া হতে পারে। ইন্টারনেট ক্যাবল কমপিউটার থেকে অথবা প্রচলিত ভোটকেন্দ্রেও ব্যবহার হতে পারে, যে ভোটকেন্দ্রে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
বিভিন্ন দেশের করপোরেশন ও সংগঠন তাদের কর্মকর্তা ও বোর্ড মেম্বার নির্বাচনে ও অন্যান্য প্রক্সি ইলেকশনে ইন্টারনেট ভোট ব্যবস্থা কাজে লাগায়। ইন্টারনেট ভোটিং বেসরকারিভাবে অনেক আধুনিক দেশে ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে সরকারিভাবে এর ব্যবহার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও এস্তোনিয়ায়। সুইজারল্যান্ডে ইন্টারনেট ভোটিং লোকাল রেফারেন্ডাম অর্থাৎ স্থানীয় গণভোটে এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠিত ভোট ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। সেখানে ভোটাররা তাদের ব্যালটে প্রবেশের জন্য ডাকে একটি পাসওয়ার্ড পান। এস্তোনিয়ার বেশিরভাগ ভোটার চাইলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্থানীয় ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাদের ভোট দিতে পারেন। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই ই-ভোটিং ব্যবস্থায় প্রবেশ রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশে এ সুযোগ আছে। সেখানে তা সম্ভব হওয়ার কারণ বেশিরভাগ এস্তোনীয়র রয়েছে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র। এই পরিচয়পত্রে আছে কমপিউটারে পাঠযোগ্য একটি মেমরি চিপ। এস্তোনীয়রা এই কার্ড ব্যবহার করে অনলাইন ব্যালটে ঢোকার জন্য। সব ভোটারের থাকতে হবে একটি কমপিউটার, একটি ইলেকট্রনিক কার্ড রিডার, জাতীয় পরিচয়পত্র ও এর পিন (PIN) তথা পার্সোনাল আইডি নাম্বার। তা থাকলে একজন ভোটার পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে ভোট দিতে পারবেন। এস্তোনীয় ই-ভোট দেয়া যায় নির্ধারিত আগাম ভোট দেয়ার দিনগুলোতে।
পেপার-ভোটিং বনাম ই-ভোটিং
পেপার-ভোটিং আর ই-ভোটিংয়ের মধ্যে তুলনা করতে গেলে বেশ কিছু বিষয় সামনে আসে। ব্যালট পেপার নির্বাচন গণতান্ত্রিকভাবে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ে তা সম্ভব নয়। কারণ পেপার ব্যালট হাতে ধরে সবাই পরীক্ষা করে দেখতে পারে। পেপার ব্যালট দৃশ্যমান এবং স্পর্শ করে অনুধাবনযোগ্য। এটি হঠাৎ করে আসেনি বলে সবার কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। সব গণতান্ত্রিক দেশ দীর্ঘকাল ধরে এর ব্যবহার করে আসছে। পেপার ব্যালটের নগণ্য অংশ হারিয়ে যেতে পারে, চুরি কিংবা ছিনতাই হতে পারে। কিন্তু কোনো বাইরের দেশ, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে সব ভোট ছিনিয়ে নিয়ে নির্বাচনের সার্বিক ফল পাল্টে দেয়া সম্ভব হবে না। এসব বিবেচনায় গণতন্ত্রের জন্য পেপার ব্যালটই উত্তম বলে বিবেচিত। আর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর কাছে পেপার ব্যালটই তাদের প্রথম পছন্দ।
অপরদিকে ই-ভোটিংয়ের নির্বাচনের ওপর যথাযথ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ সম্ভব হয় না। কারণ কমপিউটার প্রক্রিয়ার ওপর যথাযথ নজর রাখা ভোটার বা প্রার্থীর পক্ষে সম্ভব হয় না। কেননা একটি ইলেকট্রনিক মেশিনের ভেতরে যেসব অপারেশন চলে তা সবার পক্ষে জানাও সম্ভব নয়। অতএব যারা এর প্রোগ্রাম তৈরি করেনি, তাদের কাছে কমপিউটার কাজ করে একটি ব্ল্যাকবক্সের মতো এবং এসব মেশিনের অপারেশন সত্যিকার অর্থে জানতে হলে প্রয়োজন হবে এর ইনপুট জানা। আর তা পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন হবে প্রত্যাশিত আউটপুটের সাথে প্রকৃত আউটপুটের তুলনা করে। দুর্ভাগ্যবশত, ভোটের গোপনীয়তার কারণে নির্বাচনে ব্যবহারের ই-ভোটিং মেশিনে সবার জানা কোনো ইনপুট থাকে না। থাকে না কোনো প্রত্যাশিত ইনপুট জানার সুযোগও। অতএব ইলেকট্রনিক নির্বাচন প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখার কোনো সুযোগ থাকে না। ইলেকট্রনিক ভোটের ফল এর প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল এবং যাচাইয়ের অযোগ্য। কোনো কারিগরি সমাধানই এই অসুবিধা দূর করতে পারে না।
সাধারণ মানুষের কাছে ইলেকট্রনিক নির্বাচনের ফল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য প্রয়োজন এর যথার্থতা সম্পর্কে তাদের আস্থা থাকা। সেই সাথে প্রয়োজন পুরো নির্বাচনযন্ত্র তথা নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত লোকজন, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা ও সততা। বাস্তবতাদৃষ্টে এই আস্থা, সততা ও নিরাপত্তা সম্ভব নয় বলেই অনেকেই মনে করেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং গণতন্ত্রের সাথে মানানসই নয়। তা সেখানে যেকোনো ধরনের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ব্যবহার হোক না কেনো।
ধরুন, আমাদের রয়েছে একটি যথাযথ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। এর রয়েছে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা, জবাবদিহিতা, যথার্থ মান এবং পছন্দমতো জনমূল্যায়নের ব্যবস্থা। আশানুরূপ এত কিছু থাকার পরও ভোটগুলো জমা হবে একটি নামহীন মেমরিতে। আর একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যাচাইয়ের অযোগ্য এই ডাটা যাচাইহীনভাবে নির্ধারণ করবে নির্বাচনে কে বিজয়ী। সে জন্য সমাজজ্ঞানীরা বলছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং কারিগরি সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক সমস্যা। নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সরকার দেখাতে পারে না ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ের পাওয়া ফল সঠিক। অপরদিকে বিরোধীদের হাতেও এমন কোনো উপায় নেই যে, অনিয়ম আর জালিয়াতির সমর্থনে কোনো প্রমাণ হাজির করে।
যখন যথার্থ গণতান্ত্রিক উপায়ে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন মানুষ প্রকৃত ভোট টালি করতে পারে। কারণ ভোটাররা ব্যালট পেপারের ওপর হাতে লিখে অথবা সিলের ছাপ দেয়, যা সবার দর্শনযোগ্য। আর যখন ব্যালট পেপারগুলো জনসমক্ষে ভোটকেন্দ্রের একই স্থানে গণনা হয়, তখন কেন্দ্রীয় নির্বাচন প্রতিষ্ঠানের সেখানে কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে না। তখন গোটা নির্বাচনী এলাকার বহুসংখ্যক ভোটকেন্দ্রে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের সামনেই কার্যত ভোট গণনা ও ফল ঘোষণার কাজটি চলে। অপরদিকে একটি ই-ভোটিং কমপিউটারে ভোটার কোন বোতাম টিপে কিংবা ভোটিং মেশিনের স্ক্রিনের কোথায় টাচ করে ভোট দিয়েছেন, তার তথ্য টালি করে। এসব তথ্য সংগ্রহ করে জমা করা হয় একটি অজানা, সাধারণ মানুষের বোধগম্যহীন, অপঠনযোগ্য বাইটসের আকারে। তখন ভোটগুলো গণনা হয় ও ফল ঘোষণা করা হয় এককভাবে ইলেকটোরাল সার্ভিসের তথা নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে। আর এই নির্বাচন কমিশন থাকে পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ফলে কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব হয় না ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ের বেলায়।
তা ছাড়া আজকের দিনে বিশ্বের অনেক দেশকেই মোকাবেলা করে চলতে হয় দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে পরিচালিত সন্ত্রাসীদের বিপজ্জনক সন্ত্রাসী আঘাত। গণতান্ত্রিক নির্বাচন পন্ড করে এরা এ কাজটি অনেক সময় সম্পন্ন করতে চায়। ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ের বেলায় তাদের জন্য এ কাজটি করা সহজেই সম্ভব হয়। কারণ সন্ত্রাসীরা এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যে পরিণত করতে পারে ইলেকট্রনিকভিত্তিক নির্বাচনের গোটা কমপিউটার নেটওয়ার্কের ওপর। নেটওয়ার্কের কোনো একটি পয়েন্টে আঘাত হেনেই তা করা সম্ভব। পেপার ব্যালটের বেলায় আঘাত হানার এমন কোনো একক লক্ষ্যস্থল খুঁজে পাওয়া যাবে না- যেখানে আঘাত হেনে গোটা নির্বাচনকে বানচাল করে দেশকে অস্থিতিশীল করে দেয়া যায়। কিংবা নির্বাচনের ফল পাল্টে দেয়া যায়।
ইলেকট্রনিক ব্যালটের সবকিছুই চোখের সামনে। এতে ঘোরপ্যাচের কিছুই নেই। একে অকার্যকর করে দেয়ার জন্য এমন একক কোনো পয়েন্ট নেই, যা অকেজো করে দিয়ে নির্বাচনের ফল ঘোষণাকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। কমপিউটার নেটওয়ার্ক অকেজো হয়ে গেলে কিংবা বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিলেও পেপার ব্যালটের নির্বাচন পরিচালনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। যখন বিদ্যুৎ ছিল না, কমপিউটার ছিল না, তখনও পেপার ব্যালটের নির্বাচনে কোনো অসুবিধা হয়নি এবং এ নিয়ে কোনো মহল থেকে কোনো বিতর্ক বা বিরোধিতাও আসেনি।
ইলেকট্রনিক নির্বাচন হচ্ছে কমপিউটার নেটওয়ার্ক ও কমপিউটার সেন্টারভিত্তিক, যা হয়ে উঠতে পারে সন্ত্রাসীদের প্রধান টার্গেট। আসলে সন্ত্রাসীরা হামলার টার্গেট করে নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ওপর। আর কমপিউটার সেন্টারে হামলা করে নির্বাচনের ফল ঘোষণাকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। যেসব সন্ত্রাসীরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তারা এভাবে নির্বাচন বানচাল করে দেশকে বৈধ পার্লামেন্ট বা সরকারশূন্য করতে চেষ্টা করে।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের কথা প্রস্তাব করেছে তাতে বলা হয়েছে- ব্যালট কাগজে সিল মেরে ভোট দেয়ার বদলে ইভিএমে পছন্দের প্রতীকের পাশে সুইচ টিপে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
এর সুবিধা :
নির্বাচন কমিশনের দাবি মতে এর প্রস্তাবিত ইভিএম ব্যবহারের সুবিধাগুলো হলো- ০১. ব্যালট পেপার ছাপানোর ও পরিবহনের খরচ কমবে, ০২. ভোটের ফল নির্ভুল হবে, ০৩. ফল ঘোষণা দ্রুত হবে, ০৪. ইভিএম বাতিল ভোট গ্রহণ করবে না, ০৫. একই ইভিএম পরবর্তী নির্বাচনেও ব্যবহার করা যাবে এবং ০৬. কেন্দ্র দখল করে ভোটের ফল পাল্টে দেয়া যাবে না।
ইভিএমের ইউনিটগুলো :
প্রস্তাবিত এই ইভিএমের দুটি ইউনিট বা অংশ রয়েছে : ব্যালট ইউনিট ও কন্ট্রোল ইউনিট।
ব্যালট ইউনিট থাকবে বুথের ভেতরে। এ ইউনিটের ওপর প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক ছাপানো থাকবে। প্রতিটি প্রতীকের পাশে রয়েছে একটি করে সুইচ। কোনো প্রতীকের পাশের একটি সুইচ টিপলে এর পাশের সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে ও বীপ শব্দ শোনা যায়। বাতি জ্বলা দেখে ও বীপ শব্দ শুনে ভোটার বুঝতে পারবেন যে তার ভোট গৃহীত হয়েছে। অক্ষরজ্ঞানহীন লোকও সহজেই ইভিএম ব্যবহার করে ভোট দিতে পারবেন। ভোটার ভোট দেয়ার সাথে সাথে যন্ত্রটি ভোটের তথ্য তার মেমরিতে নিয়ে যায়। ইভিএমের মেমরি ন্যূনতম ১০ বছর তথ্য অবিকৃত ধরে রাখতে পারবে।
কন্ট্রোল ইউনিটটি থাকবে প্রিসাইডিং অফিসারের সামনের টেবিলে। এই ইউনিটে ‘ব্যালট’ নামের একটি সুইচ রয়েছে। এই সুইচ টিপলে বুথের মধ্যে রাখা সংযুক্ত ব্যালট ইউনিট একটি ভোট নেয়ার জন্য কার্যকর হবে। ‘ব্যালট’ সুইচ চেপে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ভোটারকে ভোট দিতে বুথে পাঠাবেন। ভোটার ভোট দেয়ার সাথে সাথে ব্যালট ইউনিট অকার্যকর হয়ে যায়। সে অবস্থায় বারবার ভোট দিলেও মেশিন তা আর গ্রহণ করবে না। ভোট দেয়ার পর ভোটার বুথ থেকে বেরিয়ে গেলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের ‘ব্যালট’ সুইচ চেপে পরবর্তী ভোটারের জন্য ব্যালট ইউনিটটি কার্যকর করবেন।
কন্ট্রোল ইউনিটের সামনের দিকে রয়েছে একটি বড় ডিসপ্লে, যা সবাই দেখতে পারেন। ভোটার সঠিকভাবে ভোট দিতে পারলে ডিসপ্লেটির সংখ্যা ১ বেড়ে যায়। এর ফলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার বা পোলিং এজেন্টরা সহজে বুঝতে পারবেন যে ভোটারের ভোটটি মোট ভোটের সাথে যোগ হয়েছে।
প্রার্থীর সংখ্যা :
প্রতিটি ইউনিটে ১২ জন প্রার্থীর জন্য ব্যবস্থা থাকে। প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হলে দুটি কিংবা তিনটি, এমনকি পাঁচটি পর্যন্ত ব্যালট ইউনিট পরস্পর যুক্ত করে প্রার্থীর সংখ্যা ৬০-এ উন্নীত করা সম্ভব। প্রার্থীর সংখ্যা ১২-র কম হলে অপ্রয়োজনীয় সুইচগুলো অকার্যকর করে রাখা হবে। কোনো আসনে ৭ জন প্রার্থী হলে সেখানে ৭টি সুইচ কার্যকর রেখে বাকি সুইচগুলো অকার্যকর করে দেয়া হবে।
ভোট গণনার পদ্ধতি :
প্রতিটি বুথের ফল আলাদা আলাদাভাবে দেখা যায়। ভোট নেয়া শেষে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের ‘ক্লোজ’ সুইচ চেপে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেন। এ সুইচ চাপার পর ব্যালট ইউনিট আর কার্যকর হবে না। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ‘ফাইনাল রেজাল্ট’ সুইচ চাপলে ব্যালটে প্রথম প্রার্থীর নাম ও পাওয়া মোট ভোটসংখ্যা কন্ট্রোল ইউনিটের ডিসপ্লেতে দেখাবে। ‘ফাইনাল রেজাল্ট’ সুইচ দ্বিতীয়বার চাপলে দ্বিতীয় প্রার্থীর পাওয়া মোট ভোটের পরিমাণ জানা যাবে। এভাবে প্রত্যেক প্রার্থীর পাওয়া ভোটসংখ্যা জেনে নেয়া যাবে। এরপর আগে থেকে সরবরাহ করা একটি ফরমে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা লিখে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারকে দেবেন। প্রতিটি বুথের ফল একীভূত করে প্রিসাইডিং অফিসার অন্য একটি ফরমে তুলে স্বাক্ষর করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে তা পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।
যোগসাজশের চেষ্টা :
একজন ভোটার ভোট দেয়ার পর সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার আবার ‘ব্যালট সুইচ’ চেপে ভোটারকে আরেকটি ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিতে চাইতে পারেন। এভাবে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সাথে যোগসাজশে বারবার ব্যালট ইউনিট চালু করে একজন ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। এখানে সে সুযোগ হবে না। কারণ ভোটার ভোট দেয়ার সাথে সাথে কন্ট্রোল ইউনিটের সাথে সংযুক্ত ডিসপ্লেতে ভোটের সংখ্যা ১ বেড়ে যাবে। সুতরাং পোলিং এজেন্টরা সহজেই বাড়তি ভোট ধরে ফেলতে পারবেন।
কেন্দ্র দখল প্রতিরোধ ব্যবস্থা :
নির্বাচন কমিশন দাবি করছে প্রস্তাবিত এই ইভিএমে কেন্দ্র দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথমত, কোনো পরিস্থিতিতে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের ‘ক্লোজ’ সুইচটি চেপে দিলেই দখলকারীরা কোনো ভোট দিতে পারবে না। তাছাড়া ইভিএমের স্মার্টকার্ড সরিয়ে ফেললেও মেশিনটি চালু করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, প্রচলিত পদ্ধতিতে যেখানে কেন্দ্র দখল করে অতি দ্রুত সিল মেরে ব্যালট বাক্স বোঝাই করা যায়, ইভিএমের ক্ষেত্রে কাজটি ততটা সহজ নয়। মেশিনের সামনে বসে সুইচ চেপে চেপে ভোট দিতে হয় এবং এভাবে প্রতি মিনিটে ৫টির বেশি ভোট দেয়া যাবে না।
ইভিএমের প্রোগ্রাম :
প্রতিটি ইভিএমের একটি প্রোগ্রাম থাকে। এতে নির্বাচনী বিধিমালা অনুসরণ করে ধাপগুলো সম্পন্ন হয়। মেশিনে প্রোগ্রাম ঢোকানোর আগে নির্বাচন কমিশন প্রোগ্রামটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করে। তাদের অনুমোদন পেলেই শুধু মেশিনে প্রোগ্রাম ঢোকানো হবে। প্রোগ্রামটি মেশিনে যে চিপের মাধ্যমে ভরা হবে, তা ওয়ান টাইম প্রোগ্রাম (ওটিপি)। চিপে একবার প্রোগ্রাম করা হলে, সেই চিপে নতুন করে আর প্রোগ্রাম করা যায় না। তাই মাঠ পর্যায়ে প্রোগ্রাম পরিবর্তনের কোনো আশঙ্কা নেই।
ই-ভোটিং ও বাস্তবতা
ই-ভোটিং মেশিনের কোনো ত্রুটির কারণেই শুধু নির্বাচনের ভুল ফল পাল্টে যেতে পারে, তেমনটি নয়। ই-ভোটিংয়ের বেলায় জালিয়াতির মাধ্যমেও সহজেই নির্বাচনের ফল পাল্টে দেয়ার সম্ভাবনাটাও প্রবল। আর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, তার উদাহরণটি বারবার সামনে এসে যাচ্ছে। এর বিস্তারিত জানতে চাইলে ভিজিট করা যেতে পারে votersunite.org অথবা voterprotect.org এমনি আরও ওয়েবসাইট।
যুক্তরাষ্ট্র :
সাম্প্রতিক বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, আজকের দিনে যেসব ই-ভোটিং সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বেশিরভাগই প্রতারণাপূর্ণ। ২০০৪ সালের ১৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামাজিক বিজ্ঞানী দল একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও ওহাইও’র প্রতিটি কাউন্টিতে ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ই-ভোটিং সম্পর্কিত ভোট জালিয়াতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এ সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, ই-ভোটিংয়ের মাধ্যমে কিভাবে জর্জ বুশের পক্ষে ভোট চুরি করা হয়েছে। গবেষকরা তাদের হিসাবে দেখিয়েছেন, ফ্লোরিডায় ইলেকট্রনিক প্রতারণার মাধ্যমে ২ লাখ ৬০ হাজার ভোট জর্জ বুশের পক্ষে টানা হয়েছে। সেখানে বুশকে ৩ লাখ ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী দেখানো হয়েছে। এই জালিয়াতি না হলে সেখানে বুশের পরাজয় ছিল নিশ্চিত। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য স্টেটেও একই ধরনের ভোটিং সমস্যার কথা সে দেশের গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। এখনও ইন্টারনেটে সে নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোট জালিয়াতির কাব্যগাথা দেখতে পাওয়া যায় হাজার হাজর ওয়েবসাইটে।
ভারত :
২০০৪ সালে ভারত ৩৮ কোটি ভোটারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে। তখন ভারতে ১০ লাখেরও বেশি ইভিএম ব্যবহার হয়। ভারতে যে ই-ভোটিং মেশিনের কথা আমরা শুনছি, তা উদ্ভাবন করেছে সে দেশের সরকারি মালিকাধীন দুটি প্রতিরক্ষা যন্ত্রপাতি নির্মাতা ইউনিট : ভারত ইলেকট্রনিকস লিমিটেড এবং ইলেকট্রনিকস করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড। ভারতের নির্বাচন কমিশনের দেয়া নির্দেশমতো এই ভোট মেশিন তৈরি করা হয়। ভারতে এই যন্ত্রের নাম ইভিএম তথা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। এই মেশিন ব্যবস্থায় আছে দুটি যন্ত্র, যা চলে ৬ ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে। একটি যন্ত্রের নাম ভোটিং ইউনিট, যা ব্যবহার করে ভোটাররা। অপরটির নাম কন্ট্রোল ইউনিট, এটি চালান নির্বাচন কর্মকর্তারা। উভয় ইউনিট সংযুক্ত রয়েছে ৫ মিটার লম্বা একটি তারের সাহায্যে। ভোটিং ইউনিটে প্রতি ভোটারের জন্য রয়েছে একটি নীল বোতাম। এই ভোটিং ইউনিট ধারণ করতে পারে ১৬ জন প্রার্থী। এর চারটিকে একসাথে জোড়া লাগিয়ে ধারণক্ষমতা ৬৪ জন প্রার্থীতে উন্নীত করা যায়। কন্ট্রোল ইউনিটের উপরিভাগে রয়েছে তিনটি বোতাম। একটি বোতাম একক ভোট রিলিজ করার জন্য, একটি বোতাম একটি সময় পর্যন্ত দেয়া ভোটসংখ্যা দেখার জন্য এবং একটি বোতাম রয়েছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সমাপ্তি টানার জন্য। রেজাল্ট বাটনটি লুকানো ও সিলগালা থাকে। ক্লোজ বাটন না চাপা পর্যন্ত রেজাল্ট বাটন চাপা যায় না। ভারতের ইভিএমের সহজ-সরল ডিজাইন, সহজে ব্যবহার উপযোগিতা ও এর বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য প্রশংসিত হয়ে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাপক নির্বাচনী অনিয়মের খবর আসার প্রেক্ষাপটে ভারতেও ইভিএম এখন সমালোচনার মুখোমুখি। এই ব্যাপক সমালোচনার মুখেও এই মেশিনের ব্যাপারে অনেক কিছুই এখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এই ইভিএমের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন থাকলেও তা এখনও করা হয়নি। তবে ভারতের একটি সূত্র (indiaevm.org/বাস) ইভিএমের নিরাপত্তা বিশ্লেষণ করে দাবি করছে, এই মেশিন ভয়াবহ প্রাযুক্তিক হামলার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। আর এই হামলার মাধ্যমে গোটা নির্বাচনী ফল পাল্টে দেয়া সম্ভব। এতে ব্যালটের গোপনীয়তাও ব্যাহত হতে পারে। তারা দেখেছেন কাস্টমাইজ হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে এ মেশিনে দুই ধরনের হামলা চালানো যায়। তাদের অভিমত, অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অনুপ্রবেশকারী অপরাধীরা ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পর ভোট গণনার আগে ভৌতভাবে এই মেশিনে মেলাসিয়াস হার্ডওয়্যার ঢুকিয়ে ভোট চুরি করতে পারে। এভাবে এরা মোট ভোটের সংখ্যা পাল্টিয়ে নির্বাচনের ফল বদলে দিতে পারে। সমস্যার শেকড় আরও গভীরে। ভারতের ইভিএম পুরোপুরি নির্ভরশীল মেশিনের ভৌত নিরাপত্তা ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সংহতির ওপর, যা যেকোনো সময় বিঘ্নিত হতে পারে। ২০১০ সালের দিকে ইসরাইলি কমপিউটার বিজ্ঞানী বলেছেন- ভারতের নির্বাচন কমিশন যেমনটি বলছে তেমনটি নিরাপদ নয় তাদের ইভিএম। ২০০৯ সালের ১১ আগস্ট ইন্দো-এশিয়ান নিউজ সার্ভিসের এক খবরে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন কী করে অপরাধীরা ইভিএম হ্যাক করে ম্যালাসিয়াস প্রোগ্রাম ব্যবহার করে ভোট চুরি করতে পারে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ‘রিটার্ন-ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং’ প্রয়োগ করে ইভিএম-কে বাধ্য করতে পেরেছে এর নিজের বিরুদ্ধে কাজ করতে। ইভিএম নিয়ে এসব বিষয় যেমনি ভারতের জন্য একটি শিক্ষা, তেমনি সব দেশের মানুষকেই গোটা ইলেকট্রনিক ভোট ব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
অন্যান্য দেশ :
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত পেপার ব্যালট থেকে ইলেকট্রনিক ব্যালটে উত্তরণ ঘটায় আজ থেকে ৭ বছর আগে ২০০৪ সালে। তাদের নিজস্ব ইভিএম চালু করে ভারত সরকার এ নিয়ে গর্ববোধ করতে শুরু করে। তারা মনে করে এর মাধ্যমে ভারত গণতন্ত্রকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই মেশিনের ওপর কতটুকু আস্থা রাখা যায়, তা নিয়ে ভারতে ক্রমবর্ধমান হারে সমালোচনাও উঠে আসছে। অনেক ভোটারের অভিযোগ, এরা ভোট দেয়ার সময় বাটন লাইট ফ্ল্যাশ করেছে ভুল প্রার্থীর পক্ষে। অনেক রাজনীতিবিদ সন্দেহ পোষণ করেছেন তাদের নিজের ফল সম্পর্কে। একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে আরও অনেক দেশ থেকে। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও বেশ কিছু দেশ রয়েছে। বিতর্কের কারণে নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও জার্মানি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ই-ভোট পরিহারের। কিন্তু ভারতে গত বছর এপ্রিলে হায়দরাবাদে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশলী হরিপ্রসাদ ও মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যালেক্স হ্যাল্ডারম্যান ইভিএমের ডিসপ্লে ইউনিট প্রতিস্থাপন করেন একটি চিপ দিয়ে। এটি দেখতে ব্লুটুথ রেডিওতে লাগানো চিপের মতো। এরা এর মাধ্যমে দূর থেকে ভোট গণনা পাল্টে দিতে সক্ষম হন। তারা বলেছেন, আমরা দেখিয়েছি ভারতীয় ইভিএম নিরাপদও নয়, স্বচ্ছও নয় এবং এর মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি সম্ভব খুব সহজেই। ভুটান ও নেপাল সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভারতীয় ইভিএম ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশসহ নাইজেরিয়া, উগান্ডা, কেনিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ইভিএম ব্যবহারে এখন আগ্রহ প্রকাশ করছে।
ই-ভোটিং প্রযুক্তির সামনে চ্যালেঞ্জ
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত এ দুটি দেশসহ আরও অনেক দেশে ই-ভোটিংয়ের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় আনলে অবশ্যই বলতে হবে : ই-ভোটিং এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ই-ভোটিং আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। ই-ভোটিং বিতর্ক আর নানা বাধার সামনে দাঁড়িয়ে। এ কারণে পাশ্চাত্যের বেশিরভাগ দেশ এখনও ই-ভোটিং চালু করেনি কিংবা চালু করতে পারেনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও মাত্র ৩০ শতাংশ স্টেটে চালু হয়েছে এই ই-ভোটিং। তাও নানা বিতর্ক মাথায় নিয়ে। তাই বাংলাদেশের মতো দুর্বল ই-লিটারেসির দেশে তা চালু নিয়ে বিতর্ক উঠলে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। তা চালুর আগে এর সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিশ্লেষণ করার তাগিদও এর সাথে আসতেই পারে। আর নির্বাচনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ছাড়া তা চালু করলে সম্ভাবনাময় ই-ভোটিং নিয়ে জটিলতা আরও বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের পারদমাত্রা চরম পর্যায়ে, সে জন্য এ নিয়ে ভয়টা আরও বেশি। সে জন্য প্রয়োজনে সময় নিতে হবে। কিন্তু আমরা জোর দিতে চাই ভিন্ন আরেকটি ক্ষেত্রে। আর সে ক্ষেত্রটি হচ্ছে : ই-ভোটিং প্রযুক্তির সামনে এই সময়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তিবিদদেরই ই-ভোটিংয়ের যাবতীয় দুর্বলতার অবসান ঘটিয়ে প্রযুক্তির অগ্রগমনকে অবাধ ও নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে। তাদের প্রমাণ করতে হবে প্রযুক্তি অপ্রতিরোধ্য। ই-ভোটিং প্রযুক্তি তা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ই-ভোটিংয়ের কার্যকারিতা নিরঙ্কুশ করে তোলার মাধ্যমেই তা সম্ভব। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রযুক্তিবিদদেরও শামিল হতে হবে। কারণ প্রযুক্তির পরাজয় নয়, জয়ই তো আমাদের সবার কাম্য।
কয়েকটি প্রশ্ন
অপটিক্যাল স্ক্যানিং মেশিনগুলো কি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নয়?
> দেয়া ভোটের রেকর্ড রাখার জন্য অপটিক্যাল স্ক্যানিং মেশিনে রয়েছে একটি ইলেকট্রনিক রিডার। এ মেশিন ভোট দেয়ার জন্য নয়। এ মেশিনের বেলায় ভোটারের পছন্দমতো ভোট দেয়ার জন্য প্রয়োজন হয় কাগজের একটি ব্যালট পেপার। এই ব্যালট পেপারে ভোট দেয়ার পর তা স্ক্যান করা হয় একটি ইলেকট্রনিক রিডারে ভোটের রেকর্ড রাখার জন্য। যেহেতু এ ক্ষেত্রে একজন ভোটার কমপিউটারে সরাসরি ভোট রেকর্ড করছেন না, তাই এই মেশিনকে ডিআরই বলা যাবে না। এর অর্থ এই নয় অপটিক্যাল স্ক্যানিং মেশিনগুলোকে অচল করে দেয়ার মতো কোনো গ্লিচিং বা ত্রুটিযুক্ত সিগন্যালের সম্ভাবনা নেই; নেই কোনো প্রোগ্রামিং ত্রুটির সুযোগ। যদি এই মেশিনে তেমন কোনো সমস্যাকর ত্রুটি দেখা দেয়, তবে পেপার ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট হাতে গুনে তা ডিজিটাল ভোটের সাথে তুলনা করে সে ত্রুটি দূর করতে পারেন।
কমপিউটারায়িত ভোট মেশিন কি নতুন?
> না, তা নতুন কিছু নয়। কোনো না কোনো ধরনের কমপিউটার সেই বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে নির্বাচনে ব্যবহার হয়ে আসছে। তখন এগুলো ব্যবহার হতো পেপার পাঞ্চকার্ডে দেয়া ভোট গণনা বা টেবুলেশনের কাজে। অপটিক্যাল স্ক্যান মেশিন ও পাঞ্চ-কী মেশিনের সূচনা ঘটে সেই ষাট ও সত্তর দশকেই। টাচ স্ক্রিন মেশিন আসে নববই দশকে, তবে ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ মেশিনের সমূহ পতনের আগে পর্যন্ত এর ব্যাপক ব্যবহার ছিল না। এ নির্বাচনে দেখা দেয়া সমস্যার প্রেক্ষাপটে ২০০২ সালে আসে পাঞ্চকার্ড ভোটিং মেশিন। সে বছরেই যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে পাস হয় ‘হেলপ অ্যামেরিকা ভোট অ্যাক্ট’। এর মাধ্যমে অন্যান্য আর সবের মাঝে স্টেটগুলোকে দেয়া হয় ৪০০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উন্নয়নের জন্য। তখন পাঞ্চকার্ড মেশিনের জায়গায় আসে নয়া ই-ভোটিং মেশিন বা অপটিক্যাল স্ক্যান মেশিন।
ই-ভোটিং মেশিন কী করে কাজ করে?
> ই-ভোটিং মেশিনে থাকে একটি মেমরি চিপ ও একটি রিমোবেবল মেমরি কার্ড। ভোটার যখন ভোট দেন, ভোট রেকর্ড হয় মেমরি চিপে ও রিমোবেবল মেমরি কার্ডে। নির্বাচন শেষে নির্বাচন কর্মীরা মেমরি কার্ডটি খুলে নিয়ে তা নিয়ে যান টেবুলেশন সেন্টার বা ভোটগণনা কেন্দ্রে। সেখানে ভোট গণনা শেষে বেসরকারি ফল ঘোষণা করা হয়। এর কয়দিন পর নির্বাচনী কর্মকর্তারা এই মেমরি কার্ড অনুযায়ী ভোট গণনার সাথে মেমরি চিপে জমা ভোটের সাথে তুলনা করে যাচাই-বাছাই শেষে যখন দেখেন, ভোট গণনায় কোনো ত্রুটি নেই, তখন সরকারিভাবে ফল ঘোষণা করেন। নির্বাচনী কর্মকর্তারা মেমরি কার্ড আর মেমরি চিপে জমা ভোট তুলনা করে এই মর্মে নিশ্চিত হতে চান যে, ভোটে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। আবার কিছু কিছু ই-ভোটিং মেশিনে রয়েছে মডেম। এর মাধ্যমে নির্বাচন কর্মকর্তারা ফোন করে বেসরকারি ফল টেবুলেশন সেন্টারে পাঠাতে পারেন। অবশ্য সমালোচকেরা বলেন, এই পদ্ধতি নিরাপদ নয়। কেননা টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারীরা মেশিনে ঢুকে ভোট কিংবা মেশিনের সফটওয়্যারে পরিবর্তন আনতে পারে।
ই-ভোটিং মেশিনের ভালো দিকটি কী?
> এ মেশিনের কিছু ভালো দিক আছে। কাগজের ব্যালট পেপার ছাপতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। ই-ভোটিং মেশিন সে খরচ থেকে আমাদের বাঁচায়। তা ছাড়া ই-ভোটিং মেশিনে একই সাথে বহু ভাষায় ব্যালট পেপার তৈরি সহজ। আর একদম শেষ মুহূর্তে এসেও খুব সহজে ব্যালট পেপারে পরিবর্তন আনা যায়। এই ই-ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরাও অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে ভোট দিতে পারে। এ মেশিনে একটি অ্যাডাপ্টার রয়েছে। এই অ্যাডাপ্টার ব্যালটের রেখাকে কণ্ঠে রূপান্তর করতে পারে। ফলে মাউথ পয়েন্টার ছাড়াই একজন প্রতিবন্ধী এই মেশিনের সাহায্যে তার ভোট দিতে পারে। এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভালো দিক হলো এর মাধ্যমে অন্যান্য যেকোনো ভোট ব্যবস্থার হারের তুলনায় দ্রুত ভোট গ্রহণ ও গণনা শেষে ফল ঘোষণা করা যায়।
ই-ভোটিং নিয়ে সমস্যাটা কোথায়?
> ই-ভোটিংয়ের সমালোচকদের মধ্যে অনেক বড় বড় কমপিউটার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞও রয়েছেন। তাদের কথা হচ্ছে ই-ভোটিং মেশিনগুলোর প্রোগ্রামিং খুবই খারাপ মানের। এই প্রোগ্রাম সহজেই হ্যাক হয়ে যেতে পারে। ভোটিং সফটওয়্যারগুলো প্রোপ্রাইটরি। অতএব এ মেশিনের প্রস্ত্ততকারক ছাড়া এ মেশিনের ভেতর কী আছে না আছে, তা আর কেউ সত্যিকার অর্থে জানে না। ই-ভোটিং মেশিন কোনো কোনো সময় বুটআপ ফেল করে, ভোট রেকর্ড করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি ভোট চলে যেতে পারে ভুল প্রার্থীর পক্ষে। বাইরে থেকে মনে হতে পারে মেশিন ভালোভাবেই কাজ করছে। কিন্তু ভেতরে ভোটের রেকর্ড চলতে পারে ভুলভাবে। পেপার ব্যাকআপ ছাড়া একটি নির্বাচনের ফল অর্থহীন হয়ে যেতে পারে।
এই মেশিনগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবস্থা তো করা যেতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আছে সমস্যা। একটি মেশিন পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরও ভোটিং ভেন্ডররা অব্যাহতভাবে তাদের সফটওয়্যার আপডেট করেন। আজ পর্যন্ত সার্টিফাইড সফটওয়্যারের নিরাপত্তা দেয়ার প্রক্রিয়া খুবই নিম্নমানের। ফলে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না সার্টিফাইড সফটওয়্যারটি অপরিবর্তিত অবস্থায় নির্বাচনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে কি না। একবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের ১৭টি কাউন্টির নির্বাচনে সমস্যা দেখা দিলে নির্বাচন কর্মকর্তারা দেখলেন ‘ডাইবোল্ড ইলেকশন সিস্টেমস’-এর মেশিনে আনসার্টিফাইড সফটওয়্যার ইনস্টল করেছে। ২০০৩ সালে ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টিতে ই-ভোটিং সিস্টেমের ত্রুটির জন্য কর্মকর্তারা নির্বাচন করতে পারেননি। ২১ ঘণ্টা পর নির্বাচন বন্ধ করে দিতে হয়। একইভাবে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কাউন্টিতে প্রাইমারি নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা যায়নি। জানার কোনো উপায় ছিল না, এখানে একই ধরনের সমস্যা হয়েছিল কি না।
তাহলে কি ই-ভোটিংয়ের এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই?
> যুক্তরাষ্ট্রের ভোট নিয়ে আন্দোলনকারীরা চায় ফেডারেল সরকারকে এমন মেন্ডেট জারি করতে হবে যে, সব ই-ভোটিং মেশিনে সংযোজন করতে হবে একটি ‘ভোটার-ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল’ অর্থাৎ এমন একটি পেপার প্রিন্টআউট, যা থেকে ভোটাররা ভোট দেয়ার পর যাচাই করে নিতে পারবেন, তার ভোট সঠিক প্রার্থী পাবেন কি না। কিন্তু এই পেপার ট্রেইলের বিরোধীরা বলেন, এর সংযোজনের ফলে ভোট প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়ে পড়বে। কারণ ভোটাররা যাচাই করতে সময় নেবেন। তারা পেপার ট্রেইলের বিকল্প প্রস্তাবও দিয়েছেন।
সাক্ষাৎকার
‘আমাদের উদ্ভাবিত ইভিএমে ভোট কারচুপি, জালিয়াতি ও হ্যাকিংয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই’
এসএম লুৎফল কবির
বাংলাদেশে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ও ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির (আইআইসিটি) পরিচালক এসএম লুৎফুল কবির বলেন- ‘‘২০০৬ সাল থেকে ইভিএম তৈরির কাজ শুরু করি। তার পূর্ব থেকেই চিন্তাভাবনা করা হচ্ছিল কিভাবে খুব সহজ ও দ্রুততম সময়ে ই-ভোটিংয়ের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। ইতোমধ্যে ২০০৬ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রায় ৫০ ভাগ ভোটকেন্দ্রে ই-ভোটিং বা ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। আমরা ভারতের ইভিএম সম্পর্কেও বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমরা নির্বাচন কমিশনকে আমাদের উদ্ভাবিত ইভিএম প্রযুক্তিটি প্রদর্শন করি এবং ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের দুবারের নির্বাচনে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের উপস্থিতিতে সফলভাবে ইভিএম প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোট সম্পন্ন করা হয়।
সেই থেকে নির্বাচন কমিশনও চিন্তাভাবনা করে কিভাবে এটি জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ব্যবহার করা যায়। ওই সময়ই নির্বাচন কমিশনের দু-জন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ই-ভোটিংপ্রযুক্তি পর্যবেক্ষণ করার জন্য বা কিভাবে ভোটাররা ব্যবহার করছে তা সরেজমিনে দেখার জন্য ভারতে যান। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে (১৭ জুন ২০১০) জামাল খান ওয়ার্ডে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ই-ভোটিং সিস্টেমে ভোট নেয়া হয়। প্রফেসর লুৎফুল কবির আরও বলেন- ভারতীয় ইভিএমের চেয়ে আমাদের উদ্ভাবিত ইভিএম ব্যবহার সহজ এবং কারচুপি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ১৭ জুন জামাল খান ওয়ার্ডের সব শ্রেণীর ভোটার অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইভিএমের সাহায্যে খুব সহজে ও কম সময়ের মধ্যে সফলভাবে ভোট সম্পন্ন করে। এ ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন শ্রেণীর ভোটারের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ শুনিনি এই ইভিএম সম্পর্কে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পর নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৩টি ওয়ার্ডে ইভিএমের মাধ্যমে ই-ভোটিং চালু করার।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অনেকের মধ্যে সন্দেহ ও প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে যে, ইভিএমের মাধ্যমে কারচুপি বা জাল ভোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের উদ্ভাবিত ইভিএমের মাধ্যমে কারচুপি, জাল ভোট হ্যাকিং বা কোনোক্রমেই ফল পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই মেশিনে কোনো ধরনের নেটওয়ার্কিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়নি এবং এক মেশিনের সাথে আরেক মেশিনের কোনো সম্পর্ক থাকবে না ভোটকেন্দ্রে এবং মেশিনের সাহায্যে একজন ভোটার মাত্র একটি ভোটই দিতে পারবেন। কারণ একজন ভোটার ভোট দেয়ার সুইচ একবারই ব্যবহার বা চাপতে পারবেন। দ্বিতীয়বার থেকে সুইচটি আর কাজ করবে না।
ইভিএমের প্রোগ্রাম ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সাথে রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বলেন, ইভিএমের প্রোগ্রামগুলো নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা অনুসরণ করেই সম্পন্ন করা হয়েছে। মেশিনে প্রোগ্রাম ইনস্টল করার আগে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল বা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যদের সামনে (যদি প্যানেলে থাকতে ইচ্ছুক হয়) ইনস্টল করা হবে। এই প্যানেল তদারকির জন্য নির্বাচন কমিশনে আবার আরেকটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল থাকবে। উল্লেখ্য, বুয়েট শুধু ইভিএমের প্রোগ্রামিংয়ের কাজটি করবে, মেশিন তৈরি হবে গাজীপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে।
একজন ভোটার ভোট দেয়ার সাথে সাথে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার আবারও ব্যালট সুইচ চেপে আরেকটি ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন। এভাবে প্রিসাইডিং অফিসারের সাথে গোপন সম্পর্কের মাধ্যমে ভোটার যাতে বারবার ব্যালট ইউনিট চালু করতে না পারেন তার জন্য দুটো ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথমত, ভোটার সুইচ চেপে ভোট দেয়ার পর ১০ থেকে ১২ সেকেন্ডের মধ্যে পোলিং অফিসার চাইলেও ব্যালট ইউনিট চালু করতে পারবেন না। একজন ভোটার ভোট দিয়ে বের হওয়ার পর অন্য একজন ভোটার বুথে প্রবেশ করার মধ্যে এরকম সময় এমনিতে লেগে যায় বিধায় ইচ্ছা করেই এরকম বিরতি রাখা হয়েছে। তারপর ভোটার ভোট দেয়ার সাথে সাথে কন্ট্রোল ইউনিটের সাথে সংযুক্ত বড় লাল পর্দায় ভোটের সংখ্যা ১ বেড়ে যাবে। সুতরাং পোলিং এজেন্টরা খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারবেন যে একই ভোটার উপস্থিত থাকা অবস্থায় ব্যালট ইউনিট দ্বিতীয়বার চালু করা হয়েছে কিনা। সুতরাং সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কোনোপ্রকার অনৈতিক কাজ করতে পারবেন না।
এ ছাড়া ভোটকেন্দ্রে কোনোপ্রকার দখল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সাথে সাথে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার মেশিনে লাগানো স্মার্টকার্ড খুলে ফেললে বা ক্লোজ সুইচ চেপে দিলেই দখলকারীরা কোনো ভোট দিতে পারবে না।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, পূর্ব থেকে মেশিনে ভোট দিয়ে রেখে কি ফল পরিবর্তন করা যাবে? আসল ভোট শুরু করার আগে পরীক্ষামূলক ভোট মুছে ফেলতে হয়। কন্ট্রোল ইউনিটে ক্লিয়ার নামের একটি সুইচ রয়েছে যেটি চেপে পরীক্ষামূলকভাবে নেয়া সব ভোট মুছে ফেলা যায়। আসল ভোট শুরু করার জন্য কন্ট্রোল ইউনিটের স্টার্ট সুইচ চাপতে হবে। মেশিনে যদি কোনো ভোট জমা থাকে তবে স্টার্ট সুইচ চাপলেও মেশিন চালু হবে না। আগে মেমরি ক্লিয়ার সুইচ চেপে সব ডেমো ভোট মুছতে হবে। তারপর স্টার্ট সুইচ কাজ করবে। স্টার্ট সুইচ চালু হওয়ার সাথে সাথে মেমরি ক্লিয়ার সুইচটি অকার্যকর হয়ে যাবে। সুতরাং আসল ভোট কখনও মুছবে না।’’
তথ্য সংগ্রহে : মোঃ ফেরদৌস হোসেন
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি : গুগল ও ডেইলি স্টার
কজ ওয়েব