লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
সম্পাদকীয়
সময়ের রথে চড়ে এই মাত্র আমরা আরো একটি বছর পেছনে ফেলে পা রাখলাম ইংরেজি নতুন বর্ষে। নতুন আর পুরনো বছরের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা যখন সদ্য পেছনে ফেলে আসা একটি বছরে আমাদের অর্জন-বিসর্জন, সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব কষায় ব্যস্ত, ঠিক তখন নতুন বছরটির সূচনাদিনে একজন প্রযুক্তিবান্ধব মহাজনের ইন্তেকাল আমাদের বুকে পাথরচাপা এক দুঃখ বয়ে আনল। এই দিনটিতে আমরা হারালাম বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির আকাশের নক্ষত্রসম ব্যক্তিত্ব ফ্লোরা লিমিটেডের কর্ণধার সর্বজন শ্রদ্ধের এম. এন. ইসলামকে। তিনি আর নেই, এ খবর শোনার পর কিছুতেই যেনো বিশ্বাস হচ্ছিল না, তিনি নেই। যে লোকটি ইন্তেকালের আগের দিন ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অফিস করেছেন বরাবরের মতো, তাকে আমরা পরদিন হারিয়ে ফেলব, তেমনটি বিশ্বাস না হওয়ারই কথা। কিন্তু তারপরও বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতেই হয়। বাস্তবতা উপেক্ষা করা কারো পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। এ সত্যকে মেনে নিয়েই আমাদেরকে চলতে হবে। এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও ফ্লোরা লিমিটেডের দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান এম.এন. ইসলাম ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি বেলা ১১টায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। এমনি একটি মৃত্যু খবর আমরা পেয়েছিলাম আজ থেকে কয়েক বছর আগে ২০০৩ সালের ৩ জুলাইয়ে, যে মৃত্যুর খবরটি একইভাবে আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। সেদিন আমরা হারিয়েছিলাম এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অপর এক অগ্রপথিক ও মাসিক কমপিউটারে জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ অধ্যাপক আবদুল কাদেরকে। তিনিও ইন্তেকালের আগের দিন এম.এন. ইসলামের মতোই পুরোদিন অফিসের নিয়মিত কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি জগতের সাথে যাদের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা আছে, তারা নিশ্চয়ই জানেন এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের ভূমিকা ছিল সমান্তরাল। তাই এম.এন. ইসলামকে হারানোর সময়টায় তাকে হারিয়ে যেমনভাবে আমরা ব্যথিত, তেমনি অধ্যাপক আবদুল কাদেরকে স্মরণে এনেও ব্যথিত হচ্ছি। সে যাই হোক, এম.এন. ইসলামের ইন্তেকালের এই সময়ে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। সেই সাথে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই, তিনি যেনো তাদের শোকভার বইবার ক্ষমতা দেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহর কাছে এম.এন. ইসলামের জন্য মাগফিরাত কামনা করছি।
মরহুম এম.এন. ইসলামের জন্ম চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার পূর্ব গাটিয়াডাঙ্গা গ্রামে। জন্মদিন ১৯৩৩ সালের ৩ জুলাই। বাবা গোলাম রহমান ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। এম.এন. ইসলামের ছিল তিন ভাই ও দুই বোন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার ছোট। ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.কম ডিগ্রি নেন ১৯৫৪ সালে। শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষকতা শুরু করেন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে। এরপর যোগ দেন তৎকালীন হাবিব ব্যাংকে। এ ব্যাংকে কাজ করেন ১৫ বছর। বাংলাদেশ হওয়ার পর ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৭২ সালের ১ জুলাই শুরু হয় তার ব্যবসায়িক অভিযাত্রা। সেজো ভাই মরহুম মো: ওবায়দুল হাকিমকে সাথে নিয়ে মতিঝিলে ১৫০ বর্গফুট জায়গা ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ফ্লোরা লিমিটেড। তখন এ জায়গার মাসিক ভাড়া দিতেন মাত্র ৯০ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি প্রথম শুরু করেন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বিক্রির ব্যবসায়। ১৯৭৩ সালে জাপান থেকে এদেশে প্রথমবারের মতো ক্যালকুলেটর আমদানি করেন। এরপর ফ্লোরা লিমিটেড ক্যানন ফটোকপিয়ার, টাইপরাইটার ও অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য বাংলাদেশে আমদানি করতে শুরু করে। আশির দশকে আমদানি শুরু করে কমপিউটার পণ্য। তখনো সারাবিশ্বে পার্সোনাল কমপিউটারের প্রচলন ও ব্যবহার শুরুই হয়নি। নববই দশকে এসে ফ্লোরা লিমিটেড বাইরের বড় বড় কোম্পানি থেকে কমপিউটার আমদানি শুরু করে। এরপর বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ফ্লোরা লিমিটেড এখন দেশের অন্যতম এক প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। ফ্লোরা লিমিটেডের বর্তমানে দেশব্যাপী রয়েছে ২৯টি শাখা এবং প্রায় ৭০০ প্রত্যক্ষ দক্ষ কর্মী। এ পর্যন্ত আসতে তাকে অনেক মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে হয়েছে। সক্রিয় হতে হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নানা আন্দোলনের সাথে। মাসিক কমপিউটার জগৎকেন্দ্রিক তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে বরাবর সহায়ক হিসেবে ছিলেন এম.এন. ইসলাম। সেজন্য তার এই চলে যাওয়ায় আমরা সমধিক ব্যথিত।
এম.এন. ইসলাম নিশ্চয় উপলব্ধিতে রেখেছিলেন, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে একদিন তাকে তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা লিমিটেডকে ছেড়ে যেতে হবে। তাই তিনি জীবিতকালে তার সন্তানদের সেভাবেই গড়ে তুলে গেছেন। তার ছেলে মোস্তফা শামসুল ইসলাম বর্তমানে ফ্লোরা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ফ্লোরা টেলিকমের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আমাদের প্রত্যাশা তাদের সুযোগ্য নেতৃত্বে ফ্লোরা লিমিটেড তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে আগামী দিনেও। আল্লাহ তাদের সহায় হোন।
কজ