লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মইন উদ্দীন মাহমুদ স্বপন
মোট লেখা:১৪১
লেখা সম্পর্কিত
কমপিউটার জগৎ হারাল তার অকৃত্রিম বন্ধু এম. এন. ইসলামকে
বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ বেকারদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত করার মহান লক্ষ্য নিয়ে এদেশে প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবসায় শুরু করে প্রযুক্তিপ্রেমীদের কাছে পথিকৃৎ ও পথপ্রদর্শক হিসেবে সবার হৃদয়ে স্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন ফ্লোরা লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো: নুরুল ইসলাম যিনি সমধিক পরিচিত এম. এন. ইসলাম নামে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ের অগ্রনায়ক এই মহান কর্মবীর ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি বেলা ১১.৪০ মিনিটে অসংখ্য গুণগ্রাহী, শুভাকাঙক্ষী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এবং তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের সহযোদ্ধাদের ফেলে রেখে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
এম. এন. ইসলাম ১৯৩৩ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার পূর্ব গাটিয়াডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশনের পর ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে মাস্টার্স শেষ করেন। তিনি প্রথম জীবনে তৎকালীন হাবিব ব্যাংকে দীর্ঘ ১৫ বছর কাজ করেন। কিন্তু পাকিস্তানীদের সাথে মিল না হওয়ায় সেই চাকরি ছেড়ে দেন।
১৯৯১ সাল থেকে এম. এন. ইসলামকে আমি চিনি কমপিউটার জগৎ-এর সুবাদে। কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ মরহুম আবদুল কাদের এবং কমপিউটার জগৎ এর প্রকাশক নাজমা কাদেরের সাথে আলাদা ও আলাদাভাবে এম. এন. ইসলামের আলাপ আলোচনার সময় তাদের মাঝে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল বেশ কয়েকবার। সেই সুবাদে জানতে পারি তার জীবনযুদ্ধের নানা দিক। তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী, মৃদুভাষী এবং অত্যন্ত প্রচারবিমুখ এক মানুষ, যা তাকে করেছে অন্যদের থেকে ভিন্ন। প্রচারই প্রসার- এ কথায় বিশ্বাসী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু আত্মপ্রচারে কখনই নিজেকে বন্দী করেননি। ফলে তিনি হয়ে উঠতে পেরেছেন এক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
এম. এন. ইসলাম ব্যাংকিং জীবন ছেড়ে দিয়ে ১৯৭২ সালে মতিঝিলে ১৫০ বর্গফুট জায়গা মাত্র ৯০ টাকা মাসিক ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ফ্লোরা লিমিটেড। ব্যবসায়ের শুরুতে তিনি কিছু টাইপরাইট সরবরাহ করেন। এর ধারাবাহিকতায় এ দেশে নিয়ে আসেন ডুপ্লিকেটিং মেশিন। যেহেতু তিনি চিন্তা-চেতনায় ছিলেন প্রযুক্তিপ্রেমী, তাই ১৯৭৩ সালে এ দেশে প্রথম ক্যানন ক্যালকুলেটর মেশিন বাজারজাত করা শুরু করেন। বলা হয়, এ সময় থেকে দেশে অফিস অটোমেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আশির দশকে এম. এন. ইসলাম এ দেশে টেকনোলজি ট্রান্সফারের দিকে নজর দেন। ১৯৮২ সালে বাণিজ্যিকভাবে কিছু কমপিউটার নিয়ে আসেন, যার তখনকার বাজারমূল্য ছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। এম. এন. ইসলামের দূরদর্শিতার কারণে ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশের বাজারে এইচপি, এপসন, ক্যানন, মাইক্রোসফট, সিসকো, থ্রিএম, ভারবাটিম, ডেল, ইন্টেল প্রভৃতি অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য বাংলাদেশে আসতে শুরু করে ব্যাপক পরিসরে। সময়ের বিবর্তনের সাথে তিনি এ দেশে বিশ্বের সেরা সেরা ব্র্যান্ডের পণ্য বাজারজাত করে শুধু দূরদর্শিতার পরিচয়ই দেননি, বরং এ দেশের জনগণকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত করতে বলিষ্ট ভূমিকা রাখেন।
এম. এন. ইসলাম কত দূরদর্শী ও প্রযুক্তিপ্রেমী ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কমপিউটার জগৎ পত্রিকায় প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার আগেই বিজ্ঞাপন দেয়ার আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে। সে সময় তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কোনো বাংলা পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ হবে এমন কথা ভাবতেও পারতেন না কেউ। শুধু তাই নয়, তিনি কমপিউটার জগৎ পত্রিকায় নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেয়ার পাশাপাশি পত্রিকাটি প্রতিমাসে ১৫০০ কপি নগদ টাকায় কিনতেন, যা তিনি ফ্লোরা লিমিটেডের ক্লায়েন্টদেরকে ফ্রি দিতেন তথ্যপ্রযুক্তিতে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষে।
তিনি মনে করতেন, এদেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে চাইলে প্রথমে প্রযুক্তি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সেই সাথে প্রযুক্তি সম্পর্কে মানুষের মনের ভীতি দূর করতে হবে। তিনি যে শুধু কমপিউটার জগৎ পত্রিকাকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন তা নয়, এদেশে যেসব আইটিবিষয়ক পত্রিকা বের হতো সেসব পত্রিকায়ও নিয়মিতভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন, যাতে এদেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটে দ্রুতগতিতে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, এম. এন. ইসলাম তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বাংলা পত্রিকাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গিয়ে এদেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখেন সেই সময়ে, যে সময় এদেশের দৈনিকগুলো তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলতো।
এম. এন. ইসলাম ছিলেন একজন সফল ব্যাংকার, একজন সফল ব্যবসায়ী। তার লেখালেখির হাতও ছিল চমৎকার যা আমাদের অনেকেই অজানা। তার লেখা কমপিউটার জগৎ পত্রিকায় ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘যার শিরোমান ছিল- কমপিউটার এবং জনশক্তি : বিশ্বে লক্ষ লক্ষ প্রোগ্রামারের চাহিদা।’ নববইয়ের দশক থেকে সারা বিশ্বে দক্ষ প্রোগ্রামারের ব্যাপক ঘাটতি হবে তা উপলব্ধি করে তিনি কমপিউটার জগৎ পত্রিকার মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরেন প্রোগ্রামারের বিপুল ঘাটতির কথা। সেই সাথে তাগিদ দেন এই ঘাটতি পূরনের। শুধু তাই নয় তিনি তার লেখনির মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরনে করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনাও দেন। তিনি এদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক তথা সংস্কার করার তাগিদ দেন। যার কিছু অংশ এখানে দেয়া হলো- ‘কমপিউটার এবং জনশক্তির মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো লাখ লাখ প্রোগ্রামারের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এরা এজন্য তৃতীয় বিশ্বের জনশক্তিকে কাজে লাগাতে চায় শ্রমমূল্যের সুবিধার জন্য। শুধু জাপানেই লাখ লাখ কমপিউটার জানা লোক প্রয়োজন। চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশ এ ব্যাপারে জনশক্তি উন্নয়ন ও রফতানির চেষ্টা চালাচ্ছে এবং সফলও হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে প্রোগ্রামার তৈরি ও রফতানির ব্যাপারে সরকারি বা বেসরকারি প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি’।
তার ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে কমপিউটার জগৎ হারাল এর সত্যিকারের এক পৃষ্ঠপোষককে, অকৃত্রিম বন্ধুকে। তবু আশার কথা তার জীবদ্দশায় তিনি তার সুযোগ্য সন্তান মোস্তফা সামসুল ইসলাম বর্তমানে ফ্লোরা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ফ্লোরা টেলিকমের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে যথাযোগ্য করে গড়ে তুলেছেন তার অবর্তমানে ফ্লোরা লিমিটেডের হাল ধরার জন্য। এর অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য। আল্লাহ তাদের সহায় হোন।
কজ
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com