• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > কমপিউটার জগৎ-এর দৃষ্টিতে বর্ষসেরা আইটি ব্যক্তিত্ব
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: অজিত কুমার সরকার
মোট লেখা:৫
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৪ - ফেব্রুয়ারী
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
থ্র্রীডি
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ৩
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
কমপিউটার জগৎ-এর দৃষ্টিতে বর্ষসেরা আইটি ব্যক্তিত্ব
এন আই খান
বর্ষসেরা আইটি ব্যক্তিত্ব

মো: নজরুল ইসলাম খান। এন আই খান নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তার বিশেষ অবদানের জন্য মাসিক কমপিউটার জগৎ তাকে ২০১৩ সালের ‘বর্ষসেরা আইটি ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এন আই খানের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১ ডিসেম্বর, যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার মশ্বিমনগর গ্রামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে মাস্টার্স। ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলার এন আই খান স্কুলজীবন থেকেই বরাবর মেধাবী। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি প্রথম হন। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এর পর থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রাধিকার কর্মসূচিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণকে স্থান দেন। প্রধানমন্ত্রীর একামত্ম সচিবের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ছিলেন অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক। সেখানেই কার্যত শু্রু হয় জ্ঞানভিত্তিক আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য তার ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অভিযাত্রা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তাপ্রসূত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। এন আই খান তার মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাইজেশনের সুফল গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। নিরলস শ্রম ও মেধা প্রয়োগ করে তিনি বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নকে সাফল্যের দিকে ধাবিত করছেন। এরই প্রতিফলন রয়েছে এই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক ও বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লমেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স প্রকল্পের কমিউনিকেশন্স কনসালট্যান্ট অজিত কুমার সরকার।

একটি রূপকল্পকে সামনে রেখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রার শুরু ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। গেল জানুয়ারিতে শেষ হয় তার সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মতো একটি কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচি বাস্তবায়নে এ সরকার কতটা সাফল্য দেখিয়েছে তা বিশ্লেষণের জন্য গবেষণার প্রয়োজন। কিন্তু দৃশ্যমান বাস্তবতা, গণমাধ্যম এবং দাতা সংস্থার প্রতিবেদন ও জরিপ থেকে একটি সত্যই বেরিয়ে এসেছে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, একটি বাস্তবতা। ২০১১ সালের ২ অক্টোবর প্রকাশিত ইউএনডিপির পরামর্শক মাইকেল মিনগেসের নেতৃত্বে একটি মূল্যায়নকারী দলের মূল্যায়নে বাংলাদেশে ডিজিটাইজেশনের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত চারটি সহজসাধ্য উদ্যোগকে খুবই সফল এবং জনপ্রিয় হিসেবে অভিহিত করা হয়। এগুলো হলো : ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (ইউআইএসসি), ই-পুর্জি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং জেলা ই-সেবাকেন্দ্র। এই চারটি সহজসাধ্য উদ্যোগের সুফলভোগী দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালু হওয়া স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের প্রচলিত শিক্ষা এবং ইউআইএসসি, ই-পুর্জি এবং জেলা ই-সেবাকেন্দ্র মানুষকে সেবার সনাতন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে, যা মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।
এই সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমত্মরিকতা ও দূরদর্শিতা। মেধাবী-দক্ষ আমলা ও বিশেষজ্ঞদের উপযুক্ত স্থানে বসিয়ে গোটা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেন তিনি। এই মেধাবী-দক্ষ আমলাদের একজন হচ্ছেন বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সচিব এন আই খান। পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাসত্মবায়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপ দেয়ায়। উচ্চাভিলাষী সেই স্বপ্নের বাসত্মবায়নে প্রধানমন্ত্রী খুঁজছিলেন কিছু সৎ, মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তিত্ব। সেই সূত্রে প্রোগ্রামের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান তারই তৎকালীন একামত্ম সচিব এন আই খান। তৃণমূলে ডিজিটাইজেশনের কার্যক্রম বাসত্মবায়নে উদ্ভাবনী প্রকল্প তৈরি, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে সক্রিয় রাখা এবং তদারকির জন্য তার মতো এক দক্ষ জনের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল।
এন আই খান ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র, জেলা ও উপজেলা ই-সেবাকেন্দ্র স্থাপন এবং সচল রাখার জন্য মাঠ প্রশাসনকে সক্রিয় রাখতে দিনের পর দিন দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট মানুষের সাথে মতবিনিময়, সভা ও সেমিনার করেছেন। এন আই খানকেও আমরা কাজ করতে দেখতে পাই ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন পর্বে।

এটুআইয়ের সহযোগিতার বিভিন্ন প্রোগ্রাম বিশেষ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবান্ধব বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন, আখ চাষীদের জন্য ই-পুর্জি চালু, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু ও টিচার্স লেড ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।

গ্রামের মানুষের কাছে তথ্যপ্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার চ্যালেঞ্জ

২০১৪ সালে এসে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করেন- সরকারের কোন উদ্যোগটি দুর্নীতি কমাতে সহায়তা করছে এবং সবচেয়ে বেশি মানুষের উপকারে আসছে? সবাই বলবেন, ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র স্থাপন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বরে টিআইবির জরিপ প্রকাশের সময় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে দুর্নীতি কমে যাওয়া অন্যতম একটি কারণ ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র স্থাপন এবং সেবাদানে প্রযুক্তির ব্যবহার।’

২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়েই প্রধানমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা দেন। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে প্রযুক্তির সংযোগ ঘটিয়ে তাদের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন ঘটানোর কথা বলেন। শুধু শহরের মানুষ নয়, গ্রামের মানুষও যাতে তথ্যপ্রযুক্তির সুফল পায় সেদিকে লক্ষ রেখে কর্মসূচি বাসত্মবায়নের ওপর গুরুত্ব দেন। শুধু শহরের মানুষ প্রযুক্তির সুবিধা পেলে তাতে ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হবে। তাই গ্রামের মানুষ ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য গ্রাম থেকেই ডিজিটাইজেশনের যাত্রা শুরু করেন।

এটি আসলেই একটি কঠিন কাজ। কারণ, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের বাস গ্রামে। কিন্তু গ্রামে তো আইসিটি অবকাঠামো বিশেষ করে বিদ্যুৎ সংযোগ ও ইন্টারনেট সুবিধা কোনো কিছুই নেই। প্রশ্ন ছিল, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে কীভাবে গ্রামের মানুষের কাছে তথ্যসেবা পৌঁছানো যাবে? এ নিয়ে এন আই খানের নেতৃত্বে এটুআই প্রোগ্রামের টিম গবেষণা শুরু করে। এ টিম সিদ্ধামত্ম নেয়, একযোগে সারাদেশে ৪,৫০১টি ইউআইএসসি স্থাপনের। এন আই খান এর নাম দেন ‘বটম আপ অ্যাপ্রোচ’। সিদ্ধান্ত হয় তৃণমূল থেকে ডিজিটাইজেশনের অভিযাত্রা শু্রু হবে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ইউএনডিপির প্রশাসক ও নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ককে দিয়ে উদ্বোধনের চেষ্টা চালানো হবে। সিদ্ধান্ত হয়, ইউআইএসসি হবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে। সরকার দেবে ইউনিয়ন পরিষদের জায়গা ও কিছু যন্ত্রপাতি এবং প্রতিটি ইউআইএসসির উদ্যোক্তারাও প্রায় একই পরিমাণ বিনিয়োগ করবে। যেসব ইউনিয়নে বিদ্যুৎ নেই, সেখানে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে। কেউ বললেন, এটা এন আই খানের ‘পাগলামি’ ছাড়া কিছুই নয়। কিছু অর্থের অপচয় হবে, কজের কাজ কিছুই হবে না। যে কথা সেই কাজ। ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ভোলার চরফ্যাশনে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর কুকরি-মুকরিতে অবস্থানরত আরেক জননেত্রী নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ইউএনডিপির প্রশাসক হেলেন ক্লার্কের সাথে কথা বলে দেশের ৪,৫০১টি ইউনিয়নে তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। গ্রামবাংলার মানুষের কাছে খুলে যায় তথ্যপ্রযুক্তির সেবার অবারিত দুয়ার। আধুনিক প্রযুক্তিসেবার সব সুবিধা নিশ্চিত করেই দেশের ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয় এসব তথ্য ও সেবাকেন্দ্র। গ্রামের মানুষের জীবনধারাই বদলে দিয়েছে এসব ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র। সরকার প্রায় দুইশ’ বছর ধরে প্রচলিত ধারার সেবা দেয়ার পদ্ধতির ডিজিটাইজেশন করে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে তা পৌঁছে দিচ্ছে গ্রামের মানুষের কাছে। শু্রুর দিনগুলোতে ইউআইএসসিতে ১৫ থেকে ২০ ধরনের সেবা দেয়া হতো। বর্তমানে কোনো কোনো তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে ৫০ ধরনেরও বেশি তথ্যসেবা জোগানো হচ্ছে। এটুআই প্রোগ্রামের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষ প্রতিমাসে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র থেকে সেবা পাচ্ছে। তিন বছরে এসব তথ্য ও সেবাকেন্দ্র প্রায় চার কোটি সেবা দিয়ে আয় করেছে ১৩০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য এসব সেবার মধ্যে রয়েছে অনলাইনে সাড়ে তিন কোটির বেশি জন্মনিবন্ধন, বিদেশ গমনেচ্ছু ২০ লাখ নাগরিকের অনলাইনে নিবন্ধন এবং সাড়ে চার লাখ জমির দলিলের নকল/পর্চা সরবরাহ।

ই-কমার্স প্রসারে

আমরা গ্রামেই থাকি আর শহরেই থাকি, প্রতিদিন আমাদের নানা পণ্য কিনতে হবে। গ্রামে মানুষ হাটে যায়, আর শহরের মানুষ যায় সুপার মার্কেটে। এজন্য আমাদের প্রচুর সময় ব্যয় হয়। কিন্তু আমরা যদি ই-কমার্সের প্রসার ঘটাতে পারি, তবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে পণ্য কেনাবেচায় প্রচুর সময় যেমনি বাঁচাতে পারি, তেমনি খরচও কমিয়ে আনতে পারি, তাই বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রসার ঘটানোর প্রয়োজন রয়েছে। এই যথার্থ উপলব্ধি ছিল এন আই খানের। তাই তিনি উদ্যোগী হন দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ই-কমার্স মেলা আয়োজনের মাধ্যমে ই-কমার্সের ব্যাপারে আমাদের দেশের মানুষকে সার্বিকভাবে সচেতন করে তোলায়। তারই আমত্মরিক প্রয়াসে আইসিটি মন্ত্রণালয় ও কমপিউটার জগৎ-এর যৌথ উদ্যোগে ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে তিনটি ই-কমার্স মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতিটি মেলার ব্যাপ্তি ছিল তিন দিন। এসব মেলায় উদ্যোক্তা ও দর্শকদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া মেলে। সেই সূত্রে আবারও এন আই খানের তাগিদে কমপিউটার জগৎ ও যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে ২০১৩ সালের ৭ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনে আয়োজন করা হয় ইউকে বাংলাদেশ ই-কমার্স মেলা। লন্ডনের মিলেনিয়াম গস্নুচেটার হোটেলে আয়োজিত এই মেলা বেশ সাফল্যের সাথেই সম্পন্ন হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ কটি মেলা আয়োজনে এন আই খানের ভূমিকা ছিল মুখ্য। এ মেলাগুলো বাংলাদেশে ই-কমার্স জনপ্রিয় করায় বিজারকের ভূমিকা পালন করে।

এন আই খানের এবারের মিশন

২০১২ সালের এপ্রিলে এন আই খান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে যোগ দেন। এ মন্ত্রণালয় যোগ দিয়েই তিনি এমন কিছু প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছেন, যা শুনলে অনেকটা অবাক হতে হয়। মনে হয়ে এও কি সম্ভব? কিছুদিন আগে ডেইলি স্টার মিলনায়তনে গ্রিন টেকনোলজি বিষয়ক এক সেমিনারে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনাম এন আই খান সম্পর্কে বলেন, এন আই খান কঠিন এবং ঝামেলার কাজ নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং কাজটি যত কঠিনই হোক, তিনি তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বাসত্মবায়নও করেন। এটিকে মাহফুজ আনাম এন আই খানের একটি বিশেষ গুণ হিসেবে দেখেন। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মোবাইল অ্যাপিস্নকেশনস (অ্যাপস) উন্নয়ন, বাড়ি বসে বড়লোক, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রোগ্রামের অধীনে ফ্রিল্যান্সার টু এন্টারপ্রেনিউর, এন্টারপ্রেনিউর টু বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) প্রফেশনালস তৈরির প্রকল্পগুলো এরই মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

কীভাবে গ্রামে ইউআইএসসিগুলোকে আউটসোর্সিং সেন্টারে পরিণত করা হবে এ নিয়ে কথা হয় এন আই খানের সাথে। তিনি বলেন, ‘২০১০ সালের নভেম্বরে যখন ৪,৫০১টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন এর সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসব কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে এবং এর উপযোগিতাও ইতোমধ্যে মানুষের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। আমার এবারের উদ্যোগ দেশে বর্তমানে যে তথ্য ও সেবাকেন্দ্র রয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগকে আউটসোর্সিং সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলা।’ তার মতে, তথ্য ও সেবাকেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি আইটি প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণী বের হচ্ছে। এদের অনেকে প্রশিক্ষণ শেষে কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এদের যদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে ফ্রিল্যান্সারেরা ওই সেন্টারে বসে অর্থাৎ গ্রামে বসেই ডলার আয় করবে। শুধু তাই নয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বছরে প্রায় ৫০ হাজার তরুণ-তরুণী আইটি প্রশিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠছে। তাদের জন্য ইউআইএসসিগুলো হতে পারে আউটসোর্সিং কাজের কেন্দ্র। এমন চিন্তা থেকে আইসিটি মন্ত্রণালয় ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রোগ্রামের আওতায় জেলা পর্যায়ের তরুণ-তরুণীদের ফ্রিল্যান্সিং আউটসোর্সিংয়ের প্রশিক্ষন দিচ্ছে। এরই মধ্যে ২০১৩ সালে এ প্রোগ্রামের অধীন ১৫ হাজার ফ্রিল্যান্সার তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে তৈরি করা হবে আরও ২০ হাজার নারীসহ ৫৫ হাজার ফ্রিল্যান্সার। এই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে উপজেলা পর্যায়ে, যেখানে ইউআইএসসি থেকে আইটি প্রশিক্ষিতরা প্রশিক্ষন নিতে পারবেন। প্রশিক্ষন শেষে এরা সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউআইএসসিতে একজন উদ্যোক্তার নেতৃত্বে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করবেন। এভাবে একটি সময়ে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র মিনি আউটসোর্সিং সেন্টারে পরিণত হতে পারে।

এন আই খান জানালেন, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রোগ্রামেরও কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। এ প্রোগ্রামে ফ্রিল্যান্সার তৈরির পাশাপাশি চলছে উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষন। ফ্রিল্যান্সারদের মধ্য থেকেই বাছাই করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। যাতে প্রত্যেক উদ্যোক্তা ২০ থেকে ২৫ জন ফ্রিল্যান্সারকে সাথে নিয়ে তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে বসেই আউটসোর্সিংয়ের বড় বড় কাজ করতে পারে। এরপর এসব উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষন দিয়ে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যারা এক সময় আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহরের হাইটেক পার্কে বিপিও পেশাজীবী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবেন।

বদলে দেয়ার কর্মসূচি

আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল ভবনে নবসৃষ্ট আইসিটি মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করলেই মনে হবে বাংলাদেশের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির আলোয় আলোকিত করে বদলে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই মন্ত্রণালয়। দরজা, দেয়ালে সেঁটে দেয়া হয়েছে অনেক কার্যক্রমের ছবি। নির্মাণাধীন বিসিসি ভবনের পাঁচ তলার অফিস কক্ষ গুলো দেখলে যেকেউ বলবেন, এটি গ্রিন টেকনোলজির ধারণায় তৈরি হওয়া একটি ভবন। কাঁচের ঘেরা অফিসে রোদ ও আলো ঢুকছে প্রতিটি কক্ষ। একটি বিশাল ফ্লোরের এক প্রামেত্ম বসা সচিব কক্ষ থেকে ফ্লোরে অবস্থানরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেমন দেখতে পান, তেমনি এরাও দেখতে পান সচিবকে। এর একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে বলে অনেকে জানালেন। মন্ত্রণালয়ের সবার কাজে গতি ফিরে এসেছে। পার্টিশন ছাড়া স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে ঘেরা অফিসের কারণেই মন্ত্রণালয়ের কাজে এত প্রাণচাঞ্চল্য। এন আই খান অবশ্য জানান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গ্রিন টেকনোলজিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আগে ঘর থেকে এর শুরু করা হলো।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বর্তমানে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে বাসত্মবায়িত হবে, তা সত্যিই দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে। প্রকল্পগুলোর তালিকায় দেখা গেল বিশ্বব্যাংকের আর্থিক ঋণে বাসত্মবায়িত হচ্ছে লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপস্নয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স প্রকল্প। এ প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩৪ হাজার শিক্ষিত তরম্নণ-তরম্নণীকে বিশ্বমানের আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে। প্রকল্পটি বাসত্মবায়িত হলে দেশে ৩৪ হাজার প্রত্যক্ষ চাকরি ও ১ লাখ ২০ হাজার অপ্রত্যক্ষ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা ও শাসনকাজে দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ই-গভর্মেন্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে এ প্রকল্প।

শেষ কথা

একবিংশ শতাব্দীতে আইসিটি ছাড়া যেমন কোনো কিছু কল্পনা করা যায় না, তেমনি হাইটেক পার্ক ছাড়া এর বিকাশ সম্ভব নয়। বিশেষ করে আইসিটি খাত থেকে আয় বাড়াতে হলে হাইটেক পার্ক স্থাপন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই বাসত্মবায়িত হচ্ছে হাইটেক পার্ক প্রকল্প। বিভাগীয় শহর ও কিছু জেলায় তৈরি করা হচ্ছে হাইটেক পার্ক। হাইটেক পার্কে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার প্রস্ত্তত করবে; কলসেন্টার প্রতিষ্ঠিত হবে। তা শুধু তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে নয়, রফতানি বাড়ানো এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। হাইটেক পার্ক ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ বাসত্মবায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সে কারণে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক আলাদা অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ হিসেবে এ প্রকল্প বাসত্মবায়ন করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
সরকারের পাবলিক নেটওয়ার্ক স্থাপনের লক্ষ্যে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর বাংলাদেশ গভর্মেন্ট (BanglaGovNet) প্রকল্প বাসত্মবায়নের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের দফতরের মধ্যে নেটওয়ার্ক সংযোগ স্থাপন করা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ৬৪টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপজেলা আইসিটি কেন্দ্র (ইউআইসিটিসি) স্থাপন ও উপজেলা আইসিটি কেন্দ্রগুলো জেলা আইসিটি কেন্দ্রের মাধ্যমে জাতীয় আইসিটি কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত হবে।

দেশে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত জনবলকে আরও দক্ষ ও আমত্মর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্য জাপানের আইটি ইঞ্জিনিয়ার্স এক্সামিনেশনস (ITEE)-এর মাধ্যমে জাইকার আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অন আইটিইই ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প ডিসেম্বর ২০১২ থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্প বাসত্মবায়ন হলে আমত্মর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে দেশের আইসিটি জনবল আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারবে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আরও অনেক প্রকল্পই রয়েছে, তবে নতুন প্রকল্প প্রণয়নে বরাবরের মতোই প্রধানমন্ত্রীর চিমত্মার আলোকে এন আই খান জোর দিচ্ছেন গ্রামে বসবাসকারী মানুষকে প্রযুক্তি নেটওয়ার্কে নিয়ে আসার ওপর। সম্প্রতি তৃণমূল পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য করার জন্য ওয়াইফাই হটস্পট স্থাপন শীর্ষক একটি প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, রেলওয়ে স্টেশন এবং বাসস্ট্যান্ডসহ বেশ কিছু স্থানে ১ লাখ ৩০ হাজার ওয়াইফাই হটস্পট স্থাপনের জন্য মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের সাথে কথা হচ্ছে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের। সারাদেশে থ্রিজি নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়ায় ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবা দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সহজে ও কম খরচের পদ্ধতি হচ্ছে ওয়াইফাই হটস্পট প্রযুক্তি। এছাড়া এসব হটস্পটের ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহার করে ব্যবসায়িক ও সামাজিক যোগাযোগ গড়ে তোলার সুযোগ পাওয়া যাবে। এন আই খান বলেন, এর ফলে শ্রমনির্ভর অর্থনীতি থেকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে উত্তরণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় শিগগিরই ১ লাখ ৩০ হাজার ওয়াইফাই হটস্পট স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়ার ব্যাপারে একটি কার্যকর উদ্যোগে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস