লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৪ - ফেব্রুয়ারী
কমপিউটিংয়ে সৃজনশীলতার তিন দশক
বাংলাদেশে তখনও টিভি দর্শকের সংখ্যা তেমন নয়। টিভিতে যেসব বিজ্ঞাপন দেয়া হতো তাও দেশী পণ্যের। কমপিউটারে টিভি বিজ্ঞাপন তো ধারণাই করা যেত না। সেই সময় অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে আমেরিকার টিভিতে প্রচারিত অ্যাপল কমপিউটারের সুপার বাউলের বিজ্ঞাপনটি দেখানো হয়। এতে দেখানো হয়, একদল লোক টেলিভিশনে কোনো একজনের কথা শুনছে। একজন মহিলা অ্যাথলেট একটি হাতুড়ি ছুড়ে মারেন সেই বিশাল পর্দার টিভিতে। খান খান হয়ে যায় টিভির পর্দা।
বিজ্ঞাপনটি এখনও ইচ্ছে করলে দেখা যাবে এই ঠিকানায় : www.latimes.com/business/technology/la-fi-tn-apple-1984-super-bowl-20140122, 0,1808416.story#axzz2rbOjAWUy
বিজ্ঞাপনের মূল কথাটি ছিল- ১৯৮৪ সালে অ্যাপল কমপিউটার মেকিন্টোস কমপিউটার বাজারজাত করছে, যে জন্য ১৯৮৪ সাল চুরাশি সালের মতো হবে না। সত্যিকার অর্থেই ১৯৮৪ সাল চুরাশির মতো হয়নি। নিশ্চিতভাবেই মেকিন্টোস কমপিউটার ১৯৮৪ সাল থেকেই দুনিয়াটিকে বদলে দিয়েছে। অমত্মত কমপিউটারের দুনিয়াটা মেকিন্টোসের আগে আর পরে এক থাকেনি।
সেই সময় বিশ্বখ্যাত টাইম পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল একটি কমপিউটারের বিজ্ঞাপন, যাতে কমপিউটারটি বলেছিল- হ্যালো আই এম মেকিন্টোস। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্টিভ জবস মেকিন্টোসকে দিয়েই এই কথাটি বলিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ প্রথমবারের মতো শুনেছিল পিসি কথা বলতে পারে।
মেকিন্টোস সাইকেলে চড়ে নিয়ে যাচ্ছে একজন স্কুলছাত্র বা একটি মাউস দিয়ে শিশু খেলছে- এমন অনেক বিজ্ঞাপন আমরা তখন দেখেছি। তবে দুনিয়া কাঁপানো কমপিউটারটি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি ১৯৮৬ সালের আগে।
১৯৮৪ সালেই কমপিউটারটির ছবি বিজ্ঞাপনে দেখলেও এ বিষয়ে নিবন্ধটি প্রথম পাঠ করি ১৯৮৬ সালে ম্যাক ওয়ার্ল্ড নামের সাময়িকীতে। সেখানে একটি নিবন্ধও ছিল। এতে বলা হয়েছিল- এটি দিয়ে প্রকাশনার কাজ করা যায়। এরপর কমপিউটারটি স চখে দেখি ঢাকার কাকরাইলের আসিফ ম্যানসনের বিইএসএল নামের প্রতিষ্ঠানে। কমপিউটারটি নিজের হয় ১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল। সেই বছরের ১৬ মে এই কমপিউটার দিয়ে আমি প্রকাশ করি আনন্দপত্র নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। আনন্দপত্র প্রকাশের ২৭ বছর এবং মেকিন্টোসের জন্মের ৩০ বছর পর মনে হচ্ছে সশ্রদ্ধচিত্তে একবার সেই ছোট যন্ত্রটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমার নিজের ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা হচ্ছে, এই যন্ত্রটি যদি না জন্মাতো তবে আমার ২৭ বছরের ক্যারিয়ারের জন্ম হতো না। জাতির কৃতজ্ঞতা হলো- এই যন্ত্রটি ছাড়া কমপিউটারে বাংলাভাষার এমন প্রচলন হয়তো হতো না। প্রকাশনা ও সৃজনশীল খাতের সবার কৃতজ্ঞতা যে এখনও ৩০ বছর পরেও এই ছোট যন্ত্রটির প্রতিস্থাপন হয়নি।
অনেকেরই মনে থাকার কথা নয়, এখন থেকে ৩০ বছর আগে মাত্র ৯ ইঞ্চি সাদাকালো পর্দার অল ইন ওয়ান একটি পার্সোনাল কমপিউটারে মাউস যুক্ত হলো আর তার সাথে এলো মেকিন্টোস অপারেটিং সিস্টেম এবং ম্যাক রাইট, ম্যাক পেইন্ট ও ম্যাক ড্র সফটওয়্যার। সারা দুনিয়াতে তখন আইবিএম পার্সোনাল কমপিউটারের অপ্রতিরোধ্য জয়জয়কার। এসএম ডস, ওয়ার্ড স্টার, লোটাস ও ডিবজের সেই জমানাতে সিনটেক্স লিখে বা প্রোগ্রামিং জেনে যখন কমপিউটার ব্যবহার করতে হয়, তখন সাইকেলের পিছে বসিয়ে যেখানে-সেখানে নিয়ে গিয়ে স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা কোনো কমান্ড মুখস্থ না করেই পিসি ব্যবহার করা শুরম্ন করল। সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ প্রথম অনুধাবন করল- কমপিউটার মানে কমান্ড মুখস্থ রাখা, বাইনারি অঙ্ক জানা বা প্রোগ্রামিং করা নয়। বিশ্ববাসী সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছিল, কমপিউটারের ভাষা একমাত্র ইংরেজি থেকে যেকোনো ভাষায় রূপামত্মরিত হয়ে গেল। এর চেয়েও গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে গেল, কমপিউটার দিয়ে শুধু লেখালেখি, হিসাব-নিকাশ বা তথ্যবিন্যাস করা নয়, এটি দিয়ে ছবি অঁকা, অডিও ব্যবহার করা, হওয়া যায় সৃজনশীল মানুষ। ১৯৭৯ সালে শুরম্ন হওয়া এই প্রকল্পের প্রধান পুরম্নষ ছিলেন জেফ রাসকিন। এতে প্রথমবারের মতো ব্যবহার হয়েছিল কুইকড্র প্রযুক্তি, যার রূপকার ছিলেন বিল অ্যাটকিন্স। এই কমপিউটারটির পূর্বপণ্য হিসেবে অ্যাপল কমপিউটার ১৯৮৩ সালে লিজা নামের আরও একটি কমপিউটার বাজারে এনেছিল। তবে সেটি উচ্চমূল্যের জন্য সফল হতে পারেনি। কিন্তু মেকিন্টোসে সাড়ে তিন ইঞ্চি ফ্লপি ডিস্ক ও গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস ধারণাটি লিজা থেকেই নেয়া হয়।
১৯৮৪ সালে জন্ম নেয়ার পর ১৯৮৭ সালে মেকিন্টোস কমপিউটারে রঙিন পর্দা আসে। কালক্রমে এতে যুক্ত হয় মটোরোলা রিস্ক প্রসেসর এবং সর্বশেষ এর গতি সঞ্চার করছে ইন্টেলের অতিজনপ্রিয় প্রসেসর। সারা পৃথিবীতে মেকিন্টোস সব ধরনের সৃজনশীল কাজের শ্রেষ্ঠতম টুল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রকাশনা, গ্রাফিক্স, অডিও-ভিডিও, অ্যানিমেশনসহ সব ধরনের সৃজনশীল কাজের জন্য এই কমপিউটারটিকে এখনও বিশ্বসেরা বলে মনে করা হয়। পার্সোনাল কমপিউটার দিয়ে লেখাপড়া করা, ছবি অঁকা, ছবি সম্পাদনা করা, ভিডিও সম্পাদনা করা, অডিও সম্পাদনা করা ইত্যাদি কাজের জনক হচ্ছে মেকিন্টোস। হাইপার কার্ড বা স্ক্রিপ্টিং ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে খুব সহজে প্রোগ্রামিং করার ধারণাটিও মেকিন্টোস থেকেই পাওয়া।
মূলত এরই প্রযুক্তি দিয়ে গড়ে উঠেছে উইন্ডোজ নামের জনপ্রিয়তম অপারেটিং সিস্টেম। এমনকি উইন্ডোজের অ্যাপিস্নকেশন প্রোগ্রামগুলোর জন্মই হয়েছে মেকিন্টোস কমপিউটারের হাত ধরে। মেকিন্টোসের প্রযুক্তিগুলো আজ দুনিয়ার সব পার্সোনাল কমপিউটারের মূল সঙ্গী হয়ে পড়েছে। বহু প্রযুক্তি আছে অ্যাপল আবিষ্কার করেছে এবং কমপিউটিং দুনিয়া ব্যবহার করেছে। ফায়ারওয়্যার তেমন একটি প্রযুক্তি। আবার বহু প্রযুক্তি আছে, যা অন্যরা উদ্ভাবন করেছে কিন্তু এর প্রথম ব্যবহার থেকে জনপ্রিয় করার কাজটি করেছে মেকিন্টোস। ইউএসবি তেমন একটি প্রযুক্তি।
১৯৮৪ সালের ২৪ জানুয়ারি জন্ম নেয়া মেকিন্টোস। সেই সময় শুধু একটি নতুন উদ্ভাবনা, একটি নতুন পণ্য বা নতুন ধারণা ছিল না, ছিল একটি বিপস্নবের নাম। মাত্র ১২৮ কিলোবাইট স্মৃতি সংবলিত মটোরোলা ৬৮০০০ প্রসেসরে তৈরি সেই কমপিউটারটি বাংলাদেশের জন্যও এক বিপস্নবের নাম। এই কমপিউটারটির জন্মের পরপরই এটিকে ভিত্তি করে জন্ম নেয় শহীদলিপি নামের একটি সফটওয়্যার। সাইফুদ্দাহার শহীদ নামের এক বাংলাদেশী প্রকৌশলী লন্ডনে প্রথম মেকিন্টোস কমপিউটারের অপারেটিং সিস্টেম ও ম্যাকরাইট অ্যাপিস্নকেশন প্রোগ্রামের বাংলা অনুবাদ করেন এবং প্রথম বিটম্যাপড বাংলা ফন্ট উদ্ভাবন করেন। মেকিন্টোসের জন্য প্রণীত রিসোর্স এডিটর নামের একটি সফটওয়্যার দিয়ে সেই কাজটি স্বচ্ছন্দে করা হয়। কমপিউটারের কোনো অপারেটিং সিস্টেমকে খুব সহজে রোমান হরফের বাইরে অনুবাদ করার সুবিধা মেকিন্টোসেই প্রথম চালু করা হয়। এর আগে কমপিউটারে প্রদর্শন করার জন্য শুধু রোমান হরফ ব্যবহার করা যেত। মেকিন্টোস সেই দেয়ালটা ভাঙে এবং মাল্টিপল ফন্ট বা মাল্টিপল আকার ব্যবহার করার সুবিধা তাতে যুক্ত হয়। পুল ডাউন মেনু, ড্র্যাগ অ্যান্ড ড্রপ প্রযুক্তিও মেকিন্টোসেই প্রথম ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। সাইফুদ্দাহার শহীদ সেই সুবিধাগুলো শহীদলিপিতে কাজে লাগান। বাংলাদেশে শহীদলিপি নামে পরিচিত এই সফটওয়্যারটি প্রথম জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে ব্যবহার হয় ও কমপিউটারে বাংলা লেখার একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। যদিও কালক্রমে শহীদলিপি হারিয়ে যায়, তবুও কমপিউটারে বাংলাভাষা ব্যবহারের সূচনালগ্নে এর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। শহীদলিপি অফিসে ব্যবহার হতে থাকাকালেই একটি যুগামত্মকারী ঘটনা ঘটে বাংলা প্রকাশনার জগতে। ১৯৮৭ সালের ১৬ মে মেকিন্টোস কমপিউটার দিয়েই কমপিউটারে কম্পোজ করা প্রথম বাংলা পত্রিকা আনন্দপত্র প্রকাশিত হয়। সৈয়দ মাইনুল হাসান নামে এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেকিন্টোস কমপিউটারে মাইনুল লিপি নামের যে ফন্ট ও জববার কীবোর্ড নামের যে কীবোর্ড প্রচলন করেন, পত্রিকাটি সেই প্রযুক্তি দিয়েই প্রকাশিত হয়।
বাংলা প্রকাশনার জগতের ছোট্ট সেই স্ফুলিঙ্গটি ধীরে ধীরে পত্রপুষ্পে পলস্নবিত হতে থাকে। ১৯৮৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আমি নিজে তৈরি করি বাংলা ফন্ট আনন্দ। মেকিন্টোস কমপিউটারের জন্য তৈরি করা সেই ফন্ট প্রথমেই বদলে দেয় বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতটিকে। দৈনিক আজাদ, দৈনিক দেশ, দৈনিক বাংলার বাণী থেকে শুরম্ন করে তৎকালে প্রকাশিত সব পত্রিকার ডিজিটাল যুগে যাত্রা শুরম্ন হয় সেই থেকে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয় আমাদের তরম্নণদের পেশার ক্ষেত্রে। হাজার হাজার তরম্নণ যারা এর আগে কোনোদিন কমপিউটার চোখে দেখেনি, তারাই কমপিউটার ব্যবহার করে প্রকাশনার কাজ করতে থাকে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে গড়ে ওঠে ডিটিপি সেন্টার। বস্ত্তত তখন থেকেই বাংলাদেশ পস্নাবিত হয় ডেস্কটপ প্রকাশনা বিপস্নবের জোয়ারে। বাংলাদেশে মেকিন্টোস কমপিউটারের সর্বাধিক প্রচলিত প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয় ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেই দিন বিজয় নামের কমপিউটারে বাংলা লেখার কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার জগত পায় বিশ্বের সর্বাধুনিকতম কমপিউটারপ্রযুক্তি। শত শত বাংলা হরফকে শুধু দুই সত্মরের কমপিউটার কীবোর্ডে অবিকৃতভাবে লেখার সুবিধা সংবলিত বিজয় বাংলা কীবোর্ড ও সফটওয়্যার বস্ত্তত বাংলাভাষার জগতটাকেই পাল্টে দেয়। সীসার হরফ থেকে বাংলা হরফের ডিজিটাল যাত্রার বাহন হয় মেকিন্টোস। ১৯৯৩ সালে আইবিএম পিসিতে উইন্ডোজ ৩.০ অপারেটিং সিস্টেম প্রচলিত হওয়ার আগে পর্যমত্ম মেকিন্টোসই ছিল কমপিউটারে মুদ্রণমানের বাংলা লেখালেখির একমাত্র বাহন।
যদি এমনটি মনে করা হয়, মেকিন্টোস কমপিউটার জন্ম না নিলে হয়তো বাংলা হরফকে রোমান হরফ স্থলাভিষিক্ত করত বা বাংলা হরফকে কমপিউটারে ব্যবহার করার সময়টি আরও অনেক পিছিয়ে যেত, তবে সম্ভবত কোনো ভুল হবে না। আজ যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাথে যে দেশের কোটি কোটি লোক যুক্ত হয়েছে, তার পেছনে মেকিন্টোসের অবদানকেই গুরম্নত্বপূর্ণ বিবেচনা করতে হবে। অন্যদিকে সারা দুনিয়ার জন্য কমপিউটার প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের ব্যবহারযোগ্য করার পথ দেখিয়েছে মেকিন্টোস।
২০১৪ সালে মেকিন্টোস প্রযুক্তির ৩০তম বার্ষিকীতে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিকাশে এর অবদান এবং সাধারণ মানুষের হাতে কমপিউটারের প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়ার কথা স্মরণ করি। এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, মেকিন্টোস কমপিউটারের জন্ম না হলে সাধারণ মানুষের সাথে কমপিউটারের মিলন হয়তো আরও অনেক দেরিতে হতো
ফিডব্যাবক : mustafajabbar@gmail.com