লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
হিটলার এ. হালিম
মোট লেখা:২২
লেখা সম্পর্কিত
হুমকির মুখে দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা
হুমকির মুখে পড়েছে দেশের ইন্টারনেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ওয়েবসাইট, ই-মেইল ও ফেসবুকের আইডি হ্যাকিংয়ের ঘটনা হালে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। অতিসম্প্রতি একটি ব্যাংকের গ্রাহকদের হিসাব হ্যাক করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের ব্যবস্থা) নিরাপত্তা নিয়েও। অন্যদিকে একের পর এক সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের ঘটনায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থার সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সচেতনতার অভাবেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির হাতে ইন্টারনেট ব্যবস্থা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্যক্তি পর্যায়ে ইন্টারনেটের অপব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ইন্টারনেট সংক্রান্ত অপরাধ বাড়ছে। আইন করে এসব অপকর্ম বন্ধ করা যাবে না বলে তারা অভিমত দেন। এসব বন্ধে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোকে সামাজিক সচেতনতায় এগিয়ে আসতে হবে বলে এরা মনে করেন। গণমাধ্যমে দ্রুতগতিসম্পন্ন থ্রিজির বিজ্ঞাপনের জন্য বরাদ্দ সময়ের পাঁচ শতাংশ জনসচেতনতামূলক কাজে (টিপস আকারে) ব্যয় করলে তা সবাইকে সচেতন করবে। পাশাপাশি সংশিস্নষ্ট ব্র্যান্ডের প্রচারেরও কাজে লাগে।
প্রযুক্তি বিশেস্নষক ও ফাইবার অ্যাট হোমের চিফ স্ট্র্যাটেজিক অফিসার সুমন আহমেদ সাবির বলেন, মানুষকে সচেতন করেই ইন্টারনেট নিরাপত্তার শতকরা ৯০ শতাংশ দুর্বলতা দূর করা সম্ভব। সচেতনতা তৈরির প্রাথমিক ধাপ হিসেবে তিনি ইন্টারনেটের পাসওয়ার্ডের প্রতি সবাইকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়ে বলেন- সহজ, প্রচলিত ও সবাই যে ধরনের পাসওয়ার্ড দিয়ে থাকে তা না দিয়ে ভিন্ন ধরনের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। এমনকি কিছুদিন বিরতি দিয়ে পাসওয়ার্ড পরিবর্তনেরও পরামর্শ দেন তিনি।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও তিনি কারিগরিভাবে আরও সক্ষম করে গড়ে তোলার আহবান জানান। আর ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা ব্যাংক জগতে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি স্ট্যান্ডার্ডটা সঠিকভাবে নিরীক্ষা হচ্ছে কি না সবার আগে তা দেখতে হবে।
এদিকে অনলাইন কার্যক্রমে ‘নিরাপত্তা দুর্বলতার সুযোগে’ একটি বেসরকারি ব্যাংকের কয়েকজন গ্রাহকের হিসাব ‘হ্যাক’ করে অন্য হিসাবে অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগের (এফআইএসডি) এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ব্র্যাক ব্যাংকের ৩৫টি হিসাব থেকে একই ব্যাংকের অন্য হিসাবে (অনলাইনের মাধ্যমে) ২০ লাখ টাকার মতো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এ ঘটনার কারণ হিসাবে ব্যাংকটির অনলাইন কার্যক্রমের নিরাপত্তা দুর্বলতাকে দায়ী করেছে এফআইএসডি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ব্র্যাক ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় নয়। এতে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কিছু ত্রুটি রয়েছে। এ কারণে গ্রাহক স্বার্থের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকটির ইন্টারনেট ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন আনা জরুরি।
জানা গেছে, ব্র্যাক ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের পাসওয়ার্ড রিসেট (পুনঃস্থাপন) করার প্রক্রিয়ায় দুই সত্মরের মধ্যে সঠিকতা যাচাই করা হয় না। ব্র্যাক ব্যাংক ছাড়া আরও কয়েকটি ব্যাংক, যেগুলো এরই মধ্যে ইন্টারনেট ব্যাংকিং চালু করেছে, সেগুলোও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে। গ্রাহকদের সেবা দেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে গিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল রাখা হলে গ্রাহকদের সেবা দেয়ার পরিবর্তে তাদের আরও হয়রানি করা হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাৎক্ষণিক সেবা পাওয়ার চেয়ে বরং দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সেবা পাওয়াটাকে তারা কাঙিক্ষত বলে মনে করেন।
এ ছাড়া বিকাশের (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান) বিরুদ্ধেও অনলাইনে কারসাজি করে গ্রাহকের তথা এজেন্টদের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওই অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। বিকাশ হিসাবধারী সিম সহজে উত্তোলনের সুবিধা থাকায় বহু জটিলতা দেখা দেয়। জটিলতা এড়াতে ও সমস্যার সমাধানে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তথা বিটিআরসি এ বিষয়ে একটি নির্দেশনাও জারি করেছে। বিটিআরসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষ মোবাইল সিমের প্রকৃত মালিকই সিম তুলতে (সিম হারিয়ে গেলে বা পুনঃস্থাপনের জন্য) পারবেন। একজন আরেকজনের সিম তুলতে পারবেন না। এই নির্দেশনা জারির পর বিকাশের এ ধরনের ঘটনা কমেছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে সুরক্ষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় দেশের সরকারি ওয়েবসাইটগুলো বারবার হ্যাকিংয়ের শিকার হচ্ছে। দুর্বল নিরাপত্তা ব্যূহ সহজে ভেদ করে দেশী-বিদেশী হ্যাকার গোষ্ঠী সাইটগুলোতে ঢুকে তথ্য সরিয়ে নিচ্ছে। দেশের প্রযুক্তিবিদেরা মনে করেন, এর ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ইতিবাচকতার বদলে নেতিবাচক ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাসত্মবায়নে তড়িঘড়ি করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের (৬০টি) ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়। বেশিরভাগ সাইটই কম খরচে মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তৈরি করা। সুরক্ষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় দেশী-বিদেশী হ্যাকারেরা তাদের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয় সরকারি সাইটগুলো। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইটগুলোতে শক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকায় হ্যাকারেরা সাইটগুলোয় সহজে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। সাপোর্ট টু ডিজিটাল বাংলাদেশের টাস্কফোর্সের (এটুআই) জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ নাইমুজ্জামান মুক্তা জানান, সরকারি সাইটগুলো সাধারণত জুমলা সফটওয়্যার ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। নতুন করে সাইটগুলো দ্রুপাল সফটওয়্যার ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো, সার্চ ইঞ্জিনও বেশ কার্যকর।
বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির (বিসিএস) বিদায়ী সভাপতি মোস্তফা জববার বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটগুলো যারা তৈরি করেছেন তারা ওয়েবসাইটের নিরাপত্তায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রণে অবহেলার কারণেই এমনটি হচ্ছে।
এদিকে সাবেক এমপি মাহী বি. চৌধুরীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট গত ১৮ জানুয়ারি হ্যাকড হয়। তিনি বুঝতে পেরে তার আইডিটি বন্ধ করে দেন। ঝামেলা হতে পারে ভেবে তিনি রাজধানীর গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়রিও করেন।
জানা গেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সংক্রান্ত অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি (ছবি সুপার ইম্পোজ করে হয়রানির জন্য তৈরি ইমেজ), কুরুচিপূর্ণ ই-মেইল, ব্লগে বাজে মন্তব্য প্রকাশ, মোবাইলে অশালীন এসএমএস, হুমকি-ধমকি, ফেসবুকে অন্যের আইডিতে বিকৃত ছবি ট্যাগ করা ও বাজে মন্তব্য করা ইত্যাদি। জানা গেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়েছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে। এ তালিকায় আরও রয়েছে ইউটিউবসহ অন্যান্য সাইট। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিটিআরসি ইন্টারনেটে কড়া নজরদারির ঘোষণা দিয়েছে। কিছু কিছু কাজে সংস্থাটি অগ্রগতিও দেখিয়েছে। শিগগিরই ফিল্টার প্রযুক্তি বসিয়ে দেশের পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা সংস্থাটি মনিটর করবে বলে জানা গেছে।
ফিডব্যাক : hitlarhalim@yahoo.com