• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > চবিবশ বছরে কমপিউটার জগৎ
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৪ - এপ্রিল
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
বর্ষপূর্তি সংখ্যা
তথ্যসূত্র:
বর্ষপূর্তি সংখ্যা
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
চবিবশ বছরে কমপিউটার জগৎ

বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রধান সাময়িকী মাসিক কমপিউটার জগৎ এবার ২৪ বছরে পা দিল। ২০১৬ সালের এপ্রিলে এর নিয়মিত প্রকাশনার ২৫ বছর পুরো হবে। দেশে কমপিউটার আসার ৫০ বছর পূর্তির এই সময়ে এমন খবরটি আমাদের সবার জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের সুখবর। অভিনন্দন মাসিক কমপিউটার জগৎ। কামনা করি, এটি এরপর সুবর্ণজয়ত্মী পালন করম্নক এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে যেনো সেটি দেখে যেতে পারি।

আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে বাংলাভাষায় কমপিউটার বিষয়ক একটি সাময়িকীর নিয়মিত প্রকাশনার ২৩ বছর পূর্তি নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। আমি নিজে এজন্য গর্ব অনুভব করি। এমন একটি সাময়িকীর ২৩ বছর তো দূরের কথা, এক বছরও পুরো হয়নি বাংলা ভাষাভাষি পশ্চিমবঙ্গে। ওই দেশে বাংলাভাষায় কমপিউটার বিষয়ক পত্রিকা বা বই গেছে বাংলাদেশ থেকেই।

প্রচ- প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে মাসিক কমপিউটার জগৎ যে মাইলফলক অর্জন করতে যাচ্ছে, তা বাংলা ভাষাভাষি ও বাংলাদেশী হিসেবে সবার জন্যই আনন্দের। বিশেষ করে দেশের মুদ্রণ ও প্রকাশনার চরম দুঃসময়ে এমন একটি অর্জন প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে।

তবে এমন একটি সময়ে বুকের মাঝে একটি শূন্যতা অনুভব করি। এই সময়ে যদি এই মাসিক কমপিউটার জগৎ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল কাদের বেঁচে থাকতেন, তবে সেই দুঃখবোধ থাকত না। একজন পরম বন্ধুর সাফল্য যদি শুধু তার সাথেই শেয়ার করা যায়, তবে তারচেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না। এই ২৩ বছর পূর্তি উৎসবটি যদি আমরা তাকে নিয়ে একসাথে উদযাপন করতে পারতাম, তবেই শুধু নিজের মাঝে স্বস্তি পেতাম। অধ্যাপক কাদেরের পরিবার, মাসিক কমপিউটার জগৎ ও সেই পত্রিকার সাথে যুক্ত সবার জন্যই তার এই অভাবটা অপূরণীয়। আমার নিজের জন্য তার সঙ্গ না পাওয়াটা হয়তো ব্যক্তিগতভাবে আরও বেশি বেদনার। আমার নিজের যেমন খুব বেশি বন্ধু নেই, তেমনি অনেক বেশিসংখ্যক ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক আবদুল কাদেরেরও ছিল না। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব যত্নের সাথে, সততার সাথে পালন করতে গিয়ে সহকর্মীদের মাঝে তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ স্থান পাননি। তিনি একজন জাত আমলাও হতে পারেননি। ফলে আমরা যারা তার চাকরি জীবনের বাইরের জগতের সহকর্মী ছিলাম, তাদের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল অকৃত্রিম।

শৈশব থেকে বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার যে স্বপ্নটা তার ছিল, তৃণমূলে বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার যে অদম্য বাসনা তার ছিল, সেটি তুলনাহীন। মাসিক কমপিউটার জগৎ সেজন্য শুধু একটি সাময়িকী হিসেবেই গড়ে ওঠেনি। যদিও এখন পত্রিকাটি দেশের শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি সাময়িকী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, কিন্তু শুরুতে এটি জন্ম নিয়েছিল একটি আন্দোলন হিসেবে। সেই দুই যুগ আগে অধ্যাপক কাদের আমাদেরকে সাথে নিয়ে বিজ্ঞানের এই অত্যাশ্চর্য প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছানোর সংগ্রাম শুরম্ন করেছিলেন।

আমার সাথে মরহুম কাদেরের বন্ধুত্বের প্রধান কারণ, আমাদের উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল একই। আমি মাতৃভাষার প্রসার চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম বিজ্ঞান বা কমপিউটার বিজ্ঞান যেনো মাতৃভাষায় চর্চা হয় এবং সাধারণ মানুষ যেনো এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। অধ্যাপক কাদেরও তাই চাইতেন। ফলে আমরা একই কাজে লেগে যাই। আমি সেই সময়টির কথা বলতে পারি যখন হাতে হাত ধরে দেশের তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, জনগণের জন্য সহজলভ্য করা, শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত কমপিউটারের আন্দোলন গড়ে তোলা, কমপিউটার শিক্ষার প্রসার ঘটানো ও কমপিউটারকে শিক্ষার বাহন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য লড়াই করছিলাম, তখন নানা প্রতিকূলতার মাঝেও সামান্যতম দুর্বলতা প্রবেশ করতে পারেনি। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে, প্লাটফরম হিসেবে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি এবং মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন মানুষকে নিয়ে আমরা সাহসের সাথে পথ চলেছি। সেই সময়ে কমপিউটার বিষয়ে বাংলাভাষায় খবর রচনা, সম্পাদনা করা ও তা পরিবেশন করার মতো মানুষও ছিল না। মরহুম কাদেরকে প্রথম দিকে পত্রিকার বড় অংশ রোমান হরফ দিয়ে প্রকাশ করতে হতো। এরপর তিনি গড়ে তুলেন বাংলাভাষায় তথ্যপ্রযুক্তির সাংবাদিক গোষ্ঠী। তৈরি হয় একদল তরুণ লেখক। আজকের বাংলাদেশে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার আইটি পাতা বের করার জন্য যে সাংবাদিকের অভাব হয় না তার প্রথম কৃতিত্ব অধ্যাপক কাদেরের। তিনি মাসিক কমপিউটার জগৎ-এ বাংলাভাষায় কমপিউটার চর্চার কাজটি না করলে এটি আজকের মতো এত সহজ হতো না।

তবে যেমনটি অন্যান্য ক্ষেত্রে হয় অধ্যাপক কাদেরের অকাল মৃত্যুতে তেমনটি আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির জগতেও হয়েছে। তিনি যেমন অনেক কাজই শেষ করে যেতে পারেননি, তেমনি আমরা তার প্লাটফরমটির মধ্য দিয়ে, তার ব্যক্তিত্বকে সামনে রেখে আরও অনেকটা পথ চলতে পারিনি। এটি এমন নয় যে তার মৃত্যুর পর কমপিউটার জগৎ আমাদের প্রতিবাদের ক্ষেত্র বা মুখপত্র থাকেনি; কিন্তু ব্যক্তি আবদুল কাদেরের অভাব তো কারও পক্ষেই পূরণ করা সহজ বা সম্ভব নয়।

অধ্যাপক কাদেরের অকাল মৃত্যু নিঃসন্দেহে আমাদের সেই লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, তিনি যদি আজও আমাদের সাথে থাকতেন, তবে আমরা কোনো না কোনো খাতে আরও একটু সামনে এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটি হয়নি। তবে এজন্য যে আমরা থেমে আছি, তা তো নয়। বরং আমাদের যে শঙ্কা ছিল তা অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের ভয় ছিল অধ্যাপক আবদুল কাদেরের অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাসিক কমপিউটার জগৎকেও আমরা হারাব। বাস্তবতা হচ্ছে, তার মতো একটি বটবৃক্ষের ছায়ায় ছোট কারও গড়ে ওঠাই কঠিন ছিল। আমি পারিবারিকভাবে তার সাথে যুক্ত ছিলাম বলে জানি মিসেস নাজমা কাদের বা আমাদের ভাবি তার স্বামীর জীবদ্দশায় তেমনভাবে পত্রিকাটির সাথে যুক্ত থাকেননি, যা তিনি থাকতে পারতেন। তার সাথে আমরা বরং পারিবারিক সম্পর্ক নিয়েই অনেক বেশি যুক্ত থেকেছি। আমি স্মরণ করতে পারি, একবার আমরা সপরিবারে কুয়াকাটা গিয়েছিলাম। ভাবি এবং তার সমত্মানেরা ছাড়াও আমাদের ছেলে বিজয় ছিল সাথে। পুরো সফরকালে আমরা বোধহয় কমপিউটার বা প্রযুক্তি নিয়ে একটি কথাও বলিনি। বরং ছেলেদের নিয়ে মজার সময় কাটিয়েছি। কাদের ভাই না থাকার সময়ে সেই ভাবি এখন তার স্বামীর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করছেন। পত্রিকাটিকে মরণের হাত থেকে রক্ষা করে কাদের ভাইয়ের মতো করেই সামনে নিয়ে যাচ্ছেন। কাদের ভাইয়ের শিশু সন্তানেরাও এখন তার পাশে। আমার কাছে অবাক লাগে, সেদিনের ছোট্ট শিশু তমাল এখন তথ্যপ্রযুক্তির জগতে অতি দাপটের সাথে বিচরণ করছে।

বাংলাদেশে ’৬৪ সালে কমপিউটার আসার পর থেকে গত ৫০ বছরে এদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশের বিষয়ে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। থাকার কথাও নয়। আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে যে গতিতে এর সম্প্রসারণ হয়ে থাকে, আমরা তারচেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই। শুরুতে অতি ধীরগতিতে পথচলা ও সীমিত সংখ্যক মানুষের মাঝে তথ্যপ্রযুক্তিচর্চাকে সীমিত রাখা হলেও আশির দশকের মাঝামাঝিতে দেশে একটি নতুন স্পন্দন জাগে। ’৮৪ সালে অ্যাপল মেকিন্টোসের জন্ম, ’৮৫ সালে ডেস্কটপ প্রকাশনার বিপ্লবের সূচনা এবং ’৮৭ সালে বাংলাদেশে কমপিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের ঘটনায় কমপিউটার লোহার সিন্দুক থেকে বের হয়ে মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তেরে ভেসে বেড়াতে শুরু করে। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে আমাদের সচেতনতার সত্মর অনেকটাই বেড়েছে। অবকাঠামোগত সুবিধাগুলোর সম্প্রসারণও হয়েছে যথেষ্ট দ্রুতগতিতে। আমরা বরং তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ব বিপ্লবের অংশ হয়ে গেছি। কোথাও কোথাও আমরা সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছি। স্মরণীয়, মাসিক কমপিউটার জগৎ সেই বিপ্লবের ধারাবারিক ইতিহাসটি বাংলাভাষায় বিশ্ববাসীর কাছে অব্যাহত ও বিরামহীনভাবে তুলে ধরেছে। এর পক্ষ-বিপক্ষ, ভালো-মন্দ, জানা-অজানা সবই ঠাঁই পেয়েছে এই প্রকাশনায়।

শুধু কাদের ভাই বা নাজমা ভাবির সাথে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কের কারণে নয়, তমালদের চাচা হিসেবেও নয়, মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর একজন নিয়মিত পাঠক ও লেখক হিসেবেও আমি একথা বলতে পারি, আমার ভাবনাগুলোর অনেক কিছুই এই পত্রিকাটিতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। অনেক বিতর্কের সূচনা করেছি আমি এখানে। অনেক অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি এখানে। আমি আমার জীবনের অনেক সৃষ্টির প্রথম তথ্য প্রকাশ করেছি কমপিউটার জগতেই।

২৩ বছর পূরণ করতে যাওয়ার সময়ে যে বিষয়টির প্রতি আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তা হলো অতীতের চেয়ে আরও সক্ষমতার সাথে, দক্ষতার সাথে, নিরপেক্ষতার সাথে মাসিক কমপিউটার জগৎকে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবকে রচনা করতে হবে। দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে সহজবোধ্য মাতৃভাষায় তুলে ধরে আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি তার বাস্তবায়ন করতে হবে।

মনে হয়, এখনও কমপিউটার জগৎ-এর আরও অনেক কিছু করার আছে। কমপিউটার জগৎ কাদের ভাইয়ের মূল নীতিকে অনুসরণ করে তার পথাচলাকে আরও মসৃণ করতে পারে। তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এজন্য তাদেরকে নীতি আর আদর্শ বাছাই করতে হবে না। এমনকি তাদের শত্রু-মিত্রও বাছাই করতে হবে না। কাদের ভাই পত্রিকা প্রকাশ করার সময়ই এসব বিষয় নির্ধারণ করে নিশ্চিত করেছেন।

আমি এই প্রত্যাশা করি, বদলে যাওয়া সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কমপিউটার জগৎ-এর সক্ষমতা আরও বাড়বে। সময় ও ক্ষেত্র বদলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন প্রেক্ষিতের সাথে খাপ খাইয়ে সাময়িকীটিকে সামনে চলতে হবে।

আমরা একদিকে ২০০৭ সাল থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ করছি, অন্যদিক থেকে আমরাই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য কাজ করছি। মাসিক কমপিউটার জগৎ জন্ম থেকেই আমাদের এই আন্দোলনের মুখপত্র। আমি অবশ্যই এই প্রত্যাশা করি, সেই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। তখনই আমরা মনে করতে পারব, কাদের ভাই আমাদের সাথেই আছেন।

ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস