লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
উন্নয়ন থেকে প্রগতির পথে...
উন্নয়ন ও প্রগতি- দুটি বিষয়কে সমগোত্রীয় মনে হলেও অর্জনের ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্নতা। উন্নয়ন গতিশীল ও ধীরগতির দুই-ই হতে পারে, কিন্তু প্রগতি অবশ্যই গতিশীল। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উন্নয়ন একটি বিষয়ে বা সীমিত পরিসরে হতে পারে, কিন্তু প্রগতি হতে হবে সার্বিক বা সামগ্রিক। আর এই সামগ্রিকতা গত শতাব্দীর মূল্যবোধ থেকে একেবারেই ভিন্নতর। চাহিদা পূরণ আর উদ্বৃত্তের ওপরই উন্নয়ন মানদ- নির্ভরশীল নয়। পরিভোগ এবং দৃশ্যমানতাই উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয় না। প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নকে টেকসই করে প্রগতির পথে চলাই হচ্ছে এই শতাব্দীতে সব জাতির নির্বাচিত লক্ষ্য। প্রথাগত সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, এমনকি রাষ্ট্রবিজ্ঞান পর্যন্ত নতুন উপজীব্য পাচ্ছে- বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে বিশ্ব ইতিহাসের গতিধারা। আর এই পরিবর্তিত ও বৈচিত্র্যময় অবস্থাটার জন্য দিয়েছে আইসিটি।
এই সিকি শতাব্দীর সময়টায় সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন ছিল, সেটা হচ্ছে ই-গভর্ন্যান্স। এ ক্ষেত্রে একেবারে উন্নয়ন হয়নি তা নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর অনলাইনে ফল প্রকাশের ব্যবস্থা কিংবা সমুদবন্দরে অটোমেশন চালু। এগুলো নিঃসন্দেহে উন্নয়ন, কিন্তু ওই ধরনের উন্নয়নের সমমাত্রিক উন্নয়ন অন্যান্য ক্ষেত্রে হয়নি। ভূমি মন্ত্রণালয়ে উন্নয়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা নেই, অথচ এই মন্ত্রণালয়টিকে পুরোপুরি আইসিটিনির্ভর করার প্রচেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে। এ ধরনের ঔচিত্যের কথা আরও অনেক মন্ত্রণালয় সম্পর্কেই বলা যায়, অর্থাৎ সম্ভাবনা ছিল, কিছু কাজও এগিয়েছিল, কিন্তু পরে থেমে গেছে।
নৈতিকভাবে সরকারের অবস্থান আইসিটিবান্ধব এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজধানী থেকে দূরবর্তী অঞ্চলগুলোর প্রশাসনিক ও উন্নয়ন নেটওয়ার্ক সাবলীল হয়ে ওঠেনি। এসবের কারণ নিয়ে বহু বছর ধরে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বস্ত্ততপক্ষে কারণ অনুসন্ধান ও সমালোচনার চেয়ে এখন আইসিটিবান্ধব প্রশাসন ও উন্নয়ন ধারার গুরুত্বকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত।
সমস্যাগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে, সেগুলোও অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। রাষ্ট্রের গুরুত্বসম্পন্ন অন্যতম দুটি মন্ত্রণালয় হচ্ছে স্বরাষ্ট্র এবং স্থানীয় সরকার ও পলস্নী উন্নয়ন। শান্তি-শৃঙ্খলা এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ প্রশাসন নিয়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করে। এ ক্ষেত্রে একটি পর্যবেক্ষণ বলছে- রাজধানী থেকে দূরবর্তী কিন্তু ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি আছে এমন থানা বা জেলা পুলিশ প্রশাসন নিকটবর্তী থানা বা প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলোর চেয়ে বেশি আইসিটিবান্ধব। এছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে আইসিটিভিত্তিক পরিচালন পদ্ধতি বাধ্যতামূলক না হওয়া এর একটি কারণ হতে পারে। অন্যদিকে প্রয়োজন হিসেবে আইসিটিকে না দেখাও এর কারণ হতে পারে। বেতন-পদায়ন এই বিষয়গুলোই এখন পর্যন্ত প্রধানত আইসিটিনির্ভর হয়েছে, কিন্তু গোপনীয়তা ছাড়া যে বিষয়গুলো অনলাইনে চলতে পারে, বিশেষত তথ্য যাচাই-বাছাই, সেগুলো এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।
প্রকৃতপক্ষে পুলিশ প্রশাসনই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বিস্তৃত ও বিকেন্দ্রীকৃত অংশ, যার ওপর সরকারের পারফরম্যান্স অনেকাংশে নির্ভরশীল। এ কারণে এলাকাভিত্তিক ও কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি এবং তার যথোপযুক্ত ব্যবহার করে জনজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনা সম্ভব। শুধু অপরাধ দমনই যে পুলিশের কাজ নয়, তা সবাই স্বীকার করবেন, সে কারণেই পুলিশের প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলোতে এলাকা সম্পর্কিত যথেষ্ট তথ্য থাকা এবং সেই তথ্যকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, বাংলাদেশ জনবহুল দেশ হওয়ায়ে অল্প জায়গায় বেশি লোক বসবাস করে। আর যত মানুষ তত বিচিত্র ধরনের কার্যক্রম, সেই সাথে নিরাপত্তাজনিত প্রয়োজনও বেশি। এই বিষয়গুলোর সহজ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব শুধু তথ্য হালনাগাদ রাখা ও তা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিভিল প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক রয়েছে স্থানীয় সরকার ও পলস্নী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। দেশের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নিয়ে পৌরসভা- সবই এ মন্ত্রণালয়ের পরিচালনাধীন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আইসিটির মাধ্যমে এই সর্ববৃহৎ সিভিল প্রশাসনিক নেটওয়ার্কটি আইসিটিনির্ভর হয়ে ওঠেনি। আইসিটি ব্যবহার কিছু কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে, কিন্তু তা সীমিত পরিসরে। ইউনিয়নে পর্যায়ে ইদানিং এটুআই কার্যক্রমের ইউনিয়ন আইসিটি কেন্দ্র গড়ে উঠতে দেখছি, যেটি সেবামূলক। কিন্তু শক্তভিত্তিক প্রশাসন ও জনসেবামূলক কার্যক্রমের জন্য প্রতিটি অঞ্চলের স্থানীয় বিষয় সংবলিত তথ্যের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি।
কারণ ছায়া-সুনিবিড় শক্তির নীতিগুলোর মধ্যেও এমন অনেক ভয়াবহ তথ্য লুকিয়ে আছে, যা জানা প্রয়োজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। দারিদ্র্য, রোগবালাই, কৃষির সমস্যা, সামাজিক সমস্যা সব তথ্যকেই গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় দেশের সব ইউনিয়নকে তথ্য নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়তো স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়, কিন্তু উদ্যোগ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। উদ্যোগ নিতে হবে দেশের ৩২১টি পৌরসভাকে যথোপযুক্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আওতায় আনার। কারণ, পৌরসভাগুলো ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ে বেশি সচ্ছল এবং পৌরসভাগুলোর অধীনে জনগুরুত্বসম্পন্ন অনেক কাজই সম্পন্ন হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বেশিরভাগ পৌরসভাতেই ন্যূনতম পৌরমানসম্পন্ন কার্যক্রম চলে না। অথচ স্বাস্থ্যসেবা বিশেষত টিকাদান, স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, বাজারহাটের রক্ষণাবেক্ষণ, এলাকার জনগণের নানা ধরনের সুবিধা দেয়ার কথা এই পৌরসভাগুলোর। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে- জনগুরুত্বসম্পন্ন অনেক তথ্যই এসব পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে নেই বা থাকে না। আর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও কেন্দ্রীয়ভাবে অনেক বিষয় সময়মতো জানতে পারে না। বরাদ্দ-অর্থ ব্যয় ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে প্রায় প্রতিটি পৌরসভায়। কারণ হিসেবে দেখা যায়, সম্যক তথ্য না থাকা, প্রয়োজনের সময় তথ্য না নেয়া, দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি বহু কারণে পৌরসভাগুলোয় অব্যবস্থাপনা চলছে, অথচ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার একটি নেটওয়ার্ক পৌরসভাগুলোকে নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। বর্তমান পৌরসভাগুলোতে যে কর্মী বাহিনী আছে, তাদের সামান্য কিন্তু উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে পারলে একই ডাটাবেজ তৈরি এবং তা ব্যবহারে অবদান রাখতে পারবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, প্রতিবছর পৌর এবং ইউনিয়ন পর্যায়েও কিছু কিছু উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু সে উন্নয়নটা টেকসই হচ্ছে না অথবা অচিরেই জনসংখ্যার চাপ ও দারিদ্র্য সামান্য অর্জনটাকে নিষ্ফল করে দিচ্ছে। সম্ভবত এ কারণে উন্নয়ন করতে প্রগতির পথে আমরা যেতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে ভাসা ভাসা ধারণা বা অনুমান নির্ভরতার কোনো সুযোগ নেই। পরিকল্পনা প্রণয়ন, লক্ষ্য স্থির এবং বাস্তবায়ন হচ্ছে উৎকৃষ্ট পন্থা। লক্ষণীয়, সব ক্ষেত্রেই প্রকৃত তথ্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই তথ্যগুলো পাওয়া যায় তৃণণমূল পর্যায়ের কর্মীদের কাছ থেকেই। ই-গভর্ন্যান্স শব্দটিকে অনেক আধুনিক এবং গালভরা মনে হলেও এটি হচ্ছে আসলে অযুত তথ্যের সমাহার ঘটানো শ্রেণীবিন্যাস করা ও কাজের ধরনে পরিবর্তন আনার ব্যাপার। অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরে নতুন প্রজন্মের কর্মীরা মুখিয়ে আছে তথ্যভিত্তিক কর্মকা-- শামিল হতে। তাদের হাতে যেসব তথ্য আসছে, সেগুলোকে উপযুক্ত স্থানে শ্রেণীবদ্ধ করতেও তারা ইচ্ছুক এবং দ্রুত কাজ করার মানসিকতাও ইতোমধ্যে তারা অর্জন করেছে। তাদের শুধু নেই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পেপারলেস অফিস গঠনের ধারণা। ওই কাজটাই এখন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে করতে হবে। সরকারের অগ্রবর্তী মন্ত্রণালয় যেগুলো তৃণমূল পর্যায়ে বেশি সংশ্লিষ্ট, সেগুলো যদি ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এগোয়, তাহলে একটা উন্নয়নও ঘটে যেতে পারে- ত্বরান্বিত হতে পারে উন্নয়নের গতি। প্রকৃত প্রগতির পথে যাত্রা শুরু করতে বাংলাদেশের সময় লাগবে না
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com