লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
কমপিউটার জগৎ-এর ২৫ বছর ও কিছু কথা
কে এম আলী রেজা, ডেপুটি চিফ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
সঠিক তারিখ মনে নেই। এতটুকু মনে আছে, ঘটনাটি ১৯৯৫ সালের জুন বা জুলাই মাসের দিকের। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে মোস্তাফা জববারের প্রতিষ্ঠান আনন্দ কমপিউটার্সে সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছি। অফিস থেকে একদিন আমাকে বলা হলো আজিমপুরে কমপিউটার লাইনের ল্যান সিস্টেম ও একটি লেজার প্রিন্টারের সমস্যা ঠিক করতে হবে। আমার জানা ছিল না ওই অফিস থেকেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কমপিউটারবিষয়ক ম্যাগাজিন মাসিক ‘কমপিউটার জগৎ’ প্রকাশিত হয়। ম্যাগাজিনটির নিয়মিত পাঠক হিসেবে ওই অফিসে আসার সুযোগ পেয়ে আমি বেশ পুলকিত হলাম। নির্দ্বিধায় বলতে হয় ২৫ বছর বয়সী কমপিউটার জগৎ-এর সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় ২০ বছর, যার সূচনা হয়েছে আনন্দ কমপিউটার্সে কাজ করার সুবাদে।
শ্রদ্ধেয় প্রফেসর মরহুম আবদুল কাদেরের প্রতিষ্ঠিত ম্যাগাজিনটি নানা কারণে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ইতিহাসে নিজস্ব একটি স্থান তৈরি করে নিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, নীতিমালা নির্ধারণ, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের উন্নয়ন সম্পর্কে আপডেটেড ধারণা দেয়া, প্রোগ্রামিং, ডাটাবেজ, নেটওয়ার্কিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, গেমিং, হার্ডওয়্যার মেইনটেন্যান্স ইত্যাদি বিষয়ে দেশের স্বনামধন্য আইটি বিশেষজ্ঞদের লেখা ও মতামত ম্যাগাজিনটিকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, গত ২৫ বছরে ম্যাগাজিনটি দেশের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। তাই এ পত্রিকাটি দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে পথিকৃৎ হিসেবে দেশের প্রযুক্তিপ্রেমীদের কাছে স্বীকৃত।
কমপিউটার লাইনের অফিসে প্রবেশ করে প্রথমেই পরিচয় হলো মইন উদ্দীন মাহ্মুদের সাথে। যিনি এখনও আমার মতো আরও অনেকের কাছে ‘স্বপন ভাই’ হিসেবেই শুধু পরিচিত। তিনি সংক্ষেপে তার নেটওয়ার্ক সিস্টেম ও লেজার প্রিন্টারের সমস্যার কথা আমাকে জানালেন। ওই সময় আমার চাকরির অভিজ্ঞতা খুব দীর্ঘ না হলেও সমস্যাগুলো বের করা এবং তার সমাধানে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হলো না। আমার কাজে মনে হলো স্বপন ভাই বেশ খুশি হয়েছিলেন। কাজ শেষে চা খাওয়ার ফাঁকে আমি কমপিউটার জগৎ-এর যে একজন নিয়মিত পাঠক ও ভক্ত সে বিষয়টি প্রকাশ করলাম। আলোচনার এক পর্যায়ে আমি অভিমত ব্যক্ত করলাম- হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্কের ছোট ছোট সমস্যাগুলো কমপিউটার জগৎ-এ ছাপা হলে এর থেকে অনেকেই উপকৃত হতে পারবেন। ছোটখাটো সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারবেন। কাউকে ডাকার প্রয়োজন হবে না। স্বপন ভাই আমার এ অভিমত বেশ ভালোমতোই বিবেচনায় নেন।
আমি কমপিউটার লাইন তথা কমপিউটার জগৎ-এর অফিস থেকে বের হয়ে চায়না বিল্ডিংয়ের গলিতে চলে এসেছি, এমন সময় দেখলাম পেছন থেকে স্বপন ভাই ডাকছেন। তিনি আমার সাথে হাঁটতে থাকলেন, মনে হলো কিছু একটা বলবেন। আমার ধারণা ছিল হয়তো তার নেটওয়ার্ক নিয়ে কিছু বলবেন। গলির শেষ মাথায় এসে তিনি আমাকে বললেন, সম্ভব হলে হার্ডওয়্যার ট্রাবলশুটিং নিয়ে নিয়মিতভাবে লেখা দিতে। স্বপন ভাইয়ের কথা শুনে আমি একেবারে হতবাক। জীবনে যে ভুলেও দুটো লাইন লেখেনি তাকে দিয়ে হবে ট্রাবলশুটিং লেখা! মনে হলো তিনি আমার সাথে মজা করছেন।
ঘটনাটি এ কারণে অবতারণা করছি যে, স্বপন ভাইয়ের সাথে আমার ওইদিনের পরিচয় এবং হার্ডওয়্যার ট্রাবলশুটিং নিয়ে লেখা দেয়ার অনুরোধ আমাকে কমপিউটার বিষয়ে লেখালেখির ভুবনে প্রবেশের একটি সুযোগ করে দিয়েছিল, যার চর্চা গত দুই দশক পর্যন্ত ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।
আমি তখন পশ্চিম ধানম--তে থাকি। আমার মেস টাইপের বাসায় ওই সময় কোনো কমপিউটার ছিল না। তাছাড়া আমি বাংলায় টাইপও জানতাম না। তাই বাসায় যাওয়ার আগে লেখালেখির সুবিধার্থে নিউজপ্রিন্ট কাগজের রাইটিং প্যাড আর বলপেন কিনে নিলাম। কমপিউটার জগৎ-এ আমার লেখা ছাপা হবে এ নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনাও আমার মধ্যে কাজ করছিল। বাসায় এসে দেরি না করে রাইটিং প্যাড আর কলম নিয়ে বসে গেলাম। কিন্তু ঠিকমতো লেখা আসছিল না। দুই-চারটি লাইন লিখি, কিন্তু পড়ে দেখি বাক্য ঠিকমতো হয়নি। প্যাডের কাগজ ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন করে শুরু করি। এভাবে মধ্যরাত পর্যন্ত আমার প্রচেষ্টা চলল, তবে ফলাফল অমত্মঃসারশূন্য। তবে আমি দমবার পাত্র ছিলাম না। তাছাড়া স্বপন ভাইকে কথা দিয়েছি লেখা দেব বলে। ওয়াদা করে তার বরখেলাপ আমার পছন্দ নয়।
যাই হোক, অফিস ছুটি থাকায় পরদিন আবার নতুন উদ্যমে শুরু করলাম। দীর্ঘ তিন দিন প্রচেষ্টার পর লেখাটি তৈরি করে স্বপন ভাইয়ের হাতে জমা করলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। লেখাটি পরের মাসের সংখ্যায় প্রকাশ হলো। আমার আনন্দ দেখে কে! ছাপার হরফে নিজের নাম কমপিউটার জগৎ-এ দেখতে পাওয়া এবং সেই সাথে লেখক সম্মানী পাওয়া ওই সময়ে আমার কাছে অনেক বিরাট কিছু ছিল।
দীর্ঘ দুই দশক সময়কালে কমপিউটার জগৎ-এর সাথে আমার সম্পর্ক কখনও ছিন্ন হয়নি। চাকরির সুবাদে পাঁচ বছরে কুয়েতে এবং উচ্চশিক্ষার জন্য দুই বছর অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করা সত্ত্বেও কমপিউটার জগৎ-এ আমার লেখালেখি বন্ধ হয়নি। এজন্য ধন্যবাদ দিতে হয় ইন্টারনেট প্রযুক্তি এবং আমার বাংলা টাইপ করার কিয়দ দক্ষতাকে। রাইটিং প্যাড আর বলপেনের জায়গা নিয়েছে এখন কীপ্যাড আর কমপিউটার স্ক্রিন। সময়ের বিবর্তনে হয়তো এ প্রযুক্তিতে আরও নতুন নতুন মাত্রা যোগ হবে।
কমপিউটার জগৎ অফিসে আসা-যাওয়ার সুবাদেই কাদের স্যারের সাথে পরিচয় হয়। তার সাথে আমার অন্তত দু’তিনবার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে বিশদ আলাপ হয়। যতটুকু তাকে দেখেছি, মনে হয়েছে তিনি স্বপ্ন দেখতেন কমপিউটার প্রযুক্তি আর শিক্ষার সুযোগ যেন দেশের সর্বত্র পৌঁছে যায় এবং সফটওয়্যার পণ্য ও সেবা রফতানির পাশাপাশি আমাদের কমপিউটার প্রশিক্ষেত জনশক্তির বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরি হয়। তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়তো অনেকখানি হয়েছে, তবে আমাদেরকে আরও অনেকদূর যেতে হবে সম্মিলিত সবার প্রচেষ্টায়।
কমপিউটার জগৎ-এর কাছে আমি আরেকটি বিষয়ে কৃতজ্ঞ, যা উল্লেখ না করলেই নয়। ম্যাগাজিনটিতে লেখালেখির সূত্রেই আমার পরিচয় সিসটেক পাবলিকেশনের কর্ণধার মাহবুবুর রহমানের সাথে। নেটওয়ার্ক বিষয়ে আমার কয়েকটি লেখা তার নজরে পড়ে। লেখাগুলোকে স্থায়িত্ব দেয়ার জন্য বই আকারে ছাপার জন্য তিনি এগিয়ে আসেন। তারই সূত্র ধরে কমপিউটার নেটওয়ার্কসহ আরও কয়েকটি কমপিউটারবিষয়ক বই সিসটেক থেকে প্রকাশিত হয়।
সময়ের পরিক্রমায় কমপিউটার জগৎ-এর আঙ্গিক ও মান অনেক উন্নত হয়েছে। এজন্য যারা নিরলসভাবে কাজ করছেন, তারা সবাই কৃতিত্বের দাবিদার। বিশেষ করে মিসেস নাজমা কাদেরের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কাদের স্যার মারা যাওয়ার পর কমপিউটার জগৎ-এর মান ও একই সাথে এর অগ্রযাত্রা সমুন্নত রাখতে তিনি পর্দার আড়ালে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। নাজমা আপার সাথে যখনই দেখা হয়, তিনি সর্বাগ্রে যে কথাটি বলেন তা হলো সময়মতো লেখা জমা দেয়া। আমি সব সময়ই আপার এ অনুরোধের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে স্বপন ভাই নির্ধারিত ডেডলাইনের মধ্যেই লেখা জমা করার চেষ্টা করি।
কমপিউটার জগৎ ওয়েবসাইট থেকে ম্যাগাজিনটি পড়া ও ডাউনলোড করা যায়। এছাড়া পুুরনো সংখ্যাগুলো অ্যাক্সেস করার সুবিধা ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। অন্যদের মতো আমারও প্রত্যাশা- কমপিউটার জগৎ যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২৫ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল, তা যেন যুগের পর যুগ অব্যাহত থাকবে