লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
প্রযুক্তি ভাবনা
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি ধারা
আমদানিকারক থেকে উৎপাদনকারী: আমরা কমপিউটার বানাব এবং রফতানিও করব
‘আমরা দেশে কমপিউটার বানাব এবং সেই কমপিউটার বিদেশে রফতানি করব’- স্বপ্ন, ইচ্ছা, নির্দেশনা বা আদেশ যাই বলি না কেনো- এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এই স্বপ্নটা তিনি ২০১১ সালেও দেখেছিলেন, যখন তিনি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য দোয়েল ল্যাপটপের উদ্বোধন করেন। কমপিউটার বানানোর স্বপ্নের কথা কেনো বলব, তথ্যপ্রযুক্তির সব খাতে সমৃদ্ধি বা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন কিংবা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর যেসব দুঃসাহসী কাজ তিনি করে চলেছেন, তাতে তার দেখানো পথেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রচিত হবে- এটি বলতে আমার নিজের কোনো দ্বিধা নেই।
২০১৫ সালের ৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত পুনর্গঠন করা ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় তিনি কমপিউটার বানানোর ও রফতানির কথা বলেন। যেহেতু আমি সেই সভাতে উপস্থিত ছিলাম, সেহেতু এর প্রেক্ষেতটির বিবরণও আমি দিতে পারি। সেদিন অনেক সময় ধরে তথ্যপ্রযুক্তির সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হচ্ছিল। চমৎকার এজেন্ডা ছিল সভার। এজেন্ডার বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তও দিচ্ছিলেন। সভা প্রায় শেষ স্তরে ছিল। আমি তার অনুমতি নিয়ে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার সুযোগ পাই। আমি তাকে জানাই, আমরা শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলছি। প্রধানমন্ত্রী আপনি নিজে প্রত্যাশা করেন, আমাদের সব ছাত্রছাত্রী ল্যাপটপ হাতে নিয়ে স্কুলে যাবে। আপনি যদি সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে চান, তবে এখনকার পরিস্থিতিতে আপনাকে কমপক্ষে ৪ কোটি ডিজিটাল ডিভাইস আমদানি করতে হবে। একটু ভেবে দেখুন, এর ফলে আমরা কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এই খাতে ব্যয় করব। আমাদের উচিত আমদানিকারক থেকে উৎপাদক হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমার প্রস্তাবনার প্রেক্ষেতে প্রধানমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করার আগেই অনেকেই বললেন, বাইরে থেকে আমদানি করলে কমপিউটারের দাম কমবে। আমরা দোয়েল করে ব্যর্থ হয়েছি সেটিও অনেকে বললেন। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে উজ্জীবিত করে তখন বলেন, আমরা কমপিউটার বানাব এবং রফতানিও করব। তিনি টেশিসের দায়িত্ব আমার হাতে দেয়ার নির্দেশও দিলেন। ঘটনাচক্রে বিষয়টি সেই সভার মিনিটসে আসেনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নটি আমার মতো আরও অনেকের কাছে একটি প্রয়োজনীয় ও বাস্তবিক উদ্যোগ বলে মনে হয়।
বাংলাদেশে কমপিউটারের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। আইবিএম ১৬২০ কমপিউটারটি আমদানি করে সেটি নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের মো: হানিফউদ্দিন মিয়ার হাতে দিয়ে আমরা কমপিউটার প্রযুক্তির যুগে পা দিই। সেই থেকে ২০১৬ অবধি আমাদের কমপিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইস চর্চা আমদানিনির্ভরই রয়ে গেছে।
আশির দশক থেকে এখন অবধি বাংলাদেশী ব্র্যান্ডের কিছু কমপিউটারের খবর আমরা জানি। কয়েকটির কথা আমি স্মরণ করতে পারি। বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সাবেক মহাসচিব মুনিম হোসেন রানার অ্যাক্সেস পিসি, বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি সবুর খানের ড্যাফোডিল পিসি, বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সদ্য সাবেক সভাপতি এএইচএম মাহফুজুল আরিফের সিএসএম, আনন্দ কমপিউটার্সের আনন্দ পিসিসহ অনেকেই নানা নামে ক্লোন পিসি বাজারজাত করেছেন। ডেস্কটপ পিসির বাজারটা প্রধানত ক্লোন পিসির দখলে। যদিও আমাদের নিজস্ব একটি ব্র্যান্ড গড়ে ওঠেনি, তথাপি ডেস্কটপ পিসির জগতে আমাদের নিজেদের হাতে সংযোজন করা পিসির দাপটই প্রধান। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গুণগত মানের নামে ব্র্যান্ড পিসি কিনে থাকে। এই হীনমন্যতার জন্য কোনো দেশীয় ব্র্যান্ড বিকশিত হতে পারেনি। তবে বেসরকারি খাতে ব্র্যান্ড ডেস্কটপ পিসি কেউ কিনেই না। ল্যাপটপ যখন জনপ্রিয় হতে থাকে, তখন ডেস্কটপ পিসির এই বাজারটি সঙ্কুচিত হতে থাকে। ল্যাপটপের কোনো ক্লোন দেশে তৈরি হয়নি। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে সরকারের টেলিফোন শিল্প সংস্থার দোয়েল ল্যাপটপ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দোয়েল তার প্রথম চালানে বদনাম কামাই করে। পণ্যের গুণগত মান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে। এর বাইরেও দোয়েলের ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন দেখা দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দোয়েল ল্যাপটপ কিনে অনেক ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ল্যাপটপের চেয়েও ভালোভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেই যে একবার বদনাম কামাই করা হলো, এর ফলে দোয়েল বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে কোনো আকর্ষণই তৈরি করতে পারেনি। বাজারজাতকরণে এই প্রতিষ্ঠানটির চরম দুর্বলতাও এজন্য চরমভাবে দায়ী। এই বিষয়টি আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারি।
যাই হোক, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বস্ত্তত একটি জাতীয় দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়কে অফিসিয়ালি কিছু সুপারিশ করেছে। এই বিভাগের সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার গত ৩০ মার্চ অর্থমন্ত্রীর সাথে সরকারের সচিবদের বৈঠকে যে ধরনের প্রস্তাবনা পেশ করেন সেটি হচ্ছে- ‘বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের এই সময়ে এখন প্রয়োজন দেশীয় পণ্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। ’৯৮-৯৯ সালের বাজেটে কমপিউটারের শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে কমপিউটারের ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু এখন সেই চাহিদা পূরণে হাজার হাজার কোটি টাকা আমদানি ব্যয় হচ্ছে। আগামীতে দেশের সরকারি অফিস-আদালত ও ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার জন্য ডিজিটাল ডিভাইস দিতে হলে লক্ষ-কোটি টাকায় আমদানি করতে হবে। এখন প্রয়োজন স্মার্টফোন, ট্যাব, কমপিউটারের দেশীয় উৎপাদনকে সহায়তা করা। আমদানিকারক থেকে উৎপাদকে পরিণত হওয়া। প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভায় সেই কথাই বলেছেন।
ক. এর জন্য সম্পূর্ণ উৎপাদিত কমপিউটার পণ্যের ওপর করারোপ ও ভ্যাট আদায় করা যায়। যন্ত্রাংশ বা কাঁচামালকে শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত করা যায়। এতে দেশের রাজস্ব বাড়বে এবং ডিজিটাল যন্ত্র দেশে উৎপাদিত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
খ. সফটওয়্যারের মতো হার্ডওয়্যার উৎপাদনকেও কর সুবিধা দেয়া যায়।
গ. সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশী ব্র্যান্ড কেনার বদলে দেশী ব্র্যান্ডের ডিজিটাল ডিভাইস কেনার বিধান করা যায়। এর মান পরীক্ষা করার দায়িত্ব আইসিটি ডিভিশন নিতে পারে।
আইসিটি সচিব দেশী সফটওয়্যারের বিষয়েও তার বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘দেশীয় সফটওয়্যার ও সেবা খাত বড় হতে পারছে না। কারণ, তারা দেশে কাজ করতে পারে না। বিদেশী সহায়তার বড় প্রকল্প করার ক্ষমতা তাদের নেই- টেন্ডারেও তারা অংশ নিতে পারে না। সরকারি কাজে দেশী প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
প্রসঙ্গত, তিনি এই কাজগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব আইসিটি বিভাগকে দেয়ারও অনুরোধ করেন।
সচিব অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সাথে কথা বলেন এবং সমিতির পক্ষ থেকে গত ৩১ মার্চ অর্থমন্ত্রী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক ও আইসিটি বিভাগের সচিব শ্যামসুন্দর সিকদারের কাছে একটি পত্র লেখা হয় এবং তাতে দেশীয় শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। সমিতির সাবেক সভাপতি এএইচএম মাহফুজুল আরিফ স্বাক্ষরিত এই পত্রে যেসব প্রস্তাবনা পেশ করা হয়, সেগুলো হচ্ছে-
০১. ডিজিটাল পণ্য তথা কমপিউটার/ল্যাপটপ/ট্যাব উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বেশ কয়েকটি মৌলিক যন্ত্রাংশ। এগুলো কোনো দেশ বা কোম্পানি এককভাবে উৎপাদন করে না। আমদানি করে অ্যাসেম্বলের মাধ্যমে নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে বাজারে অবমুক্ত করে। ফলে দেশের কমপিউটার হার্ডওয়্যার শিল্প গড়ে তুলতে গেলে এসব যন্ত্রাংশ আমদানি পর্যায়ে ধার্য করা শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু করা দরকার।
০২. ডিজিটাল পণ্য উৎপাদনের জন্য আধুনিক মানের প্লান্ট স্থাপন করতে হলে প্রয়োজন সুবিধাজনক জমি। তাই আমরা আশা করব, সব ইউটিলিটি সুবিধা দিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নির্মাণাধীন হাইটেক পার্কে এ জন্য উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দ দেয়া হবে।
০৩. বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি দেশী ব্র্যান্ডের আইটি পণ্যকে ভোক্তা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মূল্য সংবেদনশীলতাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়। তাই আইটি পণ্য ও সেবা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি বিক্রির আগেই উৎপাদিত পণ্যে অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট (এটিভি) দিতে হয়, তবে তা শুধু চ্যালেঞ্জেরই নয়, বিনিয়োজিত পুঁজি ঝুঁকির মুখে পড়ে।
০৪. স্থানীয় বাজারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার স্বার্থে ভোক্তা পর্যায়ে এসব পণ্যকে সহজলভ্য করে তুলতে হলে দেশে উৎপাদিত পণ্য খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রির ক্ষেত্রে সব ধরনের ট্যাক্স ও ভ্যাট মুক্ত রাখতে হবে।
০৫. দেশী উৎপাদক আইটি কোম্পানিগুলো যেনো চাপমুক্ত হয়ে পণ্য বাজারজাতকরণে প্রণোদনা চালাতে পারে এবং দ্রুত বাজার সম্প্রসারণ করতে পারে, সে জন্য তাদের অর্জিত আয়কে করমুক্ত রাখার দাবি জানাচ্ছি।
০৬. দেশে ব্যবসায়রত আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানে মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তত ১০ বছরের জন্য ট্যাক্স হলিডে সুবিধা চালু করা দরকার।
০৭. একইভাবে এই খাতকে পোশাক শিল্প খাতের মতো সমৃদ্ধ করতে হলে দেশে উৎপাদিত আইটি পণ্যে রফতানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটিভ চালু করতে হবে।
০৮. আমাদের দেশে শ্রমিক/কর্মীর প্রাচুর্য থাকলেও প্রযুক্তিদক্ষ মানবসম্পদ মোটেই সমৃদ্ধ নয়। ডিজিটাল শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান এই বাধা অতিক্রমের জন্য কারিগরি ও ব্র্যান্ডিং বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য একটি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা যেতে পারে।
০৯. সর্বোপরি দেশের বাজার পেরিয়ে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড আইটি পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ধরতে সিবিটের মতো আন্তর্জাতিক মেলাগুলোতে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করি।
এসব প্রস্তাবনায় মূলত উৎপাদিত পণ্যের যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্ক, উৎপাদিত পণ্যের ওপর এটিভি, খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রির ওপর শুল্ক এবং কর ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আয়কর খাতে শূন্য ব্যবস্থা প্রচলনের অনুরোধ করা হয়। এ ছাড়া ১০ বছরের কর রেয়াত, শতকরা ৫ ভাগ নগদ ইনসেনটিভ, বিশ্বমেলাগুলোয় শতভাগ সমর্থন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের দাবি করা হয়।
আমি মনে করি, ২০১৬-১৭ সালের বাজেট থেকেই বাংলাদেশ তার বিদ্যমান অবস্থান পরিবর্তনের পথে পা দিতে পারে। যদিও ২০১৬-১৭ সালের বাজেটে এমন স্বপ্নের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি, তবুও আমি আশাবাদী- বাজেট পাস করার আগে অর্থমন্ত্রী পুরো বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনা করতে পারেন। আমার আশাবাদের আরও একটি বড় কারণ- গত ১ জুন এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী নিজে আবারও আমদানিকারক থেকে উৎপাদকের দেশে পরিণত হওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com