২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাজেট নিয়ে আলোচনায় যাবার আগে জানা দরকার, এ বাজেট যখন ঘোষিত হলো তখন আমাদের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাত তথা আইসিটি খাতের প্রেক্ষাপটটি কেমন৷ যারা আমাদের আইসিটি খাতের সাথে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট, তারা নিশ্চিতভাবেই জানেন, আমরা ২০০২ সালে একটি জাতীয় আইসিটি পলিসি প্রণয়ন করেছিলাম৷ এই আইসিটি নীতিমালা খারাপ ছিল, তেমনটি আমি মোটেও বলবো না, বলতে পারি না৷ বরং সত্য প্রকাশের খাতিরে অবশ্যই বলবো, এ নীতির বাস্তবায়নে সঠিক উদ্যোগ-আয়োজন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে হয়তো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমাদের অপূর্ণ থাকতো না৷ কিন্তু এ নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য যে পরিপাণ অর্থ বরাদ্দ আমাদের প্রয়োজন ছিল, তা অমরা কখনোই করতে পারিনি৷
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত ও কিছু উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় বাজেটে আইসিটি খাতে বরাদ্দ থাকে মোটামুটি সংশ্লিষ্ট দেশের জিডিপির ৩ শতাংশের মতো৷ আমরা আমাদের অর্থ যোগানোর সীমাবদ্ধতার দিকটি চিন্তা করে ২০০২ সালের প্রণীত জাতীয় আইসিটি নীতিমালায় উল্লেখ করেছিলাম, আমরা আইসিটি খাতে বরাদ্দ রাখবো আমাদের জিডিপির অন্তত ১ শতাংশের উপরে৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, কোনো অর্থবছরেই আমরা এই ১ শতাংশ বরাদ্দ আইসিটি খাতের জন্য রাখতে পারিনি৷ এতে করে ফলাফল যা হবার, তাই হয়েছে৷ জাতীয় আইসিটি নীতিমালায় ঘোষিত অনেক পদক্ষেপই অবাস্তবায়িত থেকে গেছে৷ প্রয়োজনীয় অর্থাভাবে আইসিটি পার্ক গড়ে তোলার কাজে গতি আসেনি৷ ই-গভর্নেন্স কায়েম করা সম্ভব হয়নি৷ সরকারি অফিস-আদালতে কিংবা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় কমপিউটারায়ন ঘটেনি৷ অতি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো হয় গড়ে ওঠেনি, নয়তো গড়া হয়েছে অনেক দেরি করে, দেশে ডিজিটাল বিভাজন দূর করা যায়নি, দেশের সব জায়গায় সবস্তরের মানুষের কাছে সমভাবে সমব্যয়ে আইসিটি সেবা ও সুযোগ পৌঁছানো যায়নি৷ আইসিটি সেবা প্রত্যাশিত পর্যায়ের সস্তাতর করা যায়নি৷ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে গেছি৷
মোট কথা আইসিটিভিত্তিক একটা সমাজ গড়ে আইসিটিকে উন্নয়নের হাতিয়ার করে জাতিকে সবদিক থেকে সমৃদ্ধতর একটা অবস্থানে নিয়ে দাঁড় করার জন্য আমরা আমাদেরকে সন্তুোষজনকভাবে প্রস্তুত করতে পারিনি৷ আর এই প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে আমরা যে কতটুকু পিছিয়ে আছি, সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে সে হতাশাজনক চিত্রটিই ফুটে উঠেছে৷ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এইতো কিছুদিন আগে প্রকাশ করলো এর দ্যা গ্লোবাল ইনফরমেশন টেকনোলজি রিপোর্ট ২০০৭-২০০৮৷ এটি এই ফোরারে এধরনের সপ্তম বার্ষিক রিপোর্ট৷ এবারের এই রিপোর্টের আপ্তবাক্য ছিল fostering innovation through networked readiness৷ ফলে স্বভাবতই এবারের রিপোর্টে জোরালো আলোকপাত ছিল প্রযুক্তি দিগন্ত প্রসারিত করার জন্য নেটওয়ার্কওরেডিনেস-এর ওপর৷ সেই সূত্র এই রির্পোট ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও আন্তজার্তিক বিজনেস স্কুল INSEAD একটি নেটওয়ার্করেডিনেস ইনডেক্স তৈরি কছে৷ ১২৭টি দেশকে এ সূচকের আওতায় আনা হয়েছে৷ এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪তম স্থানে৷ এই হচ্ছে আমাদের নেটওয়ার্ক রেডিনেসের অবস্থা৷ সোজা কথায় আইসিটির ক্ষেত্রের আমাদের প্রস্তুতির বিপর্যস্ত অবস্থা৷
এই যখন অবস্থা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যখন এই বিপর্যকর প্রস্তুতি, তখন আমাদের সামনে হাজির ২০০৭-০৮ অর্থবছরের বাজেট৷ আর ঠিক এমনি সময়ে আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে অর্থাৎ ২০২১ সালের দিকে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার বিকল্প নেই৷ সে কারণেই নাকি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা-২০০২ পুনর্মূল্যায়নের কাজ শুরু হয়েছে৷ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ২৩ সদস্যের একটি কমিটিও এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে৷ বলা হচ্ছে, এবারের নীতিমালা আগেরটির মতো অবাস্তব ও অবাস্তবায়নযোগ্য যেনো না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চেয়েছে কমিটি৷ গত ১৫ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল৷ এদিনে দেশব্যাপী জনমত যাচাই সংক্রান্ত এক ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনও করা হয়৷ বলা হচ্ছে, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বিদ্যমান আইসিটি নীতিমালা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি৷ তাই নীতিমালা পুর্নমূল্যায়নের কাজে হাত দেয়া হয়েছে৷
প্রশ্ন আসে কোন সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা ২০০২ সালের জাতীয় আইসিটি নীতিমালা বাস্তবায়ন যথাযথভাবে করতে পারিনি, নিজেদের নিয়ে দাঁড় করাতে পারিনি তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে, গড়তে পারিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ, সৃষ্টি করতে পারিনি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবার চলার পথ৷ উত্তর আমার-আপনার সবার জানা৷ তবে উত্তরটা সবার উপলব্ধিতে সক্রিয় বলে মনে হয় না৷ উত্তরটা হচ্ছে তহবিলের সীমাবদ্ধতা৷ আমাদের জাতীয় বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাত বরাদ্দের সময়ে গৌণ বলে ভাবার সীমাবদ্ধতা৷ যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতটি আমাদের জন্য সামগ্রিক সমৃদ্ধির পথ খুলে দিতে পারে, বাজেটে সেই খাতটিকে এখনো গুরুত্বপূর্ণ স্বতন্ত্র খাত বলে ভাবতে পারিনি৷ এখনো এ খাতটিকে শিক্ষা খাতের সাথে জুড়ে দিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ একসাথে দিয়ে এ খাতের গুরুত্বকে কার্যত আড়াল করে রাখা হয়েছে৷ আর এর সাথে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম অঙ্কে আইসিটি খাতে বরাদ্দ দেয়ার প্রবণতা তো এখনো জারি আছেই৷ বরং সর্বশেষ প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত আরো গুরুত্বহীন পর্যায়ে নেমে এসেছে৷ আমরা আমাদের বাজেট ইতিহাসে এই প্রথমবার দেখলাম শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ দ্বিতীয় অবস্থানে নামিয়ে আনা হয়েছে৷ গত অর্থবছরে যেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বরাদ্দের ১৪.৫ শতাংশ, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তা থেকে ২.২ শতাংশ কমিয়ে করা হয়েছে মোট বাজেটের ১২.৩ শতাংশ৷ এভাবেই শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেট বরাদ্দ দ্বিতীয় অবস্থানে নামিয়ে আনা হলেও বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে অনুত্পাদনশীল খাতে৷ এবার সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতের জন্য৷ যেখানে বিদ্যমান আইসিটি নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের প্রয়াস থাকার কথা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অন্তত জিডিপির ১ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করা, সেখানে এ খাতে বাজেট কমিয়ে আনার এ নীতি-দর্শন নিয়ে যে ডিজিটাল বাংলা গড়া সম্ভব হবে না, সে কথা কাকে বুঝাই৷ নীতি দর্শনগত ভ্রান্তির কারণেই আসলে এ খাতে আমাদের অগ্রগতি নিশ্চিত হচ্ছে না৷ এবারের বাজেটেও সে ভ্রান্তিটুকু রয়েই গেছে৷ সেজন্য বাজেট নিয়ে মৌল প্রশ্নটিও থেকে গেছে অমীমাংসিত৷ এমনিতে সাধারণভাবে বলবো বাজেটে কিছু উদ্যোগ আছে, তবে কাটেনি বাজেটের বরাবরের গতানুগতিকতা৷
বাজেটের একটি ইতিবাচক দিক হলো, বাজেট প্রস্তাবে যেমনি আছে কিছু কর অবকাশ সুবিধা, তেমনি আছে আইসিটি খাতের জন্য কিছু প্রণোদনাও৷ কমপিউটার সামগ্রীর ওপর শুল্ক কমানো, ডাটা এন্ট্রি ও কলসেন্টারের আয়কে করমুক্ত রাখা, ই-গভর্নেন্স স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন এবং জাতীয় আইসিটি রোডম্যাপ তৈরি, হাইটেক পার্কের মৌলিক অবকাঠামো নির্মাণসহ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্বের কথা উল্লেখ আছে এ বাজেটে৷ তবে বরাদ্দের বেলায় সে গুরুত্বের প্রতিফলন নেই৷
বাজেটে কমপিউটার ও কমপিউটার সামগ্রীর বিদ্যমান ৫ শতাংশ হারের শুল্ক কমিয়ে ৩ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে৷ এতে করে কমপিউটার ও কমপিউটার সামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দেয়ার জন্য বাজেটকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো যাবে না৷ আর ব্যবসায়ী মহল আন্তরিক হলে আসলে শুল্ক কমানোর ফলে কমপিউটার ও কমপিউটার পণ্যের দাম কমারই কথা৷ প্রযুক্তি শিল্পকে প্রণোদিত করার কথাও এ বাজেটে আছে৷ বাজেট মতে, ২০০৮ সালের ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন ২০১১ পর্যন্ত ৩ বছরের জন্য সফটওয়্যার তৈরি, ডাটা প্রসেসিং, ডাটা এন্ট্রি ও কলসেন্টারের আয়কে করমুক্ত রাখার ইতিবাচক ব্যবস্থা রয়েছে৷ নতুন শিল্পের জন্যও আছে কর অবকাশ সুবিধা৷ এ সুবিধা আগের বাজেটেও বহাল ছিল৷ সরকার আশা করছে, এতে করে দেশী-বিদেশী শিল্পোদ্যোক্তারা বাংলাদেশে আইসিটিসংশ্লিষ্ট শিল্প স্থাপনে উদ্যোগী হবে৷ তবে উল্লেখ প্রয়োজন, শিল্পোদ্যোগে উত্সাহিত হওয়ার ব্যাপারটি শুধু এককভাবে এই কর অবকাশ সুযোগটিই মুখ্য নিয়ামক নয়৷ শিল্পোদ্যোগের পেছনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সার্বিক শিল্প পরিবেশ, বাজার সম্ভাবনা, শিল্প নিরাপত্তা, জনশক্তির সহজলভ্যতা, দেশে সার্বিক ভাবমূর্তিও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক৷ অতএব সে দিকগুলোর প্রতিও আমাদের সযতন নজর রাখা চাই৷
এবারের বাজেটে আরেকটি উদ্যোগ হচ্ছে কমপিউটারের অবচয় হার ২০ শতাংশের পরিবর্তে ৩০ শতাংশ নির্ধারণ৷ ব্যবসায়ীরা অবশ্য দাবি রেখেছিলেন এ হার ৫০ শতাংশে নির্ধারণের৷ যা-ই হোক বিদ্যমান ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ নির্ধারণ ব্যবসায়ীদের জন্য অর্থাৎ কমপিউটার বিক্রেতাদের জন্য উপকার বয়ে আনবে৷ এতে করে তাদের কমপিউটার বিক্রির পরিমাণ বাড়বে৷ কারণ, এর ফলে এখন সরকারি কর্মকর্তারা মোটামুটি প্রতি তিন বছর পর পর কমপিউটার পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন৷ এরা আগে কমপক্ষে পাঁচ বছর পর পর কমপিউটার পরিবর্তন করতে পারতেন৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এরা দুই বছর পার না হতেই কমপিউটার পরিবর্তনের জন্য অস্থির আগ্রহ প্রকাশ করতেন৷ এখন আইনগতভাবে তাদেরকে তিন বছর পর আর পুরনো কমপিউটার ব্যবহার করতে হবে না৷
এবারো গত বছরের মতোই বিনিয়োগ বাড়ানোর আশা প্রকাশ করে আইসিটি খাতের সমমূল মূলধন তহবিল তথা ইকুইটি এন্টারপিনিউরশিপ ফান্ডের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ আমরা দেখেছি, গত বছর এ তহবিলের অর্থ ব্যবহার নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে৷ আর গত বছর কোনো টাকাই খরচ হয়নি৷ আমাদেরকে সবার আগে খতিয়ে দেখতে হবে, কেনো গত অর্থবছরে এ তহবিলের কোনো অর্থ খরচ করা হয়নি৷ এর পর বিবেচনা করতে হবে এবারের বাজেটে বরাদ্দ দেয়া ১০০ কোটি টাকার তহবিল খরচের উপায়ের বিষয়টি৷ এবার অবশ্য বলা হচ্ছে, জটিলতা এড়াতে এবং এ তহবিলের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে কমপিউটার কাউন্সিল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে এ তহবিল ব্যবহারের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট করা হবে৷ এ উদ্যোগের ফলে তহবিল সহজলভ্য হয়, না আরো জটিল আকার ধারণ করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়৷ এদিকে অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকার অদূরে কালিয়াকৈরে ২৩১ একর জমির ওপর হাইটেক পার্কের মৌলিক অবকাঠামো নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ এ বছরেই শেষ হবে৷ পাশাপাশি হাইটেক পার্কের উন্নয়ন ও এতে বিনিয়োগের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা রয়েছে৷ তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের বিমূর্ত প্রচেষ্টা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে সেটাও দেখার বিষয়৷ তাছাড়া হাইটেক পার্কের পরবর্তী পর্যায়ের কাজের কী হবে অর্থ উপদেষ্টার ভাষণে তা নেই৷
আরেকটি বিষয় এ বাজেটে উপেক্ষিত হয়েছে৷ বিষয়টি হচ্ছে শিশুদের হাতে ১০০ ডলার কিংবা কম দামের ল্যাপটপ পৌঁছে দেয়ার মতো বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত বিষয়টি৷ সে ধরনের কোনো কর্মসূচি আমরা জাতীয়ভাবে এখনো শুরু করতে পারিনি৷ বাজেটে ছোটখাটো মাপের উদ্যোগ নিয়েও যদি এ কর্মসূচীর সূচনাটুকু করতে পারতাম, তবে তা হতো একটি ভালো কাজ৷ কারণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় যে স্বপ্ন আমরা প্রযুক্তিপ্রেমী বাংলাদেশীরা দেখি, তার বাস্তবায়নের জন্য তো ডিজিটাল প্রজন্ম তৈরি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই৷ আর ডিজিটাল প্রজন্ম সৃষ্টি করতে হলে শিশুদেরকে সামগ্রিকভাবে কমপিউটারের সাথে ঘনিষ্ট করে তোলা চাই৷ অতএব এবারের বাজেটে এর একটা প্রয়াস কামনা করা যথার্থ যৌক্তিক৷
বর্তমানে সরকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইলেক্ট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে৷ কোথাও কোথাও ব্যবহার্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ এ প্রেক্ষাপটে বাজেটে এ পণ্যটির ওপর বিদ্যমান শুল্ক প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে৷ সরকার ব্যবসায়ীদের জন্য এ মেশিন সহজলভ্য করতে চায়৷ এজন্য তা আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ও ১.৫ শতাংশ অগ্রিম ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে৷
সফটওয়্যার শিল্পের আয়ের ওপর রেয়াতি সুবিধা এ বছরই শেষ হওয়ার কথা ছিল৷ বাজেট প্রস্তাবে এই রেয়াতি সুবিধা আরো ৩ বছর বাড়ানো হয়েছে৷ সফটওয়্যার শিল্পোদ্যোক্তারা অবশ্য চেয়েছিলেন, তা আরো ১০ বছর বাড়ানো হোক৷ সফটওয়্যার শিল্পের প্রসার ঘটানোর জন্য এ দাবি যৌক্তিক বলেই মনে হয়৷ তারা সমমূলধন তহবিলে সফটওয়্যার কোম্পানির জন্য সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্থার দাবিও করেছেন৷
মানবসম্পদ উন্নয়নে বরাদ্দ যা আছে, তাকে উল্লেখযোগ্য বলা ঠিক হবে না৷ এবারের বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় মিলে ২১ হাজার ১১২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা প্রযুক্তি খাতের মোট বাজেটের ২১.১ শতাংশ৷ শতাংশের হারটা শুনতে ভালো লাগলেও অঙ্কের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম৷ বর্তমানে যখন কলসেন্টারের প্রসারের নতুন করে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তখন এ খাতের জন্য উপযুক্ত মানবসম্পদ তথা জনশক্তি তৈরি করতে অতিরিক্ত পরিমাণে তহবিলের চাহিদা রয়েছে৷ সে ব্যবস্থা এ বাজেটে নেই৷ অন্যান্য খাতের আইটি জনবল দেশে-বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী তৈরির জন্য এ খাতে বড় অঙ্কের বাজেট বরাদ্দের নিশ্চিত দাবি রাখে৷
সরকার আইটি, টেলিযোগাযোগ ও যোগাযোগ খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দ রেখেছে ৬ হাজার ৩৩৪ কোট টাকা৷ অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, এই বরাদ্দ যৌথভাবে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন খাতের জন্য৷ আর পরিমাণ মোট বাজেটের ৬.৬ শতাংশ৷ তবে তিনি এই তিন খাতের জন্য আলাদা বরাদ্দের কথা উল্লেখ করেননি৷
সুপারিশমালা
* আইসিটি খাতের বাজেট শিক্ষা খাত থেকে পুরোপুরি আলাদা করা হোক৷
* আইসিটি খাতের বাজেট বরাদ্দ কমপক্ষে জিডিপির ২ শতাংশে উন্নীত করা হোক৷
* সফটওয়্যার শিল্পের আয়ের ওপর কর রেয়াতি সুবিধা ১০ বছরে সম্প্রসারিত করা হোক৷
* শিশুদের কাছে কম দামে ল্যাপটপ পৌঁছানোর আলাদা কর্মসূচি ও বরাদ্দ ঘোষিত হোক৷
* তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্ভাবন প্রয়াস ও গবেষণা খাতে আলাদা বরাদ্দ ঘোষিত হোক৷
* নেটওয়ার্ক রেডিনেস বাড়ানোর বাজেটীয় প্রয়াস চাই৷
* সরকারি ই-গভর্নেন্স কার্যক্রমের প্রসার ঘটানো হোক৷
* সরকারি অফিস-আদালতের কমপিউটারয়নের সুনির্দিষ্ট বাজেট পদক্ষেপ গৃহীত হোক৷
* কলসেন্টার, ভিওআইপি ও ওয়াইম্যাক্স বাস্তবায়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো হোক৷
* স্কুল পর্যায়ের ছাত্রদের মাঝে কমপিউটার ব্যবহার জোরদার করতে হবে৷
* শুল্ক কমাতে হবে ডিজিটাল ক্যামেরার ওপর৷
* শুল্ক তুলে দিতে হবে ফটোকপিয়ার, মাল্টিফাংশনাল প্রিন্টার, নেটওয়ার্কসংশ্লিষ্ট পণ্যের ওপর থেকে৷
* ইলেক্ট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার বাধ্যতামূলক করার পরিবর্তে সফটওয়্যার ব্যবহার করা দরকার৷
* এডিপিতে আইসিটি খাতের জন্য ১০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হোক৷
কজ ওয়েব