কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ভয়াল সিডরের মর্মান্তিক আঘাত৷ এতে প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ৷ বিভিন্ন সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবীর দেয়া আগাম হুঁশিয়ারি সূত্রে অনেককে যথাসময়ে স্থানান্তর সম্ভব হয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়স্থলে৷ একইভাবে বন্যাপরবর্তী সময়ে কেউ বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছে, আবার কেউ নিঃস্ব হয়ে গেছে৷ আসলে প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় তথ্যটি হাতের কাছে পেলে মানুষ পেতে পারে ঘুরে দাঁড়ানোর পথনির্দেশনা এবং দুর্যোগ মোকাবেলার সঠিক কোনো উপায়৷ আর সেজন্যই তথ্যের সহজলভ্যতা নাগরিক সাধারণের মৌলিক অধিকার৷ প্রযুক্তিনির্ভর তথ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তাদের অধিকার অর্জনে সহায়তা করে৷ ফলে অর্জিত অধিকার এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ ও সচেতন হতে সহায়তা করে এবং এটা তাদের ভাগ্যোন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে৷ কিন্তু আমাদের মতো সুবিধাবঞ্চিত অনুন্নত দেশের পল্লী অঞ্চলের গরিব মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানোর পথটি বন্ধুর৷ প্রযুক্তির প্রসারে এর সহজলভ্যতা বাড়লেও সিংহভাগই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে শহরাঞ্চলে৷ গ্রামের মানুষ বঞ্চিত রয়েছে টেকসই তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বের সুবিধা থেকে আর সেই সাথে বাড়ছে ধনী-গরিবের তথ্যবৈষম্য৷
এই তথ্যবৈষম্য দূর করা এবং গ্রামের অভাবী জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে ২০০৭ সালের শুরুর দিকে যাত্রা শুরু করে পল্লী তথ্যকেন্দ্র তথ্য টেলিসেন্টার কর্মকাণ্ড৷ মূলত এ ধরনের টেলিসেন্টার বা পল্লী তথ্যকেন্দ্রগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বাস্থ্যসেবা, জীবনমান, আয়-রোজগার ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য প্রদানসহ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের ভাগ্যোন্নয়নে সহায়তা করে৷ ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ পর্যন্ত অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় পল্লী এলাকায় টেলিসেন্টার স্থাপন একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে, যা আমাদের গরিব জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল৷ এছাড়া এ সংস্থা দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে৷ এ ধরনের সংস্থাগুলোর মধ্যে ডি.নেট অন্যতম প্রধান সংস্থা, যারা তাদের গবেষণার মাধ্যমে পল্লী এলাকার মানুষের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য বাংলাদেশের অনেক গ্রামে স্থাপন করে পল্লী তথ্যকেন্দ্র৷ ডি.নেট বিভিন্ন জেলায় মূলত দুটি মডেলের পল্লী তথ্যকেন্দ্র তথা টেলিসেন্টার কার্যক্রম পরিচালনা করছে৷ যার একটি হচ্ছে কমিউনিটি ফর লার্নিং ইনফরমেশন কমিউনিকেশন অ্যান্ড নলেজ (ক্লিক)৷ এটি পরিচালনায় ডি. নেটকে সহযোগিতা করছে মাইক্রোসফট৷ মূলত মাইক্রোসফটের আনলিমিটেড পটেনশিয়াল পর্বের অলাভজনক কার্যক্রম এটি৷ এর আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত হয়েছে মোট ১৩টি পল্লী তথ্যকেন্দ্র এবং টেলিসেন্টার৷ এ পর্যন্ত এ কেন্দ্রগুলো থেকে মোট ৬০০০ সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিকে বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা দেয়া হয়েছে৷ ১০০০ লোককে দেয়া হয়েছে প্রযুক্তি বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ৷ মূলত এই ক্লিক প্রকল্পের অধীনে স্থাপিত পল্লী তথ্যকেন্দ্রগুলো আশপাশের অন্য তথ্যকেন্দ্রগুলোর হাব হিসেবে কাজ করছে৷ এর মাধ্যমে তথ্যকেন্দ্রগুলোর জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং ইন্টেল ওয়ার্ল্ড এহেড প্রোগ্রামের আওতায় দেয়া কারিগরি সহায়তা৷ তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ জুন ২০০৮-এ গাইবান্ধার গণউন্নয়ন কেন্দ্র (গাক) নামের স্থানীয় এনজিও এবং ডি.নেটের পরিচালিত আরেকটি স্থানীয় পল্লী তথ্যকেন্দ্রের আয়োজনে গাইবান্ধার জেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত হয় টেলিসেন্টার : সম্ভাবনার সেতুবন্ধ শীর্ষক দিনব্যাপী এক প্রশিক্ষণ কর্মশালা৷ এই কর্মশালার সহাযোগিতায় ছিলো মাইক্রোসফট, বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক (বিটিএন) এবং সিএলপি৷
কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আবু মো: ইউসুফ জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে শিল্পকারখানার স্বল্পতার কারণে কাজের সুযোগ কম এবং কারিগরি জ্ঞানের অভাবে দক্ষ জনবলও অপ্রতুল৷ সেক্ষেত্রে এধরনের সংস্থার দেয়া প্রশিক্ষণ এখানে কর্মসুযোগ তৈরি করবে৷ কর্মশালায় সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এনজিও গণউন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী এম আব্দুস সালাম৷ বিশেষ অতিথি গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম তার বক্তব্যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে দারিদ্র্য দূর করাসহ পল্লী এলাকার গরিব মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে এনজিওদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন এবং এ ব্যাপারে তিনি সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন৷ তিনি মনে করেন, এনজিওগুলো তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মূলত সরকারকেই সহযোগিতা করছে৷ এছাড়া অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি মাইক্রোসফট বাংলাদেশের প্রধান ফিরোজ মাহমুদ ক্লিক প্রকরে আওতায় সারাদেশের জেলা শহরে এ ধরনের পল্লী তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেন এবং এক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা আশা করেন৷ ইন্টেল এহেড প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আকতার উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশে টেলিসেন্টার নেটওয়ার্কের আওতায় পরিচালিত টেলিসেন্টারগুলোতে কারিগরি সহায়তা প্রদানে ইন্টেলের সহযোগিতা নিশ্চিত করেন৷ এছাড়া অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ডি.নেটের নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্কের মহাসচিব অনন্য রায়হান তথ্যভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাপনা ও জীবনমান উন্নয়নে দেশীয় সেবাভিত্তিক টেলিসেন্টার বা পল্লী তথ্যকেন্দ্রগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে জানান এবং এক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ কামনা করেন৷ এছাড়া বিটিএনের প্রধান কার্যকরী কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান জানান, বর্তমান সরকার বাংলাদেশে বিভিন্ন পল্লী অঞ্চলে টেলিসেন্টার স্থাপনের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছে, যা দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের এই কর্মকাণ্ডকে সহজ করবে৷ কর্মশালার মূল বক্তব্য পাঠ করেন ডি.নেটের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মোশাররফ হোসেন৷ বক্তব্যে তিনি ক্লিক প্রকল্পের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন, যেখানে উঠে আসে তৃণমূল পর্যায়ে পল্লী তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে গরিব জনগোষ্ঠীর জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার বাস্তব উদাহরণ৷ গাইবান্ধায় অনুষ্ঠিত এই কর্মশালায় আশপাশের জেলা শহর থেকে মোট ১৪০ প্রশিক্ষণার্থী ও নেতাকর্মী অংশ নেন৷ অনুষ্ঠানের ২য় পর্বে অংশগ্রহণকারীরা পল্লী তথ্যকেন্দ্রে কর্মী হিসেবে তাদের কাজের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে মতবিনিময় করেন৷ এছাড়া কেন্দ্রগুলোর কর্মকাণ্ডে সামাজিক মূল্যায়নে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মত পেশ করেন৷ পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের এ পর্ব পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ডি. নেটের সিনিয়র প্রোগ্রামার এস কে মাসুদুর রহমান এবং মাহমুদ হাসান৷ প্রশিক্ষণ শেষে অংশগ্রহণকারীরা ক্লিক প্রকল্পের আওতায় স্থানীয়ভাবে পরিচালিত একটি তথ্যকেন্দ্র ঘুরে দেখেন৷ আঞ্চলিক পর্যায়ে আয়োজিত এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য হলো :
০১. পল্লী তথ্যকেন্দ্র ও ক্লিক-এর কার্যপরিধি ও ব্যাপকতা সম্পর্কে বিভিন্ন পর্যায়ে জনসাধারণকে অবহিত করা৷
০২. পল্লী তথ্যকেন্দ্রের প্রশিক্ষিতদের তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র বেছে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া৷
০৩. স্থানীয় পর্যায়ে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের সাথে একদল দক্ষ জনগোষ্ঠীকে পরিচিত করে তোলা এবং দক্ষ জনবল নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া৷
০৪. ক্লিক প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত পল্লী তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক (বিটিএন)-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগকে আরো সুসংহত ও সংঘবদ্ধ করা৷
বলা দরকার
এ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি করে তাদের মাধ্যমে তথ্য ও প্রযুক্তি সেবা যদি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায়, তবে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে অনেক বেশি সচেতন ও সাবলম্বী করা যেতে পারে৷ মোবাইল সেবাভিত্তিক টেলিসেন্টারের সাধারণ মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবন-জীবিকা সম্পর্কে যে তথ্য পাবে, তার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই টেকসই সমাজ গঠন করা সম্ভব৷ কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি কারো একার পক্ষে এ গণসচেতনতা সফল করা সম্ভব নয়৷ এর জন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা৷ আর এই সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসা উচিত আমাদের সবার৷ তখন কমে আসবে তথ্যসমাজে ধনী-গরিবের বিদ্যামান এ দূরত্ব৷