লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৭ - ফেব্রুয়ারী
প্রথম বরেন্দ্র অ্যাগ্রো-ইকো ইনোভেশন রিসার্চ প্লাটফরম সম্মেলন
রাজশাহীতে প্রথম বরেন্দ্র এগ্রো-ইকো ইনোভেশন রিসার্চ প্লাটফরম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গত ২৯ জানুয়ারি ২০১৭। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সম্মেলন কক্ষে দিনব্যাপী এ সম্মেলনে বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুলস্নাহ। সম্মেলনে কো-চেয়ার ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন।
সম্মেলনে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞানী, বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মোট ৩৭টি ধারণাপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে ৩২টি উপস্থাপিত হয়। বিশেষজ্ঞেরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ভাবিত খরা-তাপসহিষ্ণু ও স্বল্প সময়ের ফসলের জাত (ধান, গম, সরিষা, তিল, যব, মসুরি, ভুট্টা, ছোলা, খেসারি, মটর, মুগ) এবং সেচ ব্যবস্থাপনা ও কৃষি সুরক্ষা প্রযুক্তি বিষয়ে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন।
সম্মেলনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), ডাল গবেষণা কেন্দ্র, গম গবেষণা কেন্দ্রসহ সরকারের কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, গবেষক ও প্রকৌশলীরা অংশ নেন।
সম্মেলনে গবেষক ও বিশেষজ্ঞেরা বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ফসল চাষে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে বৈচিত্র্য আনার তাগিদ দেন। সেই সাথে এই অঞ্চলে সেচসাশ্রয়ী প্রযুক্তি, খরা ও তাপসহিষ্ণু ফসলের জাত ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব দেন তারা।
বক্তারা বলেন, বিএমডিএতে একটি গবেষণা উইং/ইনস্টিটিউট স্থাপন করা উচিত, যেখানে দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক এবং স্টেক হোল্ডাররা কাজের সুযোগ পাবেন। এই উইং/ইনস্টিটিউটের নাম হতে পারে ‘সেন্টার অব ড্রাই ল্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল ফার্মিং’। নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে এই উইং/ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় অপরিকল্পিত সেচযন্ত্র ব্যবহারের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে উত্তরাঞ্চল শিগগির মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাবে। অপরিকল্পিত গভীর নলকূপ ও অগভীর নলকূপের পানি ব্যবহার হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে। এতে চাষের পরিধি বাড়লেও পরিবেশের ওপর পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। গবেষকেরা বলছেন, ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ায় অব্যাহতভাবে নিচে নামছে পানির স্তর। আশঙ্কা থাকছে সুপেয় পানি সঙ্কটেরও।
বক্তারা আরও বলেন, ঐতিহাসিকভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়া রুক্ষ। অতি উচ্চ ও নিমণ তাপমাত্রার পাশাপাশি কম বৃষ্টিপাতের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি অনগ্রসর ছিল। সত্তরের দশকে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে এ দেশে বোরো মৌসুমে ধানের চাষাবাদ শুরু হলে বরেন্দ্র অঞ্চলও পিছিয়ে থাকেনি। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবহাওয়া পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে দৃশ্যমান হয়ে দেখা দিচ্ছে। অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভস্থ পানি বোরো চাষে ব্যবহারের ফলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় বোরো ধান চাষে সেচসংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ধান উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির টেকসই ব্যবহারে বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো ধান আবাদ নিরুৎসাহিত করে শীত মৌসুমে পানিসাশ্রয়ী ফসল যেমন- আলু, টমেটো, গম, ভুট্টা, সরিষা, মুগ ও মসুর; খরা-সহনশীল ফসল যেমন- ছোলা, খেসারি, তিসি ইত্যাদি চাষাবাদ প্রচলনে কৃষকদের উৎসাহিত করা দরকার।
অপেক্ষাকৃত নিমণাঞ্চলে বোরো ধান চাষে এডব্লিউডি প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারিত করতে পারলে শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ পানি সাশ্রয় হবে। জৈব-অজৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। কনজারভেশন অ্যাগ্রিকালচার অনুশীলনে জোর দিতে হবে।
ভাত বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য এবং দেশের আবাদি জমির প্রায় ৭৮ শতাংশ জমিতে ধান চাষ হয়। এই প্রেক্ষাপটে বরেন্দ্র অঞ্চলের উপযোগী খরা ও তাপসহিষ্ণু আউশ এবং আমন ধানের জাত চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আউশ মৌসুমে বিআর২৬ ও ব্রি ধান৪৮; বোনা আউশ হিসেবে ব্রি ধান৬৫ এবং আমন মৌসুমে খরা-সহনশীল ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৬৬ ও ব্রি ধান৭১ চাষ করে কৃষক লাভবান হতে পারেন। বরেন্দ্র অঞ্চলে রোপা আউশ সম্প্রসারণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আংশিক ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহারের সাথে মৌসুমি বৃষ্টির পানির সুবিধা নিয়ে লাভজনকভাবে রোপা আউশ ধান উৎপাদনে উৎসাহিত করা দরকার। সমবায়ভিত্তিক আউশ ধানের বীজতলায় চারা উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে সময়মতো চারা বিতরণ ও রোপণ তদারকি বিবেচনায় আনা যেতে পারে। আমন মৌসুমে উলিস্নখিত খরা-সহনশীল জাতগুলো স্বল্প জীবনকাল ও উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় কৃষক আমন ধান কাটার পরে সহজেই রবিশস্য আবাদ করতে পারবেন, যা বাংলাদেশের টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অব্যাহত রাখতে সাহায্য করবে। কনজারভেশন অ্যাগ্রিকালচার (সিএ) সিস্টেম ও সিএ মেশিনারিজ ব্যাপকভাবে কৃষিতে বাড়ানো উচিত।
এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা মোকাবেলা করে বছরে ৩-৪টি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।
বক্তারা বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে যে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা উচিত তা হলো- জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈরী আবহাওয়া উপযোগী আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, বিভিন্ন উদ্ভূত সমস্যা নিরসনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ, কৃষিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা, বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন সমস্যা উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ ও খরাসহিষ্ণু মৌলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাত উদ্ভাবন।
এ সম্মেলন বরেন্দ্র অঞ্চলের উপযোগী প্রযুক্তিগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করে একটি লাগসই অ্যাকশন প্লান তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে সবাই আশাবাদী