লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মো: সাদা’দ রহমান
মোট লেখা:১৩
লেখা সম্পর্কিত
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির চমক মস্তিষ্কের ভাবনা রূপান্তর হবে কথায়
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির চমক মস্তিষ্কের ভাবনা রূপান্তর হবে কথায়
মো: সা’দাদ রহমান
এই প্রথমবারের মতো নিউরো ইঞ্জিনিয়ারেরা (স্নায়ু-প্রকৌশলী) এমন একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, যার মাধ্যমে কোনো মস্তিষ্কের ভাবনা-চিন্তাকে ট্র্যানসেন্ট বা রূপান্তর করা যাবে বোধগম্য কথায় বা বক্তব্যে। এর মাধ্যম মানুষ বোবা মানুষের জন্য একটি অগ্রসরমানের ব্রেন কমপিউটার ইন্টারফেস তৈরির ক্ষেত্রে আরো একধাপ এগিয়ে গেল। সোজা কথায়, এর মাধ্যমে বোবা মানুষের মাথায় যে চিন্তা-ভাবনা চলে, তা আমরা সহজেই জানতে পারব সবার বোধগম্য কথার আকারে। এতে করে বোবা মানুষের সাথে যোগাযোগ করা আরো সহজ হয়ে যাবে। এর ফলে এখন বলা হচ্ছে, টাচ স্ক্রিনের কথা ভুলে যান, শিগগিরই আসছে মাইন্ড রিডিং মেশিন বা মনপাঠক যন্ত্র। শুধু বোবা মানুষেরই নয়, যেকোনো জনের মনের কথা বলে দেবে এই মাইন্ড মেশিন সিস্টেম। এই সিস্টেমটি উদ্ভাবন করেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। এরা এক ব্যক্তির মস্তিষ্কের কর্মকান্ডের ওপর গবেষণা চালিয়ে মস্তিষ্কের সঙ্কেত চিহ্নিত করেন। এরপর গবেষকেরা এই সঙ্কেত পুনর্গঠন করেন শব্দে, যা ওই ব্যক্তি শুনতে পায়। এই সিস্টেমটি চলবে স্পিচ সিন্থেসাইজার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে।
গবেষক দলের এ সম্পর্কিত গবেষণা-প্রবন্ধটি গত ২৯ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’-এ। এতে বর্ণনা কর হয়, কী করে এই সিস্টেমটি তারা গড়ে তুলেছেন। যেটি একজন লিসেনিং পেশেন্টের মস্তিষ্কের কর্মকান্ড পড়তে পারে, যা পড়ে এই রোগী তা শুনতে পান আরো স্পষ্টভাবে, এর আগে আর কখনো এ ধরনের প্রযুক্তির কথা শোনা যায়নি। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি নিউরো প্রসথেটিকস অথবা ইমপ্ল্যান্টের নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করল। অর্থাৎ এর সাহায্যে এখন মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি কমিউনিকেট করা যাবে। আদর্শগত দিক থেকে একদিন যারা কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন, এই প্রযুক্তি তাদের বাকশক্তি ফিরে পাওয়ার সুযোগ করে দেবে। যারা স্ট্রোকের ফলে অ্যামাইয়ো ট্রফিক লেটারেল স্কেলেরোসিসে (এএলএস) ভুগছেন, তারাও এর মাধ্যমে সহজে কমিউনিকেট করার সুযোগ পাবেন।
এই গবেষক দলের নেত্রী ড. নিমা মেসগারানি বলেন, ‘এই সিস্টেম ব্যবহারকারী যদি ভাবে, তার এক গ্লাস পানি দরকার, তবে এই চিন্তা সূত্রে সৃষ্ট ব্রেন সিগন্যাল নিয়ে আমাদের সিস্টেমটি তা সিন্থেসাইজ করে মৌখিক কথায় রূপান্তর করতে পারবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটি হবে একটি গেম চেঞ্জার। যারা রোগের কারণে বা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বাকশক্তি হারিয়েছেন, এর মাধ্যমে তারা বাকশক্তি ফিরে পাবেন। আবার নতুন করে তারা তাদের চারপাশের মানুষের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন।’
আগের গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যখন কথা বলি, অথবা কথা বলার বা শোনার চিন্তা করি, আমাদের মস্তিষ্ক এর কর্মকান্ডে স্বতন্ত্র ধরনের প্যাটার্ন সৃষ্টি করে। এসব প্যাটার্ন কথায় রূপান্তর করতে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্টিমার বি জুকার ম্যান মাইন্ড ব্রেন বিহেভিয়ার ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা একটি ভোকোডার ব্যবহার করে ছিলেন। একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল ‘অ্যামাজন ইকো’ এবং অ্যাপলের ‘সিরি’ নামের সুপরিচিত হিউম্যানয়েড রোবটে স্পিচ সিন্থেসাইজ করা এবং ভয়েস কমান্ডে সাড়া দেয়ার জন্য।
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নিমা মেসগারানি এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি ই-মেইলের মাধ্যমে ‘ডিজিটাল ট্রেন্ডস’ সাময়িকীকে বলেন, ‘আমাদের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তির উদ্ভাবন, যা কথা বলতে পারেন না এমন একজন রোগীর অভ্যন্তরীণ কণ্ঠকে ডিকোড করতে পারে।’
গবেষকেরা জানান, মস্তিষ্কের কিছু অংশে খ্রিস্টমাস ট্রি’র মতো আলো জ্বলজ্বল করে। মানুষ যখন কথা বলে কিংবা এমনকি কথা বলার চিন্তা করে অথবা অলস সময়ে কিছু চিন্তা করে, তখন মস্তিষ্কে নিউরন ফায়ারিং চলে, যার ফলে আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলে। নিউরো নিয়ে গবেষকেরা দীর্ঘদিন থেকে এসব সিগন্যালে আবির্ভূত প্যাটার্ন ডিকোড করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, এ কাজটি খুব একটা সহজ নয়। বছরের পর বছর ধরে নিমা মেসগারানির মতো বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে আসছেন মস্তিষ্কের কর্মকাÐকে বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তায় অর্থাৎ ইন্টেলিজিবল থটে রূপান্তর করতে; চেষ্টা করে আসছেন কমপিউটার মডেলের মতো টুল ব্যবহার করে সাউন্ড ফ্রিকুয়েন্সির দৃশ্যমান উপস্থাপনের জন্য তা বিশ্লেষণ করতে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় নিমা মেসগারানি ও তার গবেষণা দল ব্যবহার করেছেন vocoder নামের একটি অ্যালগরিদম। এই অ্যালগরিদম সৃষ্টি করতে পারে কথার মতো শব্দ (speech-like sounds), মানুষের কণ্ঠ রেকর্ড করতে ভোকোডারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কিন্তু ভোকোডারকে প্রশিক্ষণ দিতে মেসগারানির প্রয়োজন হয় ব্রেনমডেল। সেজন্য তিনি সাথী হিসেবে নেন আশীষ দীনেশ মেতাহকে, যিনি একজন নিউরো সার্জন। কাজ করেন নিউইয়র্কের ‘নর্থওয়েল হেলথ ফিজিশিয়ান পার্টনার্স নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট’-এ। তিনি চিকিৎসা করেন এপিলেপসি তথা স্নায়ুরোগের।
মেতাহ ও মেসগারানি আশীষ দীনেশ মেতাহ’র কিছু রোগীকে স্পিচ রেকর্ডিং শুনতে বলেন এবং তাদের মস্তিষ্কের কর্মকান্ড পরিমাপ করেন। তাদের মস্তিষ্কের কর্মকান্ডে প্যাটার্ন প্রশিক্ষিত করে ভোকোডারকে। গবেষকেরা তখন রেকর্ড করেন রোগীদের মস্তিষ্কের কর্মকান্ড, যেমনটি তারা লোকদের কাছ থেকে শুনে ছিলেন ০ থেকে ৯ পর্যন্ত গুনতে। ভোকোডার চেষ্টা করে নিউরাল সিগন্যাল অ্যানালইজ করে আবৃত্তি করতে।
ফলাফল পরিপক্ব ছিল না। এটি যে শব্দ সৃষ্টি করে, তা রোবটের কথার মতো। এমনকি একটি এআই সিস্টেম ব্যবহার করে ভোকোডার ক্লিনকর এই শব্দকে আরো বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন করার পরও তা বোধগম্য হয়নি। কিন্তু গবেষকেরা দেখতে পান এসব ব্যক্তি
৭৫ শতাংশ সময়ে এই শব্দ বুঝতে পারে ও রিপিট করতে পারে। আরো সামনে এগিয়ে গবেষকেরা বাক্যে যাওয়ার আগে আরো জটিল শব্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।
এই গবেষকদের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, ভোকোডারকে প্রশিক্ষিত করে তোলা, যাতে এটি শব্দ বা কথা তৈরি করতে পারে মস্তিষ্কের সঙ্কেতের ওপর ভিত্তি করে, যেসব সঙ্কেত কারো মস্তিষ্ক থেকে বের হয়ে আসে, যখন সে কথা বলার কথা চিন্তা করে। এভাবে ভবিষ্যতে তারা হয়তো সক্ষম হবেন এমন একটি ইমপ্ল্যান্ট তৈরি করতে, যাতে এই ইমপ্ল্যাটন্ট পরিধানকারীর চিন্তাভাবনাকে শব্দে রূপান্তর করতে পারবে। আর এই প্রযুক্তি তখন জীবন পাল্টে দেবে সেই সব মানুষের, যারা বসবাস করছেন অ্যামি ও ট্রফিক লেটারেল স্কেলেরোসিস (এএলএস) নামের স্নায়বিক সমস্যা নিয়ে, অথবা স্ট্রোকের পর এখনো বেঁচে আছেন নানা সমস্যা নিয়ে। সোজা কথায়, যারা তাদের বাকশক্তি হারিয়েছেন, তাদের জীবনে এই প্রযুক্তি হবে এক চরম আশীর্বাদ