লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মো: সাদ রহমান
মোট লেখা:৪
লেখা সম্পর্কিত
সামাজিক রোবটের উত্থান
সামাজিক রোবটের উত্থান
মো: সা’দাদ রহমান
সামাজিক রোবট বা সোশ্যাল রোবট হচ্ছে একটি অটোনোমাস বা স্বায়ত্তশাসিত রোবট। এটি মানুষের বা অন্যান্য ভৌত অ্যাজেন্টের সাথে মিথষ্ক্রিয়া (ইন্টারেক্ট) বা যোগাযোগ রক্ষা করে। এসব রোবট কাজ করে এর ভ‚মিকার সাথে সংযুক্ত সামাজিক আচরণ ও নিয়মকানুন অনুসরণ করে। অন্যান্য রোবটের মতো সামাজিক রোবটের একটি ভৌত দেহ রয়েছে। এটি অ্যাভেটার বা অন-স্ক্রিন সিনথেটিক সোশ্যাল ক্যারেক্টারের মতো ভৌতদেহী নয়। এ দুটি পুরোপুরি আলাদা। কিছু সিনথেটিক সোশ্যাল অ্যাজেন্ট ডিজাইন করা হয় একটি স্ক্রিন দিয়ে মাথা বা মুখমÐল বুঝাতে, যা গতিশীলভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে ইউজারের সাথে। এসব ক্ষেত্রে, সামাজিক রোবট হিসেবে অবস্থান নির্ভর করে সোশ্যাল অ্যাজেন্টের বডির আকারের ওপর। যদি রোবটটির থাকে এবং ব্যবহার করে কিছু ভৌত মোটর ও সেন্সর সক্ষমতা, তখন এই ব্যবস্থাকে বিবেচনা করা যেতে পারে একটি রোবট হিসেবে।
প্রেক্ষাপট
এখন প্রায়শই একটি রোবটকে সামাজিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ১৯৫০-এর দশকে উলিয়াম গ্রে ওয়াল্টারের তৈরি টরটয়েজ। সোশ্যাল রোবটিকস হচ্ছে রোবটিকের একদম সর্বসাম্প্রতিক শাখা। ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকস গবেষকেরা এমনসব রোবট তৈরি করছেন, যেগুলো একান্তভাবেই নিয়োজিত সামাজিক পর্যায়ে। উল্লেখযোগ্য গবেষকদের মধ্যে রয়েছেন : সিনথিয়া ব্রিয়াজিল, টরি বেলপেয়িমি, অদি বিলার্ড, কারস্টিনডাউটেনহান, ইয়ানিস দেমেরিস, হিরোশি ইশিগুরু, মাজা ম্যাটারিস, জেভিয়ার মোভেরান, ব্রায়ন ক্যাসেলাটি এবং ডিন ওয়েবার। তাকাউকি কান্ডা, হিমেকি কোজিমা, হিরোশি ইশিগুরো, মিকো ওকাদা, টমিও ওয়াতানাবে এবং পি রবীন্দ্র এস ডি সিলভাও এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কাজ করেছেন।
একটি অটোনোমাস রোবটের ডিজাইন করা সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ এ ধরনের একটি রোবটকে সঠিকভাবে মানুষের কাজকে বুঝতে হয় এবং সে অনুযায়ী সাড়া দিতে হয়। এখনো এটি পুরোপুরি সম্ভব নয়।
উদাহরণ
আজকের দিনের সবচেয়ে সুপরিচিত সামাজিক রোবট হচ্ছে ‘সুফিয়া’। এটি তৈরি করেছে হ্যানসন রোবটিকস। সুফিয়া মানুষের মুখমন্ডলের ৫০টি অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে কথা বলতে পারে। এটি বিশ্বের প্রথম জাতিসঙ্ঘের টাইটেলপ্রাপ্ত নন-হিউম্যান। সফট ব্যাংক রোবটিকস তৈরি করেছে বেশ কয়েকটি সামাজিক মানবসদৃশ ও আধা-মানবসদৃশ রোবট। এগুলো প্রায়শই ব্যবহার হয় গবেষণায়। এগুলো মধ্যে আছে Pepper এবং Nao। অ্যাকাডেমিক ও কমার্শিয়াল কাজে ব্যবহার হয় পিপার। জাপানের হাজার হাজার পরিবারে এটি ব্যবহার হয়।
অন্যান্য সামাজিক রোবটের মধ্যে নাম করা যেতে পারে : হোন্ডা ও ক্যাসপারের রোবট ‘আসিমো’। এর ডিজাইন করেছে হার্ডফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটি। এটি ব্যবহার হয় অটিজম শিশুদের সহাতায়, গেমস ও ইন্টারেকটিভ খেলাধুলার মাধ্যমে। অহশর-র তৈরি ‘কজমো’ এবং ‘ভেক্টর’ একই ক্যাটাগরিতে পড়ে। সামাজিক রোবট মানবসদৃশই হতে হবে, তা অপরিহার্য নয়। অ-মানবসদৃশ সামাজিক রোবটের বিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে Paro the seal নামের সামাজিক রোবট।
এরিকা : জাপানে তৈরি বিশ্বের অন্যতম অগ্রসর মানের মানবসদৃশ রোবট
সামাজিক রোবট ও জাপান
ঊৎরপধ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর মানের ও অটোনোমাস অ্যান্ড্রয়িড রোবট। Erato Intelligent Conversational Android-এর সংক্ষিপ্ত রূপ ঊৎরপধ। এর মুখমন্ডল সত্যিই খুব সুন্দর। কথা বলে সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে উৎপাদন করা সিনথেসাইজড ভয়েসে। এই মানবসদৃশ রোবট ২০১৪ সালে তৈরি হয় জাপানে। এটি মানুষের সাথে পারস্পরিক কথাবার্তা বলতে, অথবা সংলাপ চালাতে সক্ষম। ২০১৪ সালের পর থেকে এর চারটি মডেল তৈরি করা হয়। এটি হাঁটাচলা করতে পারে না। কিন্তু ২০১৭ সালের গ্রীষ্মকালে এর একটি উন্নততর সংস্করণ তৈরি করা হয়। এর ফলে এটি এখন এর মাথা, ঘাড় ও কাঁধের সাথে হাতও নাড়াতে পারে।
এই রোবট এমনভাবে কাজ করে যেনো এর সুনির্দিষ্ট আবেগানুভ‚তি রয়েছে অথবা এটি এমনভাবে কাজ করে মনে হয় এর সেন্স আছে। মনস্তাত্তি¡কভাবে এটি এমন কিছু করে যেনো এটি অনুভব করতে পারে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা চাই সামাজিক রোবটগুলো প্রতিদিনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে আমাদের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করুক। অতএব যদি এগুলো দেখতে মানুষের মতো মনে হয়, তবে আমরা প্রত্যাশা করি এগুলো আমাদের সাথে মানুষের মতোই আচরণ করুক। অন্যথায় এগুলোকে মনে হবে একটি অস্বাভাবিক, ভুতুড়ে, অপার্থিব, অদ্ভুত, রহস্যময় যন্ত্রমাত্র।
‘আমরা এ ধরনের নতুন এমন একটা সামাজিক রোবট তৈরি করছি, যা সত্যিকারের কোনো মানুষ নয়। কিন্তু আমরা এর সাথে মিথষ্ক্রিয়া বা ইন্টারেক্ট করতে পারি ঠিক একজন মানুষের সাথে যেভাবে ইন্টারেক্ট করা হয়। ... এটি জীবিত নয়। তবু এর অস্তিত্ব আছে। আপনি এর সাথে সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে পারবেন অবচেতনের একটি পর্যায় পর্যন্ত। এ জন্যই সামাজিক রোবটগুলোকে মানুষের আকার দেয়া হচ্ছে। সামাজিক রোবটগুলো সত্যিকার অর্থেই অন্য সব রোবট থেকে আলাদা। একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো বন্ধনের সাথে গড়ে তুলতে পারবেন না।’Ñ বলেন ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডিলন গøস। তিনি তিন বছর কাটিয়েছেন এরিকার পেছনে কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এর মন তৈরি করেছি, তার মগজসংশ্লিষ্ট সবগুলো সফটওয়্যার তৈরি করেছি, এবং এর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করেছি। আরও অনেক অ্যান্ড্রয়িড তৈরি করা হয়েছে। মনোযোগ ছিল এরিকাকে পুরোদমে অটোনোমাস করে তোলায়, যাতে এটি যে কারও সাথে কথা বলতে পারে। এদিক বিবেচনায় আমার মনে হয়, এরিকা বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর মানের রোবটের মধ্যে একটি।’
বৃহদাকার উৎপাদনে রোবটের ব্যবহার বাড়ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রোবটিকসের দেয়া তথ্যমতে, ২০২০ সালে ১৭ লাখ রোবটকে আমরা কাজের মধ্যে পাব। রোবটিকস দেশের মধ্যে শীর্ষে থাকবে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। জাপানি বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে শীর্ষ মানের গবেষণা ফলাফল পেতে শুরু করেছেন। এর ফলে আমরা পাব রোবটগুলো আরও বেশি করে মানবিক আচরণ আয়ত্ত করতে পারবে। এরিকা এরই একটি উদাহরণ মাত্র। মনে হয় মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যকার পার্থক্য আরও কমে আসবে।
বিশ্বের বেশ কিছু দেশ শঙ্কিত, রোবটগুলো শেষ পর্যন্ত মানুষগুলোকে বিতাড়িত করবে। কিন্তু জাপানের অতি উচ্চ প্রত্যাশা রয়েছেÑ মানবসদৃশ রোবট তাদের কিছু সমস্যার সমাধান এনে দেবে। জাপানের জনসংখ্যা দ্রæত কমে আসছে। এবং জাতিসঙ্ঘের দেয়া তথ্যমতে, এর জনগোষ্ঠী হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন। জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে একটি পরামর্শিত সমাধানসূত্র হচ্ছেÑ এর শ্রমিকদের জায়গায় রোবট নিয়ে আসা এবং প্রবীণদের সেবায় রোবটকে কাজে লাগানো।
হিউম্যানয়েড বা মানবসদৃশ রোবটের গডফাদার ও বিশ্বসেরা প্রোগ্রামারদের অন্যতম হিসেবে অভিহিত অধ্যাপক হিরোশি ইশিগুরু বলেন : ‘আমরা একটি হাইপার-এজিং সোসাইটি অর্থাৎ অতি-বুড়োদের সমাজে রূপ নিতে যাচ্ছি। আমাদের প্রয়োজন রোবট থেকে অধিকতর সহায়তা নেয়া। বুড়োরা ভালোভাবেই গ্রহণ করে নিচ্ছে রোবটকে। তবে বিজ্ঞানীরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এক ধরনের চাপের মধ্যে আছেন। তবে বিজ্ঞানীরা রোটের পক্ষেই কথা বলাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।’
উল্লেখ্য, এরিকা হচ্ছে হিরোশি ইশিগুরুর মস্তিষ্কপ্রসূত সৃষ্টি বা ব্রেইনচাইল্ড। আর এটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর মানের রোবটগুলোর একটি। ইশিগুরুর বিশ্বাস, জাপানি সমাজকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অধিকতর রোবট গ্রহণ করে নেয়ার উপযোগী করে। কারণ, এখানে রয়েছে সবচেয়ে সমমাত্রিক ও আস্থাযোগ্য সংস্কৃতি। তা ছাড়া জাপান হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহারে সবার আগে এগিয়ে আসা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইশিগুরু বলেন, ‘স্মার্টফোনের কথাই ধরুন। আমরা কল্পনাও করতে পারিনি, জাপানে স্মার্টফোন এত ব্যাপকভাবে ব্যবহার হবে। সম্ভবত রোবট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা জাপানিরা আরও বেশি মাত্রায় রোবটকে গ্রহণ করতে যাচ্ছি।’