এ সংখ্যাটি আমাদের সম্মানিত পাঠকদের হাতে তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর নিয়মিত প্রকাশনার অষ্টাদশ বর্ষপূর্তি পূর্ণ করলো। আমরা এই ১৮ বছরের এ পত্রিকাটি প্রকাশের সময় বরাবর একটি উপলব্ধিকে সযতনে ধারণ করেছি। সে উপলব্ধিটি ছিল : ‘একটি পত্রিকাও হতে পারে একটি আন্দোলন’। সুস্পষ্টভাবেই ‘মাসিক কমপিউটার জগৎ’-এর আন্দোলনের ক্ষেত্রটি ছিল সুনির্দিষ্ট। সুনির্দিষ্ট এ ক্ষেত্রটি হচ্ছে : তথ্যপ্রযুক্তি খাত। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগমন এ দেশে নিশ্চিত করার জন্য আমরা ‘কমপিউটার জগৎ’কে ব্যবহার করেছি একটি হাতিয়ার হিসেবে। এক্ষেত্রে আমরা নানাধর্মী তৎপরতার মধ্য দিয়ে সে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলাম। ‘তথ্য প্রগতির জন্য’। কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিটি খবর প্রকাশে এ আপ্তবাক্যটি মাথায় রেখেছি। কোনো নেতিবাচক খবর প্রকাশে আমরা রীতিমতো ছিলাম অনীহ। তাই ইতিবাচক খবরগুলোই স্থান পেয়েছে মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিটি সংখ্যায়। তেমনি মন্তব্যধর্মী লেখালেখিতেও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে আমরা থেকেছি দায়িত্বশীল। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভুলপথে চলার তাগিদ তুলে ধরতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করিনি। তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি সব মহল ও কর্তৃপক্ষের জন্য ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা। প্রয়োজনে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য আমরা প্রকাশনার বাইরে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা, সংবাদ সম্মেলন, মেলা, প্রতিভাবানদের জাতির সামনে উপস্থাপন, বর্ষসেরা প্রযুক্তি-ব্যক্তিত্ব ঘোষণা ইত্যাদি ধরনের নানা তৎপরতাও চালিয়েছি সমান্তরাল। আসলে আমাদের সামগ্রিক কর্মসাফল্যসূত্রে মাসিক কমপিউটার জগৎ যেমনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এদেশের সর্বাধিক বিক্রীত প্রযুক্তি- সাময়িকী হিসেবে, তেমনি এটি দেশব্যাপী বিতর্কাতীতভাবে স্বীকৃত ‘তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ’ গণমাধ্যম হিসেবে।
তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় হাতিয়ার ছিল আমাদের প্রতিসংখ্যার সম্পাদকীয়গুলো। এ সম্পাদকীয়গুলোর মাধ্যমে আমরা জাতির সামনে তথ্যপ্রযুক্তির জন্য অনেক করণীয় ও দাবি তুলে ধরেছি, তেমনি সংশ্লিষ্টদের বিবেচনা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার তাগিদও উপস্থাপন করেছি। এই সুদীর্ঘ ১৮ বছরে আমরা সর্বমোট ২১৬টি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছি। যে কোনো পাঠক এ সম্পাদকীয়গুলো পাঠে যেমনি আমাদের দেশের প্রযুক্তি খাতের একটা সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন, তেমনি উপলব্ধি করতে পারবেন আমাদের সম্পাদকীয় পরামর্শগুলো কোথায় কোন মাত্রায় গুরুত্ব পেয়েছে, আর কোথায় কোথায় কিভাবে উপেক্ষিত হয়ে জাতি হিসেবে আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি। একটিমাত্র লেখায় আমাদের এই ১৮ বছরের সম্পাদকীয় বক্তব্যের বিস্তারিত তুলে আনা সম্ভব নয়। তবে এর একটি সার-সংক্ষেপ উপস্থাপনে প্রয়াস পাবো এ লেখায়। এর মাধ্যমে একজন পাঠক লক্ষ করতে পারবেন, আমরা যথাসময়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে যথাপদক্ষেপটি নেয়ার জোরালো তাগিদ যেমনি জানিয়েছি, তেমনি সমাজকেও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আহবান রেখেছি। নিচে এবারে আমাদের সম্পাদকীয় বক্তব্যের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উপস্থাপিত হলো।
মে, ১৯৯১ : ‘বিগত ২-৩ দশকের বিবর্তনে কমপিউটার আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার বিস্ময়কর অবদান মানুষের জীবন ও সভ্যতার সব ক্ষেত্রকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করছে। কমপিউটার এখন ব্যবস্থাপনায়, সরকারি প্রশাসনে, শিল্পে, শিক্ষা গবেষণায়, চিকিৎসায়, যুদ্ধে, যোগাযোগ ব্যবস্থায়, এমনকি বিনোদনে ব্যবহার হয়ে প্রযুক্তি পৃথিবীকে হাজার হাজার বছর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সূচনা হয়েছে কমপিউটার বিপ্লবের। এ বিপ্লবে যোগ দেয়ার অন্যতম অর্থ হচ্ছে কমপিউটার শিক্ষার ও কমপিউটারায়নের ব্যাপক প্রসার। ‘কমপিউটার জগৎ’ প্রকাশনা এ বিপ্লবে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার প্রত্যয়ে আমদের বলিষ্ঠ প্রয়াস।’
জুন, ১৯৯১ : ‘জনগণের মুখ্য দাবি দেশে ব্যাপক কমপিউটারায়ন। তাদের দাবি এক্ষেত্রে সরকারের সব বিভাগের স্থবিরতা কাটাতে হবে। কোনো রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যেনো এ গতি না থামে, সে ব্যাপারে সবাই সোচ্চার। মন্ত্রী পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও কেনো গত দুই বছরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে কমপিউটার শিক্ষা চালু করা হলো না, কেনো বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সফটওয়্যার রফতানির কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলো না, কেনো অন্তত সহজ প্রযুক্তি যন্ত্রাংশের উৎপাদনও এখানে হচ্ছে না, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের একটা সমন্বয় দরকার। কমপিউটারায়নের বড় বাধা কমপিউটার পণ্যের ওপর করারোপ। এর ওপর কর বাড়ানো হলে, আইটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এ হবে এক অপূরণীয় ক্ষতি।’
জুলাই, ১৯৯১ : ‘ক্ষয়িষ্ণু ও বাতিল প্রযুক্তি প্রচলনে উৎসাহিত করলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম বাহন ভবিষ্যৎজয়ী কমপিউটারের ওপর অযৌক্তিকভাবে কর বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। জনগণ এর তীব্র বিরোধিতা করছে। জনগণ তথ্যপ্রযুক্তির সুফল থেকে জাতিকে বঞ্চিত করার পদক্ষেপ চান না। জনগণ কমপিউটারের পর বর্ধিত কর চান না। আমরাও কমপিউটারায়ন প্রসার বন্ধ করার এ ব্যবস্থার অবসান চাই। আশা করি সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সচেতন জনগণের আহবানে সাড়া দেবে?’
আগস্ট, ১৯৯১ : ‘দেশের জনগণের হাত থেকে কমপিউটারকে সরিয়ে রাখার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা কমপিউটার রাজ্যের বিজ্ঞানী, উদ্যমী ও শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, চাকরিজীবী ও ছাত্রসহ সবস্তরের নাগরিকদের কাছ থেকে যে সুচিমিত্মত ধারণা ও পরামর্শ পেয়েছি, তা বিশ্লেষণ করে আমরা এই ভেবে শঙ্কিত যে, চরম অজ্ঞতা অথবা দেশের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র কালজয়ী এ প্রযুক্তির সুফল থেকে দেশ ও জনগণকে বঞ্চিত করেছে। কমপিউটারের ওপর ট্যাক্স বাড়িয়ে এর প্রচলন কমিয়ে এ প্রযুক্তির সুফল থেকে সাধারণ দেশবাসীকে বঞ্চিত করার প্রচেষ্টা চলছে।’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ : ‘সরকারের রাজস্ব বিভাগকে সাধুবাদ। দেরিতে হলেও কমপিউটার আমদানির ওপর ধার্য কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশে বর্তমানে যে কমপিউটারায়নের প্রক্রিয়া চালু রয়েছে তা হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোর মুখোমুখি হয়েছিল গত বাজেটপরবর্তী কমপিউটারের ওপর আমদানি কর বাড়ানোর সিদ্ধামেত্ম। আপাতত সে আশঙ্কা থেকে কিছুটা মুক্ত হওয়া গেল।’
অক্টোবর, ১৯৯১ : ‘গত এক দশকে তথ্যপ্রযুক্তির যে বিপ্লব ঘটেছে তাতে বিশ্বব্যাপী তৈরি হয়েছে কোটি কোটি ডলারের ডাটা এন্ট্রির বাজার। দুর্ভাগ্য, এখনো এ বাজারে আমাদের প্রবেশ ঘটেনি। অথচ এমন কোনো জটিল ব্যাপার ছিল না আমাদের পক্ষে এ বাজারে প্রবেশের সুযোগ করা। আমরা নিশ্চিত এক ধনাত্মক প্রভাবে প্রভাবিত হতো আমাদের দুর্বল অর্থনীতি। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে জোর আবেদন জানাচ্ছি।’
নভেম্বর, ১৯৯১ : ‘কমপিউটার জগৎ-এর জন্মলগ্ন থেকেই আমরা একটা বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে আসছি। সেটি হলো- ‘আধুনিক প্রযুক্তির কমপিউটার আমাদের সামনে উন্মুক্ত করেছে স্বর্ণ-সম্ভাবনার দ্বার। তবে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে দেশে দরকার সঠিক দিক-নির্দেশনা ও পরিকল্পনা, ছড়িয়ে দেয়া আধুনিক এ তথ্যপ্রযুক্তি জনগণের মাঝে। তবে এটা স্পষ্ট এক্ষেত্রে রয়েছে সরকারি দিকনির্দেশনা ও নীতিমালার অভাব। দেশ ও জনগণের স্বার্থে এ সমস্যাগুলো ত্বরিত সমাধানে আমরা সরকারি সহায়তার প্রত্যাশী।’
ডিসেম্বর, ১৯৯১ : ‘যে শীতল স্থবিরতা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে বাংলাদেশকে তা কি এবারেও তার হিমশীতল থাবায় বিনষ্ট করতে যাচ্ছে একটি স্বর্ণ-সুযোগকে? আমরা ভীত। গত কয়েক মাস ধরে দেশের সর্বত্র সুধীমহলে যে ডাটা এন্ট্রি শিল্পের কথা উচ্চারিত হচ্ছে সে ব্যাপারে সরকার এখনো নীরব।’
জানুয়ারি, ১৯৯২ : ‘বড় দুর্ভাগা এ দেশ। অতীতে অপরিমেয় সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়নি এখানে। দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা সর্বদা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে। কিন্তু সময় কি বদলেছে? অবস্থাদৃষ্টে অনুমান দৃঢ় হয়- না বদলায়নি। এখনো উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। কমপিউটার তথা ডাটা এন্ট্রি শিল্প স্থাপনে দেশের বর্তমান চালচিত্রের কি অভাবিত পরিবর্তন ঘটতে পারে সে সম্পর্কে গত কয়েক মাস ধরে কমপিউটার জগৎ এবং অন্যান্য পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হলো, অনেক অভিজ্ঞজনদের অভিজ্ঞতা ও ধারণার কথা ছাপা হলো। কিন্তু হলে কি হবে? অবস্থা তথৈবচ। সমগ্র দেশে নাকি জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই কি তার নমুনা। কর্তাব্যক্তিরা একবার ভেবেও দেখলেন না কী সুযোগ আর অমিত সম্ভাবনা থেকে আমরা বঞ্চিত হতে যাচ্ছি। এর জবাব কে দেবে?’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২ : ’৫২-র অঙ্গীকার ছিল মাতৃভাষার ও স্বাধীনতার। কমপিউটার শুধু মাতৃভাষাকেই ধারণ করেনি, আভিজাত্যের ও গজদন্ত মিনার ছেড়ে কমপিউটার গণমানুষের দ্বারপ্রামেত্ম হাজির হয়েছে। দুর্জয় স্বাধীন অসিত্মত্বে জাতীয় ভবিষ্যৎ নির্মাণে কমপিউটার বাংলাদেশে দুখী মানুষের হাতিয়ার হতে চলেছে। স্বাধীনতার স্বপ্নকে সবচাইতে সৃষ্টিশীলভাবে ধারণ করেছে কমপিউটার। কিন্তু এ সরকারের কিছু সংস্থা ও স্বার্থান্ধ কিছু ব্যক্তির কারণে এ রাষ্ট্রভাষা, জ্ঞান ও মুক্তির বাহন হিসেবে কমপিউটারকে ধারণ করতে পারছে না। সকল আকাঙ্ক্ষা ও সৃষ্টিশীলতা নস্যাৎ করে রাষ্ট্রকে বন্ধ্যা করে তোলার চক্রামেত্মর সামনে গুমরে উঠছে বুয়েটের তরুণ, ভবিষ্যতের ওপর বিশ্বাসে ঋদ্ধ তরুণ, প্রবাসী বিজ্ঞানীসহ অনেক মানুষ।’
মার্চ, ১৯৯২ : ‘একথা সত্য, বাইরে থেকে কমপিউটারের খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে এখানে বসে সংযোজন করে পূর্ণাঙ্গ কমপিউটার তৈরি করে জাতীয় আয় বাড়ানো ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিষয়টিকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সম্ভব। আমরা যে গণকমপিউটারের কথা বলছি, তাতে এ ধরনের প্রকল্প খুবই সহায়ক হবে। জনগণের হাতে কমপিউটার চাইলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত স্কুল পর্যায়ে কমপিউটার ব্যবহার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কমপিউটারের দাম কমাতে হবে। দেশের কমপিউটার সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ উদ্যোগ নিতে পারে।’
এপ্রিল, ১৯৯২ : ‘আমাদের সামর্থ সীমিত। তবুও স্বদেশ ও জাতির সেবায় আমরা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করছি। গ্রাম-গ্রামান্তরে যে শিশুরা রয়েছে, কমপিউটার স্পর্শ করার সাহস ও স্বপ্নে তাদের জাগিয়ে তোলার জন্য আমরা গ্রামীণ ছাত্রছাত্রীদের কমপিউটার পরিচিত প্রকল্প শুরু করেছি। কমপিউটার শিক্ষার তালিম প্রচার করছি। অফুরান সম্ভাবনা সামনের জনগণের সাথে পথিকৃৎ সাহসী ও সৃষ্টিশীল মানুষ নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবই।’
মে, ১৯৯২ : ‘একটি মাঝারি শক্তির দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তোলার মতো সহায়সম্পদ এ জাতির থাকা সত্ত্বেও শিল্প, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতায় আমরা দুর্দশায়। এ সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে কমপিউটার জগৎ জাতীয় পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠে জগৎ জয়ের আধুনিকতম প্রযুক্তি আয়ত্ত করার জন্য উন্নতমানের শিক্ষা, নতুন প্রজন্মের লাখ লাখ শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থানের জন্য ডাটা এন্ট্রিসহ কমপিউটার সার্ভিস শিল্পের প্রসার, দেশের কমপিউটার ও নবশতাব্দীর বিশ্বমুখী জীবন সংস্কৃতি নির্মাণ এবং জনগণ ও নতুন প্রজন্মকে পরমুখাপেক্ষী ও বেদনার্ত অবস্থায় ফেলে রাখার আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক লক্ষ্যহীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথকে তুলে ধরছে। এখন লক্ষ্য, স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও সংকল্প রূপায়ণের পালা।’
জুন, ১৯৯২ : ‘সামনে সংসদের বাজেট অধিবেশন। কমপিউটারের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই ভাবছেন কর কাঠামো কেমন দাঁড়াবে এবারের বাজেটে। আমরা বলি ট্যাক্সমুক্ত করা হোক কমপিউটার আমদানি।’
জুলাই, ১৯৯২ : ‘পশ্চিমবঙ্গে ডাটা এন্ট্রি, কমপিউটার সার্ভিস ও সফটওয়্যার শিল্পের লোকেরা যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমতল বিশ্বমানে উত্তরণের জন্য মরিয়া, তখন বাংলাদেশ সরকার, সংস্থা ও পথিকৃৎরা উৎকণ্ঠাহীন। নয়া অর্থবছরের মধ্যে কমপিউটার সার্ভিস শিল্পের ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্য ঘোষণার জন্য আমরা সরকার প্রধানের প্রতি অনুরোধ রাখছি।’
আগস্ট, ১৯৯২ : ‘বর্তমান বিপন্ন সময়ে সমাজের বিপন্নতাবোধ ও এর বেদনা সম্পর্কে সজাগ থেকে আমরা তাগিদ জানিয়ে বলছি- ‘আপন দেশ, জাতি, দেশ ও প্রশাসনকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহায়তা করা শিক্ষিত ও সৎ মানসিকতার অধিকারী কমপিউটারবিদদের দায়িত্ব। তাদের অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টির জন্য ক্যাডার সার্ভিস প্রবর্তন ও প্রশাসনিক কমপিউটার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের। এ ব্যাপারে দেরি করার কোনো কারণ নেই।’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯২ : ‘বিশ্বজুড়ে কমপিউটারের দাম কমছে। পিসির দর নেমে এসেছে ৫-৮শ’ ডলারে। বাংলাদেশে পিসির দর সে অনুপাতে কমছে না। বেশি দামের কারণে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি খাত পিসি কেনায় আগ্রহী হচ্ছে না। বিদেশের মতো কম দামে কমপিউটার পেতে চায় নতুন প্রজন্ম ও অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। আমরা চাই সরকার এ ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ নেবে।’
অক্টোবর, ১৯৯২ : ‘দেশে প্রথম কমপিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা সমাজের সমানে হাজির করেছে কমপিউটারের বিস্ময়কর শিশু, দুরন্ত কিশোর, সাহসী ও প্রত্যয়ী সংগঠক তরুণেরা। কমপিউটার জগৎ এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নতুন সাহসে সমৃদ্ধ হয়েছে নিজেও। আমাদের প্রবীণ, তরুণ ও নবীন প্রজন্মের সামনে আজ প্রশ্ন : আমরা প্রযুক্তির দাস হবো, না প্রযুক্তির প্রভু হয়ে স্বাধীনভাবে বিশ্ব পরিসরে জাতির আত্ম-প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হবো? আমরা শিল্পবাণিজ্য, অর্থনীতি, প্রযুক্তির রাজ্যে প্রবীণদের দায়িত্বশীল অভিভাবকত্ব ও নতুন প্রত্যাশা করছি।’
নভেম্বর, ১৯৯২ : ‘আমাদের জাতীয় স্বপ্ন, লক্ষ্য, কর্মসূচি ও সাব্যস্ত-স্বীকৃত; জাতীয় কর্মপদ্ধতির অভাবটাই আমাদের সবচাইতে বড় শত্রু হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, অগ্রণী ব্যক্তিমানুষ ও দিশারী উদ্যমী এসব ক্ষেত্রে সবেমাত্র ধারণা তুলে ধরতে শুরু করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির নতুন স্তরে উন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির দাসত্ব মুক্তির জন্য চাই পাঁচসালা পরিকল্পনা।’
ডিসেম্বর, ১৯৯২ : ‘সমগ্র জাতির লাখ লাখ মেধাবী মানুষের মননশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানকে ধারণ করে তার ভিত্তিতে সমস্যারাজি সমাধানের একটা প্রায়োগিক বিস্ফোরণ ঘটাতে হলে সুপার কমপিউটার ও সিডিরমের স্তর স্পর্শ করা ছাড়া আমাদের কোনো পথ নেই। হীনতা ও সঙ্কীর্ণতার দিকে অগ্রসর না হয়ে সুপার কমপিউটার যুগে প্রবেশই হোক আমাদের অগ্রযাত্রার লক্ষ্য। জাতির স্বপ্ন ব্যাপক অগ্রগতির। একথা আমরা যেনো না ভুলি।’
জানুয়ারি, ১৯৯৩ : ‘এবার ভুল করলো বাংলা একাডেমী। কীবোর্ড প্রমিতকরণে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে একাডেমীর প্রশাসনিক দফতর। প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও। কী জবাব দেবে বাংলা একাডেমী আমরা তা জানি না। কিন্তু আমরা এটুকু বুঝি, এ ঘটনা দেশীয় প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশ যেখানে একটি ভাষার জন্য প্রচলিত কীবোর্ডের সংখ্যা একের অধিক নয়, সেখানে বাংলাদেশে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের বাণিজ্যের ষোলোকলা পূরণের অভিপ্রায়ে প্রসব করে চলেছে একের পর এক কীবোর্ড। এ মানসিকতার যতদিন না পরিবর্তন হচ্ছে, ততদিন বিশ্বপ্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক না কোনো, বন্ধ্যত্ব ঘুচবে না আমাদের।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩ : ‘ভাষা আন্দোলনের ৪০ বছর পরও সরকার ও সরকারি সংস্থা একটি জাতীয় বাংলা কীবোর্ড হাজির করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার ডালি মাথায় বয়ে আরেক ফেব্রুয়ারিতে হাজির হয়েছি আমরা। বাংলাভাষায় কীবোর্ড ৬ বছরেও কেনো হয়নি। রাষ্ট্র ও ভাষা ঐতিহ্যের হেফাজতকারী সরকারের কাছে এ আমাদের জিজ্ঞাস্য।’
মার্চ, ১৯৯৩ : ‘আমরা গভীর উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ করছি, শুধু স্থবিরতাই নয়, এক ধ্বংসবাদী পশ্চাৎমুখী নৈরাজ্য কমপিউটার প্রযুক্তির অগ্রগমনকে গ্রাস করতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিচক্ষণ মানুষ এদিকে মনোযোগী না হলে বহু কষ্টে গড়ে তোলা কমপিউটারমুখী জনআগ্রহ ও পরিবেশ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার বিজ্ঞান বিভাগে কমপিউটার যন্ত্র-সরঞ্জাম সংগ্রহের টেন্ডার জমা দেয়ার দিন একদল নৈরাজ্যবাদী সন্ত্রাসী কাগজপত্র ছিন্নভিন্ন করে দৈহিক হামলা চালিয়েছে এ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত শিক্ষিত-মার্জিত অগ্রসর মানুষের ওপর। আমরা শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন রাখছি : এটি কিসের আলামত?’
এপ্রিল, ১৯৯৩ : ‘কমপিউটার জগৎ তার প্রকাশনার দ্বিতীয় বর্ষ পূর্ণ করলো। ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’- কমপিউটার জগৎ-এর এই বিস্ময়কর ধ্বনিতে দু’বছর আগে চমকে উঠেছিলেন আমাদের বিদ্বজন মহল। আজ তা বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গত এক বছর আমরা আমাদের বারোটি সংখ্যায় সে ধ্বনির সাথে একথাটিও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি- কমপিউটার হচ্ছে রাজনীতি, ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, শিল্প, প্রকাশনা, দুর্যোগ মোকাবেলাসহ একবিংশ শতকের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন গড়ার বাস্তব হাতিয়ার।’
মে, ১৯৯৩ : ‘গত তিন বছর ধরে আমরা দেখছি, সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আদায়ের ফন্দিফিকির ছাড়া কমপিউটার নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা করেনি। অযৌক্তিক বিধিকানুন ও নিষ্ক্রিয়তায় কমপিউটার কাউন্সিল এখাতে বিড়ম্বনা বাড়াছে। টিভিতে এ সরকার কমপিউটার ও বিজ্ঞানের সব নিয়মিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। বিরোধী দলও এ ব্যাপারে নীরব। তাদের প্রশ্রয়ে এক ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নতুন শতকের বরণের জন্য যখন মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালছেন, তখন আমরা বৈশাখি মেলায় কমপিউটার নিয়ে গিয়ে সৃষ্টি করেছি নতুন ঐতিহ্য। আমরা বিশ্বাস করি, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের মতোই তথ্যপ্রযুক্তির নবশতাব্দীর সংগ্রামও শুধু জনগণই এগিয়ে নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে পশ্চাৎমুখী শাসক ও ক্ষমতাবানদের কোনো অবদান থাকবে না।’
জুন, ১৯৯৩ : ‘প্রায় এক কোটি শিক্ষিত বেকারের দেশে কর্মসংস্থানের জন্য বিলীয়মান পাট ও অন্যান্য শিল্পায়নের স্থলে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য গড়ে ওঠা প্রচেষ্টার প্রতি কোনো আগ্রহ এ সরকারেই নেই, নতুন বাজেটেও অর্থমন্ত্রী তা জানিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন, কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টির বদলে সরকারের শাসনমেয়াদ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার অর্থসংগ্রহের তাগিদ সরকারের কাছে বড়।’
জুলাই, ১৯৯৩ : ‘বর্তমান যুগকে বলা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ এবং এ সময়টা জ্ঞানচর্চার। এ যুগের মূল চালিকাশক্তি কমপিউটার। এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ সত্যের উপলব্ধি থেকে আমরা কমপিউটার জগৎ ১৯৯১ সাল থেকে নিরলসভাবে কাজ করছি। জনগণ এবং সরকারের ভেতরে ও বাইরে। সচেতন করে তুলতে চেয়েছি সবাইকে। পরামর্শ দিয়েছি সরকার ও বিরোধী দলকে। পথ বাতলিয়েছি বেকারত্ব দূর করার এবং পথ দেখিয়েছি অভাবনীয় অর্থ আয়ের। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা গেছে, জনগণ যতটুকু সাড়া দিয়েছে তার কিঞ্চিৎভাগও সাড়া পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো থেকে।’
আগস্ট, ১৯৯৩ : ‘বাংলাভাষার বাংলাদেশ নয়, হিন্দুভাষী ভারত কমপিউটারে বাংলা বর্ণমালার তথ্য বিনিময় কোড আইএসও তথা ‘আন্তর্জাতিক প্রমিতকরণ সংস্থা’ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। এ খবরটি জানতে পেরে সমগ্র জাতি স্তম্ভিত ও মর্মাহত । এর পরেও বাংলাদেশ সরকার কথা বলে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগও অনুশোচনায় জর্জরিত হচ্ছে না, এটাই এদের আসল পরিচয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর রক্তঝরা দিনগুলোর অঙ্গীকার থেকে এদেশের রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান কতদূর বিচ্যুত হয়েছে, এ ঘটনা হচ্ছে তার একটি প্রমাণ। কতিপয় লোকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে পুরো জাতির ললাটে এর মাধ্যমে পরাজয়ের চিহ্ন অঙ্কিত হলো, যা হওয়ার কথা ছিল না।’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩ : ‘আমরা আশাবাদের অনন্ত সাগরে আমাদের জাতীয় স্বপ্নকে সরকারি করে পাল তুলেছি ভবিষ্যৎ অভিযাত্রার বজরায়। নেতিবাচকতার বিসর্গও আমাদের নেই। কিন্তু এই সরকার ও প্রশাসনের কাছে জনগণের প্রত্যাশা যখন অপমানিত ও উপেক্ষিত হয়ে মাথাকুটে মরছে এবং আত্মশক্তিতে উত্থানের ক্ষেত্র নির্বাচন করছে, তখন এ মন্ত্রণালয় গঠন যদি মৃতপ্রায় পুরাতন বিজ্ঞানমন্দিরগুলোতে লোলচর্মবিজ্ঞানকে আয়ুষ্মান করার জন্য ধূপধুনা জ্বালানোর আয়োজন হয়, আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের স্পষ্ট দাবি, মৃতবিজ্ঞানের গোরে জাতির সকৃপণ সহায়সম্পদ ও মনোযোগ ব্যয় না করে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা নববিজ্ঞানের দুয়ারে যদি আলো জ্বালেন, একটি জীবনমুখী জোয়ারের সৃষ্টি হতে পারে।’
অক্টোবর, ১৯৯৩ : ‘ঠেকে ঠেকে শেখা, হাতের আন্দাজে পথ খোঁজা কোনো বুদ্ধিমান জাতির কাজ নয়। কিন্তু আমাদের জনগণ যা বোঝেন আজ, সেটা সরকারের বুঝে উঠতে ৫-৭ বছর এমনকি ১০ বছর লেগে যায়। এটি এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতি। এ অবস্থা সবচেয়ে বেশি বাধা কমপিউটারায়নের ক্ষেত্রে। শুধু কনভার্টিবিলিটির জন্য নয়, সার্বিক বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তির জন্য ব্যাংকখাতের কমপিউটারায়ন দরকার। আমরা জোর দিয়ে বলেছি, কমপিউটার শুধু কর্মসহায়ক যন্ত্র নয়, অতীতের কাগজ-কলমের মতো নতুন যুগের নতুন সভ্যতার ধারণ ও বিকাশের মাধ্যম হয়েও উঠেছে।’
নভেম্বর, ১৯৯৩ : ‘পাশের দেশগুলোতে উন্নত যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এক সাড়া জাগানো গতিতে অগ্রসর হচ্ছে এখন। এ সময় আমাদের অবস্থা শোচনীয়। আমাদের জীবনে ব্যক্তিগত অভিলাষের বাইরে জাতীয় কোনো অগ্রগতির খবর নেই। অতীতের মনোবেদনা, মীমাংসার অযোগ্য খাতগুলোর সঙ্কট, পশ্চাৎপদতা ও খুবই অনগ্রসর কর্মকাঠামো নিয়ে আমাদের সরকারের পর সরকারগুলো ব্যস্ত। অথচ এ সময়েই ইউরোপ ও এশিয়া অতিক্রম করে নতুন সভ্যতার ঢেউ আফ্রিকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের ভাগ্য বদলাছে না।’
ডিসেম্বর, ১৯৯৩ : ‘বাংলাদেশে বহু প্রত্যাশিত ই-মেইল সার্ভিস শুরু হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে। জরুরিভিত্তিতে দেশে ই-মেইল প্রর্বতনের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ কমপিউটার জগৎ জনমত গঠন ও সরকারকে আহবান জানিয়ে আসছিল। বলা হয়েছিল ইসি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, জাপান, আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তানসহ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে এদেশ থেকে বিপুল তথ্য লেনদেনের জন্য ই-মেইল প্রবর্তন জরুরি। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ই-মেইলের ব্যাপারে একটি মন্ত্রিসভা সাবকমিটি গঠন করে ত্বরিত প্যাকেট সুইচিংয়ের অনুরোধ জানাই।’
জানুয়ারি, ১৯৯৪ : ‘বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি সার্ভিস শিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনা এখনো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও হাইস্পিড ডাটা লিঙ্ক চ্যানেল প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করছে। ফাইবার অপটিকের জাতীয় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বঙ্গোপসাগরের তলদেশে স্থাপনের পরিকল্পনাধীন FLAG বিশ্ব ফাইবার অপটিক সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ : ‘কমপিউটার কাউন্সিলের কর্তাব্যক্তি একজন প্রকৌশলী। রাজধানীর সরকারি স্কুলে কমপিউটার প্রবর্তনের আলোচনাসভায় তিনি শিক্ষকদের বলেছেন, ‘কমপিউটার শয়তানের বাক্স। এটা থেকে দূরে থাকুন। কারণ, কমপিউটার চর্চার কারণেই ক্যালিফোর্নিয়া শহরে দাঙ্গার গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা বুঝে উঠতে পারি না, তিনি কোন সংস্কৃতির ধারক। এদেশে বায়ান্ন, একাত্তর, শস্য-বিপ্লব, কর্মসংস্থান যেমন সরকার সৃষ্টি করেনি, তেমনি তথ্যযুগ সরকারি স্থাপনা থেকে জন্ম নেবে না।’
মার্চ, ১৯৯৪ : ‘যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান এর ২৪ হাজার কোটি টাকার ডাটা এন্ট্রির কাজের একটি অংশ করিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশে এসে দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আনুষ্ঠানিক অভিপ্রায় জ্ঞাপনের দলিল সম্পাদন করেছে। অনিশ্চয়তা ও দুর্যোগের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ এভাবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার যখন উন্মোচন করেছে, তখন আমাদের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, ই-মেইলের অনুপস্থিতি ও সরকারের গরজের অভাবে এ কাজ ফিরে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর যদি এ ব্যাপারে সামান্যতম মনোযোগ দিত, তাহলে ৪ কোটি টাকার নয়, ৪০০ কোটি টাকার কাজ ধরে দশ হাজার তরুণ কাজে বসতে পারতো ’৯৪-র এই মার্চে।’
এপ্রিল, ১৯৯৪ : ‘আরেকটি বছর অতিক্রম করলো কমপিউটার জগৎ। এই একটি বছরে উচ্চতর কমপিউটারপ্রযুক্তি এগিয়েছে উন্নত বিশ্বে ৫০ বছর। পাশের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে বিশ বছর। আমরা এগুতে পারিনি একটি মাসও। বিশ্বের গতায়ু রাজনৈতিক মানচিত্রের সীমানা ভেঙ্গে একটি একক বিশ্ব পরিবার গড়তে অবিশাস্য দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট ও ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে প্রকল্প। আমরা এখনো সুখনিদ্রায় বিভোর।’
মে, ১৯৯৪ : ‘কমপিউটার জগৎ চতুর্থ বর্ষে উপনীত হলো। এ তিন বছরের অভিজ্ঞতা থেকেও সিদ্ধামেত্ম উপনীত হয়েছি, টেলিযোগাযোগ যখন কমপিউার, টিভি, ই-মেইলের সাথে যুক্ত হয়ে উঠেছে, তখন এ খাতটিকে সর্বোচ্চ জাতীয় অগ্রাধিকারখাত হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা ও অর্থনীতির জরামুক্তি অসম্ভব।’
জুন, ১৯৯৪ : ‘অর্থমন্ত্রী বাজেটের মূল অংশে বলেছেন, ‘স্বল্পমূল্যে টেলিযোগাযোগ সুবিধা ছাড়া আমরা কমপিউটারপ্রযুক্তি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারবো না এবং বৈপ্লবিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণও আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহকে টেলিফোন ব্যবস্থা নির্মাণ এবং ডাটা ট্রান্সমিশনের অনুমতি দেয়ার নীতি ঘোষিত হয়েছে বাজেটে। বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি, কমপিউটার, টেলিযোগাযোগ এবং অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা সম্পর্কে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের এ উচ্চারণ জাতিকে আশ্বস্ত করবে।’
জুলাই, ১৯৯৪ : ‘বিশ্বের বুকে এক কর্মবাদী সভ্যতায় মানুষ যখন জাগছে, তখন নতুন অর্থনীতির বাহন হয়ে উঠছে এই আধুনিক ও সুলভ যোগাযোগ। প্রযুক্তিকে ছড়িয়ে দেয়ার তাগিদে সমগ্র এশিয়া যখন স্পন্দমান তখন আমাদের তার কর্তৃপক্ষ ও সরকার এক চরম অক্ষমতায় দেশ ও জাতিকে স্থানু করে রেখেছে। সরকার টিঅ্যান্ডটি ও কিছু মেকী কোম্পানি একটা নতুন যুগের বিশাল কান্ডকে তাদের সঙ্কীর্ণ বন্ধ্যা নালীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে আনতে চেষ্টা করছে- এটা এক বেদনাদায়ক হাস্যকর প্রক্রিয়া।’
আগস্ট, ১৯৯৪ : ‘উন্নয়ন ও উত্তরণের অজস্র পথ ও পন্থার মধ্যে কমপিউটার, টেলিযোগাযোগ, অফিস অটোমেশনের সমন্বিত ইনফো পদ্ধতি সবচাইতে দক্ষ ও কার্যকর। এ ব্যবস্থা মগজের ওপর চাপ কমায়, জাতিকে বুদ্ধিমান ও শক্তিমান করে এবং জনগণকে সক্রিয় করে। সমগ্র বিশ্ব ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে বা তথ্যস্রোতের বিশ্বআবর্তে বিশ্বকে এক মহা রাজপথে এনে ফেলছে, তখন ই-মেইল ও গ্রাউন্ড স্টেশন বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ তার পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠতে পারে। বিশ্বের ১২ হাজার ডাটাবেস ও সুপার হাইওয়ের সাথে এ জাতিকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব করবে না সরকার, এ আশা করতে পারি।’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ : ‘আমরা তথ্যযুগের পদাতিক নবীন প্রজন্মের পদধ্বনি শুনছি। আমরা কমপিউটার নিমগ্ন শিশু সৈনিকদের মধ্যে একবিংশ শতাব্দী জয়ের স্বপ্ন রেখে তাদের প্রতি আমাদের ও জাতির অতুল স্নেহ ও ভালোবাসা জানাই এবং সমগ্র দেশে গ্রাম-শহর জনপদে তথ্যযুগের শিশু সৈনিকদের গড়ে তোলার অঙ্গীকার করি।’
অক্টোবর, ১৯৯৪ : ‘দ্রুত যোগাযোগের জন্য সব দেশে রয়েছে হাইস্পিড কমিউনিকেশন। এদেশবাসী বঞ্চিত সেটা থেকেও। কমপিউটার জগৎ এ যাবৎ প্রায় অর্ধডজন সাংবাদিক সম্মেলন করেছে, এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় ইদানিং লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গাবে কে? জনসভার পর জনসভায় জনগণের প্রতি যাদের দরদ মাইক দিয়ে আছড়িয়ে পড়ে, কে বুঝাবে তাদের, তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া আজ কোনো দেশই চিন্তা করতে পারে না উন্নয়নের কথা।’
নভেম্বর, ১৯৯৪ : ‘অবাধ বিশ্ববাণিজ্যের গ্যাট চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ফিরেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু এ মরণ ফাঁদের মধ্য থেকে বিজয়ীর মতো উদ্ধারের লাভের হাতিয়ার ‘ট্রেড পয়েন্ট’ গড়ে তোলার ব্যাপারে এ মন্ত্রী বা সরকারকে একটিবারও কথা বলতে শোনেনি জনগণ। উন্নত বিশ্বের ক্রেতারা কে, কখন, কোথায় আমাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো কিনতে আগ্রহী, প্রতি মুহূর্তে তা যাচাই করে সম্ভাব্য ক্রেতার সাথে যোগাযোগ ঘটানোর কমপিউটারাইজড ব্যবস্থাটা গড়ে তোলা যে অপরিহার্য, এটা ছাড়া অবাধ্য বাণিজ্য যে আমাদের উৎপাদকদের পণ্যকে ফেলে রেখে বিদেশী পণ্য আমাদের বাজার শুষে নেবে, তা বুঝবার মতো শক্তি আমাদের মধ্যে ছিল না। ডাটা প্রসেসিং শিল্পের ক্ষেত্রেও এ অজ্ঞানতার কর্তৃত্ব আমরা দেখেছি।’
ডিসেম্বর, ১৯৯৪ : ‘কমপিউটার জগৎ ডাটা এন্ট্রি, সফটওয়্যার শিল্প, ই-মেইল ও ট্রেডনেট প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিল। নয়া বাণিজ্যিক বিপ্লবে আমাদের পাট, চামড়া, সিরামিক, গার্মেন্টস শিল্প ইত্যাদি নানান রফতানিযোগ্য পণ্য নিয়ে যেহেতু বিশ্ববাজারে অনিবার্য প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে, সেহেতু বিপুল অর্থ ও সময় সাশ্রয়ী লাভজনক ইন্টারনেট যুক্ত হওয়ার বিকল্প দেখি না।’
জানুয়ারি, ১৯৯৫ : ‘বিগত বছরে দেশের প্রযুক্তিতে রাজনৈতিক অঙ্গনের হাজারো হতাশা-বঞ্চনার মাঝে দুয়েকটা আশার আলোও ঝিলিক দিয়েছে। সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের তথ্যাবলীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্কসমৃদ্ধ কমপিউটার সেল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। দেরিতে হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কমপিউটারায়ন এবং এইচএসসি ও এসএসসি পর্যায়ের শিক্ষাক্ষেত্রে কমপিউটার বিজ্ঞানের প্রচলনের পদক্ষেপ গ্রহণ আশার সঞ্চার করেছে। এ জন্য কমপিউটার জগৎ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ জানাচ্ছে।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ : ‘বাংলাভাষার জন্য আন্তর্জাতিক একটি তথ্য বিনিময় কোড তৈরির যোগ্যতা এদেশের অনেকের ছিল এবং আছে। কিন্তু সরকার সময়মতো কাজ না করায় এদেশ ভারতের কোড ও তার প্রযুক্তির নিচে চাপা পড়ার অবস্থায় উপনীত হয়েছে। মনীষাসম্পন্ন মানুষের বদলে বর্ণচোরা আমলাদের ওপর ভর করে সরকার জাতিকে পরাভবের পথে ঠেলে দিয়েছে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতির পাশাপাশি এ জাতির আপন বাংলাভাষার অহঙ্কার খুন করে এরা যখন একুশের নাম উচ্চারণ করে, তখন ধিক্কার উচ্চারণ হয়তো সমীচীন।’
মার্চ, ১৯৯৫ : ‘৬ কোটি ভোটারের নির্বাচনী পরিচয়পত্র তৈরির এক বিশাল ডাটাবেজ সৃষ্টির কাজে হাত দিতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রথা, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় তথ্যশুমারি এবং বিকাশমান তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য এ পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ পদক্ষেপকে সর্বান্তকরণে সমর্থন জানাতে গিয়ে আমরা একটি কারণে সংশয়ে ভুগছি এবং জাতীয় গুরুত্ববহ এ কাজের বিশালত্ব, তাৎপর্য এবং এর কারিগরি প্রায়োগিক দিক দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা কাজ ভাগবণ্টনের আগে এ কাজটি জাতীয়ভাবে সম্পাদন করার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ মহল, নির্বাচন কমিশন, আগ্রহী প্রতিষ্ঠান, কমপিউটার সমিতি ও পেশাজীবী বিশেষজ্ঞ মহলের মধ্যে একটি বৈঠক দাবি করছি। কারণ, এতে শুধু অর্থ ও কাজের প্রশ্ন জড়িত নয়- এর সাথে জাতীয় প্রযুক্তি, মেধা ও ক্ষমতার গুরুতর পরীক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত।’
এপ্রিল, ১৯৯৫ : ‘বিগত চারটি বছর ছিল কমপিউটার জগৎ ও কমপিউটার আন্দোলন প্রসারে জনগণের বিপুল সাড়া ও অগ্রগতির বছর। বিপরীতে এ চার বছর হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি আন্তর্জাতিক অবকাঠামোর সাথে জাতীয় অবকাঠামোর সংযোগ রচনা, লোকবল তৈরি ও তথ্যপ্রযুক্তির কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকার, প্রশাসন ও মন্ত্রিসভার শোচনীয় ব্যর্থতার বছর। আমাদের জনগণ দেখেছে, যুগসংক্রামিত্মর দায়িত্ব পালন না করে কদর্য সরোবরে ডুব দিয়ে সরকার ও প্রশাসন নিজেদের খুদকুঁড়া খুঁজছে, এতে গরল উঠছে দেশজুড়ে।’
মে, ১৯৯৫ : ‘টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সামাজিক অগ্রগতি পিছিয়ে পড়েছে দারুণভাবে। সরকার টিআ্যান্ডাটির স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে জনগণকে ইন্টারনেটের চাইতে ৯ থেকে ২০ গুণ বেশি খরচে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা রীতিমতো মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার আধুনিক ধারণার ও পরিপন্থী।’
জুন, ১৯৯৫ : ‘আমাদের জাতীয় উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও এর ওপর কিন্তু কায়েমী স্বার্থকে ব্যবসায় ও টুপাইসের লোভে কর্মসূচিকে বিকৃত কানাগলিতে পুরে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটা কম হচ্ছে বটে, কিন্তু প্রবণতাটি খুবই প্রবল। আমাদের নীতিনির্ধারকরা ধাপে ধাপে সামান্য থেকে উচ্চতর বাস্তবে যাবার নীতি গ্রহণ করলে এসব বিকৃতির বাহকরা সুযোগ পাবে না।’
জুলাই, ১৯৯৫ : ‘নির্বাচন কমিশন বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ না করে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, মুদ্রণ ও তথ্যগ্রন্থনার সমগ্র উচ্চাভিলাষী কাজটিকে ইতোমধ্যেই লক্ষ্যহীন ও সীমিত করে ফেলেছে। সরকার ৩০০ কোটি টাকার বিপুল বরাদ্দ দান করা সত্বেও নির্বাচন কমিশন মূল কাজের দশ ভাগের এক ভাগ নিজ দায়িত্বে গুটিয়ে ফেলেছে। আমরা মনে করি, ডাটাবেজে তথ্য গ্রন্থনা করে তা সংরক্ষণ করলে এই ক্ষতি খানিকটা কাটিয়ে ওঠা যাবে। ডাটাবেজ গড়ে তোলার একটা বিরাট সুযোগ যেন আমরা অবহেলায় না হারাই।’
আগস্ট, ১৯৯৫ : ‘২৪ আগস্ট জগৎ কাপিয়ে দশ কোটি ব্যবহারকারী ও ১৩০ বিলিয়ন ডলারের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে বদলে দিতে পিসির নতুন অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ৯৫ সারাবিশ্বে একযোগ ব্যবহার ও অপারেশনে আসছে। বিশ্বজুড়ে ব্যবহারের কোটি কোটি পিসির ৮০ শতাংশেই যেহেতু মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার হয়, সেহেতু নতুন শতাব্দী লাভের মতো কমপিউটার বিশ্ব উইন্ডোজ ৯৫ নিয়ে উৎসবমুখর। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি ও কমপিউটার বেচে যারা খায়, আশ্চর্য উইন্ডোজ ৯৫ নিয়ে তারা কোনো টু শব্দটি করেননি। কী নিদারুণ দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আটকা পড়েছে, তা এ ঘটনা থেকেও বোঝা যায়।’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫ : ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ বেশকিছু মৌলিক জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে একটি ঐকমত্য তৈরি করে তারপর রাজনীতির বিভেদ খেলা চলুক, এ দাবি আমরা জানিয়ে আসছি। কারণ, বিজ্ঞানরহিত অজ্ঞানতার যাত্রা গণমৃত্যু ও বিপর্যস্ত রাষ্ট্র ছাড়া আমাদের আর কিছুই উপহার দেবে না।’
অক্টোবর, ১৯৯৫ : ‘টিঅ্যান্ডটি কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুত আন্তর্জাতিক ভিস্যাট সার্ভিস এ বছরের ডিসেম্বরে চালু করলে একদিকে যেমন উচ্চগতিতে বিশ্বব্যাপী তথ্য লেনদেনের সুযোগ ঘটবে, অন্যদিকে বহুল আলোচিত ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে ইন্টারনেটের অনলাইন সুযোগ পাওয়া যাবে। ভিস্যাট সংযোগের পর ’৯৬-এর মাঝামাঝিতে ডাটা এন্ট্রিগুলো পুরোদমে শুরু করে ডিসেম্বরের মধ্যে যেনো বিশ্ব সফটওয়্যার বাজারে আমরা দৃপ্ত পদচারণা করতে পারি তার জন্য অবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে।’
নভেম্বর, ১৯৯৫ : ‘দেরিতে হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ কমপিউটার যুগে প্রবেশ করেছে। দেশের যুবসমাজ কমপিউটার শিক্ষার ওপর সর্বাধিক আগ্রহ প্রকাশ করছে। আমরা তরুণ কমপিউটার শিক্ষার্থীরা যেনো অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের মতো শিক্ষার সময়ে একটা কমপিউটারে মালিক হতে পারে, সে জন্য দেশের ব্যাংকগুলোকে শিক্ষার্থীদের সহজশর্তে ঋণ দিতে হবে। প্রাইম ব্যাংক এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেয়ায় আমরা তাদের স্বাগত জানাই। সফটওয়্যার শিল্পের বিকাশেও ঋণদান কর্মসূচির বন্দোবস্ত প্রয়োজন।’
ডিসেম্বর, ১৯৯৫ : ‘ইন্টারনেট ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা ও অনলাইন ইন্টারনেট সংযোগের অভাবের প্রেক্ষাপটে কমপিউটার জগৎ সব জন্য গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক, শুভানুধ্যায়ী অগ্রসর চিন্তার প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে নিয়ে জানুয়ারি, ’৯৬ সালে দেশব্যাপী ইন্টারনেট দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রযুক্তিপীঠ, ভার্সিটি শিক্ষক সংগঠনসহ বিপুলসংখ্যক আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাড়া পাচ্ছি আমরা। ‘ইন্টারনেট হাতিয়ার এই মুহূর্ত দরকার’-এ প্রশ্নে একটা গণভোট নিলেও নিঃসন্দেহে এ দাবি জয়লাভ করবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর নীরবতা দুঃখজনক। এর বিরুদ্ধে সচেতন মানুষ প্রতিবাদে উচ্চকিত না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।’
জানুয়ারি, ১৯৯৬ : ‘কমপিউটার জগৎ ইন্টারনেট সপ্তাহে বিজ্ঞান ও কমপিউটার প্রযুক্তির ওপর একটি সার্বজনীন ইন্টারনেট ইউজার গ্রুপ কমপিউটার-মডেম-টেলিফোন-চিঠিপত্রভিত্তিক অনলাইন তথ্য ও জ্ঞানকেন্দ্র ভার্সিটি ও জাতির জন্য উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, জাতির অগ্রগমনের সর্বাধুনিক পথটা কেবল নিঃসম্বল জ্ঞানতাড়িত মানুষকে বাঁধতে হবে কেনো? সরকার এত কিছু বোঝে, উত্তরণের মূল কাজটি বোঝে না কেনো? আশা করি এ সপ্তাহটিতে কমপিউটারকে কমিউনিকেশনের হাতিয়ারে পরিণত করতে সরকারও এগিয়ে আসবে।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ : ‘ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের আন্তরিকতায় কমপিউটার জগৎ আয়োজিত ৩০ জানুয়ারির ইন্টারনেট সপ্তাহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ইন্টারনেট সংক্রান্ত ইউজিসি কমিটির শ্রদ্ধেয় সদস্যবর্গ সর্বসম্মতিক্রমে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইন্টারনেট স্থাপনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। পরদিন ইউজিসির আনুষ্ঠানিক সভায় সে প্রস্তাব বিনা বাধায় পাস হয়। এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আগামী মার্চের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেটওয়ে স্থাপিত হবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ইন্টারনেটের বিস্ময়কর ভুবনে প্রবেশাধিকার দেয়া হবে, ধন্যবাদ ইউজিসিকে।’
মার্চ, ১৯৯৬ : ‘এদেশে মেধাবী কমপিউটারবিদ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে আমরা মরহুম বিজ্ঞানী মফিজ চৌধুরীর নামে যে কমপিউটার ক্যুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম, তার পুরস্কার সারাদেশের কৃতী শিশুদের হাতে তুলে দেয়ার সুযোগ গত প্রায় ৪ মাস ধরে আমরা পারছি না হরতাল, অবরোধ, অসহযোগের কারণে। রাজনীতিবিদদের কর্মকান্ড শিশুদের শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চাকে পর্যন্ত ক্ষমা করেনি। আমাদের এই রাজনীতিবিদরা সিভিল ও ননসিভিল প্রশাসনের নামে স্বাধীনতাউত্তর ২৫টি বছর ধ্বংস করে এখন দেশকে জাতিরাষ্ট্রের ভগ্নস্তূপে পরিণত করার কারবালাযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে।’
এপ্রিল, ১৯৯৬ : ‘আমরা আশা করবো, তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ এ যুগকে সমগ্র জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রূপায়ণের অঙ্গীকার দিয়ে রাজনীতিকরা ও দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারকে দেশের এ জনআকাঙ্ক্ষার সমীপবর্তী করবে। আমরা একদিন শঙ্কিত স্বরে ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’ বলে আওয়াজ তুলেছিলাম। আজ সারাদেশে ঘরে ঘরে তথ্যপ্রযুক্তির দুর্গ গড়ে উঠেছে।’
মে, ১৯৯৬ : যোগাযোগ যুগপৎ প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের হাত-পা বেঁধে রেখেছে টিঅ্যান্ডটি বোর্ড ও ক্ষমতার কিছু প্রকল্প ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ এদের ভার্চুয়াল কলোনি। এমন কিছু ব্যক্তিই বাংলাদেশে অগ্রগতির পথ আগলে বসে আছে ভূতের মতো এবং এ ভূতেরাই নানা রাজনৈতিক দলকে গোঁড়া বানিয়ে ক্ষমতার লড়াই লড়ে। প্রযুক্তি ও জাতীয় অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে বসে আছে যেসব শক্তি, তারাই এদেশের মূল সঙ্কট।’
জুন, ১৯৯৬ : ‘দেরিতে হলেও ইন্টারনেটের সাথে সংযোগের সুযোগ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিস্যাট ব্যবহারের অনুমতি দান এবং জুলাই থেকে দেশের প্যাকেট সুইচ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমরা টিঅ্যান্ডটি কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।’
জুলাই, ১৯৯৬ : ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেট অফলাইনের পর অনলাইনের প্রবর্তন হয়েছে। ইন্টারনেটকে সত্যিকারের জাতীয় অগ্রগতির বাহন করতে হলে, ইন্টারনেটের জন্যই হাজার হাজার দক্ষ মানুষ দরকার পড়বে। আর বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে জাতীয় শিক্ষাঙ্গনের সংযোগ পাবার জন্য জরুরি। এ দুই চাহিদাকে সামনে রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বা ভার্সিটির মাধ্যমে দেশের সব স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিকে অনলাইনে আনার রাষ্ট্রীয় নীতি, নেতৃত্ব ও বিনিয়োগ দাবি করছি আমরা।’
আগস্ট, ১৯৯৬ : ‘ভার্সিটিতে ইন্টারনেট না দিয়ে বৈধ অবৈধতার আলোঅাঁধারী কী খেলা চলছে, তা জাতীয় স্বার্থে অনুধাবন করুন। এ অন্ধকারের মধ্যে জাতিকে অগ্রসর হতে হবে, এ নির্মম ও করুণ উপসংহার টানতে এ সরকার ও জনগণকে বাধ্য করবেন না। জ্ঞানজগতের নাগরিকদের পরামর্শ নিয়ে একটা কর্মপরিকল্পনা স্থির করে সংসদকে বুঝান। প্রশাসন-উন্নয়ন শিক্ষাকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় এনে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে হবে।’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬ : ‘পাশের দেশ ভারতের প্রশাসন ও রাজনীতিতে কমপিউটারের ব্যবহার শুরু হয়েছে সেই রাজীব গান্ধীর সময় থেকেই। সম্প্রতি তাদের সাংসদদের জন্য কমপিউটার প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছে। এবং সাংসদরা তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেনো অন্তত একটি কমপিউটার দেন, সে নীতিও ঘোষিত হয়েছে। এ সূত্র ধরেই আমাদের সংসদ ও প্রশাসনে কমপিউটারের ব্যবহার আরো বাড়ানোর আবেদন করছি।’
অক্টোবর, ১৯৯৬ : ‘বাংলাদেশে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার প্রায় শতভাগ বাজার হাত করার জন্য পাশের দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এদেশে বিশদ অনুসন্ধান ও জরিপ চালাচ্ছেন। ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের মতো কমিপউটার পেরিফেরালস ও সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিকে প্রতিবেশী দেশের পণ্য ও লোকজনের উল্টো স্রোত এক বছরের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে বলে এখাতের শিল্পোদ্যোক্তা, বণিক ও পেশাজীবীরা শঙ্কিত। এ পরিস্থিতিটা সৃষ্টি হয়েছে বিগত সরকারগুলোর ‘আমরা প্রযুক্তিবিষয়ক এসব জটিল বিষয় বুঝি না’ বলে সরে দায়িত্ব এড়ানোর পরিণামে।’
নভেম্বর, ১৯৯৬ : ‘দেশের সরকার তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে, আর সরকারের সাথে তাল মেলাবে এনজিওগুলো-এটাই হওয়ায় উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে এর বিপরীত। সরকার যেন স্থবির আর এনজিওগুলো এগিয়ে যাচ্ছে দৃঢ় পদক্ষেপে। অকারণে এনজিও আতঙ্কে ভোগার সময় ফুরিয়ে এসেছে, এবার তাদের কাজ থেকে শেখার পালা।’
ডিসেম্বর, ১৯৯৬ : ‘পাশের দেশের স্কুলগুলো পর্যন্ত যখন ইন্টারনেটের আওতাভুক্ত হচ্ছে, সে সময় আমাদের দেশে কোনো ‘জাতীয় আইটি পলিসি’ পর্যন্ত হয়নি। এ পশ্চাৎপদতা আমাদের রাজনীতিবিদদের, নীতিনির্ধাকদের।’
জানুয়ারি, ১৯৯৭ : ‘প্রযুক্তি সম্পর্কিত আরেকটি সাবধান বাণী স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ধীরে ধীরে বছর গড়িয়ে আমরা এগুচ্ছি শতাব্দী পরিবর্তনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে। তবে ২০০০ সালের আগমনে কোনো প্রতিষ্ঠানের কমপিউটার যেন ‘তারিখ সংক্রান্ত জটিলতায়’ পড়ে অচল না হয়ে পড়ে সেজন্য এখন থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ : ‘একথা অনস্বীকার্য, সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে পারলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতটি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব রাখতে পারে। আমাদের এখন প্রয়োজন নীতিনির্ধারণে দূরদর্শিতা ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যদি তথ্যপ্রযুক্তির মতো বিশাল সম্ভাবনাময় খাতটি অবহেলিত থেকে যায়, যদি এখনই একটি সুচিমিত্মত তথ্যপ্রযুক্তি-নীতি প্রণয়ন করা না হয়, যদি তথ্য-অবকাঠামো নির্মানের নীতিনির্ধারকরা যথার্থ উদ্যোগ না নেন-তবে দেশের ‘হামাগুড়ি অর্থনীতি’ কখনোই দু’পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারবে না।’
মার্চ, ১৯৯৭ : ‘সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তার সরকার খুব শিগগিরই নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করবে, যার লক্ষ্য হবে কৃষি, শিল্প, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রসার এবং প্রতিষ্ঠা ঘটানো। আর প্রধানমন্ত্রীর এই প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের ঘোষণার ক’দিনের মধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশে ১২টি স্বায়ত্তশাসিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা করে দেশের স্থবির জরাজীর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থায় এক অভূতপূর্ব আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে স্বপক্ষের শক্তি হিসেবে মাসিক কমপিউটার জগৎ প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই যুগোপযোগী ও সময়োচিত সিদ্ধান্তকে জোর সমর্থন ও অভিনন্দন জানাচ্ছে।’
এপ্রিল, ১৯৯৭ : ‘ভাবতে অবাক লাগে, মনে হয় এই তো সেদিন ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’ স্লোগানকে সামনে রেখে পয়লা মে ’৯১ সালে যাত্রা শুরু করেছিল কমপিউটার প্রযুক্তি বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথম নিয়মিত পত্রিকা ‘কমপিউটার জগৎ’। শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রথাগত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যেই আবদ্ধ থাকেনি এ পত্রিকাটি, কমপিউটার নামের যন্ত্রটিকে জনগণের কাছে বিলাসদ্রব্যের পরিবর্তে কর্মব্যস্ত জীবনের প্রাত্যহিক অনুষদ হিসেবে পরিচিত করে তোলার জন্য এগিয়ে গেছে প্রথাবদ্ধ জার্নালিজমের বাঁধ ভেঙ্গে- নিজ দায়িত্ব ও খরচে সাংবাদিক সম্মেলন, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা আর প্রদর্শনীর আয়োজন করে বোদ্ধামহলের স্বীকৃতি লাভ করেছে- এটি শুধু একটি পত্রিকাই নয়, বরং দেশে কমপিউটারপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ক্ষেত্রে একটি চলমান আন্দোলন।’
মে, ১৯৯৭ : ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’-এর সাথে সাথে ‘শিশুদের হাতে কমপিউটার চাই’ স্লোগানটিও আজকের প্রেক্ষাপটে অধিক গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ করে। মাইক্রোসফটের ‘Catch Them Young’-এর মতো বাংলাদেশ থেকে ‘Get Us Young’ স্লোগানটি সামনে রেখে আমাদের শিশু প্রতিভাদের হাতে কমপিউটার ও সফটওয়্যার তুলে দিয়ে তাদের প্রতিভা বিকাশে এগিয়ে আসুন।’
জুন, ১৯৯৭ : ‘আর ক’দিনের ভেতরেই বাজেট ঘোষণা দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে নতুন সরকারের কাছে মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর আবারো একটি পুরনো আবেদন থাকবে- জনগণের হাতে সাশ্রয়ী দামে কমপিউটার দেয়ার ব্যবস্থা করুন এবং দেশেও যেনো একটি সুসংহত কমপিউটার শিল্প গড়ে ওঠে সে পদক্ষেপ নিন।’
জুলাই, ১৯৯৭ : ‘১২ জুন জাতীয় সংসদে ঘোষণা করা হয়েছে ’৯৭-৯৮ অর্থবছরের বাজেট। আমাদের জানতে ইচ্ছে করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে সরকার কতটুকু সচতন? প্রাক-বাজেট মাসগুলোতে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতে অবশ্য এমন ধারণা জন্মেছিল যে, সরকারের বোধ করি এ ব্যাপারে সচেতনতার কমতি নেই। তবে অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত বাজেট অবশ্যই আমাদের সে ‘ভুল ধারণা’ বেশ সাফল্যের সাথে ভেঙ্গে দিয়েছে। এবারের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তিপণ্যের ওপর কর আরোপের আগে অর্থমন্ত্রী ব্যাপারটি নিয়ে কোন কোন সংস্থার সাথে আলোচনা করেছেন, সেটিও আমাদের জানতে ইচ্ছে করে।’
আগস্ট, ১৯৯৭ : ‘বিনোদন ও রাজনীতিকেন্দ্রিক অসংখ্য পত্রিকা বাজারে থাকা সত্ত্বেও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক ১২/১৩টি পত্রিকা বর্তমানে প্রকাশিত হচ্ছে। মাত্র ৭ বছরে এ পরিবর্তন জনগণের রুচি-মনন এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের এক বলিষ্ঠ সূচনা বলেই আমরা মনে করি। আমরা আনন্দিত যে, অবশেষে সচেতন হতে শুরু করেছে এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মানুষ। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে তথ্যপ্রযুক্তির জাদুকরী সম্ভাবনার কথা এরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে। এরচাইতে বড় প্রাপ্তি আমাদের কাছে আর কী হতে পারে?’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ : ‘আমাদের সরকার কমপিউটার শিক্ষিত জনবল তৈরি এখনো ভালো করে শুরুই করতে পারেনি। এ দেশে জনবল তৈরি শুরু হবে কবে, কবেই বা সরকার বুঝবে বিশ্বব্যাপী দক্ষ জনশক্তির বিপুল চাহিদা রয়েছে, আর কবেই বা সম্ভাবনাময় বাজার ধরার জন্য তৎপর হবে- তার কোনোটাই আমাদের জানা নেই।
অক্টোবর, ১৯৯৭ : ‘কমপিউটারায়নের অবস্থা নাজুক হওয়া সত্ত্বেও এদেশে কমপিউটারের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ খুবই আগ্রহী। এ আগ্রহের প্রকাশ ঘটে তখন, যখন একজন মধ্যবিত্ত বাবা তার সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও তার সন্তানকে একটা কমপিউটার কিনে দেন। কিন্তু গুটিকয়েক অসাধু কমপিউটার ব্যবসায়ীর জন্য হয়তো কখনো তাকে হতাশ হতে হয়, যখন সে প্রচারিত ও ঘোষিত সেবা পায় না। সম্প্রতি দেশে এমন কিছু ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বর্তমানে কিছুসংখ্যক ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারও নানাভাবে জনগণকে প্রতারিত করছে। আমাদের কমপিউটার শিল্প এখন বিকাশমান। এ মুহূর্তে কমপিউটার নিয়ে প্রতারণা হলে তা ব্যাকফায়ার করবে।’
নভেম্বর, ১৯৯৭ : ‘সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ও কমপিউটারভিত্তিক সচেতনতা শুরু হয়েছে বলেই কিন্তু আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সে দায়িত্ববোধ থেকেই আমরা এবারে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে। বস্ত্তত প্রায় ৭৮ লাখ বেকারের এই দেশটিকে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার পথে পরিচালিত করতে চাইলে ‘প্রযুক্তি-অশিক্ষিত’ জনগোষ্ঠীকে ‘প্রযুক্তি-প্রশিক্ষিত’ লোকবলে রূপান্তরের কোনো বিকল্প নেই।’
ডিসেম্বর, ১৯৯৭ : ‘দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দিন দিন যত বেশি সম্ভাবনা ও এর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, বোধ করি তত বেশি বাড়ছে একে নিয়ে অসাধু প্রবণতা। কমপিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে যুগ-প্রাচীন পাঠক্রম অনুযায়ী শিক্ষাদান, কমপিউটার বিপণিগুলোর পুরনো যন্ত্রাংশ গছিয়ে দেয়া- এসবেরই কিছু খন্ড চিত্র।’
জানুয়ারি, ১৯৯৮ : ‘নতুন একটি বছর শুরু হলো। বাংলাদেশে যারা কমপিউটারপ্রযুক্তির সাথে যুক্ত তাদের জন্য অনেক আশা নিয়ে এসেছে ১৯৯৮। কারণ, বিগত বছরের শেষের দিকে কমপিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে দেশে। ওইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যদি আশানুরূপ পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে বাংলাদেশ এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শিগগিরই বিশ্বমানে পৌঁছাতে পারবে বলে আমরা আশা রাখি।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮ : ‘এখন যখন বাংলাদেশেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম শক্তিশালী শিল্পখাত গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে তখন কমপিউটার তথা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিল্পখাত এবং এর প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। গত ৪ জানুয়ারি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সফটওয়্যারের ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক কমানোর এবং কমপিউটার ও হার্ডওয়্যারের ওপর ৫% শুল্ক কমানোর। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে কমপিউটারের দাম খুব একটা কমবে না। কাজেই কমপিউটারের মূল্য কমানোর এবং সফটওয়্যার শিল্প রফতানিমুখী করার জন্য গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনঃমূল্যায়ন প্রয়োজন।’
মার্চ, ১৯৯৮ : ‘তথ্যপ্রযুক্তির দুয়ারে আমাদের নিজস্ব বাংলাভাষা ক্রমেই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়ছে। কমপিউটারে বাংলা তথ্য কোড হিসেবে আইএসও-কে ভারতের আসাম রাজ্যের অহমিয়া মিশ্র বাংলা কোড গৃহীত হয়েছে। তাদের উইন্ডোজ এনটি সফটওয়্যারের ভার্সন ৬.০-এ অহমিয়া বাংলা যুক্ত করতে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, অচিরেই এ ধরনের অন্যান্য আন্তর্জাতিক সফটওয়্যারেও এ ধরনের বাংলা কোড ব্যবহার হবে, ফলে বায়ান্নর ভাষা শহীদের সন্তানেরা কমপিউটার বিশ্বে ভিনদেশীয় বাংলা কোডে তথ্য বিনিময় করতে বাধ্য হবে- এ লজ্জা আমরা কোথায় লুকাবো?’
এপ্রিল, ১৯৯৮ : ‘সময়ের পরিক্রমায় এরই মাঝে কেটে গেছে ৭টি বছর। তবে আমরা কিন্তু মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হইনি আমাদের অঙ্গীকার, স্লোগান ও সংগ্রামের কথা। অজ্ঞানতা আর অহেতুক আশঙ্কার অচলায়তন ভেঙ্গে জনগণকে তথ্যপ্রযুক্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার সংকল্প নিয়ে আমরা যে যাত্রা শুরু করেছিলাম, আজো তাতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি।’
মে, ১৯৯৮ : ‘এখন সরকারের উচ্চতর নীতিনির্ধারক মহল উপলব্ধি করেছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ছাড়া একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে না। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ হাইস্পিড ডাটা ট্রান্সমিশন, অত্যাধুনিক ইন্টারনেট যোগাযোগ এবং সুলভে কমপিউটার প্রাপ্তি নিয়ে সমস্যা আছে। অথচ অন্যান্য সার্ক দেশ যখন উদ্যোগ নেয়, তখন থেকে উদ্যোগী হলে এ অবস্থা হতো না।’
জুন, ১৯৯৮ : ‘বহুদিন যাবৎ বাংলাদেশে কমপিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি মেধার বিচ্ছুরণ দেখে এসেছি আমরা। ’৯২ সালে কমপিউটার জগৎ আয়োজিত প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় রুম্মান, মিশো, প্রশ্ন, উচ্ছ্বাস, মনির-এর মতো অসাধারণ মেধাবী কিশোর ও বালকদের আবির্ভাব দেখেছে বাংলাদেশ। এদের অনেকের ঘরেই কমপিউটার ছিল না। মিশো আজ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও বাংলাদেশের ইতিহাস সমগ্রের ওপর অসাধারণ সফটওয়্যার তৈরি করছে এসএসসি পাস করার আগেই। তার ভবিষ্যত যতই বৃহত্তর হবে, ততই বাংলাদেশ গভীর বেদনার সাথে জানবে, মিশো উচ্চদামের কারণে সমগ্র কৈশোরে একটি নিম্নমানের কমপিউটারও কিনতে পারেনি।’
জুলাই, ১৯৯৮ : ‘বাংলাদেশে কমপিউটারভিত্তিক শিল্পখাত গড়ে উঠতে কতদিন লাগবে? প্রশ্নটি সেসব লোককে ভাবাচ্ছে যারা সরকারি আনুকূল্য ছাড়াই এদেশে প্রাথমিকভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। গত ৮ বছর ধরে এরা শুধু অভিজ্ঞতার তিক্ত আস্বাদই পেয়েছেন। এক বছরও হয়নি এরা কিছু সুখবর পেতে শুরু করেছেন। এখন নতুন উদ্যোক্তারাও সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইছেন। অর্থাৎ অনুকূল একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এ দাবি করা যাচ্ছে না।’
আগস্ট, ১৯৯৮ : ‘বর্তমান যুগ কমপিউটারের যুগ। আমাদের সৌভাগ্য, আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররাই কমপিউটার সায়েন্স পড়ছে। আমরা সবচেয়ে উপযুক্ত সময়ে আমাদের সবচেয়ে উপযুক্ত মেধাগুলোকে সবচেয়ে উপযুক্ত একটি সাবজেক্টে পাচ্ছি। পৃথিবীর অনেক দেশের অবস্থাই কিন্তু এমন নয়। তবুও মনে রাখতে হবে এটা বাংলাদেশ- স্বদেশের আলোতে প্রতিভা বিকাশের ভাগ এদেশের সন্তানেরা পায় না। বাংলাদেশে বাস করে কেউ ফজলুর রহমান খান হতে পারেনি। পেন্টিয়াম ডিজাইনারদের এ দেশ ধরে রাখতে পারে না। রিয়াজ হকরাও দেশের মায়া কাটান বড্ড তাড়াতাড়ি।’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮ : ‘বহু বাক-বিতন্ডার পর এখন পর্যন্ত আমরা যা পেয়েছি, একটি ন্যাশনাল কীবোর্ড কোড সেট। বিডিএস-১৫২০। এই কোড সেটকে বিভিন্ন সফটওয়্যারের উপযোগী করে তোলার জন্য দরকার একটি ইন্টারফেস ডিজাইন। নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, সে ডিজাইন এখনো প্রকল্প প্রস্তাবের গন্ডি পেরিয়ে আলোর মুখ দেখেনি। বহু দেন-দরবার করে আইএসও’র ইউনিকোড নামের কমিটির সদস্যদের দয়ায় ১২৮ অক্ষরের একটি অক্ষর-ব্লক পাওয়া গেছে। অথচ উপযুক্ত ইন্টারফেস না থাকায় সে ব্লকেও কোনো বাংলা কোড পাঠানো যাচ্ছে না। সেই সাথে বাংলাদেশের বাংলা আজো কমপিউটার বিশ্বে সর্বজনগ্রাহ্যতা পাচ্ছে না। অবশ্য উপরওয়ালারা এখনো হবে-হচ্ছে বলে চলেছেন।’
অক্টোবর, ১৯৯৮ : ‘এই শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যা হয়ে গেল, এ বন্যার সময়ে ও পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে খুবই সীমিত। অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোই রয়ে গেছে তথ্যপ্রযুক্তির আওতার বাইরে। শুধু আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, পানির উচ্চতার তথ্য বিশ্লেষণ এবং বিশেষ একটি ওয়েবসাইট খুলে বিশ্ববাসীকে সাহায্যের আবেদন জানানোই যে তথ্যপ্রযুক্তির সব কাজ নয়, এটাও এদেশের অনেক নীতিনির্ধারক বুঝতে পারেননি। এখনো পারছেন না।’
নভেম্বর, ১৯৯৮ : ‘আমরা মনে করি, বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যবহারকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি কীবোর্ড প্রমিত হিসেবে ঘোষণা করা এবং ইউনিকোড বাংলার জন্য নির্ধারিত স্লটে আমাদের বাংলা ভাষার কোডসেটকে প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। অন্যথায় এ গাফিলতির জন্য আমাদের অপূরণীয় সীমাহীন দুর্ভোগের মোকাবেলা করতে হবে।’
ডিসেম্বর, ১৯৯৮ : ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, সম্প্রতি ডাক ও তার মন্ত্রণালয় ই-মেইল ব্যবহারের ওপর ৫% অতিরিক্ত কর ধার্যের নির্দেশ দিয়েছে। এর ফলে আগে জারি করা ১৫%সহ এখন থেকে ই-মেইল ব্যবহারকারীদের ২০% হারে কর দিতে হবে। আইএসপিগুলো একজন গ্রাহকের ই-মেইল ও ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের চার্জ একই সাথে ধরে থাকে। এর ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছাত্র ও গবেষকদের ওপর এই বাড়তি কর কার্যকর হচ্ছে, তথ্য বিনিময় পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর হওয়ায় রফতানিমূলক ডাটাএন্ট্রি শিল্প ও মাল্টিমিডিয়া ডেভেলপমেন্ট আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।’
জানুয়ারি, ১৯৯৯ : ‘দেশে আজ কমপিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়েছে। এখন প্রয়োজন এ ভূমিতে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে মেধার সযত্ন লালন। আর সেজন্য চাই সর্বোচ্চসংখ্যক কমপিউটার পেশাজীবী তৈরির সর্বাত্মক পদক্ষেপ। বোদ্ধা, গুণীজন ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহবান রইলো বিষয়টি ভেবে দেখার।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯ : ‘বছরের পরিক্রমায় আবার এসেছে ভাষা আন্দোলনের মহান মাস ফেব্রুয়ারি। ভাষার সম্ভ্রম রক্ষার যে গুরুদায়িত্ব আমাদের ওপর ছেড়ে গিয়েছিলেন আমাদের পূর্ব-প্রজন্মের ভাইয়েরা, সচেতনতা ও সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবে সে সম্ভ্রম রক্ষায় আমরা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কমপিউটার জগৎ সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে ইউনিকোডে বাংলাভাষার ব্যাপারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে সোচ্চার ও একাট্টা করতে- কিন্তু আমাদের সূচিত সে স্ফুলিঙ্গ নীতিনির্ধারকদের হিমশীতল চেতনায় কোনো বহ্নিশিখাই তৈরি করতে পারেনি।’
মার্চ, ১৯৯৯ : ‘এদেশে কমপিউটারের সৃষ্টিশীল কাজগুলো আপন নামে সংরক্ষণের কোনো মেধাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এখন দিন যতই যাচ্ছে, ততই এক শোক মূর্ছনার মতো এই শূন্যতা মর্সিয়ার মতো যুগের বিলাপ ও কান্নার শোর হয়ে দেখা দিচ্ছে। ছোট্ট মিশোরা তাদের সমগ্র প্রচেষ্টা দিয়ে যে আশ্চর্য প্রোগ্রাম লিখে এনেছিল এবারের মেলায়, তাও কপি হয়ে যাচ্ছে বিনা উল্লেখে। এই চৌর্যবৃত্তির কাছে সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে বার বার এবং নিঃশেষে কোরবান হতে বলার মধ্যে কোনো যুক্তি বুদ্ধি খুঁজে পাই না।’
এপ্রিল, ১৯৯৯ : ‘কমপিউটার জগৎ কমপিউটার শিক্ষা ও কমপিউটারের ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম থেকেই লক্ষ্য স্থির করে এগোতে হবে। প্রতি পদক্ষেপে মনে রাখতে হবে, আমাদের আর্থিক সচ্ছলতার বিষয়টি। গরিবের ঘোড়া রোগ নয়, সীমিত সম্পদের সুষ্ঠুতম ব্যবহারেই কেবল সীমা-উত্তরণ ঘটানো সম্ভব, তাই এক্ষেত্রে বে-হিসেবী হলে চলবে না।’
মে, ১৯৯৯ : ‘আজ থেকে আট বছর পূর্বে কমপিউটার জগৎ প্রকাশনার শুরু। প্রত্যেকটি সংখ্যায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এক বা একাধিক বিষয়ে বিভিন্ন সমস্যা-সম্ভাবনার কথা কমপিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে খুবই গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে আবেগের কোনো স্থান নেই। বাস্তবতার নিরিখে সবকিছু মূল্যায়ন করতে হয়। তাই গতানুগতিক সাংবাদিকতার চেয়ে ভিন্ন ধারার এই প্রকাশনার কাজ কষ্টসাধ্য, তারপরও গর্ববোধ হয় এই জন্য যে, গতানুগতিক সাংবাদিকতা পাল্টিয়ে আমরা দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে এক নতুন ধারার কমপিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিকতার সৃষ্টি করতে পেরেছি।’
জুন, ১৯৯৯ : ‘দেখতে দেখতে আবার আরেকটা বাজেটের সময় ঘনিয়ে এলো। কমপিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও কর প্রত্যাহারের পর দেশের ছাত্রছাত্রী, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের ভেতরে কমপিউটারের ব্যাপারে যে প্রবল আগ্রহ ও সচেতনতা তৈরি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে এবারের বাজেট সরকার ও জনগণের উভয়ের কাছেই নতুন গুরুত্ব বহন করে।’
জুলাই, ১৯৯৯ : ‘১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের বাজেট সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। একুশ শতকে প্রবেশের অর্থনৈতিক চাবিকাঠি থাকার কথা ছিল এ বাজেটে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যাপারে ন্যূনতম দিকনির্দেশনাহীন এ বাজেট কি আদৌ সে চাবিকাঠি ধারণ করতে পেরেছে? আমাদের প্রস্তাব ছিল কমপিউটারের ওপর ধার্য করা অবচয় হার উচ্চহারে ধার্য করার।’
আগস্ট, ১৯৯৯ : ‘বাস্তবতার রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত আত্মঘাতী কলহে লিপ্ত এখন বাংলাদেশ। চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনার একেকটি ট্রেন। ডাটা এন্ট্রি ওয়াইটুকে, ইউরো মানি কনভার্সন-এর চলমান যন্ত্র সকেট। দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশ। উদ্যোক্তারা সরকারকে বুঝাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে ভবিষ্যতে অর্থনীতির কতটুকু সুফল বয়ে আনতে পারে। আর সরকার উদ্যোক্তাদের কাছে জানতে চাইছে ঠিক কতটুকু, কবে দেয়া হলে সত্যিই কী পরিমাণ রাজস্ব সরকারের কোষাগারে জমা পড়বে। এই আত্মঘাতী বাক্যালাপের ফাঁক গলিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। পিছিয়ে পড়ছে গোটা দেশ।’
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯ : ‘আইডিবি ভবনে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে হার্ডওয়্যার ব্যবসায় ও সফটওয়্যার বিনির্মাণের প্রথম একীভূত স্থাপনা ‘কমপিউটার সিটি’। বিসিএস কর্মকর্তাদের একান্ত পরিশ্রমের সফল এ কার্যক্রমের শুরু উপলক্ষে ১১-২৫ সেপ্টেম্বর কমপিউটার মেলা চলবে আইডিবি ভবনে। পূর্ণাঙ্গ সফটওয়্যার পার্ক না হওয়া পর্যন্ত এ ভবনেই প্রাথমিক অবস্থায় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট পার্ক স্থাপনের প্রস্তাব কার্যকর করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে প্রকাশ। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গনে এ ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।’
অক্টোবর, ১৯৯৯ : ‘বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবিত কপিরাইট আইনটি সম্প্রতি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়ায় দেশের কমপিউটার শিল্পসংশ্লিষ্ট সবার দীর্ঘদিনের একটা দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। কমপিউটার জগৎ প্রথম থেকেই মেধাস্বত্ব আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু নানা অজুহাতে আইনটি সংসদ পর্যন্ত পৌঁছেনি। অবশেষে যখন দেশের কার্যকর আইনে পরিণত হতে যাচ্ছে, তখন আমাদের অবশ্যই স্বাগত জানানোই স্বাভাবিক।’
নভেম্বর, ১৯৯৯ : ‘বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও উন্নয়নের কাজের সহযোগিতার জন্য একটি সুপার কমপিউটার অচিরেই বাংলাদেশে আসছে। এ ধরনের একটি দাবি কমপিউটার জগৎ অনেক আগে থেকেই করে আসছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী কমপিউটার নতুন নয়। আণবিক শক্তি কমিশনের মেইনফ্রেমটি ছিল দক্ষিণ-এশিয়ায় ষাটের দশকের প্রথমার্থে বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের সম্পদ। শক্তিশালী কমপিউটারের যথাযথ ব্যবহারে আমরা অনেক কিছুই অর্জন করতে পারতাম। তা আমরা পারিনি।’
ডিসেম্বর, ১৯৯৯ : ‘তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে রাজনীতিবিদেরা দেশের মানুষের কাছে আরো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন। হতে পারেন রাজনীতির রোল মডেল। যেমনটি হয়েছেন ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের তথ্যপ্রযুক্তিপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু। তার প্রয়াসে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগমন আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমপর্যায়ে। আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সে উপলব্ধি কবে আসবে, সেটাই এখন ভাববার বিষয়। সে উপলব্ধি যত তাড়াতাড়ি আসবে ততই মঙ্গল।’
জানুয়ারি, ২০০০ : ‘শুধু জনসচেতনতা নয়, নতুন মিলিনিয়ামের শুরুতে দেশের তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামোর ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। হাইস্পিড ডাটা ট্রান্সমিশনের সুবিধাসম্পস্ন একটি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক আমাদের অনেক দিনের দাবি। এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। দুঃখের বিষয়, এর কোনোটিই বাস্তবায়নের প্রথম ধাপটিও পেরোতে পারেনি। নতুন মিলিনিয়ামে আমরা অবশ্যই এসব অবকাঠামোর বাস্তবায়ন দেখতে চাইব।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০০ : ‘কমপিউটারের ক্ষেত্রে আমাদের অর্ধেক কাজ বাকি। এখনো হরফ বিন্যাসের ক্ষেত্রে আমরা স্নাতক-এর সাক্ষাৎ পাইনি। বাংলা ও ভারত এক্ষেত্রে সমান প্রতিযোগী। এ প্রতিযোগিতার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে বাংলা দাবি এখন নিছক খন্ড ত(ৎ)-এর রূপ অবয়বকে চিহ্নিত করেছে। এক্ষেত্রে ভালো একটা নিরসন ঘটে গেলে তা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলেরই উপকার সাধন করতে পারে। কারণ, হরফ বিন্যাসে ভারতের সমগ্র বিন্যাস মেনে নিয়ে বাংলাদেশ শুধু খন্ড ত-এর ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছে। আমরা চলমান এ বিগ্রহের একটা সমাধান পেতে চাই।’
মার্চ, ২০০০ : ‘ভিস্যাট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিটিটিবির নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে নেয়ার বিষয়টি ডাটা এন্ট্রি ও সফটওয়্যার শিল্প বিকাশে কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ কমানোর একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। মূলত এরূপ শিল্প বিকাশে এখনো আনুষঙ্গিক এমন অনেক কাজ রয়েছে, যা বিটিটিবির ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। তাই সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থেই নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে সবার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’
এপ্রিল, ২০০০ : ‘আজ থেকে দীর্ঘ ৭ বছর আগে টেলিযোগাযোগ ফাইবার অপটিক ক্যাবলের অপরিসীম ক্ষমতা কাজে লাগানোর সে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব কমপিউটার জগৎ দিয়েছিল, এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও সরকার শেষ পর্যন্ত এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে উদ্যোগী হয়েছে বলে আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা ফাইবার অপটিক ও ভিস্যাট সমন্বিত টেলিকাঠামো চাই।’
মে, ২০০০ : ‘বিশ্বজনীন অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পাল্টে দেবে গোটা বিশ্ববাসীর জীবনযাত্রা। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এখন থেকেই এ প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য উদ্যোগী হন, তাহলে ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী সুফলও আমরা ঘরে ওঠাতে পারবো। যেমন পারছে শুধু উন্নত দেশগুলোই নয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ।’
জুন, ২০০০ : ‘আমাদের দেশে অবিলম্বে একটি আইটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এই মন্ত্রণালয়ে বিসিসিসহ সংশ্লিষ্ট দফতর ও বিভাগসমূহ রাখা যেতে পারে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আইটিসংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডকে এই মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সরকারের আইটি পরিকল্পনা, আইটির সাথে আইনের পরিবর্তন, আইটি প্রকল্প যেমন আইটি ভিলেজ, আইটি পার্ক, সফটওয়্যার পার্ক, শিক্ষায় কমপিউটারের প্রয়োগ বা স্কুল-কলেজে কমপিউটার শিক্ষা চালুকরণ প্রকল্প, বিশেষ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সরকারের আইটি চাহিদা নিরূপণ, আইটিসংশ্লিষ্ট টেলিকম প্রকল্প যেমন উপগ্রহ ও ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপন এবং বেসরকারি উদ্যোগের সাথে সরকারের সমন্বয়, সবকিছুর জন্যই এই মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পালন করতে পারে। এটি হতে পারে একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস।’
জুলাই, ২০০০ : ‘তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে সংসদ সদস্য ও অর্থনীতিবিদ পর্যায়েও সচেতনতা শুরু হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের নিচ দিয়ে ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপনের জন্য বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি বলে অর্থনীতিবিদরা যেমন সরকারের সমালোচনা করছেন, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারদলীয় সদস্যরাও সংসদে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রেখেছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত, উদ্যোগ, আলোচনা-সমালোচনা সবকিছু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। তার পরও অদ্ভুত জড়তায় ভুগছে বাংলাদেশ। অবস্থা দেখে মনে হয়, আন্তরিকতা ও নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। নইলে থ্রাস্ট সেক্টরে থ্রাস্ট আসতে দেরি হবে কেনো?’
আগস্ট, ২০০০ : ‘ডিজিটাল ডিভাইড। আইটি গ্যাপ। সহজ ভাষায় প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিভক্তি। বিত্তবান-বিত্তহীন, ক্ষমতাহীন-ক্ষমতাশীলদের মধ্যে বিভক্তি। সমাজের একটি অংশ প্রযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, প্রযুক্তি ব্যবহারে সমর্থবান। অপর অংশ প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত। এ দুয়ের অংশের মধ্যে দূরত্বই ডিজিটাল ডিভাইড। এ ডিজিটাল ডিভাইড রোধে সচেতন মানুষ চাই।’
সেপ্টেম্বর, ২০০০ : টেলিযোগাযোগের বিকাশ ও উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত বিভাগটি শুরু থেকেই দেশের এক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে আসছে। ফ্যাক্স মেশিনের আমদানি ও ব্যবহারের ওপর খবরদাবি থেকে শুরু করে আইএসপি হয়ে এটি আজ ইন্টারনেটপ্রযুক্তি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সম্ভবত সে কারণে এ সংস্থার সাম্প্রতিক এক বার্ষিক প্রতিবেদনে VOIP প্রযুক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে শত কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতির কারণ হিসেবে। দূরভিসন্ধিমূলক এই হিসেবের মারপ্যাঁচটি অবশ্য শেষ পর্যন্ত সংস্থার সততাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে।’
অক্টোবর, ২০০০ : ‘বাংলাদেশে কমপিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা আয়োজনের পথিকৃৎ কমপিউটার জগৎ দেশের প্রথম কমপিউটার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে। অত্যন্ত আনন্দের কথা, দীর্ঘ দু’বছর বিরতির পর সরকার ও বুয়েটের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্যোগে আবার আয়োজিত হচ্ছে জাতীয় কমপিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা। কমপিউটার জগৎ এ ধরনের উদ্যোগকে শুধু স্বাগতই জানায় না, পাশাপাশি এটুকু আশা করে যে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে আরো ঘন ঘন সারাদেশে আয়োজিত হবে প্রোগ্রামিংসহ বিভিন্ন ধরনের কমপিউটারসংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতা। আর মিডিয়ার কল্যাণে ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে কমপিউটার শিক্ষিত জনবল তৈরির একটি সুস্থ সংস্কৃতি। অনাগত সে সুদিনের প্রতীক্ষা এখন আমাদের।’
নভেম্বর, ২০০০ : ‘এ দশকের শুরু থেকেই আমরা বার বার জোরালোভাবে বলে আসছিলাম বাংলাদেশ পারে এর কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আনতে। কলসেন্টার, ডাটা ট্রান্সক্রিপশনের মতো সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি তৈরির জন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় দিক থেকেই উদ্যোগের সূচনা ঘটা উচিৎ। ইন্ডাস্ট্রিই বাংলাদেশের জনগণের তৃণমূল পর্যায়ে সম্পৃক্ত করতে পারে তথ্যপ্রাযুক্তিক বিপ্লবের সাথে। আমরা সর্বান্তকরণে এ ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই।’
ডিসেম্বর, ২০০০ : ‘তথ্যপ্রযুক্তির জগতে একটি নতুন থিম বা আইডিয়ার প্রচলন ঘটেছে। সেটি হলো ‘আইটি ফর কমন ম্যান’। সাধারণ মানুষের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি। কমপিউটার, ইন্টারনেট আর ই-কমার্স যেনো শুধু সমাজের বিত্তবান মানুষের প্রযুক্তি না হয়ে ওঠে। এ প্রযুক্তিকে পৌঁছে দিতে হবে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে।’
জানুয়ারি, ২০০১ : ‘মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত এবং জাতীয় সংসদের ২০০১ সালের প্রথম অধিবেশনে সাধারণ আলোচনার জন্য নির্ধারিত আমাদের ‘শিক্ষানীতি ২০০১’-এ শেষ পর্যন্ত ‘তথ্যপ্রযুক্তি’ যোগ করা হয়েছে। যদি আমরা ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’- এই প্রবাদে তুষ্ট হই, তবে বিষয়টি খুশির। নতুন সংযোজিত একটি অধ্যায়ে কমপিউটার শিক্ষা থ্রাস্ট সেক্টরের গুরুত্ব পেতে যাচ্ছে। এ খবরে আমরা আনন্দিত হতে পারি। কমপিউটারের এটি দ্বিতীয় থ্রাস্ট সেক্টর। প্রথমটি সফটওয়্যার। নিঃসন্দেহে এটি এক পরম সুসংবাদ।
ফেব্রুয়ারি, ২০০১ : ‘কমপিউটার জগৎ পাঠক-সাধারণের নিশ্চিত জানা আছে, আমরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ পত্রিকাটি প্রকাশ করে যাচ্ছি। সে বিষয়টি আমাদের লোগোতে ব্যবহৃত স্লোগান থেকে স্পষ্ট। স্লোগানটি হচ্ছে : কমপিউটার জগৎ হচ্ছে ‘বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ’। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে সেই তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যটা কী? আমাদের সে চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে একটি ‘দক্ষ প্রযুক্তিপ্রজন্ম’ সৃষ্টি করা। সে লক্ষ্যে আমরা নিশ্চিত একদিন পৌঁছে যাবো- সে দৃঢ়তা আমাদের আছে।’
মার্চ, ২০০১ : ‘ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ- এ তিনটি দেশ এক সময় ছিল এক শাসনের অধীন। সময়ের রথে চড়ে আজ পৃথক তিন দেশ। তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রাধান্য সুদৃঢ় করার জন্য তিনটি দেশের মধ্যে চলছে এখন নীরব প্রতিযোগিতা। কিন্তু এ প্রতিযোগিতায় আমরা পেছনে পড়ে আছি। ভারত-পাকিস্তান অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ভারত-পাকিস্তান পারছে, আমরা পারছি না। গবেষণা ও উন্নয়ন ছাড়া আমরা কোনো খাতেই এগিয়ে যেতে পারব না।’
এপ্রিল, ২০০১ : ‘এই দশ বছরে এ পত্রিকা প্রতিষ্ঠানের মিশন ছিল সুনির্দিষ্ট : তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের সুফল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। তথ্যপ্রযুক্তি যে শুধু অভিজাতদের ভোগের বিষয় নয়, সে বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। সেই সাথে তথ্যপ্রযুক্তির সমূহ সম্ভাবনার কথাগুরো সবার কাছে পৌঁছে দেয়া। এবং বাংলাদেশে একটি দক্ষ প্রযুক্তিপ্রজন্ম সৃষ্টি করে তাদের প্রযুক্তির মহাসড়কে পৌঁছে দেয়া। এ কাজটি করতে গিয়ে আমাদের প্রায় সব ক্ষেত্রেই শুরু করতে হয়েছে এক দম শূন্য থেকে।’
মে, ২০০১ : ‘যদি প্রশ্ন তোলা হয় ইন্টারনেটের চালচিত্রটি কেমন? এর সরল ও অকপট জবাব : ইন্টারনেটের চালচিত্রটি সার্বিকভাবেই বিবর্ণ, বিপর্যস্ত। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী এরই প্রমাণবহ। তাহলে ইন্টারনেট খাতে আমাদের ভাবনাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আমরা কি এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবো? এর যথার্থ জবাব হবে : না, ইন্টারনেট খাত থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নেবো না। বরং এর বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাজার ধারা পরিস্থিতির বাইরে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে।’
জুন, ২০০১ : ‘আমরা ভিওআইপি তথা আইপি টেলিফোনিকে গ্রহণ করি আর না করি, এর পদচারণা শুরু হয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী। এর বিকাশ ঘটছে দ্রুত। বাস্তবতার নিরিখে অনেক দেশ স্বাগত জানিয়েছে আইপি টেলিফোনিকে। ব্যয়বহুল পাবলিক সুইচও টেলিফোন নেটওয়ার্ক-এর বিকল্প হিসেবে চলছে এর ব্যবহার। আমরাও চাই আইপি টেলিফোনি ও তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগমন।’
জুলাই, ২০০১ : ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যদি আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের এইচ-ওয়ান বি ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে যথাযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারি, তবে এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের চাকরি পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে এ ভিসা পেতে হলে চাই কমপিউটার বিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অথবা কমপক্ষে একটি প্রকৌশল ডিগ্রি। যদি কারো সে ডিগ্রি না থাকে, তবে যোগ্যতা অর্জনের জন্য তাকে যথেষ্ট সচেষ্ট হতে হবে।’
আগস্ট, ২০০১ : ‘মাল্টিমিডিয়ার সমূহ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের নানা দুর্বলতা কাটাতে হবে। আমাদের অনুধাবনে আনতে হবে, আজকের পৃথিবীতে মাল্টিমিডিয়া এক প্রবল পরাক্রমশালী একটি প্রযুক্তিধারা। একে এড়িয়ে চলা কিংবা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা বোকামিরই নামান্তর। তাই আমাদের প্রযুক্তি শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়ার সংশ্লিষ্টতা আরো জোরালো করতে হবে।’
সেপ্টেম্বর, ২০০১ : ‘তথ্যপ্রযুক্তি তথা আইটি শিক্ষা ছাড়া সামনে এগিয়ে চলার কোনো পথ নেই। এ কথাটি আমাদের জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে স্বীকৃত। সব মহলেই আইটি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করা হয়। সবারই তাগিদ সর্বশক্তি কাজে লাগিয়ে জাতীয়ভাবে আমাদের নেমে পড়তে হবে আইটি শিক্ষা প্রসারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন পদ্ধতি, কোন কৌশল নিয়ে আমাদের এগুতে হবে আইটি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য?’
অক্টোবর, ২০০১ : ‘সাইবার অ্যাটাক মোকাবেলায় আমাদের সাইবার নিরাপত্তার বিন্যাস জোরালো করতে হবে, ভৌত নিরাপত্তার মূল্যায়ন পরীক্ষা করতে হবে, নীতিনির্ধারক ও সাইবার রেসপন্স টিমের মধ্যে বহুধা যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে, ভাইরাস সিগনেচার হালনাগাদ করতে হবে, নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট অকেজো করে দিতে হবে। এছাড়াও রয়েছে এ ব্যাপারে আরো কৌশলগত কিছু দিকনির্দেশনা।’
নভেম্বর, ২০০১ : ‘আইটি খাতের সাম্প্রতিক মন্দা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা গৌণ হলেও এ খাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যথাযথভাবে পালনের জন্য দেশে একটি স্বতন্ত্র আইটি মন্ত্রণালয় গঠন যে অপরিহার্য সে তাগিদ আমরা বার বার উচ্চারণ করেছি। আপাতত আলাদা আইটি মন্ত্রণালয় গঠনে সম্পদের সীমবদ্ধতা থাকলে অন্তত আলাদা আইটি বিভাগ গঠন করে এক্ষেত্রে প্রাথমিক পদক্ষেপের সূচনা করা যেতে পারে।’
ডিসেম্বর, ২০০১ : ‘আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক শক্তিতে পরিণত করতে হলে চাই একটি বাস্তবভিত্তিক কার্যকর তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের চিন্তাভাবনা চলছে। তারই অংশ হিসেবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাগণ দেশে একটি তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের কাছে একটি সুপারিশমালা পেশ করেছেন। দেশে ইতোমধ্যেই একটি খসড়া তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। এই তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালাকে বাস্তবভিত্তিক নীতিমালায় রূপ দেয়ার জন্য একটি যথাযথ কর্মপরিকল্পনা দরকার। এক্ষেত্রে ডিসিসিআই প্রণীত সুপারিশমালা বা রূপরেখা প্রণয়নে কমপিউটার জগৎ-এর একটি প্রতিনিধিদল সহযোগিতা যুগিয়েছে।’
জানুয়ারি, ২০০২ : ‘যেকোনো দেশে যেকোনো খাতের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিকনির্দেশনা। জাতীয় ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক মহল এই দিকনির্দেশনা যতটুকু সক্ষমতা আর সফলতার সাথে দিতে পারবে, সে জাতির অগ্রগমন ঠিক ততটুকু গতি পাবে। জাতি দেশ হিসেবে ঠিক একই কথা আমাদের চেতনায় প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবতাদৃষ্টে মনে হয় আমরা এক্ষেত্রে ততটা সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারি নি। পারিনি যথাসময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে। দিকনির্দেশনা দিতে। ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সাথে আমাদের সংযুক্ত করতে না পারার ব্যর্থতা এমনই একটি নির্মম উদাহরণ।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০২ : ‘নববইয়ের দশকের শুরুতে FLAG প্রকল্পের ফাইবার অপটিক ক্যাবল লাইনের সাথে বাংলাদেশের সংযুক্তির এক মহাসুযোগ এসেছিল। তখন বাংলাদেশ এ সংযোগ গড়ে তুলতে পারতো বিনে খরচায়। আমলারা তা হতে দেয়নি। পরবর্তী সময়ে সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার বিএসসিএন নামে এ সম্পর্কিত একটি প্রকল্প নেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিদায়ের আগে এর কোনো কূলকিনারা করে যেতে পারেনি। বিএনপি সরকার আবার ক্ষমতায়। আশা করবো বর্তমান সরকার এবার অন্তত যাবতীয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে বাংলাদেশকে সাবমেরিন ক্যাবল সংযুক্তির দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে দূরদৃষ্টির পরিচয় দেবেন।’
মার্চ, ২০০২ : ‘১৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে বসেছিল আইসিটি টাস্কফোর্সের সভা। বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের দ্রুত প্রসার ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রেখেছেন। তাদের প্রস্তাবের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে-তথ্যপ্রযুক্তিকে পুরোপুরি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার অংশ হিসেবে টেলিফোন খাতকে উন্মুক্ত করে দেয়া এবং সরকারি খাতে সাবমেরিন ক্যাবল লাইন না বসিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে তা বসানোর সুযোগ করে দেয়া। তারা ২০০৬ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দেড় লাখ তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন। আমাদের মনে হয় উল্লিখিত প্রস্তাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য রয়েছে।’
এপ্রিল, ২০০২ : ‘কমপিউটার জগৎ-এর এক যুগ পূর্তির এ দিনে আমরা উচ্চারণ করতে পারি : কমপিউটার জগৎই সমৃদ্ধির হাতিয়ার কমপিউটারকে জনগণের হাতে পৌঁছে দেয়ার আন্দোলনের সূচনা করে।’
মে, ২০০২ : ‘বাংলাদেশে এখন শুধু আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যার ডেভেলপই হচ্ছে না, বিশ্ববাজারে তা রফতানিও হচ্ছে। বিশ্বের অন্তত ১৩টি দেশে সফটওয়্যার রফতানি করে বাংলাদেশ বছরে ১০০ কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। স্থানীয় বাজারের জন্যও উন্নতমানের সফটওয়্যার ডেভেলপ করছে সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো বেশকিছু সাফল্যের নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো এখন বাইরে থেকে কাজ আনছে-এটাই এখন বাস্তবতা।’
জুন, ২০০২ : ‘নববইয়ের দশকের শুরু থেকেই কমপিউটার জগৎ বার বার জোরালোভাবে বলে আসছে, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবা তথা আইটি এনাবলড সার্ভিস সম্প্রসারণে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ বিষয়টি সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকসহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।’
জুলাই, ২০০২ : ‘সেরা একশ’ ব্যবসায়-সফল তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি তালিকার শীর্ষ দশটির সাতটিই এশিয়ার। এশিয়ার কোম্পানিগুলোর এ সাফল্য দেখে আমাদেরও আশাবাদী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ধরে নিতে পারি এশীয় দেশগুলো যদি পারে, তবে আমরা কেনো পারবো না। আমরা নিশ্চয় এ প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পারি : ‘আমরাও পারবো’।
আগস্ট, ২০০২ : ‘আসলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দুটি প্রয়োজন হলো, সরকারের নিজস্ব কমপিউটারাইজেশন এবং আইটি নীতি প্রণয়ন ও কপিরাইট বাস্তবায়ন। এর সাথে বিদেশে বাজার সন্ধান, মার্কেটিং মিশন, দেশের একটি সুন্দর ইমেজ গড়ে তোলা, অবকাঠামো গড়ে তোলা, আইটি শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়ানো ইত্যাদি। সঠিক পদক্ষেপ নিলে নিঃসন্দেহে এ খাতে বাংলাদেশ হাজার হাজার কোটি টাকা পাবে।’
সেপ্টেম্বর, ২০০২ : ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি বিল গেটস বাংলাদেশে আসছেন। আমাদের প্রত্যাশা বিল গেটস বাংলাদেশেও একটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্থাপন করবেন।’
অক্টোবর, ২০০২ : ‘বাংলা কীবোর্ড প্রমিতকরণ হয়নি। মাত্র ২ হাজার ডলার দিয়ে বাংলাদেশ এখনো ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য হতে পারেনি। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরির কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। আমরা মনে করি, এসব ক্ষেত্রে ত্বরিত ও কার্যকর ব্যবস্থা এখনই নেয়া উচিৎ।’
নভেম্বর, ২০০২ : ‘আমরা মনে করি দেশে এখন ইন্টারনেট বিকাশের সময়। ক্রেতারা অনেকটা না জেনেই বাজওয়ার্ড হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে যেকোনো ধরনের প্রতারণা বিপরীত ফল দিতে পারে। সুতরা আমরা আইএসপি, তাদের সমিতি এবং সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ করবো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটকে কেউ যেনো প্রতারণার হাতিয়ার না বানায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।’
ডিসেম্বর, ২০০২ : ‘বাংলাদেশে সীমিত পর্যায়ে ই-গভর্নেন্স চালু হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বলা দরকার, ই-গভর্নেন্স চালুর সূচনাপর্বেই এর নিরাপত্তার প্রতি আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নইলে ভাইরাস, হ্যাকার ও ওয়ার্মগুলোর পাল্লায় পড়ে আমাদের আমলাদের মধ্যে প্রযুক্তির প্রসারণ প্রশ্নে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা আমাদের প্রযুক্তি সম্প্রসারণের পথে একটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’
জানুয়ারি, ২০০৩ : ‘স্বাগতম প্রত্যাশার নতুন বছর ২০০৩। বিদায় সাফল্য-ব্যর্থতার বিগত বছর ২০০২। ২০০২ সালে আমরা যা পেয়েছি, তা আমাদের আশাবাদী করে তোলে। কিন্তু ২০০২ সালে আমাদেরকে একটি দুঃখজনক সত্যিকেও জানতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই বাংলা ভাষার জন্য বাংলাদেশ প্রণীত কোডিং উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক মানসংস্থা আইএসও ভারত প্রণীত কোডকে বাংলা ভাষার মান হিসেবে গ্রহণ করেছে। ভারত বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে বাংলার জন্য আমাদের কোডিং, কীবোর্ড, বানান, ব্যাকরণ, বর্ষপঞ্জি, পরিভাষা কোষ ইত্যাদি সব কিছুকে বর্জন করে বাংলা ভাষায় কমপিউটারায়ন সম্পন্ন করছে।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ : ‘মায়ের ভাষার জন্য ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে আত্মত্যাগের মহান নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সে গৌরব আজ ম্লান হতে বসেছে বাংলা কমপিউটিংয়ে আমাদের দৈন্য দেখে। সত্যিই বাংলা কমপিউটিংয়ে অমার্জনীয়ভাবে পিছিয়ে যাওয়াটা চরম লজ্জাজনক।’
মার্চ, ২০০৩ : ‘গোটা বিশ্বে যখন আউটসোর্সিংয়ের জোয়ার, তখন এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পেছনের সারিতে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, আমাদের রয়েছে অসাধারণ মেধা আর বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ এক তরুণ প্রজন্ম। বাইরে এরা সে সক্ষমতা প্রমাণ করতে পেরেছে। আমেরিকায় আমাদের তরুণদের উদ্ভাবনা ও সৃজনশীলতা স্বীকৃত ও প্রশংসিত। তার পড়েও কেনো আমাদের এ ব্যর্থতা। আসলে আমাদের রয়েছে সঠিক নীতি-সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনার অভাব। কমপিউটার জগৎ আউটসোর্সিংয়ের তাগিদ দিয়ে সেই ১৯৯১ সালের অক্টোবরে ‘ডাটা এন্ট্রি : কর্মসংস্থানের অফুরান সুযোগ দ্বারপ্রামেত্ম’ শীর্ষক প্রচ্ছদ নিবন্ধ প্রকাশ করে সে সুযোগ গ্রহণের কথা তুলে ধরে একটি দিকনির্দেশনা দেয়।’
এপ্রিল, ২০০৩ : ‘কমপিউটার জগৎ-এর এবারের প্রচ্ছদ কাহিনী তৈরি করা হয়েছে ইরাকে ডিজিটাল যুদ্ধ বিষয়টি নিয়ে। এর মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি, প্রতিটি দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে কমপিউটার, আইসিটির সর্বসাম্প্রতিক সুযোগ কাজে লাগানোর ব্যাপারে। নইলে ব্যর্থ হতে বাধ্য সব প্রতিরক্ষা আয়োজন।’
মে, ২০০৩ : ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই- এ স্লোগান নিয়ে আমরা আমাদের প্রকাশনার শুরু করেছিলাম কার্যত এদেশে আইসিটি আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার একটি সুনির্দিষ্ট মিশন নিয়ে। সে আন্দোলন প্রশ্নে এই তেরো বছর আমরা ছিলাম যথার্থ অর্থেই আপোষহীন। কমপিউটার জগৎ-এর প্রায় প্রতিটি প্রচ্ছদ কাহিনী আমরা সাজাতে সচেষ্ট ছিলাম জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে।’
জুন, ২০০৩ : ‘জানা গেছে, সরকার দেশের ১০ হাজার স্কুলে ইন্টারনেটসহ কমপিউটার সুবিধা দেয়ার জন্য ব্র্যান্ড পিসি সরবরাহ করবে। স্কুলসমূহে ব্র্যান্ড পিসির বদলে ক্লোন পিসি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াই উত্তম ছিল। কারণ, এতে আমাদের প্রচুর অর্থের সাশ্রয় হতো।’
জুলাই, ২০০৩ : ‘মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা, প্রাণপুরুষ, প্রেরণাপুরুষ, কান্ডারি, বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের সূচনাকারী-ধারকবাহক-অগ্রপথিক, একজন সৎ ও কর্মনিষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা, মহান শিক্ষক, আদর্শ পরিবার-কর্তা, প্রচারবিমুখ দেশকর্মী- ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায় যাকে, সেই মানুষটি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি জগতের অলিগলিতে ছিল যার সুদীর্ঘ, নীরব ও নিরহঙ্কার বিচরণ, সে অলিগলিতে হয়তো সশরীরে তার পদচারণা আর চলবে না, তবে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে যে আগামী প্রজন্ম, তাদের মাধ্যমে চিরজাগরূক থাকবে তার নীতি-আদর্শ। তিনি হবেন তাদের শক্তির এক আধার। হবেন প্রেরণার উৎস।’
আগস্ট, ২০০৩ : ‘অধ্যাপক আবদুল কাদের স্মরণে আয়োজিত বিভিন্ন স্মরণসভায় বক্তারা মরহুমের সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন, তার মূলকথা হচ্ছে- তিনি ছিলেন এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের প্রেরণাপুরুষ, সত্যিকারের শক্তি, কান্ডারি, সর্বোপরি অগ্রপথিক।’
সেপ্টেম্বর, ২০০৩ : ‘আগামী ১০-১২ ডিসেম্বরে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ব সম্মেলন। বাংলাদেশ এ সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি সরকারি প্রতিনিধিদল ছাড়াও বেসরকারি প্রতিনিধিদল সত্যিকারের অভিজ্ঞতা অর্জনে সচেষ্ট থাকবে। নিছক একটা ভ্রমণে যেনো তা পরিণত করা না হয়। মনে রাখতে হবে, অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের রচনা করতে হবে প্রযুক্তিখাতের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা। এ হোক অভিজ্ঞতা অর্জনের যথার্থ ক্ষেত্র।’
অক্টোবর, ২০০৩ : ‘সন্দেহ নেই, নিজস্ব স্যাটেলাইট আমাদের প্রয়োজন আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে বৈধ আইএসপির সংখ্যা কমপক্ষে ৭০টি। এর মধ্যে সেরা দশটি আইএসপি গড়পড়তা ব্যবহার করছে ৩ এমপিবিএস ব্যান্ডউইডথ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চাহিদা সর্বনিম্ন ৯০ এমপিবিএস। সর্বোচ্চ ১৫০ এমপিবিএস। এক মে.বা. একমুখী ব্যান্ডউইডথ খরচ পড়ে ৪ হাজার মার্কিন ডলার। সে হিসেবে এর পেছনে আমাদের প্রতিমাসে খরচ ৩ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৬ লাখ ডলার। এদিকে দিন দিন বাড়ছে ইন্টারনেটের ব্যবহারের পরিধি। আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্যও যোগাতে হয় উপগ্রহ খরচ। অতএব আমাদের প্রয়োজন নিজস্ব স্যাটেলাইট।’
নভেম্বর, ২০০৩ : ‘ভাইরাস মোকাবেলা করে তথ্যপ্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার সম্ভব- এটুকু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের মধ্যে থাকা চাই যথার্থ সচেতনতা ও উদ্যোগ আয়োজন। কমপিউটার জগৎ সাধারণ ব্যবহারকারীদের সচেতন রাখার জন্য সময়ে ভাইরাস সম্পর্কে প্রচ্ছদকাহিনীর লেখা প্রকাশ করছে। সাম্প্রতিক ভাইরাস আক্রমণ তীব্র হয়ে ওঠার এবারের প্রচ্ছদকাহিনী ভাইরাস নিয়ে।’
ডিসেম্বর, ২০০৩ : ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন ছিল একটি তরুণ প্রযুক্তিপ্রজন্ম। অতীতে সে প্রযুক্তিপ্রজন্ম তৈরি করতে আমরা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। এখন প্রয়োজন সে ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা। সোজা কথায় আমরা চাই একটি দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন আইটি জনশক্তি।’
জানুয়ারি, ২০০৪ : ‘আমরা জাতীয় জীবনের অনেক ক্ষেত্রে সব সময় সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারি না। তেমনি অনেক পরিকল্পনায় থাকে নানা ধরনের ভুলভ্রামিত্ম। এর ফলে অনেক প্রকল্পই বাস্তবায়নের মুখ দেখে না। তথ্যপ্রযুক্তি খাতও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই সজাগ হওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যৎ সব পরিকল্পনা যথাযথ যাচাইবাছাই করে গ্রহণ করা হয়।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ : ‘মুদ্রণপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষা প্রয়োগে আমরা অনেকটা সফল হলেও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষা প্রয়োগে আমরা অনেকটা পিছিয়ে। সেই সাথে দুঃখের সাথে বলতে হয়, আইসিটি নীতিমালায় বাংলাভাষা প্রয়োগ প্রশ্নে কোনো উল্লেখ নেই। আমরা বাইল্যাঙ্গুয়াল হবো, না ইউনিল্যাঙ্গুয়াল হবো, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষা প্রয়োগের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।’
মার্চ, ২০০৪ : ‘পাশের দেশ ভারতে মোবাইল ফোনের কলরেট আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কলচার্জ অনেক বেশি। এই চার্জ কমানোর জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করতে একটি সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। আমরা আশা করবো, মোবাইল ফোন রেট কমিয়ে আনার জন্য ফোন কোম্পানিগুলো ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সদিচ্ছা নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে দ্রুত এ গিয়ে আসবে।’
এপ্রিল, ২০০৪ : ‘অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ২৭ মার্চ বাংলাদেশ আরো ১৫টি দেশের সাথে সাবমেরিন ক্যাবল চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ২০০৫ সালের জুনের মধ্যে যাতে জনগণের হাতে অতি উঁচু গতিসম্পন্ন কম খরচের ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সুবিধা পৌঁছানো যায়, সে লক্ষ্য নিয়েই এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো। সব অজ্ঞতাকে পায়ে দলে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সব সুফলকে কাজে লাগানো জন্য যথাসময়ে যথাসিদ্ধান্ত নেবো। তাই হোক আমাদের শপথ।’
মে, ২০০৪ : ‘দেশে একটি হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার জন্য গত ২৪ এপ্রিল ২৩১ একর জমি হস্তান্তর করা হয়েছে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে। ২৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই হাইটেক পার্ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও আইসিটি মন্ত্রণালয়। এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর হাইটেক পার্কের আদলে এ পার্কটি নির্মিত হবে। আমরা এ পার্কের দ্রুত ও সফল বাস্তবায়ন কামনা করছি।’
জুন, ২০০৪ : ‘বাজেট আসন্ন। অনেকের কাছে এ সংখ্যা পৌঁছার আগেই বাজেট ঘোষিত হবে। এ বাজেটকে সঙ্গত কারণেই আমরা আইসিটি ফ্রেন্ডলি চাইবো। সরকার অতীতে যেসব ভুল করেছে, তার পুনরাবৃত্তি ঘটুক, তা আমাদের কাম্য নয়।’
জুলাই, ২০০৪ : ‘এরই মধ্যে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে ২০০৪-০৫ অর্থবছরের বাজেট। এ বাজেট এবার আইসিটি খাতের সংশ্লিষ্টদের হতাশ করেছে। আইসিটি খাতকে ট্রাস্ট সেক্টর হিসেবে বলে বেড়ালেও অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আইসিটি খাত নিয়ে একটি লাইনও খরচ করেননি। সাধারণ মানুষকে জানানো হয়নি আইসিটি খাত সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ অঙ্ক। কিংবা কোনো দিকনির্দেশনা।’
আগস্ট, ২০০৪ : ‘শেষ পর্যন্ত আমলারা তাদের অদূরদর্শিতার বিষয়টি অাঁচ করতে পেরে ‘শিয়াল মেরে বিকেলে’ উদ্যোগী হলেন দেশকে তথ্যপ্রযুক্তি মহাসড়ক তথা ফাইবার অপটিক ক্যাবলে সংযোগ দেয়ার জন্য। সে সূত্রে দেশবাসী আবারো শুনলো আশার বাণী। ২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফাইবার ক্যাবল সংযোগ পাবো। তাও মন্দের ভালো। না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়াটাও ভালো।’
সেপ্টেম্বর, ২০০৪ : ‘শেষ পর্যন্ত মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের জন্য কপিরাইট আইন পরিপূর্ণতা লাভ করতে যাচ্ছে। গত ১৬ আগস্ট মন্ত্রী পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে ‘কপিরাইট সংশোধনী আইন, ২০০৪’ অনুমোদিত হয়েছে, জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে তা পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভালোয় ভালোয় তেমনটি ঘটলে আইসিটি পণ্যের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের রক্ষাকবচ পরিপূর্ণতা পাবে।’
অক্টোবর, ২০০৪ : ‘চিকিৎসার ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের জন্য বায়োমেডিক্যাল ইনফরমেশন, উপাত্ত ও জ্ঞানের সর্বোচ্চ ব্যবহার, প্রয়োজনের মুহূর্তে তথ্য-উপাত্ত দ্রুত ফিরে পাওয়া ও সংরক্ষণ এসবের সমন্বিত বিজ্ঞানের একটি শাখা হচ্ছে হেলথকেয়ার ইনফরমেটিক্স। এর কাজের প্রয়োগক্ষেত্র, এর জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, কারা কোথায় এ কাজ করছে ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে আমরা এক্ষেত্রে বাইরে থেকে কাজ নিয়ে আসতে পারি। আমাদেরকে এজন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’
নভেম্বর, ২০০৪ : ‘গুণীজনদের কথা- ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যখন পথ হারায়, দর্শন তখন পথ দেখায়। আর দর্শন যখন পথ হারায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তখন পথ দেখায়।’ কিন্তু নানা দর্শনের ঠেলাঠেলিতে আমরা যখন আজ দিশেহারা, তখন পথ দেখাবার দায়িত্বটুকু এসে পড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথ ধরেই আমাদের নিতে হবে দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেবার জন্য।’
ডিসেম্বর, ২০০৪ : ‘বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্প দেশের আইটি শিল্পের এর উল্লেখযোগ্য অংশ। বাংলাদেশের আইসিটি খাতের রফতানি ৩৮ শতাংশ আসে সফটওয়্যার রফতানি থেকে। আইসিটি রফতানি খাতে অবশিষ্ট অবদান আইসিটি কলসালট্যান্সি ও প্রসেসিং সার্ভিস খাতের। বাংলাদেশের সফটওয়্যার পণ্য আইসিটি বাজারে এসেছে একটু দেরিতেই। এখনো এ শিল্পে কোম্পানির সংখ্যা হাতেগোনা। রফতানিকারক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরো সীমিত।’
জানুয়ারি, ২০০৫ : ‘প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৫ সালকে ‘বিজ্ঞান গ্রন্থবর্ষ’ ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণা দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী এ বছরে আরো বেশি করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক বই লেখা, অনুবাদ ও প্রকাশ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে আমরা বলতে চাই, ‘বিজ্ঞান গ্রন্থবর্ষ ২০০৫’ সফল হোক।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ : ‘বাংলা কমপিউটিংয়ে আরো অনেক কাজ এখনো বাকি। বাংলা ভাষায় ডাটাবেজ তৈরি, লাইব্রেরি ক্যাটালগ তৈরি, ভূমি জরিপের ফলাফল, কৃষি তথ্যভান্ডার, যোগাযোগ তথ্য ডাটাবেজ তৈরির মতো অনেক কাজ বাকি। বাংলা কমপিউটিংয়ে অসমাপ্ত কাজগুলো করতে এবং বাংলা নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে টিকে থাকতে আমাদেরকে রীতিমতো লড়াই করতে হবে।’
মার্চ, ২০০৫ : ‘বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি এমন একটা খাত, যেখানে সরকারি সিদ্ধান্ত হয় বটে, তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে বাস্তবে জোটে নানা ঝুট-ঝামেলা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় না। টিঅ্যান্ডটির মোবাইল ফোন ও ভিওআইপি তারই উদাহরণ।’
এপ্রিল, ২০০৫ : ‘আমাদের এই চৌদ্দ বছর পূর্তি সংখ্যাটি প্রচ্ছদ কাহিনীর বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছি ‘আর্থসামাজিক উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তি’। কারণ, আমাদের লক্ষ্য একটাই, জাতিকে তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে সচল রাখতে চাই।’
মে, ২০০৫ : ‘সামনে মাত্র আর ক’টা দিন। এরপর আমরা আসন্ন অর্থবছরের জন্য নতুন এক জাতীয় বাজেট পাবো। দেশের আইসিটি খাতসংশ্লিষ্টরা আসন্ন বাজেট নিয়ে এবার রীতিমতো আশঙ্কায় আছেন। শোনা যাচ্ছে, এবার প্রযুক্তিপণ্যের ওপর কর বাড়ানো হবে। কিংবা নতুন নতুন প্রযুক্তি পণ্যকে করা হবে শুল্ক তালিকার অন্তর্ভুক্ত। তবে আমরা একথা নিশ্চিত বলতে পারি, অর্থমন্ত্রী যদি নতুন করে আইসিটি খাতের ওপর করের বোঝা চাপান, তবে তা হবে গোটা জাতির জন্য আত্মঘাতী।’
জুন, ২০০৫ : ‘কৃষি ও আইসিটি খাতের জন্য দেয়া ৩০০ কোটি টাকার ইইএফ ফান্ড থেকে আইসিটি খাত কার্যত কোনো উপকৃত হতে পারেনি। এ তহবিল সিংহভাগ অব্যবহৃতই থেকে গেছে নানা কারণে। অভিযোগ আছে, কিছুসংখ্যক ভাগ্যবান ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান এ তহবিল থেকে টাকা নেয়ার সুযোগ পেলেও সাধারণ উদ্যোক্তারা সে সুযোগ পায়নি। আগামী বাজেটে এ তহবিল বরাদ্দ অন্যভাবে আসা দরকার, যাতে আইসিটি খাতের উপকার হয়।’
জুলাই, ২০০৫ : ‘এবারো অর্থমন্ত্রী সফটওয়্যার পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন বাজেটে এবং সে কর প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে তিনি একটি শক্ত অবস্থানও নিয়েছিলেন, এমন অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এই ১০ শতাংশ কর প্রত্যাহার করা হয়েছে বাজেটে। এজন্য অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী মোবারকবাদ পাবার দাবিদার।’
আগস্ট, ২০০৫ : ‘অ্যানিমেশন শিল্পে বাংলাদেশ দুটি সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। প্রথমত, আমরা কম খরচে বাইরের দেশগুলোকে অ্যানিমেশন যোগান দিতে পারি। দ্বিতীয়ত, আমাদের আছে অনেক ফাইন আর্টস গ্র্যাজুয়েট ছাড়াও কিছু সৃজনশীল স্বল্পশিক্ষিত অাঁকিয়ে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিলে এরাই হয়ে উঠতে পারেন দক্ষ অ্যানিমেটর।’
সেপ্টেম্বর, ২০০৫ : ‘যেকোনো ক্ষেত্রে চাকরির জন্য যেমনি কমপিউটারের জ্ঞানার্জন অপরিহার্য, তেমনি মানুষের ব্যক্তিজীবনে কমপিউটার সাক্ষরতাজ্ঞান থাকাও অপরিহার্য। দ্রুত ও দক্ষতার সাথে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসম্পাদনের জন্য কমপিউটার সাক্ষরতার কোনো বিকল্প নেই। অতএব স্কুল পর্যায়ে আইসিটি বিষয়কে নৈর্বাচনিক না রেখে বাধ্যতামূলক করা উচিত ছিল। আশা করি, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে নিয়োজিত আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।’
অক্টোবর, ২০০৫ : ‘বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্স কার্যকর চালু করতে হলে আমাদের কিছু কৌশলগত নীতি অবলম্বন ও আশুকরণীয় রয়েছে। এগুলোর বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে আমাদের চলতি সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনীতে। আমরা আশা করবো, দেশের নীতিনির্ধারক মহল এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’
নভেম্বর, ২০০৫ : ‘সম্প্রতি সরকার দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে যে পিআরএসপি অনুমোদন করেছে, এতে আইসিটি যেভাবে অবহেলিত তাতে দক্ষ প্রযুক্তিপ্রজন্ম গড়ে তোলার স্বপ্নই অপূর্ণ থেকে যাবে। অতএব আইসিটি প্রশ্নে পিআরএসপি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে বৈকি।’
ডিসেম্বর, ২০০৫ : ‘সম্প্রতি ঢাকায় আধাদিনের বাংলাদেশ সফর করে গেলেন প্রযুক্তির বরপুত্র ও জ্ঞানভিক্তিক নয়া অর্থনীতির প্রবাদপুরুষ বিল গেটস। মাইক্রোসফটের কর্ণবার বিল গেটসের এ সফরের সময় আমাদের বিশেষ করে মনে পড়ছে এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের আরেক বরপুত্র তথা কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আবদুল কাদেরের কথা। ৩১ ডিসেম্বর তার ৫৬তম জন্মবার্ষিকী। বিল গেটসের সফর সময় তাকে মনে পড়ছে এ কারণে যে, বিল গেটস আজ ঢাকায় আসলেন যে জ্ঞানভিত্তিক নয়া অর্থনৈতিক খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্য নিয়ে, মরহুম আবদুল কাদের স্বপ্ন দেখতেন সেই অর্থনীতির ফসল ঘরে তোলার।’
জানুয়ারি, ২০০৬ : ‘সম্প্রতি বেশ ক’টি জাতীয় দৈনিকে আইসিটিমন্ত্রী মঈন ও কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গবেষণার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে খবর প্রকাশ হয়েছে। অভিযোগটি মারাত্মক। অবিলম্বে এর সুষ্ঠু তদন্ত দরকার।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ : ‘গত ৩০ জানুয়ারি মাইক্রোসফট ‘বেঙ্গলি ইন্ডিয়া’ নামে বিশ্বের প্রথম ‘বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাক’ প্রকাশ করেছে। এটি কমপিউটারে বাংলা ভাষা প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক নিশ্চয়। তবে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাকে ‘বেঙ্গলি ইন্ডিয়া’ কিংবা ‘বেঙ্গলি বাংলাদেশ’ নামে আখ্যায়িত করে কেনো এভাবে ভাগ করা হবে? এর যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। তাছাড়া মাইক্রোসফটের বাংলা ফন্টের নাম রাখা হয়েছে ‘বৃন্দা’। কেনো এর নাম রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল হলো না? তাও আমাদের বোধে আসে না।’
মার্চ, ২০০৬ : ‘গত বছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্তি পেলো। এর সরবরাহ ও বণ্টন কিভাবে হবে, এক্ষেত্রে কী নীতিমালা হবে, তা এখনো সম্পন্ন হয়নি। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ রয়েছে আমাদের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে। এ পরামর্শগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় আনবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।’
এপ্রিল, ২০০৬ : ‘আমরা কমপিউটার জগৎ-এর দেড় দশক পূর্তির লগ্নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিশ্চিত করতে চাই কমপিউটার জগৎ এর অনুসৃত নীতি থেকে কখনো সরে দাঁড়াবে না। পাঠকদের সাথে সৎ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেই অব্যাহত থাকবে এর আগামী দিনের পথ চলা।’
মে, ২০০৬ : ‘এমনিতেই আমাদের বাজেট বরাদ্দ অতি নগণ্য। চলতি ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে পূর্ববর্তী বছরের বাজেটের তুলনায় বিজ্ঞান ও আইসিটি খাতে বরাদ্দ ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া হয় মাত্র ২২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৮ কোটি, ওই ১৮ কোটি টাকা লুটপাটের যে খবর এবার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে, তা সত্যিই লজ্জাজনক। আমরা চাইবো, বরাদ্দের অর্থ যেনো যথার্থভাবে সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় হয়, সেটুকু যেনো নিশ্চিত করা হয়।’
জুন, ২০০৬ : ‘আমাদের হাতে আছে একটি চমৎকার আইসিটি নীতিমালা। এতে বলা আছে, আইসিটি খাতে বরাদ্দ দেয়া হবে কমপক্ষে জিডিপির এক শতাংশ। আজ পর্যন্ত আমরা এর বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বাজেটে আইসিটি খাতে নিচু অঙ্কের বরাদ্দ থাকায় এ খাতে আমরা গতিশীলতা আনতে পারছি না।’
জুলাই, ২০০৬ : ‘নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও আমরা সফটওয়্যার শিল্পে সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। এরই মধ্যে আমরা সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে সংযুক্ত হয়েছি। এটি আমাদের সফটওয়্যার শিল্পে এক নতুন গতি সৃষ্টি করবে, তাতে সন্দেহ নেই। যাই হোক, আমাদের সফটওয়্যার শিল্পের সম্ভাবনার সাথে সাথে আছে কিছু বাধাও। তা-ই তুলে ধরা হয়েছে এবারের প্রচ্ছদ কাহিনীতে। আশা করি, দায়িত্বশীলেরা এতে তুলে ধরা সুপারিশগুলো বিবেচনা করে দেখবেন।’
আগস্ট, ২০০৬ : ‘তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে ছোট-বড়, ধনী-গরিব প্রতিটি দেশের জন্য খুলে দিয়েছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের অমিত সম্ভাবনার দুয়ার। তথ্যপ্রযুক্তি খাতটি একটি জ্ঞানভিত্তিক খাত। শ্রমঘন কিংবা মূলধনঘন খাত নয়। এখানে প্রয়োজন একটি শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত আইটি জেনারেশন। সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে যে জাতি একটি প্রযুক্তিপ্রজন্ম গড়ে তুলতে পারবে, সে জাতির পক্ষেই তথ্যপ্রযুক্তির ফসল পুরোপুরি ঘরে তোলা সম্ভব।’
সেপ্টেম্বর, ২০০৬ : ‘তথ্যপ্রযুক্তি ব্যক্তি কিংবা জাতীয় জীবনে এগিয়ে যাবার সর্বোত্তম হাতিয়ার। সমৃদ্ধি অর্জনের প্রধানতম বাহন। তবে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সামগ্রিক সচেতনতা। এ সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। দুর্ভাগ্য এ সচেতনতা সৃষ্টিতে আমরা ব্যক্তি ও জাতীয় উভয় পর্যায়েই এখনো পিছিয়ে আছি।’
অক্টোবর, ২০০৬ : ‘জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০০৬’। আশা করা যাচ্ছে, এখন থেকে এদেশের মানুষ বৈধ আইনী উপায়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড পরিচালনার সুযোগ পাবে। ই-কমার্স ও ভিওআইপি এখন চলতে পারবে পুরোপুরি বৈধভাবে।’
নভেম্বর, ২০০৬ : ‘ইন্টারনেট। তথ্য বিনিময়ে যুগান্তকারী এক বৈপ্লবিক ব্যবস্থা। এটা কেনো দেশবিশেষের কিংবা কোনো অঞ্চলবিশেষের নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা নয়। এটি একটি বিশ্বব্যবস্থা। তাই ইন্টারনেট গভর্নেন্স নিয়ে যে বিতর্ক তার অবসান হওয়া দরকার এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই।’
ডিসেম্বর, ২০০৬ : ‘আমরা মনে করি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন সত্যিকারের প্রযুক্তিবান্ধব ব্যক্তিত্ব। সে কারণেই জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ড. ইউনূসকে তার আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টার সম্মানে আসীন করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন আন্দোলনের শরিক হিসেবে আমরা তাকে প্রযুক্তিবান্ধব বিশেষণে আখ্যায়িত করতেই বেশি পছন্দ করি। চলতি সংখ্যায় সে প্রযুক্তিবান্ধব ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেই তুলে ধরেছি একটি লেখায়।’
জানুয়ারি, ২০০৭ : ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আমাদের গতিহীনতা অসহনীয় পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে রয়েছে আমাদের একটি আইসিটি টাস্কফোর্স। বছর পেরিয়েও এ টাস্কফোর্সের বৈঠক বসে না। এ টাস্কফোর্স থেকে আসে না প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ। ফলে এ খাতে বছরের পর বছর আমাদের ব্যর্থতার পাল্লা শুধুই ভারি হচ্ছে।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ : ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করতে চাইলে এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। তবে সহজেই অনুমেয়, এ গবেষণা খুবই ব্যয়বহুল। এ গবেষণা দীর্ঘমেয়াদে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হয়। এ কারণে এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ অপরিহার্যভাবে এসে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে ব্যাপক কোনো গবেষণার কথা শোনা যায় না।’
মার্চ, ২০০৭ : ‘বাংলাদেশের অসংখ্য মেধাবী তরুণ দেশ-বিদেশে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এরা দেশমাতৃকার টানে নিজ দেশে আসতে চান, দেশে বসে কাজ করে দেশের অর্থনীতির ভিতকে সুদৃঢ় অবস্থানে নিতে চান। কিন্তু আমাদের দেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রের অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও জটিলতার কারণে তা হচ্ছে না।’
এপ্রিল, ২০০৭ : ‘গবেষণা ও উন্নয়ন বা রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এ শব্দযুগলের সাথে আমরা বেশ পরিচিত। একটি আরেকটির পরিপূরক। গবেষণা ছাড়া যেমন উন্নয়নের আশা করা যায় না, তেমনি উন্নয়নের আশা করলে গবেষণা বাদ দিলে চলে না। প্রযুক্তি যখন বিবেচ্য হয়, তখন প্রযুক্তি গবেষণাকে আনতে হয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে। এক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতা দুর্ভাগ্যজনক পর্যায়ে।’
মে, ২০০৭ : ‘আমরা গত ২১ এপ্রিল কমপিউটার জগৎ-এর পক্ষ থেকে ‘আইসিটি খাতে বাজেট বরাদ্দ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করি। উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের পক্ষ থেকে আসন্ন বাজেটে করণীয় নির্দেশ করা। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের অংশ নেয়ার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক তাগিদসহ দিকনির্দেশনা পেয়েছি, গোলটেবিলে অংশ নেয়া অভিজ্ঞজনদের সম্মিলিত তাগিদ হচ্ছে, বাজেটে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে।’
জুন, ২০০৭ : ‘এখন আমাদের জাতীয় জীবনে ‘দুর্নীতি’ নামের উপসর্গটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। চারদিকে দুর্নীতি দমন নিয়ে হই-চই। সর্বত্র একই আলোচনা দুর্নীতি হঠাও। নানাজন নানাভাবে, যে যেমন পারছে এ ব্যাপারে নানা মত, অভিমত আর সুপারিশ তুলে ধরছেন, কিন্তু কেউ বলছেন না, দুর্নীতি দমনে প্রযুক্তি হতে পারে আমাদের প্রধানতম হাতিয়ার। কেউ বলছেন না ই-ডেমোক্র্যাসি চালু করে এক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে বেশি সাফল্য আনতে পারি।’
জুলাই, ২০০৭ : ‘আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও রাজ্যগুলো যখন নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে তাদের তথ্যপ্রযুক্তিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা নতুন কোনো কর্মসূচি তো পাচ্ছিই না, বরং বিদ্যমান কর্মসূচিগুলোর ভবিষ্যৎ গহিন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমাদের ভাবতে হয় হাইটেক পার্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে।’
আগস্ট, ২০০৭ : ‘আঙ্কটাড সম্প্রতি ঢাকায় প্রকাশ করেছে ‘স্বল্পোন্নত দেশ রিপোর্ট ২০০৭’। এতে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট রিপোর্টও পেশ করা হয়। এ রিপোর্টে একটি অতি মূল্যবান তাগিদ তুলে ধরে বলা হয়- বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন আজ অপরিহার্য, এগুলো বিলাসিতা নয়। রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশ ক্রমেই জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের এ রিপোর্ট পড়ে দেখা দরকার।’
সেপ্টেম্বর, ২০০৭ : ‘সফটওয়্যার কমপিউটার প্রযুক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে এদেশে অবাধে। ফলে আমরা সফটওয়্যারের গুরুত্বের কথাটি ভুলে আছি। একটা সময় আসবে যখন আমাদেরকে পয়সা দিয়ে কিনে লাইসেন্সড সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে ওপেনসোর্স। ওপেনসোর্স সফটওয়্যারই হতে পারে আমাদের প্রতিদিনের কমপিউটিংয়ের অন্যতম বিকল্প।’
অক্টোবর, ২০০৭ : ‘সময় ও প্রযুক্তি। এ দুয়ের সম্পর্ক অতি গভীর। প্রযুক্তির সাথে চলার সারকথা হচ্ছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা। নিজেদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার উপযুক্ত করে তোলা, আর এজন্য প্রয়োজন যথাসময়ে যথাপ্রযুক্তিকে কাজে লাগানো নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তির পথ সুগম করা। আর এক্ষেত্রে সফটওয়্যারের প্যাটেন্ট একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের ধীরগতি রীতিমতো পীড়াদায়ক।’
নভেম্বর, ২০০৭ : ‘অর্থনীতিতে একটা কথা আছে : প্রতিটি মন্দার পর আসে একটি অর্থনৈতিক চাঙ্গাভাব। অর্থনীতির মতো তথ্যপ্রযুক্তির বাজারেও একথাটি সত্যি। সে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পণ্যের বাজারই হোক, আর তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট চাকরির বাজারই হোক। একথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মন্দা চলার সময়টায় পরবর্তী সময়ে আসা সুযোগটাকে যথাযথ কাজে লাগানোর ব্যাপারে একটি সতর্ক প্রস্ত্ততি নেয়ার তাগিদ আপনা-আপনি আমাদের সামনে হাজির হয়।’
ডিসেম্বর, ২০০৭ : ‘এ বছরেই আমাদেরকে দু-দুটি বন্যা আর শক্তিশালী সিডরের মতো একটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমাদের প্রয়োজন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।’
জানুয়ারি, ২০০৮ : ‘গত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে পিছিয়েপড়া মানুষের জন্য টেকসই তথ্য ও জ্ঞানপদ্ধতি বিনির্মাণের লক্ষ্যে উদ্বোধন করা হলো ‘বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্কের মিশন ২০১১’ কর্মসূচি। লক্ষ্য বাংলাদেশের ৪০ বছর পূর্তির বছর ২০১১-এর মধ্যে সারাদেশে ৪০ হাজার টেলিসেন্টার স্থাপন। বাংলাদেশে টেলিসেন্টার স্থাপনের আন্দোলনকে জোরদার করে তোলার লক্ষ্যে গঠিত ‘বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক’-এর এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই, যদিও মাত্র ৪ বছরে ৪০ হাজার টেলিসেন্টার স্থাপনের বিষয়টিকে অনেকে উচ্চাভিলাষী মনে করছেন।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ : ‘এখন প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তি ভাষাকে দিয়েছে অন্যরকম গতির সুযোগ। প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার প্রয়োগের রয়েছে সমূহ সুযোগ। স্বীকার করতে হবে, এক্ষেত্রে অতীতে জাতি হিসেবে আমাদের সীমাহীন অবহেলা রয়েছে। এ অবহেলার জের-দুর্ভোগ আমাদেরকে স্বাভাবিকভাবেই পোহাতে হচ্ছে এখন। তবে দেরিতে হলেও সময়ের সাথে চলতে আমাদেরকে প্রযুক্তিতে বাংলাভাষা প্রয়োগের কাজে হাত দিতে হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি, প্রযুক্তিতে বাংলাভাষার প্রয়োগ পুরোপুরি সম্ভব।’
মার্চ, ২০০৮ : ‘আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিখাতে একটি ইতিবাচক উদ্যোগ হচ্ছে বিটিটিবি-পিজিসিবি চুক্তি। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ তথা পিজিসিবির সাথে সম্প্রতি বিটিটিবির যে চুক্তি হয়েছে, তার আওতায় আগামী ৩ বছর বিটিটিবির ফাইবার অপটিক ক্যাবলের ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করবে পিজিসিবির ফাইবার অপটিক ক্যাবল। দেশের ভেতরে বার বার ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সমস্যায় দূর করতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ চুক্তির ফলে কখনো যদি বিটিটিবির নিজস্ব ফাইবার অপটিক ক্যাবল কাটাও পড়ে, তবুও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন হবে না। সহজেই আশা করা যায়, এর মাধ্যমে গ্রাহকসেবার মানোন্নয়ন নিশ্চিত হবে।’
এপ্রিল, ২০০৮ : ‘কমপিউটার জগৎ-এর নিয়মিত পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন, আমরা এদেশে কমিউনিটি রেডিও চালুর দাবি নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী রচনা থেকে শুরু করে সভা-সেমিনার পর্যন্ত আয়োজন করেছি। এর ফসল হিসেবে সরকার সম্প্রতি কমিউনিটি রেডিওবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তাছাড়া চলতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের জন্য লাইসেন্স নিতে আগ্রহীদের কাছ থেকে দরখাস্তও আহবান করা হয়েছে। এটি একটি শুভ সূচনা বলে আমরা মনে করি।’
মে, ২০০৮ : ‘দেশে আজকের এই সময়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, ব্যবসায়-বাণিজ্যে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ‘সংস্কার’। আসলে আমাদের প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সরকার ব্যবস্থা, যে সংস্কারের মাধ্যমে আমরা পেতে পারতাম একটা ই-গভর্নমেন্ট। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের ওপর হবে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দুর্নীতিবাজদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতো এ প্রযুক্তি। কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখছি বহুল আলোচিত সংস্কারে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সংস্কার রীতিমতো অবহেলিত।’
জুন, ২০০৮ : ‘আমরা বরাবর আমাদের সম্মানিত পাঠক ও এদেশের সব স্তরের মানুষের কাছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতেরযাবতীয় সম্ভাবনার খবরটি পৌঁছাতে চেষ্টা করে আসছি। তারই অংশ হিসেবে চলতি সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে অনলাইন ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে বিপুল অঙ্কের বিদেশী মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনার নানা দিক তুলে ধরেছি।’
জুলাই, ২০০৮ : ‘আমাদের মনে হয়, এবার আমরা ভুল দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে দিকভ্রান্ত একটি বাজেট প্রণয়ন করলাম। আমরা এ পর্যন্ত একটা দর্শনের ওপর ভর করে স্বাধীনতাউত্তর সময়ের প্রতিটি বাজেট প্রণয়ন করে আসছিলাম শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে। এবার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধের খাত। এবারের বাজেটে এই দর্শনগত ভুল পদক্ষেপ আমাদের বাজেট প্রণেতাদের দূরদৃষ্টির অভাবকেই স্পষ্ট করে তুলেছে।’
আগস্ট, ২০০৮ : ‘এই তো এ বছর ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ ২০০৭-০৮ সালের জন্য যে ‘গ্লোবাল ইনফরমেশন টেকনোলজি রিপোর্ট’ প্রকাশ করলো তাতে আমাদের নেটওয়ার্ক রেডিনেসকে একদম নাজুক অবস্থায় দেখানো হয়েছে। ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম স্থানে। এ দুর্বলতা কাটাতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।’
সেপ্টেম্বর, ২০০৮ : ‘আমাদের সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে, আমাদেরকে প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পের প্রতি সমধিক মনোযোগী হওয়া দরকার। ইতোমধ্যেই আমরা বেশকিছু প্রযুক্তি শিল্প নিয়ে কাজ করছি। তবে ধ্রুপদ প্রযুক্তিশিল্প খাতে আমাদের উদ্যোগ এখনো অনুপস্থিত। যেমন সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। এক্ষেত্রে বলতে গেলে আমাদের শুরুটাই হয়নি। এক্ষেত্রেও যে আমাদের উদ্যোগ প্রয়োজন, সেকথা জানাতেই আমরা সেমিকন্ডাক্টরের ওপর এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন তৈরি করেছি।’
অক্টোবর, ২০০৮ : ‘গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইসিটি রোডম্যাপ সাধারণ্যে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশ করার সাথে সাথে তা প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। স্টেক হোল্ডাররা এরই মধ্যে অভিযোগ করেছেন, প্রস্তাবিত রোডম্যাপে এমন সব প্রস্তাব আছে, যা আমাদের জাতীয় অনেক আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাশাপাশি এসব প্রস্তাব আমাদের জাতীয় সংহতি বিনাশেও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে। রোডম্যাপ নামের এ দলিলে পার্লামেন্টকে ‘নন-ফাংশনাল’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের উল্লেখ দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র কি না?’
নভেম্বর, ২০০৮ : ‘আমাদের দেশে ই-গভর্নেন্সের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হচ্ছে, গত ২৫ অক্টোবর ‘লজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রশংসনীয় ওয়েবসাইট চালু করা। এই ওয়েবসাইটের ঠিকানা : wwwminlaw.gov.bd। আমরা এ উদ্যোগের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অন্যদের মোবারকবাদ জানাই।’
ডিসেম্বর, ২০০৮ : ‘তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ইলেক্ট্রনিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে কৃষকদের তথ্যসমৃদ্ধ করে তুলতে পারে ই-কৃষি। যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এলে ই-কৃষি ব্যাপকধর্মী সাফল্য বয়ে আনতে পারে। আর সে বিশ্বাসের সূত্রে আমরা বিজয় দিবসের এ মাসে প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের বিষয়বস্ত্ত করেছি ‘ই-কৃষি’।’
জানুয়ারি, ২০০৯ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশবাসীকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি সচেষ্ট হবেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলায়। আমরা মনে করি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার এই উপলব্ধি তার দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ : ‘ বাংলা যেহেতু পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা, সেহেতু তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে এ ভাষার প্রয়োগ অবশ্যই সম্ভব। এমনি দৃঢ় প্রত্যয়ে যারা প্রত্যয়ী, তারা কাজে নেমে পড়লেন। চললো গবেষণা আর নানামাত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বাংলাভাষা নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট গবেষণাকে আরো জোরদার করতে হবে।’
মার্চ, ২০০৯ : ‘এবারের সংখ্যায় আমাদের প্রচ্ছদ কাহিনীর বিষয় কনভারজেন্স। কনভারজেন্স প্রযুক্তির সম্ভাবনাময় নতুন ক্ষেত্র। নতুন তত্ত্ব। এক কমপিউটার, এক ল্যাপটপ, এমনকি একটি স্মার্ট টেলিফোনকেও একযোগে তথ্যপ্রবাহ ও ছবি বিনিময়ের মাধ্যমে পরিণত করেছে কনভারজেন্স। কনভারজেন্স টেলিযোগাযোগের সর্বশেষ রূপ।’