একটা সময় ছিল যখন বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য কতটা বড় ও কার্যকর, তার ওপর জোর দিয়েই পণ্যের বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রচার করতো। সেদিন এখন আর নেই। এখন বিজ্ঞাপনের ধারা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। কোম্পানিগুলো এখন সম্ভাব্য ক্রেতাদের জানাতে সচেষ্ট, তাদের পণ্য কতটা ক্ষুদ্র এবং শক্তিশালী। অর্থাৎ বড় আকারের ডিভাইস বা যন্ত্র বাদ দিয়ে, সবাই এখন শক্তিশালী, কিন্তু ক্ষুদ্রাকৃতির যন্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আজকের প্রতিবেদন মোবাইল ফোন ও ডিজিটাল ক্যামেরার সেন্সরের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রম ও বিবর্তন নিয়ে।
আজকের দিনে মোবাইল ফোন বা ক্যামেরা কতটা আধুনিক তা নির্ধারণ করা হয় সেগুলোর মেগাপিক্সেল দিয়ে। সম্প্রতি মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে মোবাইল হ্যান্ডসেটে ৮ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা সংযুক্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ডিজিটাল ক্যামেরার ক্ষেত্রে এর চেয়ে অনেক বেশি পিক্সেল অবশ্য রয়েছে। তবে এ কথা সবারই জানা, পিক্সেল নয়, কোনো আলোকচিত্রের সাফল্য নির্ভর করে ইমেজ সেন্সরের ওপর। এই সেন্সর তৈরির রয়েছে দুটো প্রযুক্তি। একটি চার্জ কাপল্ড ডিভাইস তথা সিসিডি এবং অপরটি কমপ্লিমেন্টারি মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর তথা সিএমওএস।
সিসিডি প্রযুক্তির আলোকচিত্রের মান অনেক ভালো। সে তুলনায় সিএমওএস প্রযুক্তি অনেক পিছিয়ে আছে। চরম উৎকর্ষে পৌঁছতে তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। যদিও সিএমওএস আকৃতিতে ক্ষুদ্র এবং বিদ্যুৎ খরচ কম। মোবাইল ফোনের জন্য এ সেন্সর নিঃসন্দেহে আদর্শ। সিসিডির চেয়ে সিএমওএস সেন্সর কাঠামোগত দিক দিয়ে অনেক বেশি ক্ষুদ্র। যদিও উন্নতমানের ছবি ধারণের জন্য উভয়েরই বিশেষ চিপ এবং উন্নত সেন্সের প্রয়োজন রয়েছে।
বিশ্বখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠান সনি এবং ক্যানন কাজ করছে সিএমওএস প্রযুক্তি নিয়ে। তারা তাদের ডিজিটাল এসএলআর (ডিএসএলআর) ক্যামেরায় জনপ্রিয় সিসিডির পরিবর্তে ইতোমধ্যেই সিএমওএস সেন্সর ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ডিজিটাল ক্যামকর্ডারেও তারা এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে বলে গুজব রয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আইইইই ইন্টারন্যাশনাল সলিড স্টেট সার্কিটস কনফারেন্সে এরা ঘোষণা করেছে, মোবাইল ফোনে উচ্চমানের ভিডিও ও আলোকচিত্র ধারণের ব্যবস্থা করতে এরা ৩ দশমিক ৩ মেগাপিক্সেল সিএমওএস ইমেজ সেন্সরের উন্নয়নের কাজ করছে। এদিকে সিএমওএস সেন্সরের অ্যানালগ টু ডিজিটাল রূপান্তর প্রক্রিয়ার কৌশল উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছে সনি। এটি করা গেলে ছবি মার খেয়ে যাওয়া অনেক কমে আসবে এবং উন্নতমানের ছবি পাওয়া যাবে।
মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে সিএমওএস। এখানে সিসিডির দেখা মেলা ভার। স্যামসাংয়ের অমনিয়াএইচডি তার প্রসেসর এবং ব্যাটারির তেমন ভূমিকা ছাড়াই তৈরি করছে ৭২০ পিক্সেল ভিডিও। ফুজিৎসু কাজ করছে সিসিডি নিয়ে। তারা সুপার সিসিডি ইএক্সআর তৈরির চেষ্টা করছে, যাতে সিএমওএসের উপাদান রয়েছে। তাদের তৈরি ফাইলপিক্স এফ২০০ ইএক্সআর ভালোই সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। সিসিডি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ফুজিৎসুর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে কোডাক ইস্টম্যান। গত বছর তারা তৈরি করেছে বিশ্বের প্রথম ৫০ মেগাপিক্সেল সেন্সর। এটি ব্যবহার করে আড়াই কিলোমিটার ব্যাপ্তির কোনো ক্ষেত্র ১ X ১ ফুট ল্যাপটপে নিয়ে আসা সম্ভব। ক্যামেরা জগতের আরেক বড় কোম্পানি নাইকন এখনো দু’নৌকায় পা দিয়ে আছে। তাদের কিছু ক্যামেরায় সিসিডি এবং কিছু ক্যামেরার সিএমওএস সেন্সর ব্যবহার হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যকার এসব দ্বন্দ্ব নিয়ে গবেষকদের মাথাব্যথা নেই।
আলোকচিত্রের জগতে অন্য যেকোনো কোম্পানির চেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছে কোডাক ইস্টম্যান। সম্প্রতি তারা সিসিডি এবং সিএমওএস উভয় প্রযুক্তির সেন্সর ব্যবহার করে বিশাল ক্ষেত্রের আলোকচিত্র ধারণের উপায় উদ্ভাবন করেছে। একই সাথে ভবিষ্যতে যাতে ফ্ল্যাশ বাল্বের প্রয়োজন না হয়, তা নিয়েও কাজ করছে। কোডাকের গবেষকরা ছবির মানোন্নয়ন, বিশেষ করে রাতে কিংবা চলমান দৃশ্য ধারণের ক্ষেত্রে আরো নিখুঁত ছবি পাওয়া, কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। ফিল্টারের ক্ষেত্রে বিরাজমান বায়ার প্যাটার্ন ব্যবহার করেই কাজটি করেছেন তারা। বিজ্ঞানী জন ক্যাম্পটন এবং জন হ্যামিলটনের উদ্ভাবিত ওই কৌশল ইমেজ সেন্সরকে ২ থেকে ৪ গুণ বেশি স্পর্শকাতর করে তুলেছে। তারা বায়ার প্যাটার্নে ফোর্থ পিক্সেল ফিল্টারের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। এ পিক্সেলকে বলা হচ্ছে পাঞ্চরোম্যাটিক পিক্সেল। এটি সব দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গদৈর্ঘ্য সংবেদনশীল এবং এটি আলো শোষণ করতে সক্ষম। এই পাঞ্চরোম্যাটিক পিক্সেল একসময় আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কোডাকের ইমেজ সেন্সর সলিউশন্স গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক ক্রিস ম্যাকনাইফ বলেন, নতুন উদ্ভাবিত কৌশল ইমেজ সেন্সর প্রযুক্তিতে নতুন ধারার প্রবর্তন করবে এবং কম আলোতে ছবি তোলার ক্ষেত্রে আমাদের যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা হয়তো অতিক্রম করা সম্ভব হবে।
এদিকে ছবি বিকৃত হওয়া বা ফটো ফিল্টারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসন্স ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ঝেনকিয়ং জ্যাক মা এবং ছাত্র হো-চি ইউয়ান। তারা উন্নয়ন ঘটিয়েছেন নমনীয় আলোক সংবেদনশীল উপাদানের। তারা বলছেন, এটি ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করবে। তাদের গবেষণা দলে আরো রয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসন ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রফেসর ম্যাক্স লিগালে এবং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পল্লব ভট্টাচার্য।
গবেষকরা বলছেন, মানুষের চোখ তাদেরকে এমন কৌশল উদ্ভাবনে অনুপ্রাণিত করেছে। তারা দেখেছেন, সিঙ্গেল লেন্সের মধ্যদিয়ে মানুষের চোখে আলো প্রবেশ করে। কিন্তু চোখের পেছনে ইমেজ বা ছবি ফুটে ওঠে কার্ভ বা বাঁকা রেটিনায়। আর এ কারণেই ছবি বিকৃত হয় না। প্রফেসর জ্যাক মা বলেন, আমরা যদি ক্যামেরা দিয়ে নিখুঁত ছবি তুলতে চাই, তাহলে আমাদের প্রয়োজন হবে একটি লেন্স।
জ্যাক মা এবং তার দল বিশেষভাবে ন্যানোমেমব্রেন দিয়ে তৈরি করেছেন কার্ভ বা বাঁকা ফটোডিটেক্টর। এটি খুবই পাতলা ও নমনীয় জার্মেনিয়াম শিট এবং আলোক সংবেদি উপাদান। উচ্চ পর্যায়ের ইমেজ সেন্সরে কখনো কখনো এই ধরনের উপাদান ব্যবহার হয়। গবেষকরা পাতলা, নমনীয় প্লাস্টিকের টুকরার মতো কোনো পলিমার উপাদানে ন্যানোমেমব্রেন প্রয়োগ করে দেখতে পারেন। এখন গবেষকরা একদিকে বাঁকা ফটোডিটেক্টর প্রদর্শন করেছেন। তবে জ্যাক মা আশা করছেন, শিগগিরই তারা হ্যামিসফেরিক্যাল সেন্সরের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবেন। তিনি বলেন, যেহেতু ফটোডিটেক্টর উপাদান জার্মেনিয়াম নিজে চরম নমনীয় এবং আলোক শোষণে প্রচন্ড দক্ষ, তাই তাদের পক্ষে খুব সহজেই উচ্চ ঘনত্বের নমনীয় ও স্পর্শকাতর ইমেজিং অ্যার তৈরি করা সম্ভব হবে।
গবেষণা যেভাবে চলছে তাতে বড় ছবির জন্য সেন্সর প্রযুক্তিটি ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই। এই কৌতূহল অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন হার্ভার্ডের এক বিজ্ঞানী। তিনি তৈরি করেছেন এমন এক উপাদান, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ব্ল্যাক সিলিকন’। এটি পৃথিবীতে বিরাজমান যেকোনো বাণিজ্যিক উপাদানের চেয়ে বেশি আলো শোষণ করতে পারে। তাই এই ব্ল্যাক সিলিকন আলোকচিত্র ধারণকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে তা হয়তো এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে এর সম্ভাবনা ইতোমধ্যেই চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@yahoo.com