২০০৫ সালের ৩ মে সায়েন্স ডেইলি এক খবরে জানায়, খুব শিগগিরই উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো দেশের একজন স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে বসে একজন রোগীর এক ফোঁটা রক্ত একখন্ড প্লাস্টিকের ওপর রাখবেন। প্লাস্টিকটির আকার হবে একটি ধাতব মুদ্রার মতো। ব্যস কয়েক মিনিটের মধ্যে এ রোগীর রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা তথা ডায়াগনস্টিক টেস্ট সম্পন্ন হয়ে যাবে। অন্যান্য পরীক্ষার মধ্যে ব্লাড টেস্টের পাশাপাশি সংক্রামক রোগজীবাণু বিশ্লেষণও সম্পন্ন হবে সেখানে। ম্যালেরিয়া ও এইচআইভি/এইডস, হরমোন সমস্যা, এমনকি ক্যান্সার সম্পর্কেও জানা যাবে এর মাধ্যমে। এই বিশেষ প্লাস্টিক খন্ডটির নাম lab-on-a-chip। আর এই বৈপ্লবিক পণ্য ও প্রক্রিয়াটি মানুষ পেতে যাচ্ছে ন্যানোটেকনোলজির গবেষণাসূত্রে। এই ন্যানোটেকনোলজিসূত্রে পাওয়া ন্যানোমেডিসিন আজ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে কোটি কোটি মানুষের রোগ থেকে বেঁচে থাকার অনন্য উপায় হিসেবে। শুধু ন্যানোমেডিসিন নয় অন্যান্য ক্ষেত্রে ন্যানোটেকনোলজি রাখবে বৈপ্লবিক অবদান।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জয়েন্ট সেন্টার ফর বায়োইথিকস’-এর একটি গবেষণা সমীক্ষাসূত্রে ৬৩-সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল ন্যানোটেকনোলজির সেরা দশটি প্রয়োগক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তির প্রয়োগ তথা ন্যানোমেডিসিনের প্রয়োগের বিষয়টিও উল্লিখিত রয়েছে। তারা মনে করেন পানি, কৃষি, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ও পরিবেশে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ আগামী এক দশকে ব্যাপকভাবে শুরু হবে। এই বিশেষ প্যানেল সেরা যে ১০ ক্ষেত্রে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছে, তা তাদের আরোপিত গুরুত্বের যথাক্রমে ছিল নিম্নরূপ :
০১. জ্বালানি মজুদ, উৎপাদন ও সংরক্ষণ;
০২. কৃষি উৎপাদন জোরদার করা;
০৩. পানি শোধন ও দূষণরোধ;
০৪. রোগ নির্ণয়,
০৫. ওষুধ প্রয়োগ ব্যবস্থা,
০৬. খাবার প্রক্রিয়াজাত ও মজুদ করা;
০৭. বায়ুদূষণ চিহ্নিত করা ও প্রতিকার;
০৮. নির্মাণ;
০৯. চিকিৎসা তথা ন্যানোমেডিসিন এবং
১০. কীট চেনা ও দমন।
এই সমীক্ষায় ন্যানোটেকনোলজিকে জাতিসংঘের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের সাথে বিজড়িত করা হয়েছে। ২০০০ সালে জাতিসংঘের ১৮৯ সদস্য রাষ্ট্রের সবই জাতিসংঘের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২০১৫ সালের মধ্যে এই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করে মানব উন্নয়নসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে উৎসাহিত করবে। এই সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রণেতারা বর্ণনা দিয়েছেন কী করে উল্লিখিত দশটি ক্ষেত্রে ন্যানোটেকনোলজি অবদান রাখতে পারে এই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য। তাদের দাবি : ন্যানোপ্রযুক্তির লক্ষিত প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সমূহ-সম্ভাবনা রয়েছে। ন্যানোটেকনোলজি তুলনামূলকভাবে নতুন ক্ষেত্র হলেও বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধানে তা তুলনামূলক কম খরচে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হাজির করতে সক্ষম। এ উপলব্ধি অনেক উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে এসেছে। বেশকিছু উন্নয়নশীল দেশ ইতোমধ্যেই চালু করেছে তাদের নিজস্ব ন্যানোটেকনোলজি উদ্যোগ। লক্ষ্য, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ন্যানোটেকনোলজির সুফল পৌঁছে দেয়া। ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ ২০০৪-২০০৯ সময় পরিধিতে তাদের ন্যানোমেটেরিয়াল সায়েন্স উদ্যোগ বাস্তবায়নের পেছনে খরচ করছে ২ কোটি ডলার। আমরা যে সেখানে কোনো উদ্যোগেরই সূচনা করতে পারিনি, তা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু উল্লিখিত সমীক্ষা প্রতিবেদনের অন্যতম এক প্রণেতা আব্দুল্লাহ দার মনে করেন : উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হলে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাই হোক, ন্যানোপ্রযুক্তির অন্যতম অবদান ন্যানোমেডিসিন নিয়েই বিস্তারিত আলোকপাতের প্রয়াস পাবো এ লেখায়।
ন্যানো মেডিসিন কী?
কেমন হতো যদি চিকিৎসকরা প্রথম ক্যান্সার কোষটি খুঁজে বের করে একদম গোড়াতেই সে ক্যান্সার কোষটি ধ্বংস করে দিতে পারতেন? নিশ্চয়ই তখন মানুষের শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার কোনো সুযোগ থাকতো না। আমরা ক্যান্সারে কারো মারা যাবার খবরও শুনতাম না। কেমন হতো যদি রোগজীবাণুওয়ালা দেহকোষগুলো শরীরের যেখানে আছে, সেখানে বসিয়ে দিতে পারতাম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বায়োলজিক্যাল মেশিন? নিশ্চয়ই আমরা বেঁচে যেতে পারতাম রোগযন্ত্রণা থেকে। কেমন হতো যদি আমরা প্রয়োজনের সময় অণু-পরমাণু আকারের জীবনদায়ী ওষুধ পাম্প করে দেহে স্থাপন করতে পারতাম? এ ধরনের দৃশ্য আমরা দেখবো- এমনটি আজ আমাদের কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হবে। কিন্তু আগামী এক দশকের মধ্যে মানুষ হয়তো বাস্তবে এ ধরনের ঘটনা দেখতে পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-রোডম্যাপের ন্যানোমেডিসিন উদ্যোগে এসব লক্ষ্য অর্জনের কথাই উল্লেখ আছে। আধুনিক বিশ্বের চিকিৎসক ও গবেষকদের গভীর বিশ্বাস ন্যানোমেডিসিন মানুষের সামনে চিকিৎসা জগতের এক অনন্য সম্ভাবনাময় দুয়ার খুলে দেবে।
ন্যানোমেডিসিন হচ্ছে ন্যানোটেকনোলজির একটি প্রশাখা বা উপশাখা। ন্যানোটেকনোলজির মেডিক্যাল অ্যাপ্লিকেশনই হচ্ছে ন্যানোমেডিসিন। ন্যানোমেডিসিনের ব্যাপ্তি চিকিৎসায় ননমেটেরিয়ালের ব্যবহার থেকে ননইলেক্ট্রনিক বায়োসেন্সরের ব্যবহার পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি ভবিষ্যৎ ন্যানোমেডিসিনে মলিকুলার ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহারের সম্ভাবনাও রয়েছে।
ন্যানোমেডিসিন ন্যানোপ্রযুক্তির এমনসব প্রয়োগ, যা আমাদের উপহার দিতে পারে অতি দরকারি গবেষণাযন্ত্র, অগ্রসর পর্যায়ের ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম বা ওষুধ প্রয়োগ ব্যবস্থা। ন্যানোমেডিসিন আমাদের দেবে রোগ চিকিৎসার নতুন নতুন উপায়, করে দিতে পারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোষ মেরামতের ও কোষ প্রতিস্থাপনের সুযোগ। ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম হচ্ছে মেডিসিনে ন্যানোটেকনোলজির সবচেয়ে অগ্রসর পর্যায়ের প্রয়োগ। ন্যানোস্কেল পার্টিকল বা ন্যানোপার্টিকলস উদ্ভাবিত হচ্ছে ড্রাগ বায়োঅ্যাবেইলিবিটি বাড়ানোর জন্য, যা নতুন ড্রাগ ডিজাইনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি সীমাবদ্ধতা। বায়োঅ্যাবেইলিবিটির অভাব বিশেষ করে নতুনতর ওষুধ এখনো পরীক্ষাধীন আরএনএ ইন্টারফিয়ারেন্স থেরাপির ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে আছে। চর্বি অথবা পলিমারভিত্তিক ন্যানোপার্টিকলগুলোকে কোষগুলো গ্রহণ করে এগুলোর অতি ক্ষুদ্র আকারের কারণে। এসব ন্যানোপার্টিকল কোষগুলোর মধ্যে ড্রাগ চলাচলের কাজে ব্যবহার করা যায়।
রোগ ও অসুখবিসুখের সৃষ্টি হয় মলিকুলার ও সেলুলার পর্যায়ে সমস্যা সৃষ্টির কারণে। সোজা কথায় শরীরের অণু-পরমাণু ও কোষগুলো ঠিকমতো কাজ করলে রোগ-বালাই কাছেই আসতে পারে না। আজকের দিনের সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতির আকার খুবই বড় ও ততটা উন্নত নয়। একটি ভালো মানের সার্জিক্যাল ছুরি বা কাঁচি দিয়ে কোনো কোষে শল্যচিকিৎসা করা মুশকিল। দেহকোষে এসব ছুরি-কাঁচি দিয়ে কোষ মেরামত করতে গেলে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আজকের দিনে কাটাছেঁড়া হয় একটি মাত্র কারণে : দেহকোষগুলোর উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা রয়েছে জোড়া লাগবার। এ শক্তিবলে ক্ষতস্থান শুকিয়ে যায়।
ন্যানোটেকনোলজি এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে মানুষকে সহায়তা দিতে। ন্যানোটেকনোলজিকে বলা হয় : ‘ম্যানুফেকচারিং টেকনোলজি অব দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’। এই টেকনোলজি আমাদের দিতে পারে ‘মলিকুলার কমপিউটার’সহ নানা ধরনের জটিল মলিকুলার মেশিনপত্র। এ টেকনোলজি আমাদের সক্ষম করে তুলবে কমপিউটার নিয়ন্ত্রিত অসংখ্য মলিকুলার টুলের সমন্বয়ে এক যন্ত্রবহর গড়ে তুলতে। আর এই যন্ত্র বা টুলগুলোর আকার হবে আমাদের দেহকোষের চেয়েও ছোট। এগুলো তৈরি হবে যথার্থ সঠিক ও অব্যর্থ ড্রাগ মলিউকিলের সমন্বয়ে। এসব যন্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ওষুধ প্রয়োগ করা যাবে প্রথমবারের মতো কোষ ও অণু পর্যায়ে। এর মাধ্যমে সঞ্চালন ব্যবস্থার যাবতীয় বাধা দূর করা যাবে। ধ্বংস করা যাবে ক্যান্সার কোষ। নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যাবে সাবসেলুলার ওরগানসেলের কাজের ওপর। ঠিক যেমনটি আজকের দিনে আমাদের রয়েছে কৃত্রিম হার্ট, তেমনি ভবিষ্যতে পাবো কৃত্রিম সাইটোকন্ড্রিয়ন। একইভাবে নাটকীয় ন্যানোপ্রযুক্তি আমাদের দেবে নতুন নতুন যন্ত্র, যা দিয়ে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারবো দেহকোষের, ঝিল্লির। আরো বিশদ-বিস্তৃতভাবে। কোষের চেয়েও ছোট সেন্সর দেহের নানা ক্রিয়াকান্ড কিভাবে চলছে, তা জানিয়ে দেবে। টিস্যু বা ঝিল্লি ছিল রাসায়নিকভাবে স্থির বা ফ্ল্যাশফ্রোজেন, তার বিশ্লেষণ চলবে অণুর পর্যায়ে। এর ফলে কোষের সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যাবে।
ন্যানোমেডিসিন : বিস্তৃত পরিধি
আমরা যখন ‘ন্যানোটেকনোলজি’ কিংবা ‘ন্যানোমেডিসিন’ শব্দ দুটি শুনি, তখন আমাদের মাথায় আসে অতি ক্ষমতাধর একটা কিছু। এর ক্ষমতার পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা কাজ করে চলেছেন নিরলস। ‘ন্যানো’ বিষয়টিকে আমরা অনেকেই মনে করি এটা ভবিষ্যতের বিষয়। এ সম্পর্কিত আবিষ্কার-উদ্ভাবন ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। হ্যাঁ, একথা সত্যি। ন্যানোমেডিসিনের নানা ক্ষেত্র এখনো গবেষণা, ক্লিনিক-পূর্ব অথবা ক্লিনিক-পর্যায়ে। তবে আমরা অনেকেই এখনো ন্যানোমেডিসিন সম্পর্কে কিছু না জানলেও মানবসমাজ এই ন্যানোমেডিসিন থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উপকার পেতে শুরু করেছে।
কোয়ান্টাম ডটস ব্যবহার হতে যাচ্ছে ক্যান্সার কোষ বা মন্দকোষ চিহ্নিত করতে। যদিও এটি এখনো সম্ভাবনাময় গবেষণার পর্যায়ে। এসব কোয়ান্টাম ডট অবলোহিত আলোর মতো আলো শোষণ কিংবা নির্গত করতে পারে। এ আলো মানবদেহে ঢুকতে পারে এবং ইনফ্রারেড স্ক্যানার দিয়ে তা দেখা সম্ভব। ক্লিনিক-পর্যায়ে এর ব্যবহার শুরু হলে তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহার একদম কমিয়ে দেবে। আজকাল ডায়াগনসিস বা রোগনির্ণয় কাজে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বা রেডিওঅ্যাকটিভ সাবস্ট্যান্সের ব্যাপক ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে কোয়ান্টাম ডট আমাদের দেবে আরো বিস্তৃত ও সঠিক ফল। রেডিওঅ্যাকটিভ যন্ত্র দিয়ে ততটা সঠিকভাবে রোগনির্ণয় সম্ভব নয়। কোয়ান্টাম ডট ন্যানোক্রিস্টালের মতো ন্যানোপার্টিকলগুলোর আকার একটি প্রোটন অণু বা একটি ডিএনএ অণুর সমান। কোয়ান্টাম ডট যে অবলোহিত আলো শোষণ কিংবা নির্গত করে তার তরঙ্গদৈর্ঘ খুবই ছোট। ফলে এর মাধ্যমে রোগনির্ণয় অতিমাত্রায় যথার্থ বা সঠিক হয়। তাছাড়া এগুলো প্রোটন-প্রোটন আমত্মঃক্রিয়া পরীক্ষায় আদর্শ বলে বিবেচিত। কোয়ান্টাম ডট কিছু নির্দিষ্ট প্রোটন বা ডিএনএ অণু পরীক্ষা করে জৈবিক ঘটনাবলী চিহ্নিত করতেও সক্ষম। চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম ডট হতে যাচ্ছে আমাদের রোগ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায়। ন্যানোটেকনোলজি বা ন্যানোমেডিসিন আমাদের কাছে পৌঁছে দেবে ক্যান্সার কোষ চিহ্নিত করার উন্নততর ও সহজতর উপায়। আজকের দিনে ক্যান্সার চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োজন ১০ লাখ ক্যান্সার সেল। ন্যানোডিভাইস এ সংখ্যা নামিয়ে আনবে ১ হাজারে। ক্যান্সার কোষ চিহ্নিত করার পাশাপাশি ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করবে ন্যানোমেডিসিন। গবেষণাগারে ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে ইঁদুরের রক্তপ্রবাহে সুনির্দিষ্ট ন্যানোপার্টিকল ঢুকিয়ে প্রোস্টেইট ক্যান্সার বা মূত্রস্থলীয় গ্রিবাসংলগ্ন গ্রন্থিবিশেষের ক্যান্সার দমনে সফলতা পাওয়া গেছে। গবেষকরা আরো দেখিয়েছেন, আজকের দিনে যেসব বিষাক্ত পদার্থ অবিষাক্ত পদার্থের সাথে দেহে ঢোকানো হয়, তা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাবে এই ন্যানোমেডিসিনের মাধ্যমে। এটাও বলা হচ্ছে, বিশেষ ধরনের ন্যানোপার্টিকল পেটের অসুখ-বিসুখসহ এ ধরনের আরো অনেক রোগ নির্ণয় করতে পারবে।
গোল্ড ন্যানোপার্টিকলস
আপনি হয়তো গোল্ড ন্যানোপার্টিকলের নাম শুনে থাকতে পারেন। হতে পারে, নাম শুনেছেন, কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে তেমন জানা হয়ে ওঠেনি। হয়তো একে আপনি চেনেন ভিন্ন কোনো নামে। ‘কলয়েডাল গোল্ড’ কিংবা ‘ন্যানোগোল্ড’ নামে। এটি গোল্ডের ছোট্ট মলিকুলার পার্টিকল, যা ভাসিয়ে দেয়া হয় কোনো তরল পদার্থে। সাধারণত পানিতে। যদি গোল্ডপার্টিকল অতিমাত্রায় ছোট হয়, তখন তরলকে মনে হবে লাল রঙের একটি ছায়া। পার্টিকল যদি আরো বড় আকারের হয়, তরলের রঙ হবে ময়লাযুক্ত হলুদ। যখন গোল্ডকে ন্যানোপার্টিকলে ভাঙ্গা হয়, তা ভাঙতে পারে নানা উপায়ে, এর প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে।
গবেষকরা রকমারি আকারের গোল্ডপার্টিকল পেয়েছেন। কোনোটা রঙের আকার। কোনোটা কিউব বা ঘনক আকারের। আবার কোনোটা টুপির আকারের কিংবা গোলক আকারের। ন্যানোমেডিসিন বা ন্যানোটেকনোলজি মানবসমাজের সামনে নবতর সংযোজন হলেও, কলয়েডাল গোল্ড সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষের চারপাশেই ছিল। প্রথম দিকে এর ব্যবহার হতো কাঁচ রং করার কাজে। ১৮৫০-এর দশকে মাইকেল ফ্যারাডে এর পুনঃআবিষ্কার করেন এবং তখন থেকে তা বিজ্ঞানের প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় গোল্ড ন্যানোপার্টিকলগুলোর ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাধারণ ন্যানোপ্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিকস উৎপাদন ও বিরল পদার্থ বিশ্লেষণে এর ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত। ২০০৫ সালে আবিষ্কার করা হয় যে, ন্যানোগোল্ড রেন্ডার বা গলনকারক ব্যাকটেরিয়া কোটিংয়ে খুবই উপকারী। ইলেক্ট্রনিক ওয়্যারিং কোটিংয়ে এই ন্যানোগোল্ড রেন্ডার বিশেষ উপকারী বিবেচিত হয়। নাইট্রিক অ্যাসিড প্রয়োগ করলে ব্যাকটেরিয়া বহন করে একটি নেগেটিভ চার্জ, আর ন্যানোগোল্ড বহন করে একটি পজিটিভ চার্জ। এই কোটেড ব্যাকটেরিয়া পানি শোষণ করতে সক্ষম। এতে গোল্ড দিলে তা কার্যকর বিদ্যুৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে। কলয়েডাল গোল্ড চিকিৎসার ক্ষেত্রে খুবই উপকার বয়ে এনেছে । চিকিৎসকেরা এখন সম্ভাবনা যাচাই করছেন সিলভার ন্যানোপার্টিকলের। ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ানরা বলছেন, গোল্ড ন্যানোপার্টিকল ইঁদুরে প্রবিষ্ট করে রিউমেটয়েড আথ্রাইটিস দূর করায় সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে। গোল্ড ন্যানোপার্টিকল আলজেমার রোগও উপশম করে। এই ভয়াবহ রোগটি মানুষের স্মৃতিশক্তিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এ রোগের আরো অনেক ক্ষতিকর দিকও আছে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, কলয়েডাল গোল্ড ও মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন অর্থাৎ ছোট তরঙ্গের আলোর বিকিরণ যৌথভাবে আমাদের এসব ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে প্রচলিত রেডিয়েশন থেরাপিতে ন্যানোগোল্ড সংযোজন করে এ থেরাপির আরো উন্নয়ন সাধন সম্ভব হয় কি না। তবে এর সবচেয়ে বড় ব্যবহার হয়তো ক্যান্সার চিকিৎসায়ই। কলয়েডাল গোল্ড ইন্ট্রাভেনাম স্পেকট্রোস্কপি সহযোগে ব্যবহার হয়ে আসছে মানুষের শরীরের ম্যালিগন্যান্ট টিউমার তথা মারাত্মক ক্ষতিকর টিউমার চিহ্নিত করার কাজে। গোল্ড ন্যানোপার্টিকল ধমনীতে ঢুকিয়ে তা স্পেকট্রোস্কোপ নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে টিউমারের সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। এরপর টিউমারের বড় হয়ে ওঠা থামানোর জন্য এগুলোকে টিউমারে প্রবেশ করানো হয় অ্যান্টিবডিসহযোগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করা হয় টিউমারের আকার ছোট করে আনার জন্য।
অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সমর্থন করেন বড় আকারের ন্যানোপার্টিকল। কারণ, এগুলো অধিকতর কার্যকরভাবে অবলোহিত আলোর প্রতিফলন ঘটায় এবং বড় আকারের ন্যানোপার্টিকলকে দেহের ভেতরে ঘোরানো-ফেরানো যায় খুবই সহজে। তাছাড়া এ আকারের ন্যানোপার্টিকল টিউমারে বিদ্ধ করানোর কাজও সহজতর।
ন্যানোগোল্ডের বিস্ময়কর গুণাগুণ বিভিন্নভাবে প্রাচীন যুগের মানুষও জানতে পেরেছিলেন। এরা সুদীর্ঘ সময় ও শ্রম ব্যয় করেন রসায়ন গবেষণায়। সেই সূত্রে এরা কলয়েডাল গোল্ডকে অভিহিত করতে পেরেছিলেন ‘Elixir of Life’ বা ‘জীবনের পরশমণি’ নামে। অনেক রসায়নবিদ সারাজীবন গবেষণা করে কাটিয়েছেন স্বর্ণ থেকে এমন এক চুমুক তরল সৃষ্টিতে, যা হবে মানুষের জন্য সর্বরোগহর। মানুষ পাবে নির্ভেজাল সুস্থ-সবল দেহ। এই ‘এলিক্সির অব লাইফ’ সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তবে কোথাও এমনটি জানা যায়নি যে জীবনের সেই পরশমণি তৈরির কোনো সূত্র কেউ আবিষ্কার করেছিলেন বলে। তবে ষোড়শ শতাব্দীতে Paraclesus নামের এক রসায়নবিদ দাবি করেছিলেন, তিনি এক চুমুক রহস্যময় সর্বরোগহর তরল সৃষ্টি করতে পেরেছেন। কিন্তু মানুষ জানে না, তার সৃষ্ট কী সেই পরশমণি। তবে বিজ্ঞানীরা জানতেন, তা করা সম্ভব হতে পারে। কেননা, প্রাচীন রোমানরা কলয়েডাল গোল্ড ব্যবহার করেছে বিভিন্ন দ্রবণ তৈরিতে, যা দিয়ে কাঁচ রং করা যায়। রোমানরা সোনা থেকে বেশ কয়েকটি রঙের সন্ধান পায়। পানিসহকারে স্বর্ণকে বিভিন্ন দ্রবণে মিশিয়ে এরা এসব রং তৈরি করতো। এভাবে এরা হলুদ, লাল ও বেগুনি রংয়ের ছায়া তৈরি করতে সক্ষম হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে কলয়েডাল গোল্ড ব্যবহার হচ্ছে সফলভাবে ক্যান্সার চিহ্নিত করা ও চিকিৎসার কাজে।
ন্যানোডিভাইসের আকার
ন্যানোপার্টিকল অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আকারের হওয়ায় এগুলো কোষের ভেতর দিয়ে ঢোকানো যায় এবং তা কোষ অণুগুলোর সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে। ন্যানো কথাটির অর্থ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বা অতিক্ষুদ্র। এক ন্যানোমিটার হচ্ছে ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগের সমান। এক ন্যানোগ্রাম হচ্ছে ১ গ্রামের ১০০ কোটি গ্রামের ১ ভাগ। তেমনি আমরা যদি বলি ১ ন্যানোপাউন্ড, তবে তার অর্থ হচ্ছে ১ পাউন্ডের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ। তাহলে গণিতের বিবেচনায় ‘ন্যানো’ বলতে বুঝবো ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ।
ডেক্সলারের প্রস্তাব, ‘মলিকুলার মেকানিক্যাল লজিক’ হচ্ছে সবচেয়ে কম্প্যাক্ট ও সিস্টেম বিবেচনাদৃষ্টে সর্বোত্তম লজিক। লজিক ইলিমেন্টগুলো দখল করে মাত্র কয়েক ঘন ন্যানোমিটার আয়তন। এমনকি সিস্টেম ওভারহেডসহ (বিদ্যুৎ, সংযোগ ইত্যাদি) প্রতি উপাদানের বা ইলিমেন্টের আয়তন ১০০ ঘন ন্যানোমিটারের চেয়েও কম। ১০ হাজার ইলিমেন্টের একটি লজিক সিস্টেম এমন একটি ঘনক বা কিউবে আঁটানো সম্ভব, যার এক ধারের দৈর্ঘ্য ১০০ ন্যানোমিটারের বেশি হবে না। অথচ এই সিস্টেম ধারণ করতে পারবে একটি ছোট্ট প্রসেসর। অতএব দেখা যাচ্ছে, ০.০১১ ঘন মাইক্রোনেব চেয়ে সামান্য বড় আয়তন যথেষ্ট হবে একটি কমপিউটার ধারণ করতে। এর তুলনা চলে একটি কোষের সাথে (কয়েক হাজার কিউবিক মাইক্রন), এমনকি এটি একটি সাবসেলুলার অরগান সেলের তুলনায়ও ছোট্ট। অব্যাহতভাবে এক গিগাহার্টজ মেমরি নিয়ে কাজ করতে সক্ষম এ কমপিউটারের জন্য বিদ্যুৎ খরচ হবে ১০-৯ ওয়াটের চেয়েও কম। অর্থাৎ এর জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে ১ ওয়াটের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ। যেখানে মানবদেহ বিশ্রামাবস্থায় ব্যবহার করে ১০০ ওয়াট। ধীরগতিতে চালানো ও রিভার্সিবল লজিক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ব্যবহার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনা যাবে।
বিভিন্ন ধরনের মলিকুলার সেন্সর ও অ্যাকচুয়েটর একই ধরনের আয়তনে আঁটানো যাবে। একটি মলিকুলার রোবটিক আর্ম ১০০ ন্যানোমিটারের চেয়েও কম লম্বা। একইভাবে মলিকুলার বাইন্ডিং সাইটগুলো ১০ ন্যানোমিটারের চেয়ে কম লম্বা। অপরদিকে একটি লাল রক্তকণিকার ব্যাস প্রায় ৮ মাইক্রন, রৈখিক মাত্রার দিক থেকে যা আমাদের ১০০ ন্যানোমিটার প্রসেসর থেকে ৮০ গুণ বড়। -০.১ মাইক্রোন আকারের ডিভাইসগুলোকে সহজেই সার্কুলেটরি সিস্টেমে বসিয়ে দেয়া যাবে। এমনকি তা ঢোকানো যাবে কোনো কোষে।
ন্যানোটিউব দেবে আরো স্পষ্ট এক্সরেচিত্র
মিনি এক্সরে টিউব রেডিওথেরাপিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এয়ারপোর্ট ব্যাগেজ স্ক্যানিং কাজকে করে তুলবে আরো সহজ। ন্যানোটিউব চিকিৎসকদের সামনে হাজির করবে আরো স্পষ্ট এক্সরেচিত্র। এক্সরে আবিষ্কারের শত বছর পর আজ মনে হয় এটি এর চূড়ান্ত রূপ নিতে যাচ্ছে। এক্সরে তৈরির নতুন উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কার্বন ন্যানোটিউব। এর মাধ্যমে সম্ভব হবে রিয়েলটাইম ত্রিমাত্রিক স্ক্যানিং।
চলতি ইমেজিং টেকনোলজির দিকে থাকালে দেখা যাবে ১০০ বছর আগে যে এক্সরে উইলহেম রঞ্জেন আবিষ্কার করেছিলেন, তার পরিবর্তন ঘটেছে খুবই কম। সম্প্রতি নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ম্যাটেরিয়েল সায়েন্টিস্ট প্রচলিত ইমেজিং ডিভাইসের বিকল্প হিসেবে হাজির করেছেন ন্যানোটিউব। এটি তৈরি করতে পারবে এক্সরে। এটি একটি টেকসই ও প্রয়োগযোগ্য প্রযুক্তি হতে যাচ্ছে। প্রচলিত এক্সরে ব্যবস্থায় ইলেক্ট্রন বের হয় একটি গরম টাঙস্টেন ফিলামেন্ট থেকে এবং তা চলে যতক্ষণ না তা এক্সরে সৃষ্টিকারক কোনো ধাতব টার্গেটে পৌঁছে। যেহেতু এক্সরে ছাড়া হয় একটি একক উৎস থেকে কমপিউটেড টেকনোলজির মতো ত্রিমাত্রিক ইমেজিং বা চিত্রধারণ খুবই ঝামেলাপূর্ণ। শরীরে ৩৬০০ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক্সরেচিত্র নিতে হলে সিস্টেমটিকে রোগীর দেহের চারপাশে ঘুরাতে হয়। কিন্তু এই গবেষক দলের ত্রিমাত্রিক স্ক্যানারে ব্যবহার করা হয় বেশ কয়েকটি ন্যানোটিউব। টাঙস্টেন ফিলামেন্টের বদলে এগুলোর ব্যবহার হয়। প্রতিটি ন্যানোটিউব বিকিরণ করে ইলেক্ট্রন যখন ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় তখন। এই ইলেক্ট্রন বিকিরণ চলে ফিল্ড ইমিশন নামের কোয়ান্টাম ইফেক্টের মাধ্যমে। তখন ন্যানোটিউবের চারপাশে ইলেকট্রিক ফিল্ড ঘনীভূত হয়। এর ফলে এর পক্ষে ইলেকট্রন নির্গত করা সহজতর হয়। আসলে ন্যানোটিউবই এই রিয়েলটাইম ত্রিমাত্রিক স্ক্যানিংকে সমেত্মাষজনক করে তুলেছে এবং এই স্ক্যানিং এমনকি চলে দ্রুততর উপায়ে। টিউমার চিকিৎসার রেডিওথেরাপির উন্নয়ন ঘটাবে এই ন্যানোটিউব। এই এক্সরের সময় টিস্যু ডেমেজ হবে সবচেয়ে কম হারে। গবেষক দল এর সফল প্রদর্শন সম্পন্ন করেছেন।
ন্যানোরোবট
চিকিৎসাক্ষেত্রে ন্যানোরোবট ব্যবহারের সম্ভাবনার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ন্যানোরোবট ব্যবহারের সমর্থকরা বলছেন, ন্যানোরোবট পুরোপুরি পাল্টে দেবে চিকিৎসার জগৎ। ন্যানোমেডিসিন ব্যবহার করবে এসব ন্যানোরোবট। দেহে প্রবেশ করে এসব ন্যানোরোবট ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেহকোষ মেরামত করবে। দূর করবে সংক্রমিত কোষ। ইনস্টিটিউট অব মলিকুলার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের রবার্ট ফ্রিতাসের মতে, একটি বিশেষ ধরনের রক্তবাহিত ন্যানোরোবটের আকার হবে .৫ থেকে ৩ মাইক্রন। এর সাইজের কারণে এটি যেকোনো রগের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া যাবে। এই ন্যানোরোবট তৈরি করতে প্রাথমিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার হবে কার্বন। কারণ, কার্বনের রয়েছে কিছু অন্তর্নিহিত শক্তি ও বিশেষ গুণ। এই ন্যানোরোবট তৈরি হবে এ উদ্দেশ্য সাধনে স্থাপিত বিশেষ ডেস্কটপ ন্যানোফ্যাক্টরিগুলোতে।
শরীরের ভেতরে কর্মরত ন্যানোডিভাইস পর্যবেক্ষণ করা যাবে এমআরআই ব্যবহার করে। বিশেষ করে এগুলোর উপাদান প্রধানত তৈরি হয় সাধারণ কার্বনের সি-আইসোটপের বদলে সি-অ্যাটম থেকে। কারণ কার্বন বা সি-এর রয়েছে নন-জিরো নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক মোমেন্ট। মেডিক্যাল ন্যানোডিভাইসকে প্রথমে মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হবে, এরপর তা কাজ করবে সুনির্দিষ্ট টিস্যু বা প্রত্যঙ্গের ওপর। চিকিৎসকরা অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং তারাই নিশ্চিত করবেন ন্যানোডিভাইসটি যথাস্থানে যথার্থভাবে কাজ করছে কি না। চিকিৎসকরা শরীরের অংশবিশেষ স্ক্যানও করতে পারবেন। এ স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসকরা পদ্ধতিগত সাফল্য অর্জনের সুযোগ পাবেন। টিউমার অপসারণসহ ক্যান্সার দমনে কাজ করবে এসব ন্যানোডিভাইস বা ন্যানোরোবট।
নিউরো-ইলেকট্রনিক ইন্টারফেস
ন্যানোডিভাইস গঠনে নিউরো-ইলেকট্রনিক ইন্টারফেস হচ্ছে একটি দূরদৃষ্টিসম্পস্ন লক্ষ্য। এই ইন্টারফেসের মাধ্যমে কমপিউটারের সংযোগ ঘটানো যাবে নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ু ব্যবস্থার সাথে। এতে প্রয়োজন হবে একটি মলিকুলার স্ট্রাকচার বা অণু-কাঠামো গড়ে তোলা, যার সাহায্যে বাইরের একটি কমপিউটার দিয়ে নার্ভ ইমপালস চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কমপিউটার সক্ষম হবে শরীর থেকে পাওয়া সিগন্যালের ব্যাখ্যা, সিগন্যাল ধারণ ও এর প্রতি সাড়া দিতে। এ ধরনের কাঠামোর চাহিদা ব্যাপক। কারণ অনেক রোগের বেলায় স্নায়ু ব্যবস্থার ক্ষয়সাধন ঘটে। অনেক আঘাত ও দুর্ঘটনা স্নায়ু ব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দেয়। ফলে স্নায়ু ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ে। এর ফলে দেখা দেয় প্যারাপ্লোগিয়া রোগ। এ রোগে নিম্নাঙ্গ অসাড় হয়ে পড়ে। যদি কমপিউটার নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ু ব্যবস্থা নিউরো ইন্টারফেসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে স্নায়ু ব্যবস্থার ঝামেলাও নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। তখন আঘাত ও দুর্ঘটনাজনিত জটিলতা সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে। এ ধরনের প্রয়োগে যখন বিদ্যুতের উৎস বাছাই করা হয়, তখন দুটি বিষয় মনে রাখতে হবে। এগুলো হচ্ছে : রিফুয়েলেবল এবং নন-রিফুয়েলেবল স্ট্র্যাটেজি। সোজা কথায় পুনঃজ্বালানিযোগ্য ও অ-পুনঃজ্বালানিযোগ্য কৌশল। প্রথম ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে জ্বালানি ভর্তির কাজ চলবে। কিংবা মাঝেমাঝে- ক্ষণে ক্ষণে জ্বালানি ভর্তি করবে ফোনিক, রাসায়নিক, টেথারেড, ম্যাগনেটিক ও ইলেকট্রিক্যাল উৎস থেকে। নন-রিফুয়েবল কৌশলের অর্থ বিদ্যুৎ সংগ্রহ করা হয় অভ্যন্তরীণ মজুদ জ্বালানি থেকে, যা থেমে যাবে যখন সব জ্বালানি বের করে দেয়া হবে।
এই উদ্ভাবনের একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এক্ষেত্রে ইলেকট্রিক্যাল বাধা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ইলেকট্রিক ফিল্ডসমূহ অর্থাৎ ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পালসসমূহ (ইএমপি) এবং অন্যান্য ভিভো ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসের পথভ্রষ্ট ফিল্ডসমূহ এই বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া ইলেকট্রন লিকেজ রোধের জন্য প্রয়োজন ভারি ইনসুলেটর বা ইলেকট্রনরোধক। ভিভো মিডিয়ামের উঁচুমাত্রার প্রবাহ ঘটলে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারি বৈদ্যুতিক তারও প্রয়োজন। যাতে করে অতিগরম হয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন না ঘটে। এক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি এখনো খুব বেশি হয়নি। যদিও এক্ষেত্রে গবেষণা চলছে জোরালোভাবে।
ড্রাগ ডেলিভারি
ড্রাগ ডেলিভারি সম্পর্কিত ন্যানোমেডিসিন উদ্যোগের কেন্দ্র হচ্ছে ন্যানোস্কেল পার্টিকল উদ্ভাবন অথবা ড্রাগের বায়োঅ্যাবেইলিবিলিটি বাড়ানো। বায়োঅ্যাবেইলিবিলিটি বলতে বুঝায় শরীরে যেখানে যে ড্রাগ মলিকিউল দরকার, সেখানে এর উপস্থিতি থেকে শরীরের উপকার করা। ড্রাগ ডেলিভারির নজর হচ্ছে, শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে ও একটা সময় ধরে বায়োঅ্যাবেইলিবিলিটিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছানো। তা অর্জন করা সম্ভব ন্যানোইঞ্জিনিয়ার্ড ডিভাইস দিয়ে মলিকুলার টার্গেটিংয়ের মাধ্যমে। মলিকিউলকে টার্গেট করে যথার্থ কোষে ড্রাগ পৌঁছানোই এর সবকিছু। এটাই বায়োঅ্যাবেইলিবিলিটি। এই বায়োঅ্যাভেইলিবিলিটির অভাবে প্রতি বছর ৬৫০০ কোটি ডলারের ড্রাগের অপচয় হয়। Vivo Imaging হচ্ছে আরেকটি ক্ষেত্র যেখানে ন্যানোডিভাইসের উদ্ভাবন চলছে। ন্যানোপার্টিকল কনট্রাস্ট এজেন্ট ব্যবহার করে আল্ট্রাসাউন্ড ও এমআরআই-এর মতো ইমেজ ব্যবহার করে ড্রাগ ডিস্ট্রিবিউশন ও কনস্ট্রাস্টের উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। ন্যানোইঞ্জিনিয়ার্ড ম্যাটেরিয়েলের নতুন যে পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হচ্ছে, তা ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ-ব্যাধির চিকিৎসায় কার্যকর উপায় পাওয়া যাবে। ন্যানো বিজ্ঞানীরা আগামী দিনে কী অর্জন করবেন তা কল্পনারও বাইরে। এখন স্ব-সংযোজিত ন্যানোযন্ত্র (সেলফ-অ্যাসেম্বল ন্যানোডিভাইস), যা চিহ্নিত ও পর্যালোচনা শেষে চিকিৎসাসেবা দেবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্লিনিক্যাল ডাক্তারদের কাছে রিপোর্ট করবে।
ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম- তা লিপিডভিত্তিক কিংবা পলিমারভিত্তিক ন্যানোপার্টিকলই হোক- এমনভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা ড্রাগের ফার্মাকোলজিক্যাল ও থেরাপিউটিক গুণাগুণ জোরদার করবে। ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেমের শক্তিটা হচ্ছে, এটি ড্রাগের ফার্মাকোকাইনেটিকস ও বায়োডিস্ট্রিবিউশন পাল্টে দিতে পারে। সোজা কথায় তা ওষুধের গতিধারা ও দেহের জৈবিক বস্ত্তর অবস্থান বদলে দিতে সক্ষম। ন্যানোপার্টিকলগুলোর রয়েছে অস্বাভাবিক গুণাগুণ। এই গুণাগুণকে কাজে লাগানো যাবে ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেমের উনণয়নে। যখন বড় পার্টিকলগুলো দেহ থেকে বিদায় নেবে, তখন সে স্থান দখল করবে ন্যানোপার্টিকলগুলো, এর ক্ষুদ্র আকারের কারণে। এখন উদ্ভাবন করা হচ্ছে ‘কমপ্লেক্স ড্রাগ ডেলিভারি মেকানিজম’। এর মাধ্যমে ড্রাগ পৌঁছানো যাবে নির্দিষ্ট ‘কোর্ষ-পর্দায় ও সেল সাইট্রোপ্লাজমে বা অণুর বাইরের পর্দার কোষেও। এখানে কার্যকারিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অনেক রোগ নির্ভর করে কোষের ভেতরের প্রক্রিয়ার ওপর। অতএব এ রোগ সাড়ানোর জন্য প্রয়োজন সেই ড্রাগ প্রয়োগ, যা কোষকে বাগে আনতে পারে। সেজন্য ড্রাগ মলিকিউল দক্ষতার সাথে কাজে লাগানো দরকার। ড্রাগ শরীরে প্রয়োগ করে তা কার্যকর করা হয় কোনো কাজকে থামাতে কিংবা জোরদার করতে। যেমন কম দ্রবণক্ষমতা প্রতিস্থাপন সম্ভব এমন একটি ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেমের সাহায্যে, যেখানে হাইড্রোফিলিক ও হাইড্রোফোবিক পরিবেশ বিদ্যমান। এর মাধ্যমে দ্রবণক্ষমতা বাড়ানো যায়। এটি ড্রাগ কোষ ধ্বংসের কারণও হতে পারে। কিন্তু ড্রাগ ডেলিভারির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ড্রাগ দিয়ে এ সমস্যা দূর করা যেতে পারে। যদি একটি ড্রাগ দ্রুত শরীর থেকে বের করে দেয়া হয়, এর জন্য রোগীর ওপর উঁচুহারে ডোজ দিতে হতে পারে। কিন্তু ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেমের সাহায্যে এ ড্রাগ বের হয়ে যাওয়া কমিয়ে আনা যেতে পারে ড্রাগের গতিধারা পরিবর্তন করে। বায়োডিস্ট্রিবিউশনের অভাব একটি সমস্যা। এর ফলে স্বাভাবিক টিস্যুর ওপর মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে ব্যাপকভিত্তিক ড্রাগ ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে। সম্ভাবনাময় ন্যানোড্রাগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রয়োগ করে চিকিৎসাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আন সম্ভব হবে।
ডেনড্রিমার্স হচ্ছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তির আরেকটি আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী ব্যবহার। ডেনড্রিমার হচ্ছে ন্যানোকাঠামোর কৃত্রিম অণু (nanostructured synthetic molecules), যার সাথে রয়েছে শাখা কাঠামো, যার সম্পাত ঘটেছে একটি সেন্ট্রাল কোর থেকে। ডেনড্রিমারগুলো এক সময়ে একটি স্তরই গঠন করে। অতএব ডেনড্রিমারের আকার নির্ধারণ করা হয় সিনথেটিক স্টেপের সংখ্যা দিয়ে। প্রতিটি ডেনড্রিমার সাধারণ কয়েক ন্যানোমিটার চওড়া হয়। বাইরের স্তরকে পরিবর্তন করা সম্ভব যাতে করে তা গঠন করা যায় সুনির্দিষ্ট কিছু ফাংশনাল গ্রুপ দিয়ে। জিন থেরাপির সময় ডেনড্রিমারগুলো কোষে ডিএনএ সরবরাহ করার এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ন্যানোরোবটিকস অথবা মলিকুলার ন্যানোটেকনোলজির কাজ হচ্ছে মলিকুলার পর্যায়ে জটিল মেকানিক্যাল সিস্টেম তৈরি করা, রিচার্ড ফিনম্যানই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ক্ষুদ্রতর মেশিনপত্র ব্যবহারের কথা তোলেন। ছোট্ট অণু আকারের যন্ত্র তৈরির প্রস্তাব করা হয় এতে। ডিএনএ-র অনমনীয়তার কারণে ডিএনএ হয়ে ওঠে ন্যানোমেশিন গঠনের জন্য আদর্শ বস্ত্ত। ডিএনএ-র আমত্মঃঅণুর আমত্মঃক্রিয়া বা ইন্টারমলিকুলার ইন্টারেকশন খুবই সুপরিচিত, এবং সহজেই তা আগে থেকে বলা যায়। ডিএনএ-র আত্ম-সংযোজন বা সেলফ-অ্যাসেম্বলির ধর্ম একে ন্যানোমেশিন গড়ার উপাদান হিসেবে আরো উপযোগী করে তুলেছে। ড. ন্যাড্রিয়ান সীম্যান ডিএনএ থেকে ছোট আকারের ন্যানোমেশিন তৈরির উপাদান হিসেবে ডিএনএ ব্যবহারে অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেন। ডিএনএ কার্যও যেকোনো জানা ত্রিমাত্রিক আকার দিতে সক্ষম। ১৯৯৯ সালে তার গবেষণা দল সক্ষম হন প্রথম ন্যানোস্কেল বরোটিক অ্যাকচুয়েটার তৈরিতে। তিনি তা তৈরি করেন ডিএনএ থেকে। ডিএনএ এ পরবর্তী সময়ে ন্যানোটিউব ব্যবহার হয়েছে মলিকুলার টুইজার গঠনে, যা ব্যবহার করা যাবে ন্যানো কাঠামোর ভৌত পরিবর্তনে। ন্যানোমোটর তৈরির গবেষণা বেশ অগ্রসর হয়েছে। তা ভবিষ্যৎ ন্যানোরোবট তৈরিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন করবে।
কোষ মেরামত যন্ত্র
ওষুধ ব্যবহার করে কিংবা সার্জারি বা কাটাছেঁড়া করে চিকিৎসকের শরীরের সেল বা কোষসমূহকে উৎসাহিত করেন আপনা-আপনি মেরামত হওয়ার জন্য। কিন্তু মলিকুলার মেশিন আমাদের সুযোগ দেবে সরাসরি কোষ মেরামত করার। সেজন্য ন্যানোপ্রযুক্তির অবদান এই মলিকুলার মেশিনকে বলা হচ্ছে সেল রিপেয়ারিং মেশন। বাংলায় একে আমরা বলতে পারি কোষ মেরামত যন্ত্র হিসেবে। সেল রিপেয়ারিং মেশিন ঠিক সেই কাজটাই করবে, যা লিভিং সিস্টেম সুপ্রমাণিতভাবে করতে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে কোষের মধ্যে ঢুকে পড়া সম্ভব। কারণ, জীববিজ্ঞানীরা কোষের কোনো ক্ষতিসাধন না করে তাতে সেলাইয়ের কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন। এর ফলেই মলিকুলার মেশিনগুলো কোষের ভেতর ঢুকে যেতে সক্ষম। তাছাড়া সব সুনির্দিষ্ট জৈব রাসায়নিক আমত্মঃক্রিয়া থেকে দেখা গেছে মলিকুলার সিস্টেমগুলো স্পর্শ, নির্মাণ ও পুনর্নিমাণের মাধ্যমে অন্য মলিকিউলগুলোকে চিনতে পারে। এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোষগুলোকে সরিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া কোষগুলো এর প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। এর ফলে এটি প্রমাণিত হয়, মলিকুলার সিস্টেমসমূহ কোষে পাওয়া সব সিস্টেম সংযোজন করতে সক্ষম। যেহেতু প্রকৃতিতেই মলিকিউল পর্যায়ে কোষ মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় সব কর্মকান্ড প্রদর্শন করেছে, অতএব ভবিষ্যতে ন্যানোমেশিনভিত্তিক এমন ব্যবস্থাসমূহ গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যেগুলো কোষগুলোতে ঢুকে পড়ে নিজেরাই ভালো ও মন্দ দেহকোষের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে। সেই সাথে কোষ কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারবে।
এ ধরনের নানা কোষ মেরামত মেশিন যে আমরা খুব শিগগিরই পেতে যাচ্ছি, সে বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। এই মেশিনগুলো আকার ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার সাথে তুলনীয়। এগুলোর নিবিড় খুচরো যন্ত্রাংশ এগুলোকে করে তুলবে খুবই জটিল। প্রথম দিকের এই মেশিনগুলো হবে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে খুবই বিশেষায়িত মেশিন। এগুলো কোষের পর্দা খুলে ফেলতে ও বন্ধ করে দিতে পারবে। কিংবা টিস্যুর ভেতর দিয়ে চলাচল করে কোষ বা ভাইরাসের ভেতর ঢুকতে পারবে। মেরামত করতে পারবে ডিএনএ সমস্যা ও পূরণ করতে পারবে রেচক ঘাটতি। পরবর্তী পর্যায়ে সেল রিপেয়ার মেশিনগুলো প্রোগ্রামের আওতায় এনে এগুলোকে আরো সক্ষম করে তোলা হবে। এক্ষেত্রে সহায়তা নেয়া হবে অগ্রসর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়্যাল সিস্টেমের।
এই মেশিন পরিচালনার জন্য কমপিউটারের প্রয়োজন হবে। এই কমিউটার ওই ন্যানোমেশিনকে নির্দেশ দেবে পরীক্ষা করতে, অংশ নিতে ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া অণু কাঠামো বা মলিকুলার স্ট্রাকচার মেরামত করতে। রিপেয়ার মেশিনগুলো পুরো কোষের মেরামত করতে সক্ষম। এগুলো কাজ করবে কাঠামোর পর কাঠামো ধরে ধরে। চূড়ান্ত পর্যায়ে অঙ্গের পর অঙ্গের ওপর কাজ করে মানবদেহকে করে তুলবে সুস্থ রোগমুক্ত ও ঝামেলাহীন। যেসব কোষ প্রায় কার্যকারিতা হারাবার মুখে, সেগুলোও মেরামত সম্ভব হবে। রিপেয়ার মেশিন হবে তেমনি ক্ষমতাধর এক মেশিন। অতএব ধরেই নেয়া যায়, এই সেল রিপেয়ার মেশিন হতে যাচ্ছে কোষ মেরামতের ক্ষেত্রে এক অবাধ যন্ত্র।
ন্যানোনেফ্রোলজি
নেফ্রোলজি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেই শাখা, যা কিডনিবিষয়ক নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে। ন্যানোনেফ্রোলজি হচ্ছে ন্যানোমেডিসিনের ও ন্যানোটেকনোলজির একটি শাখা। এর কাজ হচ্ছে :
০১. অণু পর্যায়ে কিডনির প্রোটিন কাঠামো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা
০২. কিডনি কোষের কোষগত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য ন্যানোচিত্রগ্রহণের উদ্যোগ নেয়া এবং
০৩. ন্যানোমেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট চালানো।
এ ন্যানোমেডিক্যাল চিকিৎসা চালানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ন্যানোপার্টিকল। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কিডনি রোগের চিকিৎসা সম্ভব। ন্যানোম্যাটেরিয়াল ও ন্যানোডিভাইস কাজ করে অণু-পরমাণু পর্যায়ে। এগুলোকে ব্যবহার করা যাবে কিডনি রোগ চেনা ও চিকিৎসার কাজে। এটি ন্যানোনেফ্রোলজির একটি অংশ। অতএব ন্যানোনেফ্রোলজি যে কিডনি রোগ চিকিৎসায় বড় মাপের অবদান রাখাবে বলে ধরে নেয়া যায়। এক্ষেত্রে আরো নতুন নতুন কী আবিষ্কার-উদ্ভাবন আসছে, তার ওপর নির্ভর করছে নেফ্রোলজির ভবিষ্যৎ অগ্রগতি। প্রোটিনের ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ এবং কিডনি পর্যায়ে অন্যান্য ম্যাক্রোমলিকিউল পর্যায়ে কিডনি কোষকে জানার মাধ্যমে কিডনি রোগকে জয় করার বৈপ্লবিক দিকের উন্মোচন করতে পারে এই ন্যানোনেফ্রোলজি। ন্যানোস্কেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ন্যানোমাত্রার কৃত্রিম কিডনি সৃষ্টিও অনেক চিকিৎসাবিদের স্বপ্ন। প্রোগ্রামযোগ্য ও ন্যানো-পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোবট এ কাজটিই সম্ভব করে তুলতে পারে। এই রোবট মানুষের কিডনির গাঠনিক ও নিরাময়ের কাজ করবে।
স্তন ক্যান্সারের জন্য বায়োকনের ন্যানোড্রাগ
গত ১৮ জুলাই ভারতের বিজনেস লাইন পত্রিকায় জানা যায়, বায়োকন লিমিটেড Abraxane নামে স্তন ক্যান্সারের একটি ওষুধ বাজারে ছেড়েছে। তিন বছর ধরে কাজ করে ১০০ কোটি রুপি খরচ করে তারা এই ন্যানোড্রাগ পণ্য বাজারে ছাড়তে সক্ষম হয়েছে। ন্যানোপার্টিকলভিত্তিক এই ড্রাগ তৈরি করেছে Abraxis BioScience Inc. নামের এক প্রতিষ্ঠান। আর এটি বাজারজাত করেছে বায়োকন লিমিটেড। আপাতত ভারত ও এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশে স্তন ক্যান্সারের ন্যানোড্রাগ পাওয়া যাচ্ছে।
এই প্যাকলিট্যাক্সেল প্রোট্রিন ও অ্যালবুমিন রাউন্ড ন্যানোমেডিসিন একক ব্যবহার হিসেবে ১০০ এমজি ভায়েল আকারে পাওয়া যাচ্ছে ধমনী নিয়ন্ত্রণের জন্য। ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল ২০০৭ সালের অক্টোবরে এ ড্রাগের অনুমোদন দেয়।
বায়োকনের বিপণন বিভাগের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, ভারতে ট্যাক্সেইনের ৮০-১০০ কোটি রুপির বাজার রয়েছে। ভারতে এক ভায়েল ট্যাক্সেইনের খরচ যেখানে ৪০০ ডলার অর্থাৎ ১৭২০০ রুপি, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এর খরচ ১০০০ ডলার অর্থাৎ ৪৩০০০ রুপি। ২০০৭ সালের বিপণন চুক্তি অনুযায়ী বায়োকন লাইসেন্স পেয়েছে এই ড্রাগ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েত ও আরো কিছু এশীয় ও পারস্য উপসাগরীয় দেশে রফতানির জন্য।
অ্যাবরেক্সিসের গবেষণা ও উন্নয়নবিষয়ক প্রেসিডেন্ট ড. নীল দেশাই বলেছেন, বিশ্বব্যাপী ১২০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে কিংবা প্রায় শেষের পথে ফাস্টলাইন মেটাস্ট্যাটিক ব্রেস্ট, লাং, ম্যালিগনেন্ট ম্যালোনোমা, প্যানক্রিয়াটিক ও গ্রাস্ট্রিক ক্যান্সারের ব্যবহার সম্প্রসারণের জন্য। অ্যাবরেক্সিসের মতো ২০০৫-০৬ সালের দিকে বিশ্বে সাড়ে ৩২ কোটি ডলারের অ্যাবরেক্সিইন বিক্রি হয়েছে। ২০০৯ সালে এ পরিমাণ ৭৫ কোটি ডলারে উঠে এসেছে। খুব শিগগিরই তা দ্রুত ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ন্যানোমেডিসিন : ১৬০০০ কোটি ডলারের বাজার
২০০৯ সালের ২৬ জুনে প্রকাশিত এক খবর মতে, বিশ্বে ন্যানোমেডিসিনের বাজার ২০১৫ সালের দিকে ১৬০০০ কোটি ডলারে পৌঁছবে। পাউন্ডের অঙ্কে তা হবে ৯৭০০ কোটি পাউন্ড। ২০০৪ সালের ন্যানোমেডিসিন বিশ্বব্যাপী বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৮০ কোটি ডলার। তখন বিশ্বের ২০০ কোম্পানি তাদের ৩৮টি ন্যানোমেডিসিন পণ্য বিক্রি করে। প্রতিবছর বিশ্বে ন্যানোটেকনোলজির গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে খরচ করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ন্যানোমেডিসিন শিল্পখাত যেহেতু অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে, সেহেতু আশা করা হচ্ছে ন্যানোমেডিসিন শিল্প একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অদূর ভবিষ্যতে ন্যানোমেডিসিনের ক্ষেত্রে আমরা পেতে যাচ্ছি মূল্যবান গবেষণাযন্ত্র ও ক্লিনিক্যাল যন্ত্রপাতি। ওষুধ শিল্পে বাণিজ্যিকভাবে আরো প্রয়োগ পাবো ন্যানোমেডিসিনের। এর মধ্যে থাকছে অগ্রসর মানের ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম, নতুন নতুন থেরাপি ও ভিভো ইমেজিং। নিউরো-ইলেক্ট্রনিক ইন্টারফেস ও অন্যান্য ন্যানোইলেক্ট্রনিকভিত্তিক সেন্সর নিয়েও চলছে সক্রিয় নানা গবেষণা। ন্যানোমেডিসিন থেকেই পাবো সেল রিপেয়ারিং মেশিন। তখন তা চিকিৎসাক্ষেত্রে আনতে পারে এক বিপ্লব। তখন ন্যানোমেডিসিনের বিশ্ব বাজার আরো অনেক দূর সম্প্রসারিত হবে।
‘গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যানালিস্ট’ একটি সমীক্ষা চালিয়ে বলেছে আগামী বছরগুলোতে ন্যানোমেডিসিনের বাজার অব্যাহতভাবে বেড়ে চলবে। এই ন্যানোমেডিসিনের ক্ষেত্রে ওষুধ ও চিকিৎসায় সোনার ব্যবহারও বাড়বে। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় দেখা গেছে, ন্যানোমেডিসিন পণ্যের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে তহবিল সরবরাহ এবং ন্যানোমেডিসিনকে ঘিরে মানুষের আগ্রহও ক্রমবর্ধমান। অতএব ন্যানোমেডিসিন খাতের প্রসার ঘটবে, এমনটি আশাই করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখ করেছে, ন্যানোমেডিসিন খাত নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতা রাখে চিকিৎসাসেবার গতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পাল্টে দেয়ার। ন্যানোমেডিসিনই আশা জাগাতে পারে জীবন-সংহারি ভয়াবহ রোগ চিকিৎসায়। ন্যানোমেডিসিন আদর্শ থেরাপিউটিকসে ক্ষতিকর দিক যথার্থ কমিয়ে এনেছে। ড্রাগ ডেলিভারি ন্যানোমেডিসিন মার্কেটের সবচেয়ে বড় মার্কেট সেগমেন্ট। ‘গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যানালিস্ট’ ভবিষ্যদ্বাণী করে বলে, আগামী দিনে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটবে বায়োম্যাটেরিয়াল সেগমেন্টে। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্য সরকার সে দেশে ন্যানোমেডিসিনের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব প্রণয়ন করেছে এবং এ খাতের উন্নয়নে সে দেশের সরকার প্রতিশ্রুতবদ্ধও হয়েছে।
প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
ড. পিটার এ সিঙ্গার। টরন্টে মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এবং ‘ম্যাগলনলিন-রটম্যান সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ’-এর উর্ধ্বতন বিজ্ঞানী। তাঁর অভিমত : ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বসবাসরত ৫০০ কোটির বেশি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবায় অপরিমেয় উপকার বয়ে আনবে ন্যানোটেকলোজি তথা ন্যানোমেডিসিন। ন্যানোমেডিসিন কম-শিল্পায়িত দেশগুলোর জন্যও এক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারে অনন্য সম্ভাবনা। এই ন্যানোটেকনোলজি এমনকি গরিব দেশগুলোর মানুষের রোগ-নির্ণয় এবং রোগ-নিরাময়সহ বিশুদ্ধ পানি পাবার অভাবনীয় সুযোগ সৃষ্টি করবে।
একই প্রসঙ্গে উইড্রোউইলসন সেন্টারের ‘প্রজেক্ট অন ইমার্জিং ন্যানোটেকনোলজিস’-এর প্রধান বিজ্ঞান উপদেষ্টা ড. অ্যানড্রু ম্যানার্ড বলেন : ব্রাজিল, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ে গবেষণা চলছে। তাদের এ গবেষণা মেটাতে পারে গরিব মানুষের অতিপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা-চাহিদা। কিন্তু তারপরও এখানে বিপদও রয়েছে। যদি শুধু বাজারশক্তিই এক্ষেত্রে নিয়োজিত থাকে, তবে ধনী দেশগুলোর একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই ন্যানোপ্রযুক্তির ফসল নিজেদের করে তুলবে। ন্যানোমেডিসিনের প্রকৃত কোনো উপকার গরিব মানুষের কাছে পৌঁছবে না। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ সে বঞ্চনার শিকার হবে। উপরে ড. পিটারের উল্লিখিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং উইড্রোউইলসনের আশঙ্কাকে দূর করে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল ও গরিব দেশের মানুষের কাছে ন্যানোপ্রযুক্তি চিকিৎসাসেবা তথা ন্যানোমেডিসিন সুফল পেতে হলে প্রয়োজন এক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে সুপরিকল্পিত ও ব্যাপকধর্মী প্রকল্প চালু ও গবেষণা উদ্যোগ নেয়া। দুঃখের বিষয়, এ দু-ক্ষেত্রেই আমরা অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে কোনো কাজই কার্যত আমরা এখনো শুরুই করতে পারিনি। এক্ষেত্রে কাজে নেমে পড়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দেরির কোনো অবকাশ নেই। ন্যানোমেডিসিনের অপরিমিত সুফল এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে আমরা পৌঁছাবই- এ সুদৃঢ় শপথ নিয়ে কাজে নেমে পড়ার এটাই সময়। সে কথা মনে রাখলে উত্তরণ, নইলে শুধুই পিছিয়ে থাকা।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক jagat@comjagat.com