দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ব্যাংকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এদেশে এ পর্যন্ত যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তার জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবিদার ব্যাংকিং খাত। তাই এদেশের প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর গ্রাহকসেবা আরো উন্নত করার জন্য মনোযোগ দিচ্ছে ADC তথা Alternative Delivery Channels-এর দিকে। বিলস পে, টেলি-ব্যাংকিং, ফোন-ব্যাংকিং, এসএমএস-ব্যাংকিং, ইন্টারনেট-ব্যাংকিং ইত্যাদি সেবা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়। বেড়ে যাচ্ছে মানুষের প্রত্যাশা আর চাহিদা।
সেবা যে ধরনেরই হোক না কেনো, যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে বসে টাকা পাওয়ার সুবিধা মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া। গ্রাহকরা চান একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে যেকোনো সময় টাকা তোলার সুবিধা। গ্রাহকের এ চাহিদার দিকে লক্ষ রেখেই ব্যাংকগুলো এটিএম তথা অটোমেটেড টেলার মেশিনের সুবিধার কথা চিন্তায় আনে।
এটিএম মেশিন
একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক কোনো স্থানে এটিএম স্থাপনের আগে বেশকিছু দিক বিবেচনায় আনা হয়: ওই স্থানে যথেষ্ট লোকের চলাচল আছে কিনা; স্থানটি বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিনা; স্থানটির জন্য ভাড়া বাবদ কেমন খরচ হবে; স্থানটিতে সংযোগের জন্য সুবিধাজনক ইলেকট্রনিক মাধ্যম আছে কিনা ইত্যাদি।
এটিএম স্থাপন যেকোনো ব্যাংকের জন্য সাধারণত লাভজনক ব্যবসায় হিসেবে নেয়া হয় না। এটিকে বরং চেক বইয়ের মাধ্যমে টাকা ওঠানোর বিকল্প হিসেবে ধরা যেতে পারে। যদিও এই সুবিধা দেয়ার জন্য একটি ব্যাংককে অনেক খরচ করতে হয়। ব্যাংক যদি সরাসরি নিজস্ব খরচে মেশিন কিনে, তাহলে এ খরচ আরো বেড়ে যায়। এর সাথে যোগ হয় বুথের জন্য ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, নিরাপত্তা বাবদ খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, সংযোগের জন্য মাসিক ভাড়া ইত্যাদি।
এটিএম-এর মাধ্যমে যেকোনো সময় টাকা তোলার সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে একটি ব্যাংক বেশ কিছু সুবিধা পায় : ব্যাংকের সার্বিক ইমেজ বাড়ে; গ্রাহক অ্যাকাউন্ট সংখ্যা বাড়ে; অ্যাকাউন্ট সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আমানত বাড়ে; আমানত বাড়ার মাধ্যমে সম্পদ বাড়ে এবং সম্পদ বাড়ার মাধ্যমে সামগ্রিক মুনাফা বেড়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে আজকের দিনে কোনো ব্যাংকই প্রধানত মুনাফা অর্জনের জন্য এটিএম স্থাপন করছে না। বরং সামগ্রিক সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সার্ভিসের মান উন্নয়নের জন্যই গ্রাহকের যেকোনো সময় প্রয়োজনে টাকা তোলার সুবিধার কথা চিন্তা করা হয়েছে। আর এই সুবিধা শুধু ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নয়, বরং সমগ্র জাতি এ সুবিধার আওতাভুক্ত হচ্ছে।
এটিএম বুথ
এটিএম সার্ভিসের মাধ্যমে গ্রাহকরা নানা সুবিধা পাচ্ছে : টাকার জন্য শাখাতে ছুটে যেতে হয় না; জরুরি প্রয়োজনে টাকা পাবার নিশ্চয়তা থাকে; সাথে ক্যাশ টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন হয় না; অ্যাকাউন্টের জন্য চেক বই না তুলে সাথে কার্ড রাখলেই চলে; কত টাকা প্রয়োজন তত টাকা তুলে কাজ চালানো যায়; বাড়তি টাকা সাথে রাখার প্রয়োজন হয় না ইত্যাদি।
যা হোক, ব্যাংক যেহেতু একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সেহেতু মুনাফা অর্জন এর অন্যতম উদ্দেশ্য। ফলে ব্যাংকগুলো তাদের এটিএম নেটওয়ার্ক একটি নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে রাখতে চায়, এটিএম-এর সংখ্যা সীমিত রাখতে চায়। এর আরো একটি কারণ হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশে এটিএম নেটওয়ার্ক শেয়ার করা যায়। যে ব্যাংকের এটিএম নেটওয়ার্ক শেয়ার করা হয় তাদেরকে প্রতিটি এটিএম বুথের বিপরীতে মাসিক ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিটি লেনদেনের চার্জের ভিত্তির হিসেবেও এ চুক্তি হয়ে থাকে। এটিএম নেটওয়ার্ক শেয়ারের ক্ষেত্রে যাদের এটিএম সংখ্যা বেশি থাকে তাদেরই সাধারণত এ চুক্তিতে সুবিধা হয় অর্থাৎ মুনাফা অর্জনের সুযোগ থাকে বেশি।
এটিএম-এর মাধ্যমে যেমনি যেকোনো সময় টাকা তোলার সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তেমনি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় কিছু সাধারণ অসুবিধা ও আছে। যেমন একজন গ্রাহক বুথে গিয়েও সব সময় টাকা পান না। কারণগুলো হতে পারে : বুথে বিদ্যুৎ না থাকা, ফলে মেশিন নাও চলতে পারে, কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারে সমস্যা থাকতে পারে, মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণে কাজ চলতে পারে; তাছাড়া রয়েছে কিছু অজানা অসুবিধা, যার ফলে ব্যালেন্স থাকা সত্ত্বেও টাকা পাওয়া যায় না। যেমন- সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা ইত্যাদি।
এটিএম ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি একটি অল্টারনেটিভ ডেলিভারি চ্যানেল (ADC), যার মাধ্যমে ক্যাশ কাউন্টারে না গিয়েও একজন গ্রাহক টাকা পেতে পারেন। সরাসরি টাকা না পেলেও আরো কিছু অল্টারনেটিভ ডেলিভারি চ্যানেল, যেমন- এসএমএস-ব্যাংকিং, ইন্টারনেট-ব্যাংকিং, কলসেন্টার, বিলস পে ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাংকিংয়ের তথ্য জানা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যালেন্স ট্রান্সফার করা যায়। আমাদের দেশের ইলেকট্রনিক ব্যাংকিংয়ের জগতে এ সেবাগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, দক্ষ লোকবল ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত উপকরণের অভাবে এসব সেবা সঠিক ও কার্যকরিভাবে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এ দেশের ব্যাংকগুলোর এসব ব্যাপারে আরো উন্নয়নের সুযোগ আছে। সুযোগ আছে আরো কাজ করার।
তাছাড়া গ্রাহকের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে আমাদের দেশীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরো ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বা পণ্য উদ্ভাবন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ব্যাংকগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের সেবাদানে সক্ষম করে তুলবে। এর জন্য গ্রাহক ও ব্যাংক-উভয়কেই হতে হবে আরো সচেতন ও সমসাময়িক প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত। আশা করা যায়, এ ধরনের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এদেশের ব্যাংকগুলোতে আমরা দেখতে পাবো।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : suahmed@primebank.com.bd