লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:৯৩
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
নীতিপ্রসঙ্গদেশ,
বিনে পয়সায় বলে কি কয়লা খেতে হবে?
যাচাই করে দেখা গেছে, বিনে পয়সায় তৈরি করা আইসিটি নীতিমালার কর্মপরিকল্পনাটি তথাকথিত মিলিয়ন ডলারের রোডম্যাপের চাইতে অনেক ভালো। দেখা গেছে, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নানা স্তরের মানুষেরা অনেক বাস্তবসম্মত সমস্যা চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়ন করার জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, তার সাথে যুক্তরাজ্যের গভ-৩ নামের প্রতিষ্ঠানের সুপারিশসমূহকে মোটেই সুপরিকল্পিত মনে হয় না।
সরকারি তহবিল কিংবা বিশ্বব্যাংক; যার পকেট থেকেই হোক, ঋণ বা অনুদান যাই হোক, খরচের টাকার পরিমাণ কত, সেটি সঠিকভাবে জানা না গেলেও বছর জুড়েই এসব কর্মকাণ্ড বার বার আমাদের চারপাশে উঁকি দিচ্ছিল। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আমাদের দুয়ারে এসে তাইফুর বা নুরুল কবিররা তাদের বিদেশী বন্ধুদের নিয়ে বার বার জানতে চেয়েছেন কী করা উচিত রোডম্যাপের জন্য বা কী হওয়া উচিত ই-গভর্নমেন্টের কৌশল। আমার মনে আছে, ভারতীয় নীল রতনকে প্রথম দিনেই বলেছিলাম, আমাদের নাগরিকদের জন্য ই-সেবা দেবার আগে সরকারকে বলুন, তাদের নিজেদের কাজ করার বর্তমান ফাইলভিত্তিক এনালগ পদ্ধতি বদল করে ডিজিটাল একটি ব্যবস্থা চালু করুক। নীল রতন আমার কথা রাখেননি। তার সুপারিশে তিনি এই জায়গাটিতে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারেননি। এর ফলে ই-গভ কৌশল পুরোটাই ব্যর্থ হওয়া ছাড়া আর কিছু হবার নয়।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষ দুটি বড় রোগ চিহ্নিত করার মৌলিক নায়ক বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল। তবে এসবের ঠিকাদার কয়েকটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান। কাজের খাত মোট চারটি। শুনেছি বাণিজ্যটা মিলিয়ন ডলারের। এই অভাগা দেশে এ পরিমাণ টাকায় কী পরিমাণ কমপিউটার শিশুদের হাতে তুলে দেয়া যেত, সেই হিসেবও আমি করতে জানি না। এতে শরিক কোম্পানিগুলোর পার্টনার বাংলাদেশী হলেও প্রকৃত বাণিজ্য বিদেশীদের। এই বাণিজ্যের মাঝে কয়েক রিম মুদ্রিত কাগজই প্রধান ফলাফল হলেও এর মাঝে লুকিয়ে আছে কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিদেশ সফর এবং সম্ভবত আরও কিছু সুযোগসুবিধা। যতদূর জেনেছি, প্রকল্পের অধীনে আমলাদের বিদেশ সফর শেষ হয়ে গেছে।
৩০ অক্টোবরের জাতীয় কর্মশালার সমন্বয়কারী ড. আতিউরের ভাষায় কাজটি আমরা করলেই ভালো হতো-তবুও এটি বাস্তবতা, আমাদের চিকিৎসা করার জন্য প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে বিদেশীরা।
কাজগুলোর বিষয়বস্তুর মাঝে আছে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে তথ্যপ্রযুক্তির কী কী বিষয় পড়ানো হবে তার সিলেবাস নির্ণয় করা ও প্রশিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তির রোডম্যাপ তৈরি এবং সরকারের ই-গভর্নমেন্ট কৌশল নির্ধারণ। ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ড. আব্দুল মঈন খান প্রণীত ২০০২ সালের আইসিটি নীতিমালাকে ভিত্তি করে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। কাকতালীয়ভাবে জানুয়ারি মাস থেকে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি এবং আইসিটি খাতের অন্যান্য সংগঠনের সুপারিশে বেটার বিজনেস ফোরাম-এর মাধ্যমে আইসিটি নীতিমালা নবায়ন করার সুপারিশ করার প্রেক্ষিতে ২০০২ সালের নীতিমালার আলোকে শুরু করা কর্মকাণ্ড শেষ হবার আগেই ২০০৮ সালের নীতিমালার খসড়া প্রণীত হয়। এই নীতিমালায় ৩০৫টি কর্মপরিকল্পনা বা অ্যাকশন প্ল্যান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এই বিষয়ক একটি কর্মশালায় কৃষি উপদেষ্টা ড. সিএস করিমসহ বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গভ-৩-এর সুপারিশে দেশটিকে ফেডারেল রাষ্ট্রে রূপান্তরে অযাচিত সুপারিশ উপদেষ্টাসহ অংশগ্রহণকারীদের দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। রোডম্যাপ নিয়ে এরই মাঝে বিভিন্ন পত্রিকায় বেশ লেখালেখি হয়েছে। বিশেষ করে সিরডাপে আয়োজিত সেমিনারের পর রোডম্যাপকে অনেকেই তুলাধুনো করেছেন। আমরা রোডম্যাপ ও আইসিটি নীতিমালার অ্যাকশন প্ল্যান উভয় ক্ষেত্রেই বেশ কিছু অসম্পূর্ণতা পেয়েছি। আইসিটি নীতিমালায় কর্মপরিকল্পনা অংশটি অপেক্ষাকৃত ভালো। আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে রোডম্যাপওয়ালারা যদি নীতিমালার অ্যাকশন প্ল্যানের চুম্বক অংশ বাছাই করেন, তবে সেটি অনেক ভালো কাজ হবে। তবে নীতিমালার সূচনা থেকে মূল অংশ নিয়ে আমার আগেও ভিন্নমত ছিল, নীতিমালাটি সরকারের কাছে পেশ করার পরও সেই ভিন্নমত রয়ে গেছে। সরকারকে ধন্যবাদ, মন্ত্রণালয় এটিকে সরাসরি চূড়ান্ত না করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মতামত নিচ্ছে। আশা করি, এর ফলে নীতিমালাটির বিষয়ে কিছু পরিবর্তন আমরা পাব। আমি বিশেষত নীতিমালার সেই অংশে পরিবর্তন চাই যেখানে মিশন, ভিশন, অবজেকটিভ ইত্যাদির কথা বলা আছে। একটি সমতার সুযোগকে নীতিমালা প্রণয়নের র্যাপশনাল হিসেবে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি কোনোভাবেই মানতে পারছি না। আমাদের সংবিধানে সমসুযোগ বিধানের চাইতে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জনগণের সমৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে। সংবিধানের ৩ ধারায় রাষ্ট্রভাষার কথাও বলা আছে। বরং মনে হয়, আইসিটি নীতিমালা হচ্ছে এই জাতির সামনে চলার স্বপ্নের দলিল। এই দলিল দেশের কোটি কোটি তরুণের স্বপ্নকে জাগ্রত করবে এবং তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নসহ জাতীয় অগ্রগতির একটি প্রকৃত রোডম্যাপ তাদের সামনে তুলে ধরবে। এই নীতিমালাটির কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করলাম, আমাদের দেশে দূরদৃষ্টি নিয়ে সামনে দেখার মানুষের চরম সঙ্কট আছে। আমরা যাদেরকে শ্রদ্ধেয় বলে মনে করি, তাদের কারও কারও চোখ কুয়াশার গভীরে বন্দী থাকে। তারা এমনকি সামনে দুহাত দূরেও দেখতে পান না। অন্যদিকে তারা এতটা একগুঁয়ে যে কোনো ভালো পরামর্শও সহজে নিতে চান না। আইসিটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করার ক্ষেত্রে এবার যেমনটি ঘটেছে, তেমনটি অবশ্য এর আগে আর কখনো ঘটেছে বলে আমি স্মরণ করতে পারিনি।
রোডম্যাপ নিয়ে সিরডাপে আয়োজিত কর্মশালা থেকে আমরা একটি বড় ধরনের ঝটকার মুখোমুখি হই। সেই কর্মশালার পরপরই বিসিসির এই প্রকল্পের পরিচালক ড. কামাল উদ্দিনকে বদলি করা হয়। তবে কামাল উদ্দিনের খুঁটির জোর ভালো বলে তিনি তার সচিবকে সংস্থাপন সচিব পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করিয়ে তার নিজের বদলি ঠেকাতে সক্ষম হন। অবশ্য এখন পর্যন্ত কেউ জানে না, কেনো সচিব মহোদয় প্রকল্প পরিচালকের প্রতি এত আকৃষ্ট। একজন প্রকল্প পরিচালকের চাকরি ঠেকানোতে তিনি কিভাবে লাভবান হবেন, সেটিও কেউ জানে না। বলা হয়ে থাকে, দীর্ঘদিন যাবত একই পদে বহাল থাকা এই প্রকল্প পরিচালক তার খুঁটির জোরেই মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক রয়ে গেছেন-এমনকি তার ওপর কালিয়াকৈরের হাইটেক পার্কেরও দায়িত্ব দেয়া আছে।
যাহোক, গত ৩০ অক্টোবর সরকারের ই-গভর্নমেন্ট কৌশল নিয়ে সর্বশেষ পাবলিক ফাংশনটি হয় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের মিডিয়া বাজারে। এর আগে সিরডাপ মিলনায়তনে আইসিটি রোডম্যাপ নিয়ে জাতীয় সেমিনার হয়েছে। ৩০ অক্টোবরের সেই জাতীয় সেমিনারে সর্বশেষ প্রদত্ত ভাষণে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ওয়াহিদুজ্জামান সমালোচকদের কড়া সমালোচনার জবাবে একথা জানান, বিশ্বব্যাংকের খয়রাতির টাকায় এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সাথে সাথেই অংশগ্রহণকারীদের মাঝে গুঞ্জন ওঠে যে, মাগনা পাইলে কি কয়লা খাইতে অইবো? বস্তুত আমাদের এই প্রকল্পটি কয়লা ভক্ষণের মতোই।
তবে সরকার যেহেতু যথেষ্ট পয়সা খরচ করে ই-গভ কৌশল তৈরি করছে, সে সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট কথা বলা দরকার। শুরুতেই বলা দরকার, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় হোক আর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় হোক নীতিমালা তৈরির সময় তারা এর ভাষা ইংরেজি করেই ছাড়ে। ই-গভ কৌশল যেহেতু বিদেশীরা করেছে সেহেতু এর ভাষা ইংরেজি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ব্রডব্যান্ড পলিসি করেছে এদেশের মানুষ, সেটিরও ভাষা ইংরেজি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এটি বুঝতে অক্ষম, এদেশের শতকরা ৯৫ জন মানুষ ইংরেজি বোঝে না। ফলে ইংরেজিতে প্রণীত নীতিমালাও এরা গ্রহণ করে না। যাহোক ই-গভ সেমিনারে আমার একতরফা চাপের মুখে উপদেষ্টাসহ সবাই এটি মানতে বাধ্য হন, বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি প্রকাশের ভাষা বাংলা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এমনকি আমার কাছে এটি ভালো লেগেছে, একটি ইংরেজি ভাষার সেমিনার শেষাবধি বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়। সেমিনারের সমন্বয়কারী ড. আতিউরও শেষ পর্যায়ে এই ঘোষণা দেন, সেমিনারে যেকেউ বাংলায় বলতে পারবেন। এমনকি তিনি শেষ অংশটি বাংলায় পরিচালনাও করেন। এতে আজিজ ভাই পুরোই বাংলায় বলেন। কামাল ভাই কিছুটা বাংলা ব্যবহার করেন। আমি পুরো বক্তব্যই বাংলায় দেই। বুয়েটের উপাচার্য বাংলায় বলার পর বিশেষ সহকারী মানিক লাল সমাদ্দার এবং তার পরে রাশেদা কে চৌধুরী বাংলায় বক্তব্য রাখেন। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সচিব অবশ্য ইংরেজিতেই বক্তব্য রাখেন। কারণ, তিনি আগেই তার বক্তৃতা লিখে এনেছিলেন।
কিন্তু আমি অবাক হলাম ই-গভ কৌশলের দুটি বিষয় বাদ দেয়া নিয়ে। এরা অনেক বিষয় নিয়েই সুপারিশ করেছে। নাগরিকদের জীবনে সরকারের ডিজিটাল সেবাদানের ক্ষেত্রটিও একেবারে ছোট নয়। শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, জমিজমা নিবন্ধন এসব অনেক কিছুর জন্যই এরা ৩৬টি অগ্রাধিকার খাত তৈরি করেছে। কিন্তু কৌশলের কোথাও বিচারব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। আমার বক্তব্যের জবাবে এরা বলেছেন, অন্যত্র নাকি বিচার বিভাগ নিয়ে সুপারিশ আছে। যদিও সেটি কোথায় তা নীল রতন দেখাতে পারেনি।
আমরা সবাই জানি, দেশের নাগরিকরা কখনো জানে না, তাদের মামলা কোথায়, কিভাবে আছে এবং কবে নাগাদ এসব মামলা আদালতে উঠবে, কবে শুনানি হবে বা কবে তার রায় হবে। ডিজিটাল সরকারকে অবশ্যই বিচার বিভাগের এসব খবর জনগণকে দিতে হবে। অন্যদিকে কৃষি ঋণ বা সার, বীজ সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে কোনো কৌশল নেই প্রাইসওয়াটার হাউস-এর প্রতিবেদনে। কিন্তু কৃষক যদি ইন্টারনেটে কৃষি ঋণের আবেদন করতে না পারে বা কৃষক যদি জানতে না পারে যে, তার এলাকার জন্য কী পরিমাণ সার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং কোন ডিলারের কাছে কী পরিমাণ সার আছে, তবে সরকার ই-গভর্নমেন্ট সেবা কার জন্য তৈরি করবে?
তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে, প্রতিবেদনে এসব ডিজিটাল সেবা সরকারের কাছ থেকে কিভাবে পাওয়া যাবে, তার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেদিন একথা স্পষ্ট করে বলেছি, সরকার প্রস্তাবিত ই-গভ কৌশল বাস্তবায়ন করতে কোনোভাবেই সক্ষম হবে না যদি তারা নিজেরা না বদলায়, ই-গভ সেবা নাগরিকদের কাছে তখনই পৌঁছানো যাবে, যখন সরকার ফাইল ও ফিতার বন্দিত্ব থেকে বেরোতে পারবে। তাদের উচিত এখনই একটি জাতীয় নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং সরকারের সব তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা। একই সাথে সরকারকে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নেটওয়ার্কভিত্তিক করতে হবে। অন্যথায় একটি ডিজিটাল সরকার আমাদের সবার কাছেই স্বপ্ন হয়ে থাকবে। এজন্যই আবার বলতে হচ্ছে, বিনে পয়সায় খয়রাত পেলেই এমনসব প্রতিবেদন তৈরি উচিত নয়, যাতে মনে হবে আমরা হাভাত হিসেবে কয়লা খেতে শুরু করেছি।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com