আজকের দিনে মানুষ দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বাস করছে। এখন পৃথিবীজুড়ে অবাধ ও উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহ, ধারণা ও জ্ঞানের বিনিময় ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। তথ্য সংগ্রহ, মজুদ, প্রক্রিয়াজাত এবং সরবরাহ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে প্রাযুক্তিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পথ ধরে। সমাজের সব ক্ষেত্রে এর প্রমাণ এখন দৃশ্যমান। ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিনোদন, শিক্ষা, সরকারি সেবা-পরিষেবা ইত্যাদি সবখানে এখন প্রযুক্তির ছোঁয়া। প্রযুক্তির পরিবর্তন যে হারে ঘটছে, তাতে করে আমরা কেউ নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি না, আমরা তথ্যে অংশ নেয়া বা প্রবেশের ক্ষেত্রে কী ধরনের বা মাত্রায় প্রাযুক্তিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারব।
ইন্টারনেট এখন এক গুরুত্বপূর্ণ গ্লোবাল রিসোর্স। উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় শ্রেণীর দেশই এখন তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধাবলী সবার জন্য কী করে সম্প্রসারিত করা যায়, তারই সন্ধানে আছে। নতুন নতুন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এখন অবলম্বিত হচ্ছে বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে। ব্যক্তি ও সমাজ চাইছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে, ব্যবসায় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চাইছে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা করতে, সরকার চাইছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ও নাগরিকদের কাছে উন্নততর সেবা-পরিষেবা যোগাতে। মোটকথা এসবের মাধ্যমে এরা সবাই চাইছে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক ও কারিগরি প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকর ও দক্ষ করে তুলতে। আর এক্ষেত্রে সবাই হাতিয়ার করেছে আইসিটি-কে।
তবে বলা দরকার, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইসিটি’র প্রভাব সম্পর্কে চূড়ান্ত উপসংহার এখনো টানা সম্ভব হয়নি। এটি সুস্পষ্ট, প্রযুক্তি বিভিন্ন দেশকে সহায়তা করছে তাদের গণতন্ত্রের মৌল উপাদান জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, জনগণের অংশীদারিত্ব ইত্যাদির মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করে রাষ্ট্রীয় বৈধতা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আহবানের প্রতি সাড়া দিতে।
কমপিউটার ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নাগরিক সাধারণ, সংগঠনসমূহ, গণমাধ্যমকে ক্ষমতাধর করে তুলছে জনবিতর্কে তাদের অংশ নেয়া সম্প্রসারিত করতে। পাশাপাশি ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজের মধ্যে সংলাপের পরিসর। তথ্যসমাজবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডব্লিউএসআইএস-এর ভাষায় : ‘বিশ্ব চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইসিটি’র সম্ভাবনাকে জোরদার করে তোলা, যাতে করে অভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করা যায়। আর সে উন্নয়নের লক্ষ্যটা হচ্ছে- জনকেন্দ্রিক, জনসংশ্লিষ্ট ও উন্নয়নমুখী তথ্যসমাজ গড়া, যেখানে সবাই সুযোগ পাবে সৃষ্টির, প্রবেশের, ব্যবহারের এবং তথ্য ও জ্ঞানে অংশীদারিত্বের। আর এর মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ ও পুরো জনগোষ্ঠীকে সক্ষম করে তোলা হবে টেকসই উন্নয়ন অর্জন ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য।’
এই যে কমন ভিশন বা অভিন্ন রূপকল্প, তা হচ্ছে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে সুদীর্ঘ সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে। তবে, এখনো আইসিটি বিপ্লবের সুফল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ সমভাবে পাচ্ছে না। আর সমাজের মধ্যে সব শ্রেণী সমভাবে আইসিটি’র সুফল ভোগ করছে না। সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী, প্রত্যাবাসী, সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, অভাবী, অশিক্ষিতরা বলতে গেলে সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর ফলে এক ধরনের ডিজিটাল বিভাজন পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্যমান। প্রযুক্তির এই বিভাজন দূর করার তাগিদ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক তথ্যসমাজ গড়তে জাতীয় সংসদের অবদান
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ উপরে উল্লিখিত সমস্যা জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সমাধান করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে। এখন জাতীয় সংসদগুলোর উচিত এসব লক্ষ্য অর্জনে ইতিবাচক নীতিপ্রণয়নকারীর ভূমিকা পালন করা, যাতে করে বিশ্বের মানুষ ডব্লিউএসআইএস ভিশন বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রযুক্তিবান্ধব আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সচেতন দায়িত্ব পালন এককভাবে জাতীয় সংসদসমূহের বা পার্লামেন্টের। নিজ নিজ দেশে প্রযুক্তিবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইলে এর বিকল্প নেই।
আইপিইউ তথা ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন ‘পার্লামেন্ট অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি ইন দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ শীর্ষক সুশাসনবিষয়ক নির্দেশিকায় এক জায়গায় উল্লেখ করেছে : ‘বিভিন্ন পর্যায়ে একই সময়ে গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পার্লামেন্ট। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে পার্লামেন্ট হচ্ছে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছের প্রকাশ ঘটে, তাদের মতামতের বিভিন্নতার প্রতিফলন প্রকাশ পায়। আর এই পার্লামেন্টের মাধ্যমে মতপার্থক্যের ব্যাপারে বিতর্ক শেষে সমঝোতা গড়ে ওঠে। পার্লামেন্ট সর্বোত্তম উপায়ে গণতান্ত্রিক অভিমতের আলোচনা শেষে পারস্পরিক সমঝোতা গড়ে তোলায় ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় জনস্বার্থ। এই জনস্বার্থ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের চেয়ে অনেক বড়। অধিকন্তু যে কার্যকারিতা নিয়ে পার্লামেন্ট তার প্রধান প্রধান কাজ, যেমন আইন প্রণয়ন, বাজেট নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাহীদের ওপর নজরদারি কায়েম ইত্যাদি সম্পন্ন করে, তা মানসম্পন্ন গণতান্ত্রিক জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য। এসব কাজ সম্পাদনে পার্লামেন্ট সুশীল সমাজের সাথে মিলেমিশে কাজ করে। এক্ষেত্রে পার্লামেন্টের অনন্য অবদান হচ্ছে নাগরিক সাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা করা। পার্লামেন্ট তখন এ অবদান রাখতে গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতির পর্যবেক্ষণে ও বিবেচনায় থাকে। এজন্য প্রয়োজন ইলেকটোরাল বা নির্বাচকমন্ডলীর জন্য উন্মুক্ততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রবেশযোগ্যতা নিশ্চিত করা। আর এ কাজটি নিশ্চিত করতে হলে পার্লামেন্টে আইসিটি’র প্রয়োগ অপরিহার্য ও বিকল্পহীন।’
উপরোল্লিখিত প্রকাশনায় একটি গণতান্ত্রিক সংসদের বা পার্লামেন্টের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে :
০১. প্রতিনিধিত্বমূলক- representative :
পার্লামেন্টে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন মতাবলম্বীর প্রতিনিধিত্ব থাকা চাই। এবং পার্লামেন্টের সব সদস্যের সমানাধিকার, সমান সুযোগ কার্যকর করতে হবে।
০২. স্বচ্ছতা- transperency :
বিভিন্ন মাধ্যমে পার্লামেন্ট উন্মুক্ত হবে গোটা জাতির কাছে। উন্মুক্ততার মধ্যে পার্লামেন্ট স্বচ্ছ হবে। পার্লামেন্টের কর্মকান্ড ও আচার-আচরণের মাধ্যমে এ স্বচ্ছতার বিধান করতে হবে।
০৩. প্রবেশযোগ্যতা- aceessibility :
এর অর্থ সংসদীয় কর্মকান্ডে জনগণের অংশ নেয়ার সুযোগ থাকা চাই। বিভিন্ন সংগঠন ও সুশীল সমাজের আন্দোলনকেও সংসদীয় কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে।
০৪. জবাবদিহিতা- accountability :
পার্লামেন্টে সদস্যদেরকে তাদের কাজ ও আচার-আচরণের ব্যাপারে জবাবদিহি থাকার ব্যবস্থা থাকা চাই।
০৫. কার্যকারিতা- effectiveness :
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন ও নির্বাহীদের ওপর নজরদারি প্রশ্নে পার্লামেন্টের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে পার্লামেন্টকে জনগণের চাহিদা মেটাতে হবে।
এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, পার্লামেন্টে এসব লক্ষ্য অর্জন ও মূল্যবোধ কার্যকর করার ক্ষেত্রে আইসিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে তিনটি ব্যাপকভিত্তিক উদাহরণ বিবেচনায় আনতে হবে।
প্রথমত, স্বচ্ছতা-প্রবেশযোগ্যতা-জবাবদিহিতার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল সংসদ সদস্যদের পাওয়া তথ্যের মান, সংসদীয় প্রশাসন, গণমাধ্যম, সমাজ এবং সংসদীয় কার্যপ্রণালী ও দলিলপত্রে জনগণের প্রবেশযোগ্যতার ওপর। আর এ কাজ দক্ষতার সাথে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন আইসিটি’র প্রয়োগ। এর মাধ্যমে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াকে গণতান্ত্রিকভাবে জোরদার করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, পার্লামেন্টের অভ্যন্তরীণ কর্মানুশীলনের দক্ষতা, পার্লামেন্ট সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের দক্ষতা, পার্লামেন্টের কর্মকান্ডের দক্ষতা সার্বিকভাবে পার্লামেন্টের কর্মসাফল্যকেই বাড়িয়ে তুলবে। পার্লামেন্ট সদস্যদের সুষ্ঠু দায়িত্ব পালনেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে আইসিটি।
তৃতীয়ত, শুধু পার্লামেন্টই নয়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানেরই উচিত যথাসম্ভব বেশিমাত্রায় বিকাশমান গ্লোবাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্কে পুরোপুরি অংশ নেয়া। প্রান্তিক কোনো অবস্থানে নিজেকে ঠেলে দিতে না চাইলে এর প্রয়োজন খুবই বেশি। পার্লামেন্টগুলো আজকের দিনের তথ্য-সমন্বয় ও জ্ঞান-বিনিময়ের নতুন বাস্তবতার পাশাপাশি আমত্মঃপার্লামেন্ট সহযোগিতার বাস্তবতার মুখোমুখি। আর এজন্য প্রয়োজন পার্লামেন্টের একটি আমূল পরিবর্তন। এ পরিবর্তন যেমনি আসবে পার্লামেন্টের ভেতরের নিজস্ব কর্মপ্রক্রিয়ায়, তেমনি আসবে বাইরের দুনিয়ার সাথে এর মিথষ্ক্রিয়ায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এ পরিবর্তন আসবে আইসিটি’র প্রয়োগের পথ ধরে।
এ তিনটি উদাহরণ থেকে সুস্পষ্ট, পার্লামেন্টে আইসিটি’র ব্যবহারে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাপক। আইন প্রণয়ন সংস্থা তথা পার্লামেন্ট ও পার্লামেন্ট সদস্যদের নিজেদের পরম প্রতিষ্ঠানে আইসিটি’র সর্বোত্তম ব্যবহারে সচেষ্ট হতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি বিশ্বের প্রতিটি দেশের পার্লামেন্টের জন্য সমানভাবে কার্যকর। পার্লামেন্টে আইসিটি’র কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্পষ্ট ভিশন-মিশন থাকা চাই। থাকতে হবে কৌশলগত পরিকল্পনা। বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সুস্পষ্ট ধারণা থাকা চাই, সুষ্ঠু পার্লামেন্ট পরিচালনার জন্য কী করে আইসিটি’র সর্বোত্তম প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়। এসব উদ্যোগে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলে সবই ব্যর্থ হতে বাধ্য। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে কার্যকর করেই নাগরিক সাধারণ ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। এরই নাম ই-পার্লামেন্ট।
ই-পার্লামেন্টের সংজ্ঞা
অতীতে অনেকেই ই-পার্লামেন্টের সংজ্ঞা দিতে চেষ্টা করেছেন। ইসিপিআরডি তথা ‘ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর পার্লামেন্টারি রিসার্চ অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন’ প্রথমদিকে ই-পার্লামেন্টের যে সংজ্ঞা দেয়, তাতে পার্লামেন্টের সাংগঠনিক দিকের প্রতিফলন ঘটে। সেখানে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় স্টেকহোল্ডার ও প্রক্রিয়াসমূহের মিথষ্ক্রিয়া ঘটে আধুনিক মানসম্পন্ন আইসিটি প্রয়োগের মাধ্যমে পার্লামেন্টের স্বচ্ছতা, গুণমান, দক্ষতা ও নমনীয়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।
গণতান্ত্রিক নেটওয়ার্ক
ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্টার ফর গভর্নমেন্টাল স্টাডিজ গণতান্ত্রিক নেটওয়ার্ক অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটিক নেটওয়ার্ক (DNet) তৈরি করেছিল, যা ছিল ইন্টারনেটে প্রাপ্ত একটি অন্যতম উদ্ভাবনামূলক ইলেকট্রনিক ভোটার গাইড। ডিনেট-এর ওয়েবসাইট চালু হয়েছিল ১৯৯৬ সালের গ্রীষ্মকালে এবং এখানে প্রার্থী এবং বিষয় সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। যেমন প্রার্থীর বিষয় সম্পর্কিত বিবৃতি, জীবনীবিষয়ক তথ্য, প্রার্থীর স্বাক্ষর এবং ভোটপত্রের উদ্যোগের খুঁটিনাটি।
এটি প্রার্থীদের মধ্যে বিতর্কের একটি ফোরাম এবং ওয়েবে সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে এবং নাগরিক ও প্রার্থীর মধ্যে যোগাযোগের উপায় হিসেবে কাজ করে। ইন্টারনেট এমন একটি সুযোগ এনে দিল যা আগে কখনো হয়নি, যেমন একই সময়ে বিনামূল্যে সম্প্রচার, যার ফল হলো চাহিদার তুলনায় কম সম্প্রচার থেকে মুক্তি। ডিনেট-এর লক্ষ্য হলো জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনকেন্দ্রগুলো। সারাদেশে ব্যবহারকারীরা ১৯৯৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় তথ্য পেয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা লসঅ্যাঞ্জেলেস শহরে স্থানীয় নির্বাচনের তথ্য পেতে সক্ষম হয়েছেন এবং নিউইয়র্ক শহরে ও সিটেলের ডিনেট সংবাদ সরবরাহ করবে।
১৯৯৮ সালের শেষে পঞ্চাশটি স্টেটে নির্বাচন সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহের জন্য ডিনেট-কে বাড়ানো হয়েছিল, যার মধ্যে নয়টি স্টেটে তারা নির্বাচন সংক্রান্ত বিশদ বিবরণ দেয়, এবং এই সংস্থা এখনো তার প্রসার বাড়াচ্ছে। ১৯৯৮-তে যে নয়টি রাষ্ট্র নজরের কেন্দ্রে ছিল তার মধ্যে প্রায় ১০০% গুরুত্বপূর্ণ পার্টির প্রার্থীরা ডিনেট-এ অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ই-পার্লামেন্ট যদিও সংজ্ঞার সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে বৃহত্তর পরিসরে সুশাসন ও উন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ তথ্যসমাজ নিশ্চিত করার জন্য। ‘e’-এর প্রচলিত ব্যবহারে এর ডিজিটাল প্রকৃতি প্রকাশ করে। এই ডিজিটাল প্রকৃতির ধারণা আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়ন ও পরিবর্তন সাধনে পার্লামেন্টে আইসিটি ব্যবহারের মূল্যাবধারণ করে না। ই-পার্লামেন্টকে একটি পরিপূরক ধারণা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ ধারণায় পার্লামেন্টের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ-আয়োজনে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগকেই বুঝতে হবে। এখনো এ ধারণা বিকাশমান পর্যায়ে। কারণ, নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটে চলেছে, সংসদীয় পরিবেশ উদ্ভাবনামূলক আইসিটি’র প্রয়োগ হচ্ছে এবং বিশ্বে তথ্যসমাজের উদ্ভব ও অগ্রসর হচ্ছে।
তারপরও আমরা ই-পার্লামেন্টের সংজ্ঞা দিতে পারি একটা লেজিসলেচার হিসেবে। এর ক্ষমতায়ন করা হয় আইসিটি প্রয়োগের মাধ্যমে অধিকতর স্বচ্ছ, প্রবেশযোগ্য ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। এটি জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটায় শতধা বৈচিত্রের মাঝে মানসম্পন্ন তথ্যের যোগান দিয়ে কিংবা তথ্যে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে। সেই সাথে সংসদীয় দলিলপত্র ও কর্মকান্ডে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে এবং সংসদীয় প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশ নেয়ার পরিসর বাড়িয়ে। ই-পার্লামেন্ট এমন একটি প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট স্টেকহোন্ডার আইসিটি ব্যবহার করে এর প্রতিনিধিত্ব, আইন প্রণয়ন ও নজরদারির কাজ কার্যকরভাবে সম্পন্ন করে। আধুনিক মানসম্পন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ও সহায়ক নীতিমালা প্রয়োগ করে ই-পার্লামেন্ট সচেষ্ট হয় একটি বৈষম্যহীন, বিভাজনহীন ও সর্বজনীন তথ্যসমাজ গড়ে তোলা নিশ্চিত করতে।
ই-পার্লামেন্টের রাজনীতি
তথ্যসমাজের উদ্ভব পার্লামেন্টের সামনে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ের জন্ম দিয়েছে। আজকের তথ্যসমাজ চায় পার্লামেন্ট হয়ে উঠুক একুশ শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। পার্লামেন্ট হচ্ছে গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিত্ব অনুশীলনের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধকে এগিয়ে নেয়ায় পার্লামেন্টের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা। পার্লামেন্টই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার অনন্য প্রতিষ্ঠান। নাগরিক সাধারণের সাথে পার্লামেন্ট তথা পার্লামেন্ট সদস্যদের উন্নততর সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে তাদেরকে আইসিটি প্রয়োগে সুদৃঢ় নেতৃত্ব দিতে হবে। পার্লামেন্টে এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে করে জনগণ বৃহত্তর পরিসরে তথ্যে প্রবেশের সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা রক্ষা, তথ্য-উপাত্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অতএব পার্লামেন্টের অনন্য অবস্থান হচ্ছে, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘উন্মুক্ততার মূল্যবোধ’ বা ‘ভ্যালুজ অব ওপেননেস’ ও স্বচ্ছতা সরকারি পর্যায়ে সমুন্নত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে জনপ্রশাসনের মুখ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পার্লামেন্টের প্রভাব বিস্তার করতে হয় তথ্যসমাজে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইসিটি বেছে নেয়ার জন্য প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পাশাপাশি এর সাথে সংশ্লিষ্ট কারিগরি বিবেচ্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারিগরি বিবেচনায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যেমন- আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ‘ওপেন ডকুমেন্ট স্ট্যান্ডার্ড’ প্রয়োগ, ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে ‘এক্সেসিবিলিটি স্ট্যান্ডার্ড’ অবলম্বন কিংবা নাগরিকদের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার ধরনের যোগাযোগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে ই-পার্লামেন্টের ব্যাপক প্রভাব থাকতে পারে অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসূত্রে।
উদাহরণ টেনে বলা যায়, সম্প্রতি ‘অ্যাসেম্বলি অব দ্য রিপাবলিক অব পর্তুগাল’ আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এর সব দলিলপত্র ও তথ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হবে। এবং তাদের ইন্টারনেট হবে ওপেন ফরমেটের। এমনকি এই সিদ্ধান্ত যদি শুধু পার্লামেন্টেও কার্যকর করা হয়, তবে পার্লামেন্টারি প্রতিষ্ঠানের এটি হবে একটি অনুসরণীয় উদাহরণ। এবং তা সে দেশের ও অন্যান্য দেশের প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব ফেলবে। অন্যান্য দেশের পার্লামেন্টকে তথ্যসমাজ গড়ায় সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলায়ও এটি হবে অনন্য উদাহরণ।
তথ্যসমাজ গড়ে তোলায় ই-পার্লামেন্ট যে আরেকটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে, তা হচ্ছে পার্লামেন্টারি ওয়েবসাইটের এক্সেসিবিলিটি স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া। রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আইসিটি’র প্রভাব এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
সংসদ সদস্যদের আইসিটি ব্যবহার
সংসদ সদস্য তথা এমপিদের বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশে ক্রমবর্ধমান হারে আইসিটি ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রতিদিনের কাজের সাথী এখন আইসিটি। তথ্যসংগ্রহে, দলীয় নেতাকর্মী ও সংসদীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, ভোটার, নাগরিক সাধারণ, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গণমাধ্যমের সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি নানা কাজে এমপিরা ব্যবহার করছেন আইসিটি।
এক্ষেত্রে অবশ্য এখনো তেমন গবেষণা হয়নি। এমপিদের আইসিটি ব্যবহারের ফলে পরিবর্তনটা কী হচ্ছে, এর ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের তেমন জানা হয়নি। প্রয়োজনীয় গবেষণা হলে, আইসিটি ব্যবহারে এমপিদের ভূমিকা, রাজনৈতিক এজেন্ডা নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় কী পরিবর্তন এনেছে বা আছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে আমরা জানতে পারতাম। এ কারণে COST A14 নামে ‘তথ্যযুগে সরকার ও গণতন্ত্র’ বিষয়ক একটি গবেষণা নেটওয়ার্কের আওতায় একদল ইউরোপীয় গবেষক ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কো-অপারেশন অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র অর্থসহায়তায় এমপিদের আইসিটি ব্যবহার বিষয়ে একটি তুলনামূলক সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পার্লামেন্টারি প্রকল্পে যোগ দিতে ইচ্ছুক দেশগুলোর এমপিদের জন্য একটি অভিন্ন প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়। এই দেশগুলো ছিল অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক। এসব দেশে ২০০১ সালে এ জরিপ পরিচালিত হয়। এরপর ২০০২ সালে স্কটল্যান্ড ও জার্মানিতে আরেকটি জরিপ চালানো হয়। এরপর একই ধরনের আরেকটি জরিপ চলে সুইজারল্যান্ডে। এ বিষয়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যেও জরিপ পরিচালিত হয়। লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বড় দেশগুলো জরিপের আওতায় আনা। দুঃখজনকভাবে এসব উদ্যোগে সাফল্য আসেনি।
‘লেডার অব পার্টিসিপেশন’ মডেল
প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণায় ইতোমধ্যেই পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, কী করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সহায়তা করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে মডেল হিসেবে এসেছে আর্নস্টাইনের ‘অংশগ্রহণের মই’ বা ‘লেডার অব পার্টিসিপেশন’। এ মডেলে তথ্য ও ক্ষমতার কৌশলগুলোর মধ্যে জটিল ও আমত্মঃসম্পর্ক প্রদর্শিত হয়েছে। কিভাবে আইসিটি’র প্রয়োগ জোরদার করে জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাদের পরিষেবা যোগানোর কাজে রাষ্ট্রকে আরো কার্যকর করে তোলা যায়, এর প্রভাব বাড়ানো যায় এবং কিভাবে মই বেয়ে আরো উপরে ওঠার পাশাপাশি আইসিটি হয়ে উঠতে পারে ‘নাগরিকের প্রযুক্তি’, যেখানে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা সরাসরি জনসাধারণের কাছে ছেড়ে দেয়া যায়, বেলামি ও বার এই মই ব্যবহার করে তাই দেখিয়েছেন। প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করতে আইসিটি কতটা কার্যকর হতে পারে, তা মূল্যায়নের একটি নতুন পদ্ধতি হিসেবে এ মডেল বিবেচিত। এর ভিত্তি তিনটি অগ্রগতি : ০১. ই-পার্লামেন্ট : সংসদের ভেতরের কর্মকান্ডের উন্নতির জন্য আইসিটি’র ব্যবহার, ০২. ই-গভর্নমেন্ট : ক্রমাগত আরো উঁচুমানের সাইট তৈরি করে জনসাধারণকে তথ্য ও অনলাইনে লভ্য পরিষেবা সুবিধা দেয়া এবং ০৩. ই-ডেমোক্র্যাসি : নতুন ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আইসিটি’র অবদান নিশ্চিত করা।
যেসব দেশে শাসনপ্রক্রিয়ায় আইসিটি প্রয়োগের জন্য সম্পদ বরাদ্দ করা হয়েছে, সেসব দেশে সাধারণভাবে সংসদীয় কর্মকান্ডের উন্নতি ঘটেছে এবং আরো ভালোভাবে তথ্য ও পরিষেবা যোগানোর লক্ষ্যে এগিয়ে গেছে। যদি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র থেকে উন্নতির মই ক্রমাগত অনুসরণ করা যায় তাহলে এর ফল হবে সংসদীয় গণতন্ত্রকেই আরো শক্তিশালী করা।
ই-পার্লামেন্ট :
এটি উল্লিখিত তথ্যের মইয়ের প্রথম ধাপ। এ ধাপে বিশ্বের সবখানে সংসদগুলোতে তাদের কাজের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য আইসিটি’র ব্যবহার শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে উন্নতির পর্যায়গুলোর মধ্যে অবশ্যই তারতম্য হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তি যোগ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে সেই সব সংসদ, যেখানে আজকের দিনের প্রশাসনিক ও তথ্যব্যবস্থার কাজে যুক্ত করার মতো প্রযুক্তিগত সামর্থ্য আছে।
শিল্পোন্নত দেশের বেশিরভাগ সংসদের মতো কানাডার ‘হাউস অব কমন্স’ প্রত্যেক সদস্যকে একটি ব্যক্তিগত অফিস ব্যবহারের সুযোগ দেয়। সেখানে আসবাবপত্র আছে। আছে পর্যাপ্ত উপকরণ : কমপিউটার, লেজার প্রিন্টার, টাইপরাইটার, টেলিভিশন, টেলিফোন এবং অফিসে সরবরাহ করা অন্য জিনিসপত্র। কানাডার সংসদে ইন্টারনেট সংযোগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন ইন্টারনেট তথ্যসংগ্রহ ও যোগাযোগ রক্ষার দ্রুততম, সহজতর ও সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপকরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় সংসদ সদস্যদের তথ্য ও সূত্র অনুসন্ধানের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করার জন্য ভারতেও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। ১৯৮৫ সালে ন্যাশনাল ইনফরম্যাটিকস সেন্টারের সহায়তায় ‘পার্লামেন্ট লাইব্রেরি ইনফরমেশন সিস্টেম’ (PARLIS) পরিচালনার জন্য একটি কমপিউটার সেন্টার গড়ে তোলা হয়। তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের তথ্যভান্ডার : কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বিতর্ক, সংসদীয় কার্যক্রমের মাইক্রোফিল্ম, বিল, সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট, সদস্যদের জীবনী। এসব তথ্যভান্ডারের মাধ্যমে সংসদ সদস্য ও গবেষকরা জাতীয় কার্যক্রম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যে প্রবেশ করতে পারেন।
১৯৬০ সালে জার্মানির বুন্ডেস্টাগ আইসিটি ব্যবহার করে সংসদীয় সামগ্রীর জন্য একটি নথিভুক্তি এবং তথ্য আহরণ পদ্ধতি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এর বাস্তব রূপায়ণের জন্য তিনটি পর্যায় নির্ধারণ করা হয়েছিল : ০১. সংসদীয় সামগ্রীর জন্য একটি কমপিউটারভিত্তিক নথিভুক্তি ও তথ্যব্যবস্থা তৈরি করা; ০২. বাইরের তথ্যভান্ডার থেকে তথ্যসংগ্রহ এবং ০৩. অর্থনৈতিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে আইনের পরিণামের একটি কৃত্রিম অনুরূপ অবস্থায় সৃষ্টি। সূচনায় এই তথ্যভান্ডারগুলো শুধু প্রশাসনিক পরিষেবার উপকরণ হিসেবে কাজ করত। তা প্রত্যক্ষভাবে বুন্ডেস্টাগ সদস্যদের সাহায্য করত। কিন্তু ১৯৮৫ সালে বুন্ডেস্টাগ সদস্যদের সরাসরি ও ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার দেয়া হয়। এখন তথ্যের এ সূত্রটি জার্মানির সংসদ সদস্য ও জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বমূলক ভূমিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
ডেনমার্কের সংসদের ওয়েবসাইটের যাত্রা শুরু ১৯৯৭ সালে। উদ্দেশ্য ছিল সংসদের নথিগুলো জনসাধারণ, ব্যবসায়-ক্ষেত্র ও গণমাধ্যমগুলোর কাছে সহজলভ্য করে তোলা। সংসদের কক্ষে অনুষ্ঠিত বিতর্ক, সংসদ সদস্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ওই ওয়েবসাইট ব্যবহার করা যায়। ডেনমার্কের সংসদের একজন সাবেক স্পিকারের এই ওয়েবসাইটের লক্ষ্য ছিল তিনটি : বিশেষত সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের আরো কার্যকর তথ্য-পরিষেবা দেয়া; রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনী ব্যবস্থাকে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া অনুসরণ করার সুযোগ দেয়া এবং জনসাধারণের সামনে প্রশাসনের স্বচ্ছতা বাড়ানো।
এই শেষ উদাহরণটি থেকে গণতন্ত্রের অবদান হিসেবে সংসদীয় কর্মকান্ডের উন্নতি সাধনের জন্য আইসিটি ব্যবহারে কিছুটা সীমাবদ্ধতা বোঝা যায়। এর ফলে সংসদে তথ্য সংরক্ষণের সামর্থ্য বেড়েছে ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, আইসিটি প্রয়োগের ফলে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার কোনো উন্নতি ঘটেছে। তা সত্ত্বেও ‘অংশগ্রহণের মই’য়ে এটি একটি যুক্তিসঙ্গত প্রথম ধাপ। যতদিন পর্যন্ত না দৈনন্দিন কাজের সময় সংসদে ই-মেইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার হবে, ততদিন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো স্বচ্ছভাবে কাজ করা ও নতুন গণমাধ্যমের কাছে আরো বেশি জবাবদিহি করার সম্ভাবনা খুবই কম। আর সংসদেই যদি প্রযুক্তি ব্যবহার না হয়, তাহলে আইসিটি ব্যবহার করে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোতে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা আরো কম হবে।
ই-গভর্নমেন্ট :
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইসিটি’র প্রয়োগের সর্বাধিক দৃশ্যমান ও সর্বজনগ্রাহ্য দিকটি হলো আরো স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত সরকার সৃষ্টির জন্য আইসিটি’র ব্যবহার। গণতান্ত্রিক শাসনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে মার্চ এবং ওলসেনের গবেষণা অনুসারে সংসদের ওয়েবসাইট গণতন্ত্রকে কিভাবে সাহায্য করে, তা বোঝার চারটি উপায় আছে :
০১. প্রবেশাধিকার ও অংশগ্রহণ; ০২. রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নেয়া; ০৩. গণতান্ত্রিক পরিচয় ও গণতান্ত্রিক সামর্থ্যের উন্নতি এবং ০৪. জনসাধাণের মধ্যে মতবিনিময়ের উন্নতি।
একইভাবে একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ই-গভর্নমেন্টের ছয়টি পর্যায়ের রূপরেখা দেয়া হয়েছে : ০১. তথ্য প্রকাশনা, ০২. তথ্য সম্প্রচার, ০৩. সরকারি দ্বিপক্ষীয় বিনিময়, ০৪. একাধিক উদ্দেশ্য সম্বলিত পোর্টাল, ০৫. সাধারণ পরিষেবাগুলোকে একত্র করা এবং ০৬. সম্পূর্ণ সংহত করা উদ্যোগের রূপান্তর।
এখন বিশ্বের বেশিরভাগ সরকারেরই ওয়েবসাইট আছে। বেশিরভাগ দেশেই অনলাইনে সব ধরনের সরকারি তথ্য বিনামূল্যে পাওয়া যায়। অনেক দেশই চিরাচরিত আমলানির্ভর প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তে আরো সহজে প্রবেশযোগ্য ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থার সূচনা করতে চাইছে, যাতে করে যোগাযোগ ও তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে ই-মেইল ও ইন্টারনেটের সম্ভাবনাকে ব্যবহার করা যায়।
অনলাইনে ভোট দেয়ার পদ্ধতিকে আরো সুবিধামূলক করে তুলতে আইসিটি’র ব্যবহার নিয়ে অনেক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ ব্যবস্থাটি এখনো শৈশবে আছে। ভোটারদের উপস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে এমন পদ্ধতিতে একটি বাস্তব রূপায়ণের মাত্র কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ আছে। অনলাইনে পরিচালিত প্রথম বড় ধরনের ও বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক নির্বাচন ছিল ২০০০ সালের আরিজোনার ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারি নির্বাচন। সেখানে ইন্টারনেটে ৩৯,৯৪২ ভোটার ভোট দেয়। জনসাধারণের অংশ নেয়ার পদ্ধতি প্রয়োগের অনুরোধ এসেছে। যদিও ই-ভোটিংয়ে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ায় বলে দাবি করা হয়। আরিজোনার প্রাইমারি ভোটে ভোটারদের মাত্র ৪১ শতাংশ অনলাইনে ভোট দেয়। বেশিরভাগ ভোটার পোস্টার ব্যালটের মাধ্যমে কিংবা কেন্দ্রে হাজির হয়ে ভোট প্রয়োগ করেছিল।
অনলাইনে ভোটদানের একটি আগ্রহব্যঞ্জক বিকল্প রূপ হলো সম্প্রতি সেনেগালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় একটি ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠা। এতে সেনেগালের অধিবাসী ও বিদেশে বসবাসরতদের তাদের ভোট-যোগ্যতা আছে কি না, তা জানতে দেয়া হয়। ভোটারদের উপস্থিতির ওপর তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অনেক দেশের সরকার আইসিটি ব্যবহার করে জনসাধারণের সাথে যুক্ত হওয়ার নতুন উপায় সৃষ্টি করেছে। ক্রমেই বেশি থেকে বেশি পরিষেবা অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন সম্পদকে সর্বসাধারণের কাজে সহজলভ্য করে তোলা হচ্ছে। যেমন, অনলাইনে কর-সংক্রান্ত ফরম জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উদাহরণ টেনে বলা যায়, যুক্তরাজ্যে ই-এনভয়ের অফিসের কথা, যা কেবিনেট অফিসের অংশ, সমগ্র ই-এজেন্ডার বিষয়ে একটা দায়িত্ব আছে। বিশেষত ই-কমার্স/ই-গভর্নমেন্ট বিষয়ে। ই-গভর্নমেন্ট গ্রুপের একটা স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল সব সরকারি পরিষেবাকে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ২০০৫ সালের মধ্যে গ্রাহকদের কাছে লভ্য করা। এর অর্থ সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মে প্রবেশাধিকারের রূপান্তর। ইন্টারনেট অনলাইনে পরিষেবা দেয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে। বিশেষত ‘এক জায়গায় সব পেয়েছির দোকান’-এর মাধ্যমে যাতে ব্যক্তি এবং সরকারের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদান আরো অর্থবহ হয়ে ওঠে এবং এক দফতর থেকে আরেক দফতরে যাওয়ার প্রয়োজন না হয়।
ই-ডেমোক্র্যাসি :
অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত ঘটনাবলী আছে, যেগুলো সংসদীয় গণতন্ত্র সমানতালে অস্তগামী হওয়ার সাথে জড়িত। যুক্তরাজ্যে এগুলোকে শনাক্ত করা হয়েছে এভাবে :
* বিপুল সংখ্যায় রাজনৈতিক দল এবং দলের ক্রমবিকাশ, নির্বাচন যন্ত্র হিসেবে যেগুলোর মূল উদ্দেশ্য তাদের নির্বাচকমন্ডলীর প্রতিনিধিত্ব করার বদলে নির্বাচনে জেতা;
* পার্টির শৃঙ্খলার বিকাশ, যার ফলস্বরূপ রাজনৈতিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ;
* গণমাধ্যমের বিকাশ।
আইসিটি জনসাধারণকে সেই ক্ষমতা দেয়, যাতে তারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ এবং সংশ্লিষ্ট থাকার মাধ্যমে আরো সক্রিয়ভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। ইন্টারনেটে আদানপ্রদানের এবং নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক সহজসাধ্য করে তুলতে সাহায্য করতে পারে। রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার প্রকাশ এবং নির্বাচনের ধরাবাঁধা পদ্ধতি এবং পলিসি নেটওয়ার্ক ও পার্টির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত চ্যানেলের বাইরে মতপ্রকাশের সুযোগ করে দিতে পারে আইসিটি। তা নির্ভর করবে নির্বাচকমন্ডলী সঠিকভাবে আইসিটি ব্যবহার করতে পারছে কি না তার ওপরে, যাতে করে তারা প্রতিনিধিদের ও তাদের দিয়ে সরকারকে কার্যকর জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারে। জনসাধারণ প্রায়ই সরকারকে নিজেদের থেকে দূরে মনে করে, বিশেষ করে এমন একটি যুগে; যখন উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং সক্ষম সরকারের প্রত্যাশা বেশি। আইসিটি ফোরামগুলো, বিশেষ করে বিতর্কে অংশ নেয়ার ভার্চুয়াল ফোরামগুলোর বাক-স্বাধীনতার জন্য প্ল্যাটফরম দিতে পারে এবং একটি চ্যানেল হতে পারে। যার ভেতর দিয়ে প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করা যায়, তাদের নিয়োজিত করা যায় এবং প্রভাবিত করা যায়। এখন পর্যন্ত এ ধরনের ই-ডেমোক্র্যাসি ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বা আশানুরূপ হারে বাড়েনি। জনসাধারণ রাজনীতিবিদের সাথে অনলাইন বিতর্কে অংশ নিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। যদিও প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ই-মেইলের ব্যবহার বেড়েছে। এতে করে তথ্যের মাত্রাতিরিক্ত বোঝা বেড়ে যাচ্ছে। এটা মনে করা উচিত নয়, প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করার এটিই সবচেয়ে ভালো উপায়।
OMB Watch নামের একটি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সব কংগ্রেসীয় অফিসে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল, এরা কিভাবে ভোটদাতাদের ই-মেইলের উত্তর দেন। এরা নির্ণয় করতে চেয়েছিল যে সদস্যরা ই-মেইল যোগাযোগকে অতটা গুরুত্ব দেন কি না, যা তারা অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমকে দিয়ে থাকেন। সামগ্রিকভাবে সমীক্ষায় জানা গেছে, কংগ্রেসের যথেষ্ট ও ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি থাকলেও ভোটদাতাদের কাছে পৌঁছানোর এবং তাদের প্রয়োজনগুলো সম্পর্কে সংবেদনশীল হওয়ার যে সুযোগ ইন্টারনেট দিয়েছে, তার যথেষ্ট ব্যবহার হয়নি। সমীক্ষা থেকে কিছু বিষয় বেরিয়ে আসে :
০১. ব্যক্তিগত যোগাযোগের মতো ফলপ্রসূ আর কিছুই নয়, কোনো কর্মনীতি নিয়ে ভাবনা-চিন্তার সময় যে যোগাযোগের উপায়কে কংগ্রেসীয় অফিসগুলো সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়, তা হলো ডাকে আসা ব্যক্তিগত চিঠি, এর পর আসে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, তৃতীয় স্থানে আসে টেলিফোন কল।
০২. ই-মেইল বা অন্যান্য ধরনের যোগাযোগকে গুরুত্ব পেতে হলে, তা ব্যক্তিগত হতে হবে এবং কোনো নির্বাচন কেন্দ্র থেকে হতে হবে।
০৩. সংসদ সদস্যরা তাদের নির্বাচকমন্ডলীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য ই-মেইল ব্যবহার করেন না- বেশিরভাগ কংগ্রেসীয় অফিস চিঠির উত্তর ই-মেইল ব্যবহার করে দেয় না। এরা ডাকে উত্তর দেয়। শুধু ১৫ শতাংশ কংগ্রেসীয় অফিস তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে নিজেদের ওয়াকিবহাল রাখতে ই-মেইল ব্যবহার করে।
০৪. যদিও বর্তমানে কংগ্রেস সদস্যরা কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেন, এই নিরিখে কর্মনীতিবিষয়ক ই-মেইল খুব উঁচু স্থান পায় না। কিছু ভবিষ্যতে ই-মেইল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
০৫. যদিও কংগ্রেসের প্রায় সব সদস্যের ওয়েবসাইট আছে, কিন্তু এ সাইটগুলোর গণমানের বিস্তর তারতম্য আছে এবং এতে তথ্য সবসময় সহজলভ্য নয়।
‘ই-সংসদ এমপিদের কাজ কার্যকরভাবে সম্পাদনের সুযোগ সৃষ্টি করে’
ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী,
এমপি, চেয়ারপার্সন, সেন্টার ফর ই-পার্লামেন্ট স্টাডিজ
সাধারণত ই-সংসদ জনসাধারণ, সংসদ ও সরকারের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে সেতুবন্ধন স্থাপন করে। ই-পার্লামেন্ট স্টাডিজের প্রধান কাজগুলো হলো দক্ষতা বিনির্মাণ, গবেষণা ও উন্নয়ন, কারিগরি সহায়তা এবং প্রতি বছর ই-পার্লামেন্টবিষয়ক সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা।
আমি মনে করি, ই-পার্লামেন্ট হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া। এটি বাস্তবায়িত হলে জনসাধারণ, সংসদ ও সরকারের মধ্যে বিদ্যমান যোগাযোগ অধিকতর শক্তিশালী হবে। সংসদ সদস্যরা অধিকতর ও ফলপ্রসূ প্রক্রিয়ায় সংসদের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং অতি সহজে এলাকার যাবতীয় সমস্যাবলী সমাধানের উপায়সমূহ আরো সুনির্দিষ্টভাবে সংসদে উপস্থাপন করাসহ ফলোআপ পরিবীক্ষণ করতে সমর্থ হবেন।
শেষ কথা
মূল্যবান কিছু সমীক্ষা চালানো হয়েছে আইসিটি’র মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের সাথে আরো বেশি করে মেলামেশার ব্যাপারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজলভ্য করতে গিয়ে তা যেনো ইন্টারনেটনির্ভর না হয়ে পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এটি গণতান্ত্রিক অভাব দূর করার বদলে তা আরো বেশি প্রকট করে তুলতে পারে। তবে এটি সত্যি, আইসিটি ব্যবহার করে সংসদকে আরো বেশি কার্যকর (ই-পার্লামেন্ট) বানানোর ক্ষেত্রে যাতে মানুষ সরকারি পরিষেবা আরো ভালোভাবে পেতে পারেন (ই-গভর্নমেন্ট) এবং এর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের আরো বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক বানানো সম্ভব (ই-ডেমোক্র্যাসি)। সংসদীয় গণতন্ত্র নতুনভাবে উজ্জীবিত করার জন্য এসব পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। এটি পৃথিবীজুড়ে ঘটছে। যতক্ষণ না গণতান্ত্রিক ঘাটতি ও ডিজিটাল ডিভাইড বাড়িয়ে তোলার বিপদগুলোকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, ততক্ষণ এসব ক্ষেত্রে সত্যিকারের অগ্রগতি সম্ভব নয়।
অনলাইন গণতন্ত্র নতুন ই-পলিটি’র দিকে : এটা অস্বীকার করা যাবে না যে আইসিটি কিছু সংসদকে কার্যক্ষেত্র হিসেবে আরো সক্ষম করে তুলেছে, কিছু সরকারকে আরো সহজলভ্য করেছে এবং কিছু সংসদ সদস্যদের আরো প্রতিনিধিত্বমূলক করে তুলেছে। যাই হোক, এমন কিছু লোক আছেন যারা বলেন যে এটা যথেষ্ট নয়। তারা বলেন, মানুষের জন্য ইন্টারনেট যে সুযোগগুলো এনে দিয়েছে তা আকঁড়ে ধরতে এবং ই-মেইলকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে দিতে। তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে চান।
স্কুমপিউটার প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের তিনটি স্তরের বিশ্লেষণ বলে যে মানুষ প্রথম নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুরনো পদ্ধতির বদলে উদাহরণ, টেলিফোনের বদলে ই-মেইল পাঠানো। দ্বিতীয় স্তরে, মানুষ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের কাজ করার ধরনে উন্নতি আনার জন্য। উদাহরণ- স্থানীয় লাইব্রেরিতে যাওয়ার বদলে ওয়েবে বিশাল ভার্চুয়াল লাইব্রেরির ব্যবহার। শুধু তৃতীয় স্তরে স্কুমপিউটার মনে করে যে প্রযুক্তির পুরো ক্ষমতা প্রকাশ পায় যখন মানুষ যেভাবে ব্যবহার করে তাতে সম্পূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়।
কেউ কেউ আছেন, যারা আইসিটি’র এই মডেলটি ব্যবহার করেন। তারা গণতন্ত্রকে পুরোপুরি পাল্টে ফেলতে ডাক দিয়েছেন। এতে এক নতুন ধরনের ই-পলিটি তৈরি হবে। সেখানে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে পাল্টে ফেলবেন তারা, যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের জীবন কী করে পরিচালিত হচ্ছে তা স্পষ্টভাবে শক্তিশালী এবং অব্যর্থ ভাষায় ব্যক্ত করতে পারছেন।
অনলাইন গণতন্ত্রের অনেকদিনের ব্যবহারকারী এবং প্রবক্তা হিসেবে স্টিফেন ক্লিফট গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবহার রূপান্তর ঘটাতে ডাক দিচ্ছেন :
‘আমি কামনা করি, রূপান্তরসাধনের যে সম্ভাবনা আমি দেখেছি এবং সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা পৃথিবীর অন্যান্য নাগরিকের কাছে পৌঁছে যাক। সময়ের সাথে এই তথ্য আদানপ্রদান করা নাগরিকদের অনলাইন সরঞ্জাম এবং শিক্ষা পাওয়ার দরকার, যা তাদের সাহায্য করবে যাতে তারা তাদের যে সামাজিক সমস্যাগুলো আছে তার প্রতিকার করতে পারে।’
তিনি তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন যেখানে তিনি সাহায্য করেছিলেন মিনিসোটাকে ই-ডেমোক্র্যাসিতে রূপান্তরিত করতে যা নতুন ধরনের রাজনীতির একটা জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ, যা মানুষকে সুযোগ দেয় আইসিটি ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে।
ক্ষুদ্র পর্যায়ে অনলাইন গণতন্ত্র :
ভারতে একটা প্রকল্প দেখিয়েছে আইসিটি ব্যবহার করে ছোট স্তরে শাসনপ্রক্রিয়ার উন্নতির সম্ভাবনা। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন. চন্দ্র বাবু নাইডু শুরু করেছেন ‘কুপ্পম নির্বাচনকেন্দ্রের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের জন্য ছোট স্তরে পরিকল্পনা’। দ্য রিজিওনাল সেন্টার ফর আরবান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ-ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি (RCUES-OU) অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের সহযোগিতায় একটি খুব বড় সমীক্ষা চালিয়েছিল নির্বাচনকেন্দ্রে এবং একটি কমপিউটারাইজড ডাটাবেজ তৈরি করেছিল নির্বাচনকেন্দ্রের মানুষের এবং বসতির জন্য, যাতে ভবিষ্যতের সিদ্ধান্তগুলো নিতে সাহায্য করে।
প্রকল্পটি এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে তা ৬০ হাজার পরিবারবিশিষ্ট ডাটাবেজ তৈরি করতে পারে। একটি প্রশ্নপত্র যাতে ১৬২টি প্রশ্ন ছিল গ্রামের সামগ্রিক অবস্থার ব্যাপারে, গ্রামের উন্নতির জন্য পরামর্শ ছিল, সন্তুষ্টির অভাব, উপার্জনের উপায়, ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি, পরিবারের খুঁটিনাটি ইত্যাদি সম্পূর্ণ করা হয়েছিল সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এই ডাটাবেজকে এমপিএইচএস (মাল্টিপারপাস হাউসহোল্ড সার্ভে) ডাটাবেজের সাথে সংযুক্ত করা যাতে কোনো বিশেষ গ্রামের ব্যাপারে, বসতি, পঞ্চায়েত, মন্ডল অথবা নির্বাচনকেন্দ্র এবং গ্রামের প্রত্যেক মানুষের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়।
যদি সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের উন্নতি করা যায় ছোট স্তরে তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে ও মানুষের যদি আরো সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকে যে সিদ্ধান্তগুলো রাজনীতিবিদরা নিচ্ছেন, তার ওপর আইসিটি’র প্রয়োগের মাধ্যমে তাহলে রাজনৈতিক বাস্তবতা পাল্টাতে বাধ্য হবে।
বৃহৎ স্তরে অনলাইন গণতন্ত্র :
স্কেলের অপর দিকে এরকম উপায় আছে, যাতে আইসিটি’র রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ আন্তর্জাতিক স্তরে বদলে দিতে পারে। আর্থ অ্যাকশন, নাগরিক গ্রুপ এবং বিধায়কদের একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক, একটি ই-পার্লামেন্ট তৈরি করার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে- একটি ক্ষেত্র যা প্রধানত ইন্টারনেট রয়েছে, যেখানে পৃথিবীর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিধায়করা মানবসমাজের সাথে মিলে যৌথ উদ্যোগে নিয়োজিত হবেন বিশ্বব্যাপী সমস্যাগুলোর সৃষ্টিশীল সমাধানের খোঁজে।
ই-পার্লামেন্টের পরিকল্পনা করা হবে যাতে :
* সাহায্য করতে পারে পৃথিবীর ২৫ হাজার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিধায়কের সংযোগ স্থাপন করতে একটি ইন্টারনেট গেটওয়ের মাধ্যমে।
* ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে হার্ডওয়্যার বন্দোবন্ত করার ক্ষেত্রে এবং উন্নয়নশীল দেশের সাংসদদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা তৈরির জন্য, যাতে তারা অনলাইনে যেতে পারেন এবং এভাবে ডিজিটাল ডিভাইড খানিকটা কম করতে সাহায্য করতে পারেন।
* বিশ্বব্যাপী ভালো শাসনপদ্ধতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে ভালো আইন-প্রণয়নের এবং কর্মনীতির উদাহরণের ‘লাইব্রেরির’ মাধ্যমে যা জমা করা আছে সাংসদদের দিয়ে ই-পার্লামেন্ট সাইটে এবং যা পৃথিবীজুড়ে বিধায়করা ব্যবহার করতে পারেন এবং দরকার হলে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী মানিয়ে নিতে পারেন।
প্রস্তাবিত কাঠামোটি হবে খুবই সরল
* নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ব্যাপারে বিধায়করা নিজেদের সংগঠিত করতে পারেন ‘ইন্টারগ্রুপে’। প্রত্যেক ইন্টারগ্রুপের একটি আলাদা আলোচনার স্থান থাকবে যেখানে অংশগ্রহণকারীরা কোনো বিষয়ের ব্যাপারে জানতে পারবেন, সংসদের অন্য সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করতে পারবেন, প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করতে পারবেন, সাধারণ মানুষ এবং বিনিয়োগকারীদের সাথে আলোচনা করতে পারবেন এবং ভোটগ্রহণ করতে পারবেন।
* একটি ই-পার্লামেন্ট পরিষদ, যা নির্বাচিত হবে সদস্যদের দিয়ে, নিশ্চিত করবে যে, প্রত্যেক ইন্টারগ্রুপ যেন নিয়মিতভাবে সুযোগ পায় পুরো ই-সংসদের সামনে বিষয়গুলো তুলে ধরার তথ্যসম্পন্ন বিবৃতির মাধ্যমে, অনলাইন হিয়ারিংয়ের মাধ্যমে।
* ই-পার্লামেন্ট সাইটে নাগরিকবর্গ এবং অন্যদের উৎসাহিত করা হবে তাদের নিজেদের মধ্যে ইন্টারগ্রুপ তৈরি করার জন্য, যাতে তারা ই-পার্লামেন্টের জন্য প্রস্তাব তৈরি করতে পারেন।
* একটি ভার্চুয়াল ‘সংসদ ভবন’ তৈরি করা হবে অন্য সংসদ ভবনগুলোর আদলে।
এই অভিপ্রায়ের সহজত্ব-একটি বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে বিদ্যমান জাতীয় বিধায়কদের একত্রিত করা-এটি তার একটি শক্তি। কয়েক বছর আগেও এরকম একটি বিশ্বব্যাপী কাঠামো অসম্ভব ছিল, কিন্তু ইন্টারনেট সব কিছু বদলে দিয়েছে।
যদিও এই প্রজেক্টটি এখনো শুরু হয়নি, কিন্তু নতুন ধরনের রাজনীতি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে আইসিটি’র ক্ষমতা জাহির করেছে-একটি আন্তর্জাতিক ই-পলিটি।
তথ্যসূত্র : ০১. বিশ্বব্যাংক ইনস্টিটিউট এবং ০২. ওয়ার্ল্ড ই-পার্লামেন্ট রিপোর্ট ২০০৮।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : jagat@comjagat.com