মানিবুকারস (www.MoneyBookers.com) হচ্ছে ইউরোপের একটি অন্যতম প্রধান অনলাইনে অর্থ লেনদেনের প্রতিষ্ঠান। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির দ্রুত উন্নতি ঘটছে। এর বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ৩৫০ কোটি ইউরোর উপরে। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি আগের বছরের তুলনায় দিবগুণ লাভ করেছে, যা একে বিশ্বের একটি সফল অর্থ লেনদেনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। বর্তমানে মানিবুকারসের নববই লাখ অ্যাকাউন্ট হোল্ডার রয়েছে। এটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের দুই শয়েরও বেশি দেশে ৮০ ধরনের অর্থ লেনদেনের সুবিধা দেয়। ৪৫ হাজারেরও বেশি মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠান মানিবুকারসের মাধ্যমে অনলাইনে সার্ভিস দিয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে eBay.com, Skype.com, GetAFreelancer.com, MochiMedia.com এবং ThemeForest.com। মানিবুকারস কতটা জনপ্রিয় তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বর্তমানে প্রতিদিন ১২ হাজারের ওপর নতুন ব্যবহারকারী মানিবুকারসে রেজিস্ট্রেশন করে।
মানিবুকারসকে ধরা হয় পেপালের প্রধান বিকল্প হিসেবে। বিশেষ করে যেসব দেশে পেপালের কোনো সার্পোট নেই, সেসব দেশের জন্য মানিবুকারস একটি আদর্শ মাধ্যম। এটি পেপালের মতোই নিরাপদ, দ্রুত ও সাশ্রয়ী অর্থ লেনদেনের পদ্ধতি। এর মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী থেকে অপর আরেকজনের কাছে মূহুর্তের মধ্যে অর্থ লেনদেন করা যায়। এতে খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ০.৫ ইউরো। অর্থ লেনদেনের জন্য প্রাপকের নাম বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিছুই জানার প্রয়োজন নেই। শুধু তার ই-মেইল ঠিকানাটিই যথেষ্ট। মানিবুকারস দিয়ে খুব সহজেই ২০ হাজারের ওপর ইকমার্স ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে কেনাকাটা করা যায়। মানিবুকারসকে আপনার ওয়েবসাইটের সাথে যুক্ত করে আপনি নিজেই একটি ই-কমার্স সাইট চালু করতে পারবেন। বর্তমানে বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে মানিবুকারস সাপোর্ট করে। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম খরচ পড়ে, মাত্র ১.৯%। ফ্রিল্যান্সিং সাইট ছাড়া কোনো ব্যক্তি থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য কোনো ফি দিতে হয় না। মানিবুকারসের অ্যাকাউন্ট থেকে নিজের ব্যাংকে টাকা নিয়ে আসতে মাত্র ২.৬৫ ডলার খরচ পড়ে।
রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি
মানিবুকারসে রেজিস্ট্রেশন খুবই সহজ তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে মানিবুকারসের পুরো সুবিধা পেতে হলে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। মানিবুকারসের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য এটি প্রত্যেক ব্যবহারকারীকে তিনটি পদ্ধতিতে যাচাই করে থাকে। এগুলো হচ্ছে- ঠিকানা যাচাই, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাচাই এবং ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড যাচাই। তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে ঐচ্ছিক, তবে প্রথম দু’টি অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।
ঠিকানা নিশ্চিত করা
লগইন করার পর My Account পৃষ্ঠায় Account Status অংশ থেকে Address Verify লিঙ্কে ক্লিক করুন। পরবর্তী পৃষ্ঠায় আপনার ঠিকানাটি দেখাবে, এরপর ‘Send me a verification letter’ বাটনে ক্লিক করুন। মানিবুকারস আপনার ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠাবে। চিঠিটি আসতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। চিঠিতে আপনাকে ছয়টি সংখ্যার একটি কোড পাঠানো হবে। কোডটি পাবার পর সাইটে লগইন করে ‘My Account’ → ‘Profile’ পৃষ্ঠায় গিয়ে আপনার ঠিকানার পাশের ‘Verify’ লিঙ্কে ক্লিক করুন। সেই কোডটি জমা দিন। এরপর যেকেউ আপনি মানিবুকারসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন শুরু করতে পারবেন।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যোগ করা
মানিবুকারস থেকে আপনার ব্যাংকে অর্থ তুলতে হলে My Account থেকে প্রথমে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যোগ করে নিন। এক্ষেত্রে আপনার ব্যাংকের SWIFT কোড, ব্যাংকের ঠিকানা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার ইত্যাদি দিতে হবে। মানিবুকারসে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যোগ করার সাথে সাথে আপনি ব্যাংকে অর্থ তুলতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে মানিবুকারস আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি যাচাই করতে বলবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাচাই করার জন্য ব্যবহারকারীর ব্যাংক থেকে মানিবুকরসের অ্যাকাউন্টে সামান্য পরিমাণ অর্থ (৫ থেকে ১০ ডলার) পাঠাতে হয়। তবে বাংলাদেশের আইনের জন্য কোনো ব্যাংক থেকেই মানিবুকারসে কোনো টাকা পাঠাতে পারবেন না। এক্ষত্রে নিচের পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে হবে :
০১.
কোনো ফ্রিল্যান্সিং সাইট থেকে অর্থ পাবার পর মানিবুকারস দিয়ে একবার উত্তোলন করুন। ব্যাংক
অ্যাকাউন্ট যাচাই না করেও আপনি দুইবার অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন। এজন্য লগইন করে Withdraw লিঙ্কে ক্লিক করুন।
০২.
টাকা ব্যাংকে জমা হবার পর ব্যাংক থেকে বিগত ছয় মাসের একটি ব্যাংক স্টেটমেন্ট চেয়ে নিন।
০৩.
ব্যাংক স্টেটমেন্টের মধ্যে মানিবুকারস থেকে আপনি যে অর্থ পেয়েছেন তার তারিখ এবং ডলারের পরিমাণ দেখতে পাবেন। কিন্তু এই ডলার কার কাছ থেকে এসেছে, তা উল্লেখ থাকবে না। এজন্য আপনাকে ওই লেনদেনের SWIFT Transaction নামের আরেকটি কাগজ সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত ব্যাংক এ কাগজ আপনাকে দিতে চাইবে না। কিন্তু আপনি যদি পুরো বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে বলতে পারেন, তাহলে তারা আপনাকে কাগজটির ফটোকপি দিতে সম্মত হবে। প্রকৃতপক্ষে আপনি যে ঘরে বসে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন, তা জানতে পারলে তারা খুশি হয়েই আপনাকে সাহায্য করবে।
০৪.
ব্যাংকের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কাগজগুলো সত্যায়িত করার পর এগুলোকে স্ক্যান করে কমপিউটারে নিয়ে নিন। সাথে আপনার পাসপোর্টও স্ক্যান করে নিন।
০৫.
এরপর merchantservices@moneybookers.com ঠিকানায় ই-মেইল অ্যাটাচমেন্ট করে এগুলো পাঠিয়ে দিন। ই-মেইলের Subject হিসেবে Manual Bank Account Verification উল্লেখ করুন এবং তাদের জানিয়ে দিন বাংলাদেশ থেকে যেহেতু কোনো টাকা মানিবুকারসে পাঠানো সম্ভব নয়, তাই আপনি ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট কাগজের স্ক্যানকপি ই-মেইলের সাথে পাঠাচ্ছেন। তারা যেন Manually আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাচাই করে নেয়।
০৬.
ই-মেইল পাঠানোর ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে আপনি মানিবুকারস থেকে ই-মেইল পাবেন। সবকিছু উপরে উল্লিখিত নিয়ম অনুযায়ী করতে পারলে মানিবুকারস কর্তৃপক্ষ আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি নিশ্চিত করে নেবে। এরপর আপনি মানিবুকারসের সব সুবিধা নিরবচ্ছিন্নভাবে উপভোগ করতে পারবেন।
ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড যোগ করা
যাদের ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড রয়েছে তারা ইচ্ছে করলে মানিবুকারসে কার্ডটি যোগ করে কার্ডের টাকা মানিবুকারসে নিয়ে যেতে পারবেন। বর্তমানে অনেকেরই পেওনার প্রদত্ত ডেবিট মাস্টারকার্ড রয়েছে। এই কার্ডের বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে। তবে এই কার্ডের টাকাকে শুধু এটিএম থেকে ক্যাশ হিসেবে তোলা হয়, ব্যাংকের সাথে এর কোনো যোগাযোগ নেই। আপনি যদি কার্ডের টাকাকে আপনার ব্যাংকে জমা রাখতে চান, তাহলে এটিএম থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে জমা দিতে হবে। এটিএম থেকে এক দিনে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি অর্থ তুলতে পারবেন না। ফলে বড় অঙ্কের অর্থের ক্ষেত্রে কয়েকদিনে টাকা জমা দিতে হবে, যা ঝামেলাপূর্ণ ও নিরাপদও নয়। মানিবুকারসের মাধ্যমে সে কাজ ঘরে বসে কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমেই করা যাবে। এজন্য প্রথমে মাস্টারকার্ডটি মানিবুকারসে যোগ করুন। কার্ডটি সঠিকভাবে যাচাই হবার পর উপরের মেনু থেকে Upload Funds লিঙ্কে ক্লিক করে Credit Card অপশনটি সিলেক্ট করুন। এরপর আপনার কার্ডের পেছনে লেখা তিনটি সংখ্যার CVV2 কোড দিন এবং কত টাকা কার্ড থেকে মানিবুকারসে নিতে চান তা উল্লেখ করুন। Next বাটনে ক্লিক করার সাথে সাথেই কার্ড থেকে মানিবুকারসের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়ে যাবে। এরপর মেনু থেকে Withdraw লিঙ্কে ক্লিক করে এই টাকা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠান। কার্ড থেকে মানিবুকারসে টাকা আনতে ১.৯% চার্জ যুক্ত হবে, যা মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে টাকা তোলার চেয়ে সাশ্রয়ী। কারণ, পেওনারের মাস্টারকার্ড থেকে এটিএম-এর মাধ্যমে প্রতিবার টাকা তুলতে ৩% চার্জ দিতে হয়।
মানিবুকারসের এত সুবিধার মধ্যে এর একটি বড় ধরনের অসুবিধা রয়েছে, যে কারণে এটি পেপালের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হতে পারছে না। এটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে মানিবুকারসের কোনো সার্ভিস নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মানিবুকারসে রেজিস্ট্রেশন করতে পারে না। যে সব ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস বা ই-কমার্স সাইট যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো মানিবুকারসের মাধ্যমে কোনো সার্ভিস দিতে পারে না।
মানিবুকারসে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যুক্ত করে তা যাচাই করাটা প্রথম দিকে একটু ঝামেলাপূর্ণ। কিন্তু একবার যাচাই হয়ে গেলে মানিবুকারসের কল্যাণে অনলাইনে অর্থ লেনদেনের একটি বিশাল ক্ষেত্র আপনার সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে। যা দিয়ে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স সাইট তৈরি, অনলাইনে কেনাকাটা ইত্যাদি অসংখ্য কাজে মানিবুকারসকে ব্যবহার করতে পারবেন। বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সাররা তাদের পরিচিত ক্লায়েন্টের কাছ থেকে এই পদ্ধতিতে কোনো খরচ ছাড়াই সরাসরি অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন (যুক্তরাষ্ট্রের ক্লায়েন্ট ব্যতীত)। মানিবুকারস একদিকে যেমন সাশ্রয়ী, অন্যদিকে নিরাপদ এবং ঝামেলাহীন অনলাইন লেনদেনের মাধ্যম।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : zakaria.cse@gmail.com