• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > পাইরেসিতে বি বিশ্বে তৃতীয় স্থান সফটওয়্যার শিল্পের কী হবে
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১০ - জুন
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
পাইরেসি
তথ্যসূত্র:
সফটওয়্যার সমালোচনা
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
পাইরেসিতে বি বিশ্বে তৃতীয় স্থান সফটওয়্যার শিল্পের কী হবে

পাইর্যাযসি নিয়ে এ লেখার পেছনে দুটি বড় খবর রয়েছে। প্রথম খবরটি হলো একেবারে তাজা। গত ২৩ মে ২০১০ রাতে ইন্টারনেটে জানা গেল, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সরকারের প্রতি একটি রুল জারি করেছে। খবরটিতে বলা হয়েছে, ‘পাইর্যারসি বন্ধে কেনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে না এবং পাইর্যা টেড কপি জব্দের নির্দেশ কেনো দেয়া হবে না, জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করা হয়েছে।’ একই সাথে আইন অনুযায়ী পাইর্যা সি বন্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মো: দেলোয়ার হোসেন ২৩ মে ২০১০-এ আদেশ দেন। ‘মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহেদ আলী এবং ‘বাংলাদেশ ফিল্ম প্রডিউসার ডিস্ট্রিবিউটর অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি গাজী মাজহারুল আনোয়ার এ রিট করেন।

আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে বাণিজ্য সচিব, অর্থ সচিব, সংস্কৃতি সচিব, শিল্প সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব, তথ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাপবের মহাপরিচালক, কপিরাইট বোর্ডের চেয়ারম্যান ও রেজিস্ট্রারকে জবাব দিতে বলা হয়েছে। পরদিন পত্রিকার পাতায় সেটি ছাপা হয়। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কোনো আলোচনা করেছে এমনটি চোখে পড়েনি।

আমি বিগত তেইশ বছর ধরে মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবসায় করি, কিন্তু এমন কোনো খবর এর আগে আর কখনো পড়িনি। যারা রিট করেছেন, তাদেরকে যেমন আমি চিনি, তেমিন আমি চিনি এই দুটি শিল্প খাতকে। কখনো কপিরাইট বোর্ডের সদস্য হিসেবে, কখনো কপিরাইট আইন সংশোধন সংক্রান্ত কমিটির সদস্য হিসেবে বা কখনো অ্যান্টি-পাইর্যা সি টাস্ক ফোর্সের সদস্য হিসেবে আমি এই দুটি শিল্প খাতের মানুষদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। ক’দিন আগে কপিরাইট আইন সংশোধন সংক্রান্ত এক সভায় গাজী মাজহারুল আনোয়ার উপস্থিত ছিলেন। তিনি সম্ভবত চলচ্চিত্র প্রযোজকদের সমিতির নতুন সভাপতি। কারণ, এর আগে তাকে আর কোনো সভায় দেখিনি। সচরাচর সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির মহিউদ্দিন আহমেদ, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কুমার বিশ্বজিৎ, ওয়াইপোর কবি নুরল হুদা এবং সরকারের কর্মকর্তারা সভায় উপস্থিত থাকেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার সেদিন বলছিলেন তার নিজের কষ্টের কথা। তার কথায়, তিনি এখন ফিল্ম পাইরেটদের হুমকির মাঝে বিপন্ন জীবনযাপন করছেন। কোটি কোটি টাকায় একটি চলচ্চিত্র তৈরি করার পর কেউ ছবি রিলিজ হবার পরের দিন ফোনে জানায়, দশ লাখ টাকা দাও, নইলে কপির সিডি বাজারে ছেড়ে দেবো, তখন কার মাথা ঠিক থাকে? তার মতে চলচ্চিত্র শিল্পে এখন চলছে নীরব সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি। পাইর্যা সির নামে এই ভয়ঙ্কর কর্মকান্ড যদি অব্যাহত থাকে, তবে একদিন বাংলাদেশে সিনেমা হলে দেখানোর জন্য কোনো চলচ্চিত্র তৈরি হবে না। চলচ্চিত্র শিল্প বলতে কিছু থাকবে না। বিশ্বজিৎ জানান, প্রতিদিন লাখ লাখ কপি পাইর্যা টেড সিডি উদ্ধার করা হয়, কিন্তু রাক্ষসের বংশের মতো তার কোনো শেষ নেই। আবার লাখ লাখ জন্ম নেয়। সেজন্য অবাক হইনি, এই দুটি সমিতি শেষ পর্যন্ত আদালতের দুয়ারে কড়া নেড়েছে। মনে হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও গানের ক্ষেত্রে পাইর্যা সি এতটাই ভয়াবহ, এই দুটি শিল্প খাতের বেঁচে থাকার মতো কোনো অবস্থা দেশে বিরাজ করে না। অথচ এমনি একটি জঘন্য অবস্থা থেকে এ দুটি শিল্পকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কোনো মহলের কোনো প্রচেষ্টা নেই। হাইকোর্ট যাদেরকে কারণ দর্শাতে বলেছে, তারা হাত-পা গুটিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে শুধু তামাশা দেখা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা পালন করে না।

তবে পাইর্যা সির সীমানাটা শুধু চলচ্চিত্র বা গানেই সীমাবদ্ধ নয়। অনেক আগেই পাইর্যাষসি চলে আসছে। ঢাকার নীলক্ষেতে গেলে কারো মনে হবার কারণ নেই যে, এটি কোনো সভ্য দেশ। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বই পাইর্যা সির দেশ। রাস্তায় রাস্তায় আন্তর্জাতিক প্রকাশনাগুলো ফেরি করা হয়, কেউ টু শব্দ করে না।

আমরা যারা বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্পের মানুষ, তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। চলচ্চিত্র বা গানের মানুষদের অন্তত একটি ভালো দিক হলো যে, তাদের সমিতি তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সফটওয়্যার শিল্পের পক্ষে এই খাতের সমিতিরও কোনো অংশগ্রহণ নেই। বেসিস নামের একটি সফটওয়্যার সমিতি আছে। এ সমিতি তার নিজের সদস্যদের বিরুদ্ধে কাজ করে। আমি নিজে সমিতির সেসব অপকর্মের শিকার। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় পাইর্যােসির দেশে পরিণত হয়েছে। সেজন্যই আমি সাম্প্রতিক দ্বিতীয় খবরটির প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।

হাইকোর্টের এই আদেশের মাত্র দশ দিন আগে ঢাকার পত্রিকাগুলোতে আরেকটি খবর ছাপা হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার ১৩ মে ২০১০ সংখ্যার ৯-এর পাতায় টেক প্রতিদিন বিভাগের শীর্ষ শিরোনাম ছিল ‘পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারে বাংলাদেশ তৃতীয়।’ খবরটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যবহার করা শতকরা ৯১টি সফটওয়্যার পাইর্যা টেড। এই হিসেবটি বিজনেস সফটওয়্যার এলায়েন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের দেয়া। তাদের হিসেবে দুনিয়াতে শতকরা ৯৫ ভাগ পাইর্যা সি নিয়ে সবার উপরে অবস্থান করছে জর্জিয়া। শতকরা ৯২ ভাগ পাইর্যাসসি নিয়ে জিম্বাবুইয়ে আছে দ্বিতীয় স্থানে। একই সমান বা শতকরা ৯১ ভাগ পাইর্যাবসি নিয়ে আমাদের সাথে এক কাতারে আছে মলদোভা। অন্যদিকে সবচেয়ে কম পাইর্যাাসি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর রয়েছে জাপান, লুক্সেমবার্গ, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার নাম।

আমাদের ব্যাপারে দৈনিক পত্রিকাটি শুধু তৃতীয় স্থানটির কথা বলেছে। কিন্তু প্রতিবেদনটিতে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। এমনকি পাইর্যাাসির ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ছে সেটিও এরা বলেনি। আমার নিজের বিবেচনায় সেই তথ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজনেস সফটওয়্যার এলায়েন্স জানাচ্ছে, ২০০৯ সালে সারা দুনিয়াতে ৫১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বেশি (বাংলাদেশী টাকায় ৩৫৭০ হাজার কোটি টাকার চাইতে বেশি) মূল্যের সফটওয়্যারের পাইর্যা সি হয়েছে। বিএসএ প্রেসিডেন্ট ও সিইও রবার্ট হোলিম্যান বলেছে, “Software theft exceeded $51 billion in commercial value in 2009. The public and private sectors need to join forces to more effectively combat an epidemic that stifles innovation and impairs economies on a global scale,”

আমি নিজে খুশি হতাশ যদি বাংলাদেশের হিসেবটাও থাকতো। তাতে আর যার যে অবদানই থাকুক না কেন, বিজয়-এর ক্ষতিগ্রস্ত হবার তথ্যটা জানা যেতো। কিছুদিন বিএসএ-র কেউ একজন এদেশে ছিলেন। এখন বিএসএ-এর প্রতিনিধিত্ব করেন এমন কেউ নেই বাংলাদেশে। ফলে বাংলাদেশে বিএসএ-এ কোনো কর্মকান্ডও নেই। যাহোক, আমরা খুব সহজভাবে যদি দুনিয়ার অর্থনীতিতে এই ক্ষতিটার দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে পারবো, পাইর্যাাসির ঘা কোন কোন খাতে কিভাবে আঘাত করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একটি শিল্প খাত তার আয় থেকে ৫১ হাজার ১০০ কোটি ডলার হারিয়েও কেমন করে সমৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এই ক্ষতিটা না হতো, তবে এই খাত আরো কতটা সামনে যেতে পারতো?

বিজনেস সফটওয়্যার এলায়েন্সের মতে, ২০০৯ সালে পাইর্যা সির হার ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। আগের বছর যেখানে ১৬টি দেশে পাইর্যাহসি বেড়েছিলো, ২০০৯ সালে সেখানে ১৯টি দেশে পাইর্যােসি বেড়েছে। দুনিয়াতে পিসি বিক্রি বাড়ার জন্যই পাইর্যা০সি বেড়েছে বলে বিএসএ মনে করে। এই প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, দুনিয়াতে পিসির যে বাজার বেড়েছে, তার শতকরা ৮৬ ভাগ বেড়েছে মাত্র তিনটি দেশে : ব্রাজিল, চীন ও ভারত। বিএসএ দাবি করে, এক ডলার যদি সফটওয়্যারের জন্য ব্যয় করা হয় তবে দেশী কোম্পানিগুলোর জন্য ৩-৪ ডলারের উপযোগ তৈরি হয়। অর্থমূল্যে চীনে সবচেয়ে বেশি পাইর্যালসি বেড়েছে। অন্যদিকে ভারত, চিলি ও কানাডা পাইর্যাগসি কমাতে সাফল্য দেখিয়েছে।

১১ মে ২০১০-এ প্রকাশিত এ প্রতিবেদন থেকে এটি বোঝা গেছে, বাংলাদেশের অবস্থা শুধু ভয়ঙ্কর নয়, উদ্ধারের পর্যায়েও নয়। যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সফটওয়্যারটি আমার তৈরি করা সেহেতু এই ক্ষেত্রে আমার অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। এমনিতে বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের ব্যাপক পাইর্যােসি আছে। এছাড়া আছে বিজয় বাংলা কীবোর্ডের পাইর্যাংসি। ফ্রিওয়্যার, ওপেন সোর্স বা বাণিজ্যিক সফটওয়্যারের নামে বিজয় বাংলা কীবোর্ড নকল করে দেদার বিতরণ করা হচ্ছে কপি, কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করারও কিছু নেই। ক’মাস আগে ঢাকার একটি এলাকায় পাইর্যা,টেড সফটওয়্যার ধরতে গিয়ে পরে এমন অবস্থায় পড়েছিলাম যে, এরা আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও মিছিল করার হুমকি দিল। বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমার পাইর্যা সিবিরোধী লড়াইকে নেতিবাচক প্রচারণা হিসেবে দেখা হয়েছে। এমনকি আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে মিছিল করা হবে এবং মানববন্ধন করে প্রতিবাদ করা হবে। তারও আগে একজন আমার বিজয় কীবোর্ড চুরি করে আমারই বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছিল। এখনো একটি ওপেন সোর্স ইউনিজয়, একটি ফ্রিওয়্যার ইউনিবিজয় এবং হাফ ডজন বাণিজ্যিক সফটওয়্যারে বিজয় কীবোর্ডে পাইর্যাকটেড হচ্ছে।

এ কারণে এদেশের সব সৃজনশীলতা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনো নতুন কর্ম তৈরি করছে না। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে সরকার এ বিষয়ে নীরব থাকায় পাইর্যাকসি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অ্যান্টি-পাইর্যারসি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। সেটি দুয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু এরপর সেই টাস্কফোর্স এখন নীরবতা পালন করছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত সবাই এই বিষয়ে কবরের নীরবতা পালন করে। পুলিশের চোখের সামনে পাইর্যা সি হয়, পুলিশ টু শব্দ করে না। সফটওয়্যার পাইর্যা সির জন্য নীলক্ষেত থানায় ছয়টি মামলা হয়েছে। পুলিশ হাতেনাতে তাদের কাছ থেকে পাইর্যা টেড সফটওয়্যার উদ্ধার করেছে, কিন্তু মাসের পর মাস অতিবাহিত হলেও এদের বিরুদ্ধে কোনো চার্জশীট দেয়া হয়নি। ২০০০ সালের কপিরাইট আইনে পাইর্যাদসির জন্য যথেষ্ট কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও একটি মামলাতেও কারো কোনো শাস্তি হয়নি। বরং যাদেরকে এসব অপরাধে গ্রেফতার করা হয়, তারা আদালতে উঁকি দিয়ে বের হয়ে আসে। এমন অবস্থায় দেশের সফটওয়্যার শিল্পের কী হবে, আমি তা আন্দাজও করতে পারি না।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস