দৈনিক প্রথম আলোর ১৫ মে ২০১০-এর খবর হলো- ইউনিকোড চালু হচ্ছে পাঁচ মন্ত্রণালয়ে। সেখানে বলা হয়- আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ে ইউনিকোডে বাংলা লিখন পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়গুলো হলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, অর্থ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। ‘ইউনিকোডে বাংলা টাইপিং চালুবিষয়ক প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ’ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের সহায়তায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ উদ্যোগ নেয়। সনাতন পদ্ধতিতে বাংলা টাইপ করার ক্ষেত্রে ফন্টকেন্দ্রিক বিভিন্ন সমস্যা দূর করা এবং সরকারি বিভিন্ন দফতরে ইউনিকোডে বাংলা লিখন চালুর জন্য এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
বিদ্যমান সমস্যা
সনাতনী বাংলা টাইপ করতে সমস্যা একাধিক :
• একই ফন্ট না থাকার কারণে এক কমপিউটারের বাংলা লেখা অন্য কমপিউটারে দেখা যায় না।
• বাংলাভাষায় ইংরেজির মতো অক্ষরের ক্রমানুযায়ী বাংলা লেখা সাজানো যায় না, অর্থাৎ ইংরেজিতে যেমন অ, ই, ঈ, উ অনুযায়ী নাম/লেখাগুলো সাজানো যায়, প্রচলিত পদ্ধতির বাংলা লেখায় সেটি করা যায় না। অর্থাৎ ক, খ, গ, ঘ অনুযায়ী লেখা/নাম সাজানো যায় না। এর ফলে তথ্য খুঁজে পেতে অনেক অসুবিধা হয়।
• প্রচলিত সনাতনী পদ্ধতিতে বাংলায় লেখা তথ্য অবিকৃত অবস্থায় ইন্টারনেটে প্রকাশ করলে সেখানে বাংলা অক্ষরের পরিবর্তে হিজিবিজি কিছু অক্ষর দেখায়। যেটির পাঠোদ্ধার করা অসম্ভব।
• কমপিউটারে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করলেও এখন কমপিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষের অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারেও ভিন্নতা এসেছে। কিন্তু সব অপারেটিং সিস্টেমে এ প্রচলিত বাংলা লিখন পদ্ধতি সমর্থন করে না।
• এছাড়া সনাতনী পদ্ধতির লেখা বাংলা মোবাইলের পড়া যায় না।
• ইংরেজিতে কোনো শব্দ/সংখ্যা লিখে সার্চ দিলে হাজার হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট থেকে খুব সহজেই যেমন কাঙ্ক্ষিত শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায়, সনাতনী পদ্ধতির বাংলায় লিখিত ডকুমেন্টগুলোর ক্ষেত্রে সেটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর ফলে বাংলায় লেখা কোনো ডকুমেন্ট থেকে কাঙ্ক্ষিত শব্দটি খুঁজে পেতে হলে প্রতিটি লাইন ধরে ধরে পড়তে হয়। এতে সময় ও শ্রমের অপচয় হয়।
• মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের অটো কারেক্ট অপশন বাংলা লেখায় অসম্ভব ঝামেলা করে। লিখিত প্রতিটি শব্দকেই কমপিউটার ভুল হিসেবে বিবেচনা করে। যেটি লেখার মনোযোগে বাধা সৃষ্টি করে।
• বাংলা লেখার পাশাপাশি কোনো English শব্দ ব্যবহার করতে হলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। এজন্য প্রথমে বাংলা কীবোর্ডকে নিষ্ক্রিয় করতে হয়, এরপর ফন্ট পরিবর্তন করার পর বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি লেখা যায়। ইংরেজি লিখে বাংলায় ফিরে আসতে আবার একই ঝামেলা পোহাতে হয়।
• ইংরেজিতে লেখা হলে শব্দের বানান পরীক্ষা করার সুযোগ থাকলেও বাংলায় সেটি সম্ভব হয় না। ফলে, অনেক সময় খুঁজে অথবা শুনে বাংলা বানান সংশোধন করতে হয়।
আমাদের সরকারি অফিসগুলোর কথা কল্পনা করুন। উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো সেখানে প্রতিদিনই ঘটছে। ভাবার চেষ্টা করুন, এসব সমস্যা নিয়ে সেখানে প্রতিদিন কী ফলাফল সৃষ্টি হচ্ছে? কখনো ভেবে দেখেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জনের প্রক্রিয়ায় এর কী প্রভাব পড়ছে? জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেবার যে স্বপ্নের কথা সরকার বলছে- সেবা মানুষের কাছে যাবে, মানুষ আর সেবার কাছে যাবে না। সরকারি অফিসের দাপ্তরিক কাজে এমন সমস্যা যদি চলতেই থাকে, তাহলে এ স্বপ্ন অর্জনের কী হবে। এর সমাধান কোথায়?
উপরের এসব বড় সমস্যার অনায়াসেই সমাধান করা যাবে যদি সব মন্ত্রণালয়ে ইউনিকোডভিত্তিক আধুনিক বাংলা লিখন পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হয়। যেমন-
• যেটি বাস্তবায়িত হলে ইংরেজির মতো কোনো ধরনের ফন্টবিষয়ক ঝামেলা ছাড়াই যেকোনো কমপিউটারে অথবা মোবাইল ফোনে বাংলা লেখা এবং পড়া যাবে।
• বাংলা লেখার পাশাপাশি ইংরেজি শব্দও ব্যবহার করা যাবে কোনো রকমের ঝামেলা ছাড়া।
• হাজারো শব্দের ভেতর থেকে কাঙ্ক্ষিত বাংলা শব্দটি খুঁজে বের করা যাবে অনায়াসে।
• ইন্টারনেটে বাংলাভাষা লেখা এবং পড়া যাবে বাধাহীনভাবে। মাইক্রোসফটের অটো কারেক্ট অপশন বাংলা লেখায় কোনো ঝামেলা করবে না।
• অক্ষরের ক্রমানুসারে বাংলা লেখাকে সাজানো যাবে ঠিক ইংরেজির মতো।
• সরকারি অফিসগুলোতে ইউনিকোড পদ্ধতিতে বাংলা লেখা চালু করা গেলে দেশের অসংখ্য মানুষের ভোগান্তি কমানোর পাশাপাশি তাদের মূল্যবান শ্রম এবং সময়ের অপচয় কমে যাবে অনেকাংশে।
• আর সনাতনী পদ্ধতিতে লিখিত আগের ডকুমেন্টগুলো একটিমাত্র ক্লিকের মাধ্যমে ইউনিকোডে রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ গুরু দায়িত্বটা পালন করতে উদ্যোগী হয়েছে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, এ কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
ডিজিটাল বাংলাদেশ সফল করতে হলে সরকারের প্রতিটি অফিসের মধ্যে আন্তঃযোগোযোগ বাড়ানো, অনলাইনে তথ্য প্রকাশ ও তথ্য বিনিময় ত্বরান্বিত করা জরুরি। এ কাজগুলো সহজেই করা সম্ভব হবে যদি প্রযুক্তিক্ষেত্রে বাংলা টাইপিংয়ে ইউনিকোডের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। দীর্ঘমেয়াদী তথ্য সংরক্ষণসহ সনাতনী লিখন পদ্ধতির বিভিন্ন ধরনের বাধা দূর করার জন্য ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম ইউনিকোডের প্রবর্তন করে ১৯৮৬ (http://unicode.org/history/) সালে, যার পরিপূর্ণ রূপ পায় ১৯৯২ সালে এবং ভার্সন ১.০ হিসেবে এটি আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম থেকেই পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাথে ইউনিকোডে বাংলাভাষা অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশে ইউনিকোডভিত্তিক টাইপিং সফটওয়্যার তৈরি ও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে ২০০২-২০০৩ সালের দিকে কিন্তু সরকারি পর্যায়ে এর ব্যবহার এতদিনেও পরিপূর্ণতা পায়নি।
ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের সহায়তায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরকারি সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটসমূহে ইউনিকোডে বাংলা টাইপিংবিষয়ক প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু করার কর্মপরিকল্পনা নেয়া। ইতোমধ্যে প্রায় ৪৫টি মন্ত্রণালয় ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এর ১৩৫ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। জুলাই ২০১০-এর মাঝামাঝি নাগাদ অবশিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বড় বিভাগগুলোর জন্যও প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হবে। এভাবেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাংলায় ইউনিকোড টাইপিংয়ের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করবে।
এর পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিকল্পনা হলো- এই প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ নেয়া রিসোর্স পুলকে দিয়ে তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়/বিভাগে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করানো। সেজন্য প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, প্রেজেন্টেশন ও হ্যান্ডআউট দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণে ৬টি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মধ্যে অংশ নিয়েছিল- বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (বেনবেইস), সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের পিএসিসি, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), বিসিএস এডমিন একাডেমি প্রভৃতি। মন্ত্রণালয়/বিভাগ অংশ নেয় ৩৩টি।
প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণের আলোচ্য বিষয় ছিল- কমপিউটারে সনাতনী বাংলা লেখার প্রতিবন্ধকতা, ইউনিকোডের সুবিধা, ইউনিকোড বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার, ইউনিকোডভিত্তিক ফন্টের ব্যবহার, কীবোর্ড লেআউট, আধুনিক পদ্ধতিতে বাংলা টাইপিং, কনভার্টার এবং ওয়েবসাইটে তথ্য সংরক্ষণের ব্যবহার। প্রশিক্ষণের জন্য যে বিষয়বস্তু তৈরি করা হয়েছে তাতে সরকারি পর্যায়ে তৈরি ফন্ট, কীবোর্ড লেআউট ও কনভার্টার ব্যবহারের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যার ফলে নির্বাচন কমিশনের তৈরি ৫টি ফন্ট ও নিকশ কনভার্টার এবং বিসিসি (বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল) কর্তৃক তৈরি জাতীয় কীবোর্ড ব্যবহারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। সর্বত্র যেন একইভাবে প্রমিতকরণের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয় তার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ইউনিকোডের গ্রহণযোগ্যতা
তথ্যপ্রযুক্তিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কিংবা প্রয়োজনীয় নথির আন্তঃযোগাযোগ বাড়াতে ইউনিকোডের বিকল্প নেই। এ বিষয়টি এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে আগত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সনাতনী বাংলা লিখন পদ্ধতির সমস্যা ও ইউনিকোডের সুযোগ-সুবিধা দেখে সবাই ইউনিকোডে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর। সফটওয়্যার, ফন্ট কিংবা কনভার্টারে কিছু কিছু কারিগরি ত্রুটি রয়েছে যা ধীরে ধীরে সমাধান হবে বলে জানানো হয়েছে।
টাইপিং সফটওয়্যারের গ্রহণযোগ্যতা
টাইপিং সফটওয়্যার হিসেবে অভ্র টাইপিং সফটওয়্যার শেখানো হয়। অনেক সুযোগসুবিধা সম্বলিত এ সফটওয়্যারটি সম্পূর্ণ ফ্রি এবং জনপ্রিয় হওয়ার কারণে এটি নির্বাচন করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীরা এ সফটওয়্যারটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে আয়ত্ত করতে পেরেছে। এ টাইপিং সফটওয়্যারটি ব্যবহারে কারো মধ্যে কোনরকম দ্বিধা পরিলক্ষিত হয়নি।
কীবোর্ড লেআউটের গ্রহণযোগ্যতা
প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণে জাতীয় কীবোর্ড লেআউট শেখানো হয়। শুরুতে সবাই লেআউট পরিবর্তনে সম্মতি না দিলেও পরে ইউনিকোডের অন্যান্য সুবিধার কারণে জাতীয় কীবোর্ড লেআউট ব্যবহারে সম্মতি দেয়। একজন ব্যক্তির পক্ষে লেআউট পরিবর্তন করে নতুন লেআউটের সাথে অভ্যস্ত হতে কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে। এই পরিবর্তন করার সময়ে তাদের কাজের গতি কমে আসবে। এ বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিবেচনায় নিতে হবে। নতুবা ইউনিকোডের এ বিশাল পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে অনেক প্রশিক্ষণার্থী মন্তব্য করেন।
শেষ কথা
বিয়াম থেকে আসা এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, নতুন প্রযুক্তিকে স্বাগত জানানোর প্রতি তারা বদ্ধপরিকর। উদ্ধৃতিটি হলো- আমাদের কৃষকরা এক সময় লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ করতো, সময়ের পরিবর্তনে লাঙ্গলের পরিবর্তে এসেছে ট্র্যাক্টর। আমাদের কৃষকরা যদি নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে পারে, তবে আমরা কেন পারব না? একাধিক প্রশিক্ষণার্থী মন্তব্য করেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এই নেতৃত্ব নীরবে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করল- যা আমাদের সরকারি দাপ্তরিক কাজের গতিকে বহুগুণ ত্বরান্বিত করবে। এতে একইসাথে আমাদের কর্মদক্ষতা বাড়ার পাশাপাশি মানুষকে সেবা দেবার গতিও বাড়বে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : manikswapna@yahoo.com