লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
এম. মিজানুর রহমান সোহেল
মোট লেখা:১০
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
কমপিউটারে বাংলা ব্যবহার
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ২
বিজয় সফটওয়্যারের ২৫ বছর
১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ বিজয় বাংলা কিবোর্ড তথা সফটওয়্যার পূর্ণ করছে তার ২৫ বছরের অভিযাত্রা। কমপিউটারে বাংলাভাষা প্রচলনের ইতিহাসে এটি শুধু এক বিশাল ঘটনা নয়, কমপিউটারে এটি বাঙালির মাতৃভাষা চর্চার বিশাল মাইলফলকও। দেশ-বিদেশের যে বিশাল জনগোষ্ঠী বিজয় ব্যবহার করছে, তার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে যে ২৫ বছর ধরে কেমন করে এটি আরও বিকশিত হচ্ছে এবং কী কারণে এটি বাংলাদেশের অন্য সব বাংলা কিবোর্ড তথা সফটওয়্যার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে দিনে দিনে সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিজয় বাংলা হরফ দিয়ে ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা লেখাকে অবিকৃত রেখে এর পরিপূর্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করেছে। বিজয়ের আগে ও পরে আরও অনেক বাংলা সফটওয়্যারের জন্ম হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই বিজয়কে প্রতিস্থাপিত করতে পারেনি। আর তাই বিজয়ের রজতজয়ন্তিতে এর বৈপ্লবিক সাফল্যের আদ্যোপান্ত পাঠকদের সামনে তুলে ধরার এ আমাদের প্রয়াস।
বাংলাভাষায় কমপিউটারের কিবোর্ড
পৃথিবী জুড়ে রোমান হরফের আধিপত্যের মাঝেও হরফ বিক্রি করার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাভাষাকে একেবারেই অবহেলা করেনি। হট মেটাল মেট্রিক্স থেকে শুরু করে আধুনিক টাইপসেটার পর্যন্ত সব জায়গায় হরফ বিক্রেতা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজনেই প্রথমে বাংলা কম্পোজিং মেট্রিক্স ও পরে কী তৈরি করেছে। এতে এরা তাদের ইচ্ছেমতো রোমান বোতামের স্থানে বাংলা হরফ বসিয়ে কিবোর্ড তৈরি করে ফেলেছে। এসব প্রতিষ্ঠান যেসব কিবোর্ড তৈরি করেছে, তাতে বাংলা কম্পোজের ক্ষেত্রে উইলিয়াম কেরি আমল থেকেই ইংরেজি যেভাবে অন্ধ অনুকরণ করা হয়েছে, তারই প্রতিফলন ঘটেছে। বিদ্যাসাগর ও বটতলা উভয় পদ্ধতিতেই দু’শ’ বছর ধরে এ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। মনোটাইপের মেট্রিক্স পাঠানো হয়েছিল মনোটাইপের কলকাতা অফিস থেকে, সেটিও পৌনঃপুনিকতাভিত্তিক ছিল না। সুরেশ চন্দ্র মজুমদার যে বাংলা লাইনো কী করেন, সেটিও পৌনঃপুনিকতাভিত্তিক ছিল না।
বিজয়ের আগের বাংলা
১৯৮৮ সালে বিজয় জন্ম নেয়ার আগে বাংলাদেশের মানুষ সীসার হরফ দিয়ে বাংলা লিখত ৪৫৪টি খোপ দিয়ে। কমপিউটারে কমপক্ষে ১৮৮টি বোতাম লাগত বাংলা লিখতে। টাইপরাইটারে বাংলা লেখা যেত, তবে যুক্তাক্ষরকে বিকৃত করতে হতো। এসব বোতামের অবস্থান মুখস্থ করে বাংলা লেখার কাজটা করা যেত। ইংরেজির তুলনায় বাংলা লেখার গতি ছিল অর্ধেকেরও কম। বিজয় সেই জটিলতা দূর করে মাত্র ২৮টি বোতামে ৫৫টি অক্ষর দিয়ে কমপিউটারে বাংলা লেখার ব্যবস্থা চালু করে।
২৫ বছর আগে বাংলা লেখার চ্যালেঞ্জ
বিজয় দিয়ে লেখার আগে বাংলা লেখা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল- এর উত্তরে মোস্তফা জববার বলেন, তখন অনেকেরই মনে থাকার কথা, আমার সাথে কমপিউটারের সম্পর্কটা বিজয় দিয়ে হয়নি। ১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল আমি মেকিন্টোস কমপিউটার স্পর্শ করি এবং ১৬ মে আনন্দপত্র নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা কমপিউটার দিয়ে প্রকাশ করি। বাংলাদেশে মুদ্রণ ও প্রকাশনায় কমপিউটার বিপ্লবের সূচনা হয় সেই থেকে। এরপর ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে আমি প্রথম আনন্দ নামে বাংলা ফন্ট তৈরি করে বাংলা প্রকাশনায় নিজের ভিতটাকে মজবুত করি। যত কথাই বলি, ১৯৮৭ সালে আনন্দপত্র প্রকাশ করে আমি বাংলাদেশের মুদ্রণ প্রকাশনার জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছি। আসলে বিজয় কিবোর্ড লেআউট ও সফটওয়্যার হচ্ছে আমার স্বপ্ন, আমার গর্ব, আমার নিজের জীবনে করা শ্রেষ্ঠতম কাজগুলোর সেরাটি। ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সেই বিজয় তার ২৫ বছর পূরণ করার বিষয়টি তাই আমার জীবনের সুন্দরতম সময়ের একটি।
বিজয় কিবোর্ডের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
বিজয় কিবোর্ড সেই সময়ে বিদ্যমান সব কিবোর্ডের মৌলিক ধারণা থেকে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। বিজয় কিবোর্ড বিন্যস্ত করার সময় বিজ্ঞানসম্মত কিছু বিষয়কে মাথায় রাখা হয়েছে। এখানে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হলো। বাংলা মূল বর্ণের সংখ্যা ৫০ এবং এতে হসন্ত ও দাড়ি নামে দুটি অতিরিক্ত চিহ্ন মিলিয়ে মোট ৫২টি মৌলিক বর্ণকে প্রথমে কিবোর্ডে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে সাকুল্যে ৫৫টি অবস্থান বাংলা হরফের জন্য নিশ্চিত করা হয়। কিবোর্ডে ফ্রিকোয়েন্সি অনুযায়ী অক্ষর বসানো হয় এবং চন্দ্রবিন্দু, খ-ত ও বিসর্গকে ইংরেজি বর্ণগুলোর স্থানে না রেখে বাংলার জন্য প্রয়োজন নয় এমন চিহ্নে স্থাপন করা হয়। বর্ণগুলোকে যথাসম্ভব জোড় হিসেবে বসানো হয়। জোড় বিবেচনার সময় অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ ও উচ্চারণের সমিলতা বিবেচনা করা হয়। হ ও ঞ-এর ক্ষেত্রে এসব সমিলতা না পাওয়ায় এমনিতেই জোড় হিসেবে আবদ্ধ করা হয়। ফ্রিকোয়েন্সি বেশি হওয়ায় স্বরচিহ্নকে বোতামে বসানো হয়। বাম হাতের হোম কী ও এর কাছাকাছি নিচের সারিতে স্বরচিহ্ন + স্বরবর্ণ এবং ডান হাতে ও বাম হাতের ওপরের সারিতে ব্যঞ্জনবর্ণ স্থাপন করা হয়, বর্ণ সংঘটনের স্বার্থে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। একই কারণে র ফলা, য ফলা ও রেফ বাম হাতে রাখা হয়েছে। ইংরেজি জি বোতামটিকে লিঙ্ক বোতাম বা সংযুক্তি বোতাম হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তাক্ষর ও স্বরবর্ণ তৈরির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিজয় বনাম অন্যান্য বাংলা কিবোর্ড
সেই ১৯৮৬ সালের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে প্রচলিত হলো শহীদলিপি। নতুন একটি কিবোর্ড নিয়ে প্রথম বাংলা সফটওয়্যার বাজারে এলো। সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় গণমাধ্যমের টাকায় তৈরি করা সেই সফটওয়্যারের কিবোর্ড আলোড়ন তুলল। ২৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি করা সেই বাংলা সফটওয়্যার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতেও শুরম্ন করল। অন্যদিকে শহীদলিপির অন্তত দুই বছর পর প্রকাশিত হলো বিজয় বাংলা কিবোর্ড ও সফটওয়্যার। অথচ আজ দুনিয়ার কোথাও শহীদলিপি ব্যবহার হয় না। এক সময়ে বাংলা একাডেমী এ সফটওয়্যারের ব্যবহারকারী ছিল। কালক্রমে তারাও শহীদলিপি ছেড়ে বিজয় ব্যবহার করছে। সেই সময়ই তৈরি হয়েছিল জাফর ইকবাল-রতনের কিবোর্ড। মেকিন্টোসের জন্য একটি ফন্টও এরা তৈরি করেছিল। তারও আজ কোনো অস্তিত্ব নেই। স্মরণ করা যেতে পারে টাইপরাইটারের মুনীর কিবোর্ডের কথা। কিবোর্ডটি এখনও কিছুটা প্রচলিত থাকলেও বস্ত্তত টাইপিস্টদের সাথে সাথে সেই কিবোর্ডটিও হারিয়ে যাবে। কারণ, নতুন করে কেউ সেই কিবোর্ড ব্যবহার করতে শেখে না। এরপর স্মরণ করা যায় বাংলা একাডেমীর কিবোর্ডের কথা। জন্ম নেয়ার আগেই সেটি মারা যায়। একাডেমী সাইটেকের সাথে আরও একটি কিবোর্ড প্রমিত করেছিল। কিন্তু একজন ব্যবহারকারীও সেই কিবোর্ডটি পায়নি। তারও আগে আবহ ও অনির্বাণ কিবোর্ডের জন্ম হয়েছিল। সেগুলো আজ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজে পাওয়া যায় না লেখনী কিবোর্ডকে। এমনকি সরকারিভাবে যে কিবোর্ডটিকে প্রমিত করা হয়, সেটিও এখন কেউ ব্যবহার করে না। বস্ত্তত কোনোদিনই ব্যবহার করেনি।
বিজয় থেকে লেখনী
১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় কিবোর্ড প্রকাশ করার সাথে সাথে দৈনিক আজাদ, দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক দেশ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রচলিত সুনন্দা ফন্ট বদলে তন্বী সুনন্দা ফন্ট দেয়া হয় এবং বিজয় কিবোর্ড চালু করা একটা বড় কাজ হয়ে পড়ে। প্রথমদিকে অপারেটরেরা প্রতিবাদ করলেও মাত্র সপ্তাহখানেকের মাঝেই এরা জববার কিবোর্ড ফেলে দিয়ে বিজয় কিবোর্ড ও তন্বী সুনন্দা ফন্ট ব্যবহার করতে শুরু করে।
বাংলা বর্ণ ও কিবোর্ড
অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের মতে, বাংলা বর্ণের সংখ্যা এমন : ক. স্বরবর্ণ ১১টি, খ. সংযুক্ত বর্ণ ৩৬টি, গ. দ্বিত্ব ব্যঞ্জনবর্ণ ২৬টি, ঘ. নাসিক্য ও ব্যঞ্জনবর্ণ ১৯টি, ঙ. স্বরচিহ্ন ১০টি, চ. বঞ্জনবর্ণ ৪০টি, ছ. দুই বর্ণের সংযুক্তবর্ণ ২০৩টি, জ. তিন বর্ণের যুক্তাক্ষর ৬৬টি, ঝ. চার বর্ণের যুক্তাক্ষর ৩টি, ঞ. কারাদিযুক্ত হলে পরিবর্তিত হয় এমন বর্ণ ৪০টি, মোট বর্ণ ৪৫৪টি। এছাড়া সংখ্যা ১০টি, চিহ্ন-(অন্তত) ১৫টি, সর্বমোট ৪৭৯টি। ভারতীয় গবেষক মনোজ কুমার মিত্রের মতে, অবশ্য বাংলা যুক্তবর্ণই ৫২১টি। তার মতে, বিশুদ্ধ যুক্তবর্ণ ৩৫৪টি ও যুক্তধ্বনি ৫৪টি। অর্থাৎ মনোজ মিত্রের হিসাব বাংলা বর্ণের সংখ্যা ছয়শ’র কাছাকাছি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণ পরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগ অনুসারে বাংলা যুক্তবর্ণের সংখ্যা ১৮১টি। আমরা হিসাব করে দেখেছি স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ ও স্বরচিহ্ন ছাড়া স্বরচিহ্ন যুক্ত হয়ে সংঘটিত পরিবর্তন, স্বরচিহ্নের স্থান পরিবর্তনজনিত ভিন্নরূপ এবং যুক্তাক্ষর নিয়ে মোট ২৪০টি বর্ণ হলে বাংলাভাষা মোটামুটি ভালোভাবেই লেখা সম্ভব। খুব সুন্দরভাবে বাংলা লিখতে হলে এর বাইরে অন্তত আরও ৭৬টি বর্ণ ও চিহ্ন প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ বাংলার জন্য প্রয়োজনীয় মোট অক্ষরের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩১৬। বলাবাহুল্য, কোনো টাইপরাইটার কিবোর্ডের সাহায্যেই সরাসরি এ বর্ণগুলো তৈরি করা নিঃসন্দেহে কঠিন ও দুরূহ কাজ। কিবোর্ডে বিদ্যমান ৪৭টি বোতামে প্রায় ৭টি স্তর থাকলে এতগুলো অক্ষর সরাসরি লেখা সম্ভব। মুনীর চৌধুরী উপরোলিস্নখিত অক্ষরগুলার মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বিচারে টাইপরাইটারের একটি প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছেন। তার কিবোর্ড একটি শূন্যতা পূরণ করেছে ও একটি প্রাথমিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে।
বিজয় নামকরণ
বিজয় হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জনগণের বিজয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তি পায় বাংলার মানুষ, সেটিই বিজয়। কমপিউটারে বাংলা প্রচলন করতে গিয়ে মোসত্মাফা জববার উপলব্দি করেন, যন্ত্রে বাংলাভাষা ব্যবহার করার জন্য আমার একটি ‘মুক্তি’ প্রয়োজন। বিজয় বাংলা লিপিকে সেই মুক্তি দিয়েছে বলে এর বিজয় নামকরণ তিনি যথাযথ মনে করেন। তবে মোসত্মাফা জববারের ছোট মেয়ে সুনন্দা শারমিন তন্বী পাঁচ বছর বয়সেই বাবার কাছে তার তৈরী কিবার্ড ও সফটওয়্যারের নাম ‘বিজয়’ রাখার প্রস্তাব করলে সেই নামটিই মূলত চূড়ান্ত করা হয়।
বিজয় থেকে ইউনিকোড
২০০৩ সালে বিজয় নতুন জীবন পায় রিফাত-উন-নবীর হাতে। বিজয় ইউনিকোড পদ্ধতিতে যাত্রা করে রিফাতের সাথে। রিফাতের পরই বিজয়ের কোড লেখার কাজটির দায়িত্ব নেয় রজব, শোভন, উর্মিসহ একটি বড় টিম। এরা নতুন করে বিজয়কে উপযোগী করে তোলে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় কিবোর্ড দিয়ে ইউনিকোড লেখা শুরু হয় ২০০৫ সাল থেকে। বিজয় একুশের মাধ্যমে প্রথম বিজয় ইউনিকোড অবমুক্ত হয়।
বিজয়ের কপিরাইট প্যাটেন্ট
১৯৮৮ সালে বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার তৈরি করার পর মোস্তফা জববার এর মেধাস্বত্ব রক্ষার উদ্যোগ নেন। তখন দেশে সফটওয়্যারের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করার কোনো বিধান ছিল না। সাহিত্যকর্ম, শিল্পকর্ম বা সঙ্গীতকে কপিরাইট করা যেত। সেই আইনের আওতাতেই বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার সাহিত্যকর্ম হিসেবে কপিরাইট নিবন্ধিত হয়। এরপর কপিরাইট আইন সংশোধিত হয় ও সফটওয়্যার কপিরাইট করার উপায় তাতে যুক্ত হয়। পরে বিজয় সফটওয়্যারের বিভিন্ন সংস্করণ কপিরাইট নিবন্ধিত হয়। ২০০৪ সালে অনুমোদিত হলে সেই থেকে বিজয় প্যাটেন্টেড প্রযুক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া সফটওয়্যার বিজয়
প্রথমত, বিজয় বাংলাভাষা ও বঙ্গলিপি সংশিস্নষ্ট বলে এর সাথে বাঙালির আবেগের সম্পর্কটা গভীর। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের আর কোনো সফটওয়্যার এত মানুষ ব্যবহার করে না। এটি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম ডিজিটাল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন। এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র সফটওয়্যার প্যাটেন্ট। শুরুর সময় বিজয়ের একটি সফটওয়্যারের দাম ছিল এক হাজার টাকা। তবে প্রফেশনাল বিজয় সফটওয়্যারের দাম ছিল পাঁচ হাজার টাকা। সে দাম অবশ্য এখনও অব্যাহত আছে। তবে সময়ের প্রয়োজনে এক হাজার টাকা দামের সফটওয়্যার এখন ৫০ টাকার সহজলভ্য মূল্যে নিয়ে আসা হয়েছে।
২৫ বছরে বিজয় ইনস্টলের পরিমাণ কত?
গত ২৫ বছরে কী পরিমাণ কমপিউটারে বিজয় ইনস্টল হয়েছে তার হিসাব নেই মোস্তফা জববারের কাছে। সেই সংখ্যা দেশের কমপিউটার ব্যবহারের সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি। হয়তো শতকরা ৯৫ ভাগ কমপিউটারে এ সফটওয়্যারটি ইনস্টল হয়েছে। এ সফটওয়্যারটির সমপরিমাণ পাইরেসি দেশের আর কোনো সফটওয়্যার নিয়ে হয়নি। শুধু মাইক্রোসফট উইন্ডোজ বা অফিস বিজয়ের কাতারে রয়েছে। এর বাইরেও দুনিয়ার যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী আছে, সেখানেই এ সফটওয়্যারটি বিরাজ করছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় এ সফটওয়্যারটি এখনও অন্য যেকোনো বাংলা সফটওয়্যারের চেয়ে বেশি প্রচলিত।
ভারত ও যুক্তরাজ্যে বিজয়ের ডিস্ট্রিবিউটর
বাংলাদেশের বাইরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশী প্রবাসীরা সাধারণত বাংলা লিখতে বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। তবে এ ক্ষেত্রে সব দেশেই বিজয়ের ডিস্ট্রিবিউটর নেই। সবাই বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। তবে ভারত ও যুক্তরাজ্যের বাজারে বিজয়ের অনুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে।
উইকিপিডিয়াতে নেই বিজয়!
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ডিজিটাল ডিভাইসে বাংলা লেখা শিখিয়েছে বিজয় সফটওয়্যার। অনেক বাধা পেরিয়ে আগামী ১৬ ডিসেম্বর ২৬ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে বিজয়। অথচ এ সম্পর্কে জানতে কেউ যদি তথ্যভান্ডার উইকিপিডিয়াতে গিয়ে অনুসন্ধান করেন, তাহলে তাকে নিরাশই হতে হবে। এত বছর পার হলেও এখানে এ সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য দেয়া হয়নি। কৌতূহলী বা আগ্রহী কেউই এ সম্পর্কে এখানে কিছু লেখেননি। এমনকি এ ব্যাপারে বিজয় কর্তৃপক্ষও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু কেনো? উত্তরে মোস্তফা জববার বলেন, আমরা বাংলাভাষায় একটি বিশাল উদ্ভাবন করেছি মাত্র। কিন্তু উইকিপিডিয়াতে আমরা নিজেরা নিজেদের ঢোল পিটাব তা নিশ্চয় ভালো দেখা যাবে না। বাংলাদেশে উইকিপিডিয়া কর্তৃপক্ষ যদি কখনও এর প্রয়োজন অনুভব করে তখন দেবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা চাইলে আমরা তা দিতে প্রস্ত্তত আছি।
২০১৩ সালের বিজয়
সবারই জানার আগ্রহ থাকবে ২০১৩ সালে বিজয় যখন রজতজয়ন্তি পূর্ণ করছে, তখন এর অবস্থাটি কী? বিজয়ের এ সময়ের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে এটি এখন ম্যাক ওএস, উইন্ডোজ, অ্যান্ড্রয়িড এবং লিনআক্সে বিজয় আসকি ও ইউনিকোড দু’টি পদ্ধতিতেই কাজ করে। শুধু ম্যাক ওএস থেকে বিজয় যাত্রা শুরু করলেও এটি এখন চারটি অপারেটিং সিস্টেমে সমভাবে কাজ করে যাচ্ছে, যা এক বিশাল উত্তরণ। এটি ছাড়া আর কোনো বাংলা সফটওয়্যার এভাবে চারটি প্রধান অপারেটিং সিস্টেমে চলে না। এ চারটি অপারেটিং সিস্টেমেই বিজয় কিবোর্ড কাজ করে। ম্যাক ও উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে বিজয় বাংলা সফটওয়্যার ‘একাত্তর’ নামে আরেকটি বাড়তি এনকোডিংয়ে কাজ করে। এটিতে বাড়তি যুক্তাক্ষর থাকায় বাংলা টাইপোগ্রাফি আরও সুন্দর হয়েছে। অ্যান্ড্রয়িডে বিজয় শুধু ইউনিকোড পদ্ধতিতে কাজ করে। বিজয় ইন্টারনেট নামে একটি সফটওয়্যার বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়, যা উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে শুধু ইন্টারনেটে ইউনিকোড পদ্ধতিতে কাজ করে।
রজতজয়ন্তিতে বিজয়ের উপহার বিজয় ৭১ প্রো
বাংলায় লেখা বিজয় সফটওয়্যারের সর্বশেষ সংস্করণ ‘বিজয় ৭১ প্রো’ অবমুক্ত হচ্ছে আগামী ১৬ ডিসেম্বর। ২০০৮ সাল থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নতুন ভার্সনের এ সফটওয়্যারের জন্য কাজ করে আসছে বিজয় টিম। এখানে সব ফন্ট নতুন করে এডিট করা হয়েছে। আগে বিজয় সফটওয়্যারে সম্ভাব্য যে কয়েকটি সমস্যা ছিল তা সমাধান করা হয়েছে। উইন্ডোজের জন্য এ বাংলা সফটওয়্যারটি একটি বড় মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। মোস্তফা জববার বলেছেন, বিজয়ের ২৫তম বছরের উপহার বিজয় ৭১ প্রো।
বিজয়ের পরবর্তী যত উদ্যোগ
পিসি বা ল্যাপটপ কমপিউটারের জন্য দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে কাজ করলেও বিজয় তার ২৬তম বছরে গিয়ে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে বেশি কাজ করবে। আগামী ২০১৪ সালের মধ্যে উইন্ডোজ ও আইওএসের জন্য সফটওয়্যার নিয়ে আসবে বিজয় টিম। এছাড়া প্রফেশনাল পাবলিশিং, ডিজিটাল ডিকশনারির জন্যও কাজ করবে তারা। তবে প্রতিষ্ঠানটির আগামী দিনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন সব ডিজিটাল ডিভাইসে বিজয় ব্যবহার চালু করা
ফিডব্যাক : mmrsohelbd@gmail.com