• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > ইউএস-বাংলাদেশ টেকনোলজি সামিট : সম্ভাবনার অন্য দিগন্ত
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: রুবাইয়াত বিন আরিফ
মোট লেখা:১
লেখকের নাম: রাজিব আহমেদ
মোট লেখা:৬
লেখকের নাম: মো: আবদুল ওয়াহেদ তমাল
মোট লেখা:৪১
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১০ - নভেম্বর
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ফিচার
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ২
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
ইউএস-বাংলাদেশ টেকনোলজি সামিট : সম্ভাবনার অন্য দিগন্ত


১৩ অক্টোবর ২০১০-এ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের হোটেল ম্যারিয়টে অনুষ্ঠিত হলো ‘ইউএস-বাংলাদেশ টেকনোলজি সামিট’ তথা ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ প্রযুক্তি সম্মেলন’। এর আয়োজনে ছিল বেসিস (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস), ইউএস-বাংলাদেশ টেকনোলজি পার্টনার্স ও ইপিবি (এক্সপোর্ট প্রোমোশন ব্যুরো, বাংলাদেশ)। এছাড়া গ্রেটার নিউইয়র্ক চেম্বার অব কমার্স, ইউএস প্যান অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স, ইউএস বাংলাদেশ টেকনোলোজি অ্যাসোসিয়েশন ও নেটওয়ার্ক অব ইয়াং বাংলাদেশী আমেরিকান প্রফেশনালসসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন এ সম্মেলনের আয়োজনে সহযোগিতা দেয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা মশিউর রহমান ছিলেন বিশেষ অতিথি। সম্মেলনে ২টি অধিবেশন ছিল। পুরো অনুষ্ঠানটি কমপিউটার জগৎ-এর উদ্যোগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি নিউইয়র্ক থেকে ওয়েবসাইটে সম্প্রচার করা হয় www.comjagat.com/সহ দেশের আরো কয়েকটি ওয়েবসাইট থেকে। এর ফলে সারাবিশ্ব থেকে বাংলাদেশের আইসিটিপ্রেমীরা সরাসরি এ অনুষ্ঠানটি উপভোগ করার সুযোগ পান। উল্লেখ্য, কমপিউটার জগৎ-এর এই অনলাইন সম্প্রচার স্পন্সর প্রতিষ্ঠান ছিল দেশের সুখ্যাত সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান দোহাটেক ও বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল।



প্রথম অধিবেশনের বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত রূপান্তর : যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য সুযোগ’। অন্য কথায় ‘র্যা পিড টেকনোলজিক্যাল ট্রান্সফরমেশন অব বাংলাদেশ : অপরচুনিটিজ ফর ইউএস কোম্পানিজ’।

‘ইউএস বাংলাদেশ পার্টনার্স’-এর প্রধান নির্বাহী Joyce Moi তার স্বাগত ভাষণে বলেন, তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই উৎসাহী। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে তার ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধে চীনের অর্থনীতির কথা মনে পড়েছে। তখন চীনের অর্থনীতি মাত্র বিকশিত হচ্ছিল এবং চীন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর মূল ভিত রচিত হয় ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধে। Joyce Moi মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা তেমন এবং বর্তমান সময়টা হচ্ছে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ও ক্রান্তিকাল। তার মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এই সময়টা খুব উৎকৃষ্ট সময়। তিনি নিজে বাংলাদেশে কয়েকবার সফরে এসেছেন এবং এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে তিনি অভিভূত। তিনি সুদৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশে রূপ নেবে।



বেসিসের আন্তর্জাতিক মার্কেট কমিটির সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ প্রযুক্তি সম্মেলনের সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি শামিম আহসান তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ উদ্যোগে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরের একটি প্রচেষ্টা চলছে। এর ফলে বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর সব দেশের কোম্পানিগুলোর জন্য এই দেশের আইসিটি খাতে বিনিয়োগের জন্য নানারকম সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে তিনি এও উল্লেখ করেন, ভারত ও পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলো আউটসোর্সিংয়ের জন্য বিখ্যাত, সেসব দেশে দক্ষ জনশক্তির কিছুটা সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং কাজের মজুরি বেড়ে গেছে। এর ফলে মাইক্রোসফট, নকিয়া, স্যামসাং, ইন্টেলের মতো বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আসছে এই তথ্য উল্লেখ করে শামিম আহসান বলেন, এভাবেই বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আউটসোর্সিংয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে রূপ নিতে যাচ্ছে। এ জন্য বেসিসের পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ নামে একটি ব্র্যান্ডিং ইমেজ তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। এই ব্র্যান্ডিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। শামিম আহসান আশাবাদ ব্যক্ত করেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ প্রযুক্তি সম্মেলনের মাধ্যমে এই দু’টি বন্ধুভাবাপন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরদার হবে এবং প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা অনেক বেশি বাড়বে।

সজীব ওয়াজেদ জয়



সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট কমপিউটার বিজ্ঞানী সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি তার প্রবন্ধে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রথমে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মূলত অদক্ষ ও আধাদক্ষ কর্মীর সংখ্যাধিক্য থাকলেও বর্তমানে খুব দ্রুত এই চিত্র বদলে যাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন বাংলাদেশে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা খুব দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। এর প্রমাণ মেলে আইসিটি সেক্টরে। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত লোক ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন আইসিটি কোম্পানিতে সাফল্যের সাথে কাজ করছেন।

তিনি বলেন, এখন বোধহয় সময় এসেছে বাংলাদেশকে গরিব দেশ বলে চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, গত প্রায় ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার প্রশংসনীয় এবং আগামী এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র অনেকটা বদলে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটির মতো লোক রয়েছে এবং যেকোনো বিচারে এটি একটি বড় বাজার। তাছাড়া বাংলাদেশে একটি দ্রুত ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠছে, যা এই দেশকে বিদেশী যেকোনো কোম্পানির জন্য একটি আকর্ষণীয় বাজারে পরিণত করছে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আট থেকে দশ শতাংশে উন্নীত করা। বাংলাদেশের যে দক্ষ জনশক্তি রয়েছে, তাতে করে এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অর্জন করা মোটেও অসম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন তার জীবনের একটি স্বপ্ন। বাংলাদেশকে তিনি ডিজিটাল ও সফল বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চান। বর্তমানে আউটসোর্সিং ও আইসিটি সেক্টরে ভারত যে সাফল্য পাচ্ছে, সে ধরনের সাফল্য বাংলাদেশেও আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং বাংলাদেশের এই দিকটাতে যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে তার বিভিন্ন প্রসঙ্গ তিনি তুলে ধরেন।



ধীরে ধীরে বাংলাদেশ আউটসোর্সিংয়ের জন্য একটি ক্রমবিকাশমান কেন্দ্রে রূপ নিতে চলেছে এমন অভিমত ব্যক্ত করেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি এ প্রসঙ্গে স্যামসাংয়ের একটি উদাহরণ দেন এবং বলেন স্যামসাংয়ের একটি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার রয়েছে ভারতে। তাতে স্যামসাং খুব একটা খুশি নয়- খরচ, কাজের মান ও সরকারি বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। তাই স্যামসাং তাদের কাজের একটা অংশ বাংলাদেশে কিভাবে আনা যায়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা করেছে। এ ব্যাপারে হয়তো অচিরেই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত



বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, নানা সমস্যার মধ্যেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সাফল্যের সাথে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ হয়তো মাত্র গত ১৫ বছর ধরে আইসিটি সেক্টরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং তা ভবিষ্যতে আরও হবে।

ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণে বাংলাদেশ সরকারের ইনফরমেশন কমিউনিটি সেন্টার খুব ফলপ্রসূ হবে বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে হয়তো অনেকেই মনে করতে পারেন মোবাইল ডেনসিটির পরিমাণ বড়জোর ৩০ শতাংশ হতে পারে, কিন্তু তা বর্তমানে প্রায় ৬০ শতাংশের মতো এবং এর ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটছে। বাংলাদেশের আইসিটি খাতের দ্রুত বিকাশ ঘটানো কোনো অসম্ভব ব্যাপার হবে না।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০২১ ভিশন সম্পর্কে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে এমন বাংলাদেশ যেখানে সবকিছুই ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরিত হবে।

ড. মশিউর রহমান



প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, আইসিটি খাতের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা ও ভিশন রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশকে বর্তমান সরকার তার সব কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। আমি আশাবাদী, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। তিনি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে আরো বলেন, বিনিয়োগকারীরা নির্ভয়ে এবং নিশ্চিন্তে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারেন। তাদের বিনিয়োগের বিনিময়ে তারা ভালো ফল লাভের আশাও করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সরকারের ঋণের পরিমাণ খুবই সামান্য এবং বাজেট ঘাটতির পরিমাণও নগণ্য। মুদ্রাস্ফীতির হারও আশঙ্কাজনক নয় এবং ক্রমবর্ধমান রফতানির আয় এটাই নির্দেশ করছে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে, যা দেশের রফতানি আয় বাড়াতে অবদান রাখছে।

এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ড. মশিউর রহমান বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ একটি আদর্শ স্থান বলে উল্লেখ করেন।

ড. আতিউর রহমান



বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান উল্লেখ করেন, বিনিয়োগ করার জন্য বাংলাদেশ এখন এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও বেশ ভালো। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখতে পারবে। আর সার্বিক মাথাপিছু আয় বাড়ার কারণে আরো কয়েক বছর পর বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এর ফলে বিদেশী কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশ হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার। তিনি মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জানান, বাংলাদেশে বিনিয়োগের যে সুবিধা রয়েছে তা এখন এশিয়ার অনেক দেশেই নেই।

আইসিটি খাতের জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য একটি ভালো দেশ হতে পারে, সে কথাও মার্কিন কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের ড. আতিউর রহমান স্মরণ করিয়ে দেন। সফটওয়্যার ও আইসিটি খাতের কোম্পানিগুলোকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় প্রস্তুত।

মাহবুব জামান



বেসিস সভাপতি মাহবুব জামান যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ প্রযুক্তি সম্মেলনের আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, বেসিসের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের আইসিটিকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তুলে ধরা। তিনি বর্তমান সরকারের ডিজিটাল ২০২১ ভিশনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, এই ভিশন ঘোষণার মাধ্যমে এটি প্রতীয়মান হয় বাংলাদেশের সবকিছুতেই একটি আমূল পরিবর্তন আসতে চলেছে। এই ভিশন আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব।

মাহবুব জামান উপস্থিত সবাইকে অবহিত করেন বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতে বেশ উঁচুমাপের মেধা ও প্রতিভাসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি রয়েছে। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে পেরেছে।

অন্যান্য বক্তা

মাইকেল জোন্স-বে (Michael Jones-Bey), এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, নিউইয়র্ক এস্টেট, এম্পায়ার এস্টেট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন অভিমত ব্যক্ত করেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার উপস্থিতি প্রমাণ করে বাংলাদেশ সরকার আইসিটি খাতে তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি একটি জরিপের কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বের অর্থনীতিতে একটি উদীয়মান শক্তি হবার জন্য সবরকম সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ যেহেতু ভারত ও চীনের পাশে এবং এই অঞ্চলে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক লোক বাস করে, তাই বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ।

গ্রেটার নিউইয়র্ক চেম্বার অব কমার্সের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মার্ক জেফরি তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রশংসা করেন।

ইউএস বাংলা পার্টনার্সের সভাপতি আজিজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর উচিৎ এই সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা। এই জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি রয়েছে এবং এর রয়েছে একটি বিশাল বাজার।

যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ প্রযুক্তি সম্মেলনের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের আইসিটি খাতকে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর কাছে এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে তুলে ধরা। প্রধান অতিথি থেকে শুরু করে সব বক্তাই এক সুরে বলেছেন, বাংলাদেশে এখন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক স্থিতিশীলতা-নিরাপত্তা রয়েছে এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ করার জন্য একটি আদর্শ রাষ্ট্র। শুধু অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নয় বা ব্যবসায় বাণিজ্যের বিনিয়োগ নয় বরং সুনির্দিষ্টভাবে আইসিটি খাতে বিনিয়োগের জন্য বর্তমানে বাংলাদেশ একটি উৎকৃষ্ট দেশ।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা বার বার মার্কিন বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেছেন, এই দেশের সরকার একটি আইসিটি বন্ধুভাবাপন্ন সরকার। সরকারের একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশকে আগামী দশ বা এগারো বছরের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত করা। তাই যদি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসেন, তবে তাদেরকে তেমন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পোহাতে হবে না- এই কথাটি আশ্বস্ত করারও এক ধরনের চেষ্টা ছিল এই সম্মেলনে।

প্রবাসীদের অংশীদারিত্ব

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ প্রযুক্তি সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনের বিষয়বস্তু ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ায় প্রবাসীদের অংশীদারিত্ব। এই অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের নীতি উপদেষ্টা আনীর চৌধুরী। এই পর্বে সভাপতিত্ব করেন বেসিস সভাপতি মাহবুব জামান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বেসিসের সিনিয়র সহ-সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর।

আনীর চৌধুরী ভারত, চীন এমনকি ঘানার উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেসব দেশের প্রবাসী নাগরিকরা তাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও ঠিক একইভাবে চেষ্টা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগের সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। তিনি বলেন, তিনি নিজে একজন এনআরবি তথা অনাবাসী প্রবাসী বাংলাদেশী ছিলেন, তাই অন্যান্য প্রবাসী বাংলাদেশীর সমস্যার কথা তিনি বুঝতে পারেন। সেসব সমস্যা সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন ও বলার চেষ্টা করেন, বর্তমান সরকার বা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। ফলে এই সব সমস্যা আর আগের মতো প্রকৃত নয়। একটু চেষ্টা করলেই এই সমস্যাগুলোর খুব সহজ সমাধান সম্ভব।

উন্মুক্ত আলোচনা

দ্বিতীয় অধিবেশনের শেষদিকে উন্মুক্ত আলোচনা হয় এবং এনআরবিরা বাংলাদেশের আইসিটি খাত, অর্থনৈতিক অবস্থা, বিনিয়োগের পরিবেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন রাখেন ও পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের মধ্যে বেসিস সভাপতি মাহবুব জামান, বিশিষ্ট কমপিউটার বিজ্ঞানী সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের নীতি উপদেষ্টা আনীর চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এসব প্রশ্নের উত্তর দেন।

ইন্টারনেটে সরাসরি ওয়েবকাস্ট

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ প্রযুক্তি সম্মেলনের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো পুরো অনুষ্ঠানটি ইন্টারনেটে সরাসরি ওয়েবকাস্ট বা সম্প্রচার করে মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান কমজগৎ টেকনোলজিস। এ উপলক্ষে কমজগৎ টেকনোলজিসের কর্ণধার আবদুল ওয়াহেদ তমাল ও রুবাইয়াত বিন আরিফ নিউইয়র্কে গিয়ে অনুষ্ঠানটি ইন্টারনেটে সরাসরি সম্প্রচার করেন। বেসিস সভাপতি এ কারণে কমপিউটার জগৎকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং তিনি বলেন, এর মাধ্যমে বিশ্বের বাংলাদেশের আইসিটিপ্রেমীরা এ অনুষ্ঠানটি উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন।

আমেরিকান ৩ কোম্পানির অভিজ্ঞতা

আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রযুক্তি সম্মেলনে তিনটি আমেরিকান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা অতিথিদের কাছে তুলে ধরে।

বোয়িং কর্পোরেশনের ক্রিস ইয়র্ক বাংলাদেশে তার কাজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে বলেন, বাংলাদেশে মেধাসম্পন্ন লোকের ঘাটতি নেই। এখানে সবার মধ্যে কাজ করার ইচ্ছে আছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ বিমান বোয়িং কোম্পানির থেকে চারটি 777-300ER (EXtended Range) এবং চারটি 787-8 Dreamliner মডেলের বিমান কেনার ঘোষণা দেয়। একই বছর জুন মাসে বিমান বাংলাদেশ আরো দুটি NeXt-Generation 737-800 কেনার ঘোষণা দেয়। এই বিমানগুলো কিনতে বাংলাদেশ বিমানের খরচ হবে ১৩০ কোটি ডলার। বোয়িং কোম্পানি আগামী বছর থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের মধ্যে বিমানগুলোর হস্তান্তর সম্পন্ন করবে। এই বিমানগুলোর জন্য বোয়িং যে টাকা পাবে, তার একটি অংশ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে পরিশোধিত হবে।

এই অত্যাধুনিক বিমানগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আইটি খাতে বিভিন্ন উন্নতি সাধন করে, যা বোয়িং কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। বোয়িং তাদের বাংলাদেশী পার্টনার স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের মাধ্যমে এই উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড সম্পাদন করে। বোয়িং ২০০৮ সালে এই উন্নয়ন কাজ শুরু করে এবং ২০১০-এ বিমান বাংলাদেশকে তাদের প্রজেক্ট হস্তান্তর করে। এই উন্নয়ন কাজের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারপাশে ১৯ হাজার মিটার ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপন, ৪ হাজার মিটারেরও বেশি ক্যাট ৬ ওয়্যারিং, ২টি নতুন ডাটা সেন্টার তৈরি করা এবং ডাটা সেন্টার দুটি চালু রাখার জন্য দুটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ১০০ কেভিএ জেনারেটর স্থাপন। পাশাপাশি বোয়িং ৯ জন সিএমআইএস কর্মকর্তার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। তাদের মাইক্রোসফট নতুবা CISCO ট্রেনিংয়ের জন্য লন্ডন অথবা দুবাইয়ে পাঠানো হবে।

ক্রিস ইয়র্ক এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করেন। তিনি বিগত দুই বছরের মধ্যে চার মাস বাংলাদেশে অবস্থান করেন এবং তার এ অভিজ্ঞতাকে তিনি খুবই আনন্দময় বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ খুবই উদার ও অতিথিপরায়ণ। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে আইটি খাতে অনেক দক্ষ লোক কাজ করছে। হাজার বাধা সত্ত্বেবও তারা খুবই দক্ষতা এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

যুক্তরাষ্ট্রের এমআইথ্রি কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট জন বার্টোনি বাংলাদেশের আইটি কর্মকর্তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমআইথ্রি একটি আউটসোর্সিং কোম্পানি এবং বাংলাদেশে এর শাখা আছে। এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের আইটি সেবা দিয়ে থাকে। এমআইথ্রি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্যও কাজ করেছে, যার মধ্যে গ্রামীণফোন অন্যতম।

জন বার্টোনি বলেন, বাংলাদেশে আইটি খাতে অনেক মেধাসম্পন্ন লোক কাজ করছে, যারা আন্তর্জাতিক মানের এবং বাংলাদেশের আইটি খাতের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। বার্টোনি সাত বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে কাজ করছেন।

বার্টোনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশের সাথে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ভবিষ্যতেও থাকবে এবং বাংলাদেশের আইটি খাতে তারা বিভিন্ন কাজ করে যাবেন।

রিচার্ড রবিন্স ‘থেরাপ সার্ভিসেস’ নামের আরেকটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সিইও। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০০৩ সালের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীর সংখ্যা ১০০ এবং এদের মধ্যে ৭০ জন কাজ করছেন বাংলাদেশের অফিসে। থেরাপ সার্ভিসেস কোনো আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান নয়। ঢাকা অফিস তাদের প্রতিষ্ঠানেরই একটি অংশ। থেরাপ সার্ভিসেসের একটি অফিস কানেকটিকাটে এবং অন্যটি ঢাকায়। থেরাপ সার্ভিসেস মূলত আমেরিকার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে। এই কাজের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে বিশদ জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি।

রিচার্ড রবিন্স বাংলাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। একই সাথে যানজট আরেকটি সমস্যা। তাদের অনেক কর্মচারী সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছতে পারে না যানজটের কারণে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য তারা গাড়ির ব্যবস্থা করেন। একই সাথে কর্মচারীদের খাবারের ব্যবস্থাও তারা অফিসেই করে থাকেন। কারণ বাইরে খেয়ে আসতে অনেক সময় নষ্ট হয়।

থেরাপ সার্ভিসেস সবসময় কমবয়েসী ও কাজে উৎসাহী কর্মী নিতে চায়। এজন্য এরা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সাথে একত্রে কাজ করে যাচ্ছে।

শেষ কথা

একেবারে শেষ মুহূর্তে পূর্বনির্ধারিত পণ্য প্রদর্শনী বাতিল হয়ে যাওয়ায় অনেক বাংলাদেশী উদ্যোক্তা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সম্মেলনটি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। ইউএস-বাংলাদেশ টেকনোলজি সামিট বাংলাদেশের আইসিটি খাতের জন্য এক বড় অনুষ্ঠান। এ ধরনের আয়োজন প্রতিবছর হওয়া উচিত। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এমন একটি অনুষ্ঠান যত দ্রুত সম্ভব যুক্তরাজ্যে আয়োজন করা, কেননা সেখানে অনেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মানুষের বাস। বিসিএস, বেসিস, বিসিসি, বুয়েট, এফবিসিসিআই- সবার উচিত বাংলাদেশের আইসিটি তথা অর্থনীতির অগ্রগমনের জন্য হাত মেলানো এবং বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও আউটসোর্সিংয়ের নেক্সট ডেস্টিনেশন বানানো।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : ahmed_razib@yahoo.com

পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস