নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মিডিয়া অঙ্গনে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে উইকিলিকস। গত এপ্রিল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ৫ লাখেরও বেশি গোপন ও স্পর্শকাতর নথি প্রকাশ করে শুধু একটি ওয়েবসাইটই তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নথিগুলোর প্রায় সবই হচ্ছে মার্কিন মুলুকের পররাষ্ট্রসংক্রান্ত। যদিও পূর্বে ভিয়েতনাম, ইরাক, উপসাগরীয় বা আফগান যুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কমবেশি তথ্য ফাঁস হয়েছে, তবে সেগুলো খুব বেশি নয় বা সেগুলো নিয়ে কাউকে তেমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এই সাইটটি (উইকিলিকস) নিয়ে এতটাই দুশ্চিন্তায় আছে যে- প্রত্যেক নাগরিককে সাবধান করে দেয়া হয়েছে এই বলে- যদি কেউ উইকিলিকসকে কোনোপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করে এবং তা প্রমাণিত হয় তবে সে সরকারি চাকরির অযোগ্য বলে গণ্য হবে।
শুধু যে মার্কিন কর্তাব্যক্তিরাই উইকিলিকস নিয়ে মহাবিপদে আছে তা নয়, উইকিলিকসের মহানায়ক জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জের নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়াই তার পাসপোর্ট বাতিলের চিন্তা করছে। ইতোমধ্যে সবার মাঝেই উইকিলিকস নিয়ে বিরাট একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কে বা কারা তৈরি করেছে এই ওয়েবসাইট, কোথা থেকে পরিচালিত হয় এটি, এর কর্মকর্তা কতজন, এর অর্থের যোগান দেয় কারা ইত্যাদি।
উইকিলিকস হচ্ছে একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী আন্তর্জাতিক অনলাইন সংবাদ সংস্থা। এটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারনেট দুনিয়ায় তাদের অবস্থান জানান দেয়। উইকিলিকসের মূল স্লোগান হচ্ছে- ‘উই ওপেন গভর্নমেন্ট’। অর্থাৎ তথ্য স্বাধীনতার মাধ্যমে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা। উইকিলিকসের ভাষ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউরোপের কিছু সাংবাদিক, গণিতবিদ, প্রযুক্তিবিদ, কিছু উঠতি প্রতিষ্ঠান এবং চীনের কিছু ভিন্নমতাবলম্বীদের নিয়েই উইকিলিকসের জন্ম। কিন্তু এর মূল পরিকল্পনাকারী বা মূল উদ্যোক্তাকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। তবে বহুল আলোচিত জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ, যিনি সাইটটির প্রধান সম্পাদক, তিনিই ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে উইকিলিকসকে জনসম্মুখে আনতে থাকেন। ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ‘দি সানসাইন প্রেস’ হচ্ছে এর কর্ণধার।
২০১০ সাল থেকে সাইটটিতে ৫ বা ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি শক্তিশালী উপদেষ্টামন্ডলী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তথ্যমতে, ২০০৯ সালের দিকে উইকিলিকসে ১২০০ স্বেচ্ছাসেবী প্রোগ্রামার কাজ করত। বর্তমানে এখানে ৮০০-র বেশি স্বেচ্ছাসেবী প্রোগ্রামার কাজ করছে। সাইটটির অফিসিয়াল কোনো হেডকোয়ার্টার নেই বলে এটি দাবি করেছে। অনেকে ইউরোপের যেকোনো একটি দেশে হেডকোয়ার্টার আছে বলে সন্দেহ করেছে। তবে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ স্বীকার করেছেন, তাদের মূল সার্ভার সুইডেনে এবং অন্যগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে সাইটটির পথচলা শুরু হলেও আলোচনার তুঙ্গে ওঠে ২০১০-এর এপ্রিলে। এ সময় উইকিলিকস প্রকাশ করে ইউএস আর্মিদের সাধারণ ইরাকী ও সাংবাদিক হত্যার চিত্র, যে ঘটনাকে বলা হয়েছে ‘কোল্যাটারাল মার্ডার’ (ইরাক যুদ্ধের সময় ২০০৭-এর ১২ জুলাই রয়টার্সের দুই সাংবাদিকের ক্যামেরাকে মেশিনগান ভেবে গুলিবর্ষণ ও সাধারণ জনতাকে শত্রু ভেবে গুলিবর্ষণ)। এর পরই তারা ‘আফগান ওয়ার ডাইরি’ অর্থাৎ আফগান যুদ্ধের প্রায় ৭৭ হাজার গোপন ও স্পর্শকাতর নথি প্রকাশ করে বিশ্বে আলোড়ন তোলে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, এত প্রভাবশালী একটি ওয়েবসাইটের খরচের যোগান আসে কোথা থেকে? বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ভক্তকুলের দেয়া অর্থের যোগানেই এর খরচ চলে যায়। তবে ভ্রমণ, দাপ্তরিক কাজ, ব্যান্ডউইডথ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে বছরে প্রায় দুই লাখ ইউরো খরচ হয়। যদি তাদের স্বেচ্ছাসেবীদের ন্যূনতম সম্মানী দিতে হতো তবে বছরে কম করে হলেও ছয় লাখ ইউরো গুনতে হতো। উইকিলিকসের আরো কিছু আইনী সহায়তা দেয় এপি, দি লসঅ্যাঞ্জেলেস টাইম এবং নিউজ পেপার পাবলিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। সে দেশেরই একটি রাজনৈতিক সংগঠন ‘পাইরেট পার্টি’ (যারা তথ্যের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে) কোনোপ্রকার অর্থ ছাড়াই উইকিলিকসকে সার্ভার সাপোর্ট এবং ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ মিডিয়ার সবার দৃষ্টি এখন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের দিকে। কে এই ক্ষিপ্র সাংবাদিক? যে কি না একাই বিশ্ব মোড়লের একের পর এক কুকীর্তি ফাঁস করে যাচ্ছেন, যার টিকিটির নাগাল পাচ্ছে না কেউ।
অ্যাসাঞ্জের নিজ দেশের জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘দৈনিক অস্ট্রেলিয়ান’-এর ভাষ্যমতে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জই হচ্ছেন উইকিলিকসের জনক। কিন্তু জুলিয়ান নিজেকে উইকিলিকসের উপদেষ্টামন্ডলীর একজন সদস্য বলে পরিচয় দেন। তবে তিনি নিজের পরিচয় যা-ই দিক না কেন, তিনিই যে উইকিলিকসের মূল হর্তাকর্তা- এ বিষয়ে আর কারো সন্দেহের অবকাশ নেই।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পুরো নাম জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ। তিনি ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিলে জন্মগ্রহণ করেন। জুলিয়ান প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী এবং কমপিউটার প্রোগ্রামিংয়ে ছিল তার ব্যাপক ঝোঁক। মাত্র ১৬/১৭ বছর বয়সেই হ্যাকিংয়ের উদ্দেশ্যে দুই বন্ধু মিলে গঠন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল সাবভারসিভ’ নামে একটি হ্যাকার গ্রুপ। ওই গ্রুপে তিনি ছদ্মনাম মেনডেক্স ব্যবহার করেন।
অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব ক্রিমিনোলজির তথ্য থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ জুলিয়ানের হ্যাকার গ্রুপটিকে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কানাডার নর্দার্ন টেলিকমের তথ্য চুরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য হ্যাকিং করার অপরাধে গ্রেফতার করে। পরে অবশ্য তাদের কোনো দুরভিসন্ধি প্রমাণ না হওয়ায় ২১ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পান। ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি নিয়মিতভাবে মেলবোর্নেই বসবাস শুরু করেন। উইকিলিকসে কাজ করার আগে তিনি সাংবাদিকতা, প্রোগ্রামিং বক্তৃতা এবং একজন ইন্টারনেট অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে কাজ করেন। এসময় তিনি ফ্রি সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং নিয়েই কাজ করেন। এর মধ্যে তিনি ও তার সহযোগী মিলে ‘আন্ডার গ্রাউন্ড : দি টেলস অব হ্যাকিং মেডনেস অ্যান্ড অবশেসন অন দ্য ইলেকট্রনিক ফ্রনটিয়ার’ নামে একটি বই লেখেন। প্রোগ্রামিং এবং হ্যাকিং তার প্রিয় বিষয় হলেও জুলিয়ান কমপক্ষে পাঁচটি বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেছেন। তিনি একাধারে গণিত, পদার্থবিদ্যা, দর্শন, নিউরোসায়েন্স নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।
জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ সাহসী সাংবাদিকতা, তথ্য স্বাধীনতা, সরকারের জবাবদিহিতা সৃষ্টি, স্পর্শকাতর বিষয় তদন্ত ইত্যাদি বিষয়ের জন্য পেয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি।
তিনি ২০০৯ সালে ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’, ২০০৮ সালে ‘ইকোনোমিস্ট ইনডেক্স অন সেন্সরশিপ মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’, স্যাম অ্যাডামস অ্যাসোসিয়েটস কর্তৃক ‘স্যাম অ্যাডামস অ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদিতে ভূষিত হন। এছাড়া ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘নিউ স্ট্যাটমেন্ট’ তাকে ২০১০ সালের ৫০ জন ক্ষমতাবান ব্যক্তির সারিতে নিয়ে এসেছে। টাইম ম্যাগাজিন স্বীকৃতি দেয় ‘ইয়ার অব দ্য পারসন ২০১০’। এছাড়া আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘উইটনে রিডার’ ‘টোয়েন্টি ফাইভ ভিজনারিজ হু আর চেনজিং ইয়োর ওয়ার্ল্ড’-এ ভূষিত করে। ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড পারসন হওয়াতে তিনি সম্প্রতি কোথায় অবস্থান করছিলেন তা ছিল সবারই অজানা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। গত ৩০ নভেম্বর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের অপরাধে সুইডিশ আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। সম্প্রতি তিনি লন্ডনে গ্রেপ্তার হন।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে ওয়েবসাইট মারফত বলেন, ‘উইকিলিকসের শত্রুরাই এটা করেছে’। যুক্তরাষ্ট্র, তার অনুসারী ও ইন্টারপোলের অভিযোগ মাথায় নিয়েই গত ৩ ডিসেম্বর তিনি অনলাইনে হাজির হয়েছিলেন। জুলিয়ান জানান, তাকে বিভিন্ন সময়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। তিনি বলেন, নথি ফাঁস করে তিনি কোনো ভুল কাজ করেননি। তিনি জানান, উইকিলিকস বা তার কোনো ক্ষতি হলে আরো ১ লাখ গোপন নথি ফাঁস করে দেবেন।
তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, বিভিন্ন সময় পেশাগত কারণে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা ও ওশেনিয়ার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে তিনি। তার ভাষায়, ‘লিভিং ইন এয়ারপোর্টস দিজ ডেইজ’। গুজব উঠেছিল, জুলিয়ান যুক্তরাজ্যে ছিলেন। দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট দাবি করে- জুলিয়ান যুক্তরাজ্যে বহাল তবিয়তে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গত অক্টোবরে তিনি যুক্তরাজ্যে আসেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের কোথাও ছিলেন। তার আইনজীবী স্টিফেনও একথা বলেন। স্বয়ং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও নাকি জানত, তিনি যুক্তরাজ্যেই ছিলেন। অভিযোগ ওঠে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেনেও তাকে গ্রেফতার করেনি। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকেও গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়।
অন্যদিকে জুলিয়ান ইকুয়েডরে ছিলেন এমন খবর পাওয়া গেছে। ইকুয়েডরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিনটো লুকাস জুলিয়ানকে সসম্মানে নাগরিকত্ব দেয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। তবে জুলিয়ানের দেয়া তথ্যমতে, তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য সুইজারল্যান্ড ও আইসল্যান্ডকে বেশি পছন্দ করেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, ব্যক্তি, মানবাধিকার সংগঠন উইকিলিকসকে সমর্থন দিয়ে আসছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী শক্তিগুলো উইকিলিকসকে বাহবা দিচ্ছে। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ এক টেলিভিশন বার্তায় বলেন, ‘আই হ্যাভ টু কনগ্রাচুলেট দি পিপল অব উইকিলিকস ফর দেয়ার ব্রেভারি অ্যান্ড কারেজ’। বিশ্ববিখ্যাত ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার জন পিলজার বলেন, ‘উইকিলিকস মাস্ট বি ডিফেন্ডেড’। নথি ফাঁসকে তিনি পাবলিক অ্যাকাউন্টেবিলিটি বলে উল্লেখ করেছেন।
‘ভেটেরান ফর পিস’ (যুদ্ধফেরত সাবেক সৈন্যদের সংগঠন)-এর প্রেসিডেন্ট মাইক ফেরনার বলেন, ‘উইকিলিকস বা যেই নথিগুলো ফাঁসের সাথে জড়িত, তাদের অবশ্যই পুরস্কৃত করা উচিত’। কেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাইলা ওড়িংগা তথ্য ফাঁসের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিউবান কিংবদন্তি ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘তথ্য ফাঁসের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী কত বড় বড় কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত।’
নথি ফাঁসের ঘটনাকে জুলিয়ান তথ্যযুদ্ধ বা ‘ইনফো ওয়ার’-এর সাথে তুলনা করেছেন। কোনো কারণে যদি উইকিলিকস বন্ধ হয়ে যায় তবুও তথ্য ফাঁস অব্যাহত থাকবে। কারণ জুলিয়ান নিজেই পৃথিবীর বিখ্যাত পত্রিকাগুলোর সাথে চুক্তি করে রেখেছেন। এর মধ্যে লাঁ মঁদ্, গার্ডিয়ান, দি নিউইয়র্ক টাইমস ইত্যাদি।
উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসরদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নথি ফাঁস করেই যাচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্তরা আসলে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে? চীন সে দেশের উইকিলিকস সাইটটি বন্ধ করে দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও বন্ধ করতে অনুরোধ করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তথ্য ফাঁসের ঘটনাকে গোটাবিশ্বের হামলা বলে অভিযোগ করেছেন। নথি ফাঁসের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। কারণ সব নথিই পররাষ্ট্রবিষয়কে কেন্দ্র করে। এদিকে জাতিসংঘে অবৈধভাবে খবরদারির নির্দেশ দেয়াতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ হিলারিকে পদত্যাগ করার আহবান জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা ভবিষ্যতে নথি ফাঁস ঠেকাতে অবকাঠামো সংস্কার এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সন্ত্রাসবাদবিরোধী বিশেষজ্ঞ রাসেল টেভার্সকে নিয়োগ নিয়েছেন।
এদিকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ তার নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডেরও বিরাগভাজন হয়েছেন। অ্যাসাঞ্জ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন- প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। জুলিয়ান আশঙ্কা করছেন, অস্ট্রেলিয়া তার পাসপোর্ট বাতিল করবে। উইকিলিকস সম্প্রতি তাদের সার্ভার ফ্রান্সে স্থানান্তর করবে জেনে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে যেন উইকিলিকসে কোনোপ্রকার সহায়তা না দেয়া হয়। ইন্টারনেটে অর্থ লেনদেনকারী সহায়তা প্রতিষ্ঠান পেপাল মার্কিন প্রশাসনের অনুরোধের প্রেক্ষিতে উইকিলিকসের হিসাব স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। অতিসম্প্রতি হোয়াইট হাউস থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘গোপন তথ্য গোপন রাখাই প্রত্যেক কর্মকর্তার দায়িত্ব। গোপন তথ্য প্রকাশ হওয়া মানে এই নয় যে সেগুলো গোপন রাখার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের ডোমেইন নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠান এভরিডিএনএস ডট নেট খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে উইকিলিকস বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বন্ধ হওয়ার ছয় ঘণ্টা পরই একটি সুইস ডোমেইন হোস্টিং www.wikileaks.ch নামে আরেকটি ওয়েব চালু করে। এছাড়া উইকিলিকস কর্তৃপক্ষ জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও ফিনল্যান্ডে তাদের ডোমেইন নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে রেখেছে। সাইট বন্ধের তীব্র সমালোচনা করে অ্যাসাঞ্জ বলেন, ‘ওয়েবসাইট বন্ধ করে আমাদের লক্ষ্য থেকে ফেরানো যাবে না।’
উইকিলিকস সম্পর্কিত যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি পাঠকমনে দোলা দেয় তা হলো- এত বিশাল তথ্যের ভান্ডার উইকিলিকস পায় কিভাবে? আমরা জেনেছি প্রায় ৮০০-এর মতো প্রখর ধীশক্তির অধিকারী স্বেচ্ছাসেবী প্রোগ্রামার রয়েছেন উইকিলিকসের। এদের মধ্যে কেউ হ্যাকার, কেউ গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা, কেউ কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তা, আবার কেউবা উইকিলিকসের ভক্ত। এছাড়া সাইটটি যারা জন্ম দিয়েছেন তারাও এক দেশের অধিবাসী নন। তাদেরও প্রত্যেকের সাথে রয়েছে বিভিন্ন মিশনের গোপন যোগাযোগ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েব হোস্টিং কোম্পানিগুলোর অসহযোগিতার খবর পেয়ে বিভিন্ন হ্যাকার উইকিলিকসের জন্য প্রায় ২০টির মতো ডোমেইন জোগাড় করে রেখেছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের সময় রিপাবলিকান পার্টির সারা পোলিনের ই-মেইল হ্যাক করে উইকিলিকসে পোস্ট করে দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তথ্যফাঁসের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করা হচ্ছে ব্রাডলি ম্যানিংকে। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। ইরাকে দশম মাউন্টেন ডিভিশনে যোগ দেয়ার আগে তাকে গোয়েন্দা বিশ্লেষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফলে ম্যানিংয়ের সেনাবাহিনীর গোপনীয় কমপিউটারের (সিক্রেট ইন্টারনেট প্রটোকল রাউটার নেটওয়ার্ক) স্পর্শকাতর বিশাল নেটওয়ার্কে প্রবেশ করার সুযোগ ছিল। তাই সন্দেহের তালিকায় ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ের নামই অগ্রগণ্য। ২০১০ সালে বাগদাদ এয়ারস্ট্রাইকের ভিডিও চিত্র ফাঁস করাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে ম্যানিং কুয়েতের ক্যাম্প আরিফজানে বন্দী রয়েছে। ব্যক্তিগত এক বার্তায় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ প্রকাশ করেন, ‘ব্রাডলি ম্যানিং একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বীর’।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পৌনে তিনশ’ কূটনৈতিক মিশনের বার্তা (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো) প্রকাশ করে উইকিলিকস। এরপর ধারাবাহিকভাবে ইরাক যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ, পরমাণু স্থাপনা, ইয়েমেনে বিমান হামলা, রাশিয়াকে মাফিয়া রাষ্ট্র, জাতিসংঘের ওপর নজরদারি, ব্যাংকিং তথ্য, এমনকি এলিয়েন নিয়েও প্রায় ৬ লাখের ওপর গোপন নথি ফাঁস করে।
বিশ্বমোড়ল আমেরিকা ও তার দোসররা বিব্রতকর অবস্থা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। উইকিলিকসের ডোমেইন হোস্টিং বন্ধ, পেপালের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন স্থগিত, ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্টসহ মিত্রদের বা ক্ষতিগ্রস্তদের আয়ত্তে আনার চেষ্টাও করছে। ওদিকে তথ্যফাঁসকে জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ ‘তথ্যযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। মৃত্যুর হুমকি সত্ত্বেও তিনি এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। দেখা যাক, মানবকল্যাণে জুলিয়ানের এই যুদ্ধ কতদিন চলে?
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : ferdousbdvaga77@yahoo.com